বাবার সঙ্গে আমার রোজ দুএকবার দেখা হলেও পিতৃস্নেহেরু স্বাদ উপভোগ করেছি বলে মনে পড়ে না। ঐ অতি শৈশবেই আমি অনুভব করতাম, উনি আমাকে ভালবাসেন না।
মোটামুটি ঐ রকম অনাদর-হতাদরেই আমার জীবনের প্রথম কয়েকটা বছর কেটে গেল। তারপরের কয়েকটা বছর কাটল ব্যাঙ্গালোর-মাদ্রাজ-কোচিনে। ইতিমধ্যে শুরু হল আমার লেখাপড়া। স্কুলের সময়টা খুবই আনন্দে কাটত। ক্লাশের প্রত্যেকটা মেয়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হলো। কত হাসিঠাট্টা খেলাধূলা করতাম ওদের সঙ্গে। তাছাড়া সিস্টাররাও আমাকে খুব স্নেহ করতেন।
এই সময়ই আমি জানতে পারলাম, আমার মা অত্যন্ত অহংকারী ও বদমেজাজের ছিলেন বলে সংসার ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু কেন জানি না কথাটা আমার একটুও বিশ্বাস হলো না। মার ব্যাপারে বাবার ঔদাসীন্য ও নোংরা মন্তব্য শুনলে আমার গা জ্বলত, কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে পারতাম না। তাছাড়া বাবাকে আমার একটুও ভাল লাগত না। উনি আমার জন্য শুধু অর্থব্যয় করা ছাড়া আর কিছুই করেন নি।
আরো একটু বয়স বাড়ার পর আমি বেশ বুঝতে পারলাম, আমার বাবা চরিত্রহীন। ছোটবেলা থেকেই দেখছি, বাবা ভাল চাকরি করেন ও প্রচুর আয়ও করেন। সর্বত্রই দুএকজন অধস্তন কর্মচারীর স্ত্রীর সঙ্গে বাবার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। শুধু তাই নয়, আমাকে দেখাশুনার জন্য যেসব আয়ারা কাজ করেছে, রাত্রির অন্ধকারে তাদের ঘরে যেতেও বাবার রুচিতে বাধত না।।
তখন আমরা কোচিনে থাকি। রোজি নামে একটা মেয়ে তখন আমাদের বাড়ীতে থাকে। বাবার অফিসের ড্রাইভার এ্যাব্রাহাম বাবার গাড়ী চালান ছাড়াও বাজার যেত ও আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিত। অফিসের কাজে আটকে না পড়লে ও আমাকে ছুটির পর বাড়ীতেও পৌঁছে দিত। সন্ধ্যার পর এ্যাব্রাহাম গাড়ী রেখে সাইকেল চড়ে নিজের বাড়ী চলে যেতো। এই এ্যাব্রাহামই আমাকে সাইকেল চড়া শেখায়।
আমি তখন ক্লাশ ফাইভে পড়ি। নেহাত ছোট নয়। নিজের সব কাজই নিজে করতে পারি। রোজি সংসারের সব কাজ করত।
রোজি কালো হলেও দীর্ঘাঙ্গী ও সুন্দরী ছিল। বয়স তিরিশ বত্রিশের মত হবে। দীর্ঘদিন একজন বাঙ্গালী ন্যাভাল অফিসারের বাড়ীতে কাজ করার জন্য বেশ ভাল রান্না শিখেছিল। রোজি ইংরেজি তো জানতই; তাছাড়া একটু-আধটু হিন্দী-বাংলাও বুঝতে পারত। সুতরাং ওকে পেয়ে ভালই হলো।
ওখানে আমাদের বাড়ীটা পুরানো হলেও বেশ বড় ছিল। অনেকগুলো ঘর। সামনে-পিছনে বিরাট লন; দুপাশে ফুলের বাগান।
বিকেলবেলায় স্কুল থেকে ফিরে কিছু খাওয়া-দাওয়া করার পরই আমি আর রেজি ব্যাডমিন্টন খেলতাম। খেলাধূলার পর আমি আমার ঘরে চলে যেতাম; রোজি যেত রান্নাবান্না করতে। পড়াশুনা করতে করতে যখনই দেখতাম বাবার গাড়ী ঢুকছে, আমি তাড়াতাড়ি সামনের বারান্দায় চলে যেতাম। উনি অত্যন্ত মামুলি দুটো-একটা কথা বলেই নিজের ঘরের দিকে চলে যেতেন। আমিও আমার ঘরে ফিরে আসতাম।
রাত্রে কদাচিৎ কখনও আমি আর বাবা একসঙ্গে ডিনার খেতাম। ডিনার খাবার পরই আমরা দুজনে দুজনের ঘরে চলে যেতাম এবং রাত্রে বাবার সঙ্গে আমার আর দেখা হতো না। অন্যান্য দিন বাবা একবার ঘরে এসে জিজ্ঞাসা করতেন, কী করছ? পড়ছ?
হ্যাঁ।
গুড! ঘর থেকে বেরুবার আগে বলতেন, ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করবে।
ব্যস্! আর নয়! বাবা সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঘরে চলে যেতেন।
কেন জানি না, বাবা কোনদিন আমাকে ওঁর ঘরে ডাকতেন না। আমি বেশ বুঝতে পারতাম, উনি পছন্দ করেন না আমি ওঁর ঘরে যাই। তাই আমিও কোনদিন ওঁর ঘরে যেতাম না। বাবাকে কিছু বলতে হলেই আমি রোজিকে দিয়ে বলে পাঠাতাম। তাই কখনও কখনও প্রয়োজনের জন্যই আমাকে নোজির ঘরে যেতে হতো।
সেদিন রাত্রে ডিনার খাবার সময় বাবা বললেন, কাল খুব ভোরে আমি ত্রিবান্দ্রম যাচ্ছি। সেখান থেকে মাদ্রাজ ঘুরে ফিরব।
ডিনারের পর আবার পড়তে বসলাম। পড়াশুনা শেষ করে শুতে যেতে বেশ রাত হলো। বোধহয় এগারটা। শোবার পর হঠাৎ মনে পড়ল, পরশুদিন স্কুলের মাইনে দিতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি উঠে রোজির ঘরে গেলাম; কিন্তু কোথায় রোজি? গেলাম কিচেনে। না, দরজা বন্ধ। ড্রইং রুমে গেলাম, ডাইনিং রুমে গেলাম, সব বারান্দা গুলো ঘুরলাম কিন্তু কোথাও রোজিকে দেখতে পেলাম না। ভাবলাম, বোধহয় লনে ঘোরাঘুরি করছে। এ পাশের লন ঘুরে ও পাশের লনে যেতেই চমকে উঠলাম। দেখি, বাবার ঘরের জানালা খোল। আলো জ্বলছে। রোজি? হা, বাবার ঘরেই আছে কিন্তু ওদের দুজনকে এমন ঘনিষ্ঠভাবে দেখলাম যে সেকথা আমি আপনাকে লিখতে পারব না।
যে বয়সে পৃথিবীর সবকিছুই সুন্দর মনে হয়, সব মানুষকেই ভাল লাগে, ঠিক সেই সময়ই আমার মন বিষিয়ে গেল। ঘেন্না হলো সব পুরুষদের উপর।
জন যখন আমাদের বাড়ীতে এলো তখনও আমার বয়স বেশী নয়। ইতিমধ্যে অনেক রোজির মধু খাবার পর বাবা হঠাৎ একবার বিলেত থেকে আমার নতুন মাকে নিয়ে এসেছেন। সে এক বিচিত্র পরিস্থিতি। বাবা আমাকে দূরে সরিয়ে রাখেন, নতুন মা আমার কাছে আসেন না, জনকেও আমি বিশ্বাস করি না।
বাবা অফিস যান; মাও বেরিয়ে পড়েন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে। কোনদিন ওরা লাঞ্চে বাড়ীতে আসেন, কোনদিন আসেন না। সন্ধ্যার পর দুজনেই নিয়মিত বাইরে যান ককটেল-ডিনার-রিসেপসন বা কোন পাঁচ তারার হোটেলে। ফিরে আসেন মধ্যরাত্রিতে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমন কি বছরের পর বছর এইভাবেই কেটে গেল। ইতিমধ্যে আবিষ্কার করলাম, জন পশু নয়, মানুষ। ওর চরিত্রে স্নেহ-মায়া-মমতা আছে। আস্তে আস্তে উপলব্ধি করলাম, ও আমাকে স্নেহ করে, আমাকে ভালবাসে, আমার কল্যাণ কামনা করে।