জন কোন কথা না বলে সই করল।
এবার মিস মজুমদার ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে টেবিলে রেখে বললো, আপনার ফী।
ওরা আর দেরী করল না। উঠে দাঁড়াল। দুজনেই বিদায় নেবার আগে বললল, গুড বাই!
গুড বাই।
ওরা চলে গেলেও ওদের পথের দিকে চেয়ে মিঃ সোম বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলেন।
ঠিক এক মাস পরে শিক্ষিত, সুন্দরী ও আধুনিক মিস প্রীতি মজুমদারের সঙ্গে খানসামা মিঃ জন নিকোলাস ডায়াসের বিয়ে হলো।
বিয়ের জন্য মিস মজুমদার একটা সুন্দর ম্যাকসিস্কার্ট পরেছিল; জন পুরোদস্তুর সাহেব সেজেছিল। যারা সাক্ষী দিল তারা সবাই জনের বন্ধু। বিয়ের শেষে প্রীতিকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে জন চুমুও খেল।
মিঃ সোম ভেবেছিলেন, এখানেই নাটক শেষ হলো, কিন্তু না, নাটকের তৃতীয় অঞ্চ অভিনীত হলো মাস দুয়েক পরে।
সকালবেলায় কাগজ পড়ার সময় ঠিক নজরে পড়ে নি। দুপুর বেলায় ভাল করে কাগজ পড়তে গিয়েই মিঃ সোম চমকে উঠলেন।…….
ঘটনাস্থল–দিল্লী।
দৃশ্য বিশিষ্ট অভিজাত পল্লী।
সময়-গভীর রাত্রি।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক মার্কিন সংস্থার উত্তর ভারতের ম্যানেজার সস্ত্রীক ককলেট আর ডিনার সেরে যখন ফিরলেন, তখন রাত প্রায় একটা। এ ধরনের নেমন্তন্ন থেকে উনি এইরকম সময়েই ফেরেন এবং গাড়ীর হর্ন বাজাবার সঙ্গে সঙ্গেই ওদের বারো বছরের পুরানো খানসামা জন নিকোলাস ডায়াস ছুটে এসে দরজা খুলে দেয়। ম্যানেজার সাহেব আরো দু-তিনবার হর্ন বাজালেন, কিন্তু না, খানসামা এলো না। অত রাত্রে বেশী জোরে বারবার হর্ন বাজালে প্রতিবেশীদের বিরক্ত করা হবে মনে করে ম্যানেজার সাহেব গেট টপকে লনে ঢুকে বাড়ীর পিছনদিকে গেলেন।
একটু এদিক-ওদিক উঁকি মেরেও খানসামাকে দেখতে পেলেন না। তারপর মেয়ে প্রীতির ঘরের পর্দার ফাঁক দিয়ে সামান্য একটু আলো দেখতে পেয়ে সেদিকেই গেলেন। ম্যানেজার সাহেব উন্মাদের মত চিৎকার করে উঠলেন; জন, আই উইল কিল ইউ।
মেয়ে প্রীতি আর খানসামা জনকে এমন পরিস্থিতিতে ম্যানেজার সাহেব দেখলেন যে উনি সত্যি আর স্বাভাবিক থাকতে পারলেন না। পাগলের মত ছুটে এলেন সামনের দিকে। দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকলেন। রাইফেলটা দেখতে পেলেন না। আলমারির লকার থেকে রিভলবার বের করলেন। গুলী ভরলেন। এগিয়ে গেলেন মেয়ের ঘরের দিকে।
প্রতি জনকে আড়াল করলেও জনের হাতের রাইফেলা ম্যানেজার সাহেব দেখতে পেলেন।
ম্যানেজার সাহেব গর্জে উঠলেন, প্রীতি, সরে যাও। আই মাস্ট কিল দ্যাট বীস্ট। জানোয়ারটাকে মারতেই হবে। প্রতি চিৎকার করে উঠল, ড্যাডি জন আমার স্বামী।
ননসেন্স।
ইয়েস ড্যাডি, জন ইজ মাই…..
প্রীতিকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই পিছন থেকে জন একটু বিদ্রূপ করে বললো, প্রীতি ইজ প্রেগন্যান্ট। আর কমাস পরেই……
স্টপ! বাস্টার্ড!
জন পাশ থেকে মুখখানা একটু বের করে বলে, সত্যি, আপনার নাতি হবে।
এ নাটক বেশীক্ষণ চলেনি। মাত্র মিনিট দশেক। নাটকের অভিনয় শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চের উপর ম্যানেজার সাহেব, জন আর প্রীতির মৃতদেহ গড়িয়ে পড়ল।
খবরের একেবারে শেষে বলা হয়েছে, পুলিশ প্রীতির ঘর থেকে ওদের বিয়ের ম্যারেজ সার্টিফিকেট উদ্ধার করেছে এবং জানা গেছে, মাস ছয়েক আগে কলকাতায় ওদের বিয়ে হয়।
খবরটা পড়া শেষ হতেই মিঃ সোম যেন প্রীতিকে চোখের সামনে দেখতে পেলেন। জনকে ভালবাসার মধ্যে তার কোন দ্বিধা নেই, দ্বন্দ্ব নেই, সংশয় নেই। মিঃ সোম যেন স্পষ্ট শুনতে পেলেন সেই সুন্দরী, শিক্ষিতা, আধুনিক মুক্তকণ্ঠে বলছে, আই ইনটে টু ম্যারি জন।
কতক্ষণ যে উনি চুপচাপ বসেছিলেন, তা ওর নিজের খেয়াল নেই।
সাবিত্রী পাশে এসে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন, বিনু মামা খাবার সামনে নিয়ে কতক্ষণ বসে থাকবেন?
মিঃ সোম খুব আস্তে বললেন, তুমি যাও। আমি আসছি।
মিঃ সোম খাওয়া-দাওয়া করেই আবার এই ঘরে ফিরে এলেন। তারপর টেবিলের নীচের ড্রয়ার থেকে পুরানো.চিঠির বাণ্ডিল বের করে কী যেন খুজতে লাগলেন। পোস্টকার্ড-ইনল্যাণ্ড লেটারগুলো। পাশে সরিয়ে রেখে নানা রংয়ের, নানা সাইজের বহু খাম দেখার পর হঠাৎ একটা এয়ার-মেল খাম হাতে পড়তেই উনি যেন একটু চঞ্চল হয়ে উঠলেন। হ্যাঁ, এর মধ্যেই প্রীতির চিঠিগুলো আছে।…
হাজার হোক আপনি ম্যারেজ অফিসার। আইনগতভাবে উপযুক্ত সাবালক ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেওয়াই আপনার কাজ। মিঃ জন নিকোলাস ডায়াসের সঙ্গে আমার বিয়েও আপনার ওখানেই হয়েছে। আপনার সঙ্গে আমার ভাবাবেগের সম্পর্ক গড়ে ওঠার কোন অবকাশ নেই, ইচ্ছাও নেই। তবুও কলকাতা থেকে দিল্লী ফিরে এসেই আপনাকে চিঠি লিখতে ইচ্ছে করল বলেই এই চিঠি লিখছি।
জনকে বিয়ে করার জন্য মাত্র দুদিনই আপনার ওখানে গিয়েছি। এই সামান্য সময়ের জন্য দেখা হলেও আপনাকে আমার ভাল লেগেছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই অপরের ব্যাপারে একটু বেশী উৎসাহী; মেয়েদের ব্যাপারে আগ্রহ ও উৎসাহ প্রায় সীমাহীন। আপনাকে দেখে মনে হয়েছে, আপনি এই পর্যায়ের না। তাই আপনাকে কিছু জানাতে ইচ্ছে করছে।
খুব ছোটবেলার কথা আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে, আমি প্রায় সারা দিনই একটা ঘরের মধ্যে বন্দিনী হয়ে থাকতাম। আমার প্রচুর খেলনা ছিল আর ছিল একটা কালো মোটা আয়া। নতুন নতুন খেলনা নিয়ে খেলতে ভালই লাগত; কিন্তু আমার মত শিশুর কাছে নতুন খেলনা পুরানো হতে বেশী সময় লাগত না। খেলনা পুরানো হলেই আমার মন খারাপ হয়ে যেত। আয়া আমাকে ঠিকমত খেতে দিলেও কোনদিনই আদর করত না বলে ওর উপর ভীষণ রাগ হতো। তবে হ্যাঁ, রোজ বিকেলে ও আমাকে নিয়ে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যেতো। বোষের কোলাবার ঐ সমুদ্রদর্শনই আমার শৈশবের একমাত্র সুখ-স্মৃতি।