- বইয়ের নামঃ ম্যারেজ রেজিস্টার
- লেখকের নামঃ নিমাই ভট্টাচার্য
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
১. রমেন্দ্রনাথ সোম, ম্যারেজ রেজিস্টার
রবিবার বিকেলে দোতলার বারান্দায় সাইনবোর্ড ঝোলান হলো– রমেন্দ্রনাথ সোম, ম্যারেজ রেজিস্টার। বড় বড় অক্ষরে এই লেখাগুলির নীচে ছোট তাক্ষরে লেখা–এখানে ১৯৫৪ সালের স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুসারে বিবাহ দেওয়া হয়।
চব্বিশ ঘণ্টা পার হতে না হতেই খুব জোরে কলিং বেল বেজে উঠল। রমেনবাবু তাড়াতাড়ি দরজা খুলতেই একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, মিঃ সোম আছেন?
হঠাৎ আনন্দে উত্তেজনায় রমেনবাবুর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, আমিই মিঃ সোম।
আমি এসেছিলাম বিয়ের নোটিশ দিতে।
কিন্তু আপনি একা তো নোটিশ দিতে পারবেন না।
ভদ্রলোক হেসে বললেন, না না, একা নোটিশ দেব না। সুমিত্রা নীচে অপেক্ষা…
ওঁকে ডেকে আনুন।
ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। রমেনবাবুও প্রায় দৌড়ে ভিতরের ঘরে গিয়ে ওঁর স্ত্রী সাবিত্রীকে বললেন, সাবি, এক ভদ্রলোক বিয়ের নোটিশ দিতে এসেছেন। তুমি তাড়াতাড়ি তিন কাপ চা কর।
সাবিত্রী সেলাই করছিল। মুখ না তুলেই হাসতে হাসতে বললো, দেখে মনে হচ্ছে তুমিই বিয়ে করবে।
স্ত্রীর কথায় মিঃ সোম একটু হাসেন কিন্তু কোন কথা না বলেই তাড়াতাড়ি বাইরের ঘরে যান। আলমারী থেকে স্পেশ্যাল ম্যারেজ আইনের ৫নং ধারা অনুযায়ী বিয়ের নোটিশ দেবার একটা ফর্ম বের করেন। টেবিলটা একটু ঠিকঠাক করেন। দুটো চেয়ার একটু কাছে টেনে আনতে না আনতেই আবার কলিং বেল বাজে।
মিঃ সোম তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেন। না, ওরা না। গোয়ালা দুধ দিতে এসেছে। অন্য দিন তিরিশ বছরের পরিচিত এই গোয়লাকে দেখেই ভাল লাগত কিন্তু আজ ওকে দেখেই মিঃ সোমের মেজাজ বিগড়ে গেল। বেশ একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, যাও, যাও, ভিতরে যাও। যাতায়াতের রাস্তা আটকে বসে না।
গোয়ালা চলে যাবার পর পরই আবার বেল বাজল। মিঃ নোম দরজা খুলতেই দেখলেন, সেই ভদ্রলোক আর একজন ভদ্রমহিলা। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আসুন–আসুন।
ওঁরা দুজনে মিঃ সোমের পিছন পিছন বাইরের ঘরে এলেন। বসলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সাবিত্রী চা নিয়ে এলেন।
ভদ্রলোক কিছু বলার আগেই ভদ্রমহিলা বললেন, আমরা এখুনি চা খেয়ে এলাম।
সাবিত্রী ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলার উপর দিয়ে দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিয়ে বললেন, তাতে কী হলো? করেছি যখন, খেয়েই নিন।
সাবিত্রী ভিতরে চলে যেতেই মিঃ সোম বললেন, আমি ম্যারেজ অফিসার হবার পর আপনারাই প্রথম এলেন।
ভদ্রলোক বললেন, তাই নাকি?
হ্যাঁ।
তাহলে তো আমরা খুব লাকী।
মিঃ সোম হাসতে হাসতে বললেন, আপনাদের চাইতে আমি বেশী লাকী।
ওঁরা হাসেন।
চা খেতে খেতেই মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার নামটা জানতে পারি কী?
নিশ্চয়ই। আমি প্রবীর ব্যানার্জী আর ওর নাম সুমিত্রা সরকার।
মিঃ সোমের মুখের হাসি তখনও মিলিয়ে যায়নি। বললেন, দেখে মনে হয়, আপনারা দুজনেই কলেজের প্রফেসর।
মিঃ ব্যানার্জী একটু হেসে বললেন, আমরা দুজনেই এম. এ. পাস করেছি কিন্তু কেউই কলেজে পড়াই না। আমি এল. আই. সী.-তে আছি আর সুমিত্রা একটা স্কুলে পড়াচ্ছে।
সুমিত্রা একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, একদিন দুজনেই অধ্যাপক হবার স্বপ্ন দেখতাম কিন্তু মানুষ যা চায় তা সে কখনই পায় না।
মিঃ সোম বললেন, বোধহয় আমরা সেভাবে মন-প্রাণ দিয়ে চাইতে পারি না বলেই…
ওঁকে পুরো কথাটা বলতে না দিয়েই মিঃ ব্যানার্জী বললেন, মন প্রাণ দিয়ে চাইলেও অনেক সময় অনেক কিছুই পাওয়া যায় না। এবার একটু হেসে বললেন, আজ থেকে কুড়ি বছর আগে আমাদের বিয়ে হাওয়া উচিত ছিল কিন্তু পেরেছি কী?
এ তো ভাগ্যের পরিহাস!
এবার সুমিত্রা বললেন, ঐ ভাগ্যের দোহাই দিয়েও সবকিছু মেনে নেওয়া সহজ নয়।
চা খাওয়া শেষ। এবার মিঃ সোম ১৯৫৪ সালের স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্টের সেকেণ্ড সিডিউলের ৫নং ধারা নোটিশ অব ইনটেনডেড ম্যারেজ-এর ফর্ম মিঃ ব্যানার্জীর সামনে এগিয়ে দেন।
ফর্মের উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিয়ে মিঃ ব্যানার্জী এবার পকেট থেকে কলম বের করে লিখতে শুরু করেন : পাত্রের নাম–শ্রীপ্রবীর কুমার ব্যানার্জী, কণ্ডিসন–আনম্যারেড, অকুপেশন–সার্ভিস, বয়স–৪২, ডোয়েলিং প্লেস–৩৫১এ, ক্ষেত্ৰমোহন নস্কর রোড, কলিকাতা ৪°, লেনথ অব রেসিডেন্স–১২ বছর।
এবার উনি পাত্রীর বৃত্তান্ত লিখতে শুরু করেন। পাত্রীর নাম-শ্ৰীমতী সুমিত্রা সরকার, কণ্ডিসন–উইডো, অকুপেশন সার্ভিস…
পাত্রীর বৃত্তান্ত লেখা শেষ হতেই মিঃ সোম ওঁকে বললেন, আগে ব্রাইড সই করবেন, তার নীচে আপনি সই করবেন।
ওঁরা দুজনে সই করার পর মিঃ সোম ফর্মটা হাতে নিয়েই বললেন, আপনাদের দুজনের হাতের লেখাই অপূর্ব।
মিঃ সোমের কথায় ওঁরা দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠলেন।
হাসলেন কেন? মিঃ সোম ওঁদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন।
প্রবীর হাসতে হাসতে সুমিত্রাকে বললেন, বলো, হাসলে কেন।
সুমিত্রার মুখেও হাসি। বললেন, আমরা যখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই তখন কেউ কাউকে চিনতাম না। এই হাতের লেখার জন্যই আমাদের প্রথম আলাপ হয়।
মিঃ সোম বললেন, ভেরী ইন্টারেস্টিং।