দেবেন দা’র সাথে দেখা হয় আমার ১৯৪৬ সালে। তিনি তখন ৬ বছর পর জেল থেকে এসেছেন। ১৯৩০ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত একটানা ৮ বছর জেলে ছিলেন। আবার গ্রেফতার হয়ে যান ১৯৪০ সালে। দেবেন দা তখন সর্বজনশ্রদ্ধেয়। আরএসপি’র নেতা। আমাদেরও নেতা। কিন্তু দেবেন দা-দের সাথে আমার মতানৈক্য শুরু হলো কিছুদিন পরেই। অগ্নিযুগের প্রবীণ বিপ্লবীদের অনেকে ভাবলেন-ভারতবর্ষে সমাজতন্ত্র করতে হলে বড় দল করতে হবে। আরএসপির নেতৃত্বে সারা ভারতবর্ষে বিপ্লব সম্ভব নয়। তখন সমাজতন্ত্রী নেতা হিসাবে জয়প্রকাশ নারায়ণ, অশোক মেহতা, নরেন্দ্র দেও, অরুণা আসফ আলী, রাম মনোহর লোহিয়া সারা ভারতে পরিচিত। তাঁরা আবার গান্ধীর আশীর্বাদপুষ্ট। আমাদের অনেক নেতা মনে করলেন, এঁদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হলে ভারতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ত্বরান্বিত হবে। আমাদের নেতারা বললেন ভিন্ন কথা। তারা বলেন-জয়প্রকাশ এবং তাঁদের দল প্রকৃতপক্ষে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। এরা সোস্যাল ডেমোক্রাট। এরা ভোটের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র চায়, এরা বিপ্লব করবে না। এবং গান্ধীজীর প্রভাবের বাইরে তারা যেতেও পারবে না। অর্থাৎ আরএসপি’র তরুণ নেতৃত্ব দেবেন দা-দের সাথে একমত হলেন না। মনা দা, দেবেন দা চলে গেলেন আরএসপি থেকে।
১৯৫০ সালে দাঙ্গার পর দেবেন দা ও মনা দা গ্রেফতার হলেন। তাঁদের বরিশাল থেকে ঢাকা জেলে আনা হলো। তাদের পাঠানো হলো আমাদের ওয়ার্ডে। আমি চমকে গেলাম। মনে হলো কোন দেশে জন্মেছি! পাকিস্তান সরকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গ্রেফতার করেছেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী দেবেন ঘোষ ও মনা ঘোষকে। এ কোন রাজনীতি? এ কোন পুরস্কার? সারাজীবন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে বৃদ্ধ দেবেন ঘোষ গ্রেফতার হলেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দায়ে। বরিশালের একটি মাত্র বাসায় কোনো সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। অথচ পাকিস্তান সরকার সেই বাসাটিকেই আক্রমণ করলো দাঙ্গার দায়ে। একশ্রেণির বন্ধুরা বললেন–এটাই তো হবার কথা। তাদের কথা হচ্ছে, দেবেন দা, মনা দা’র ভারতে চলে যাওয়া উচিত ছিল। সেখানে তারা অগ্নিযুগের বিপ্লবী হিসেবে সমাদর পেতেন। সাহায্য পেতেন। পাকিস্তানে তাদের ভিক্ষুকের মতো জীবনযাপন করতে হতো না।
কিন্তু শত দুঃখেও দেবেন দা মাতৃভূমি ছাড়েননি। ১৯৫৪ সালে তিনি পূর্ববাংলা আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বয়স একশ’ ছাড়িয়েছে। চোখে তেমন দেখেন না। কানে শোনেন না বললেই চলে। বরিশালের কাউনিয়ার বাসায় থাকেন। চেষ্টা করেন যতদূর সম্ভব অন্যের উপকার কতে। মনা দা মারা গেছেন দেশ স্বাধীন হবার পর। দীর্ঘদিন বহুমূত্রে ভুগছিলেন। চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বড্ড ইচ্ছে ছিল চোখের চিকিৎসার। ইচ্ছে ছিল নতুন করে পৃথিবী দেখার। আমার কাছে বার বার চিঠি আসত। অন্যের হাতের লেখায় আর মনা দা’র জবাবে। তিনি লিখতেন-নির্মল, তুমি আমাকে বিদেশে পাঠাতে পার না, আমার চোখের একটা চিকিৎসা করাতে? আমার পক্ষে কোনো কিছুই সম্ভব হয়নি। মনা দা পরিবার নিয়ে এক দুর্বিসহ জীবনযাপন করতেন। বাণীপীঠ স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রেমাংশু সেনগুপ্তের কোনো খোঁজ পাইনি। তিনি ঢাকা জেলে আমাদের ওয়ার্ডে দীর্ঘদিন ছিলেন। প্রচণ্ডভাবে ভগবানে বিশ্বাস করতেন। প্রতিদিন আমার সাথে তর্ক হতো। বড্ড দুঃখ পেতেন আমি ভগবান বিশ্বাস করি না বলে। বেদ-উপনিষদ থেকে অনেক যুক্তির অবতারণা করতেন। আমি বলতাম-ভগবান আমার সৃষ্টিকর্তা হলে ভগবানের সৃষ্টিকর্তা কে? এ প্রশ্নের জবাব কোথায়? আমি যা দেখি না তার আমি বিশ্বাস করি না।
প্রেমাংশু বাবু বলতেন, তুমি লন্ডন দেখেছ? আমি বলতাম, না। তিনি বলতেন তাহলে লন্ডন আছে বিশ্বাস কর কী করে? আমি বলতাম, পরোক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। এবার তিনি পাল্টা প্রশ্ন করতেন। বলতেন, যারা ভগবানের সান্নিধ্যে গিয়েছে তাহলে তুমি তাদের অভিজ্ঞতা মানবে না কেন? আমি বলতাম–সান্নিধ্যে যাবার কোনো প্রমাণ নেই। এরপর আর কথা জমতো না।
জেলখানা থেকে মুক্তি পাবার পর ১৯৫৩ সালে বরিশালে গিয়েছিলাম। কালীবাড়ি রোডে খুঁজতে গিয়েছিলাম বাণীপীঠ স্কুল ও প্রেমাংশু বাবুকে। কালিবাড়ি রোডের বিএম স্কুলের পশ্চিমে গিয়ে ডানে দেখলাম বাণীপীঠ স্কুলের চিহ্নমাত্র নেই। বাণীপীঠ স্কুলের ভিটিতে ধান চাষ হচ্ছে। ধানের ডগা লক লক করছে। এরপর প্রেমাংশু বাবুর খোঁজ করার মানসিক অবস্থা আমার ছিল না। বাণীপীঠ স্কুলের ভিটিতে এখন পরিবার পরিকল্পনার বিরাট দালান। এখন কে রাখে সে খবর!
১৯৫২ সাল। দেখতে দেখতে ৪ বছর কেটে গেল জেলখানায়। ১৯৪৮ সালের আগস্টে গ্রেফতার হয়েছিলাম বরিশালে। বরিশাল জেল থেকে ঢাকা এসেছিলাম অক্টোবরে। তারপর অনেক ঘটনা ঘটল। জেলখানায় দিনের পর দিন অনশন হলো। ১৯৪৯ সালে ভারত হায়দারাবাদ অভিযান চালাল। এ অভিযানকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানে গ্রেফতার হলো হাজার হাজার লোক।
ঢাকা জেল ভরতে থাকল। মাদ্রাজের এক তরুণকে গ্রেফতার করে আনা : হলো ঢাকা জেলে। সে নাকি ভারতের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী জনমাথাইর আত্মীয়। তবে তাকে প্রকৃতিস্থ মনে হতো না। মাঝে মাঝে অদ্ভুত চিঠি লিখত। চিঠির ঠিকানা লেখা থাকত–to god, P.O HEAVEN, Dominian HEAVEN…। এ সময় এক হিন্দিভাষী ভারতীয়কে ধরে আনা হয়েছিল। ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান। সে নাকি ভারতের চর। সে মাঝে মাঝে মাছি ধরে ধরে খেত। এরা বাইরে থাকলে ভারত নাকি পাকিস্তানকে দখল করে নেবে।