অথচ দেশে রাজনৈতিক কোনো আন্দোলন নেই। কথায় কথায় জাসদ বা সর্বহারা পার্টির কিছু খবর পাওয়া গেলেও অন্যান্য রাজনৈতিক দল একেবারে চুপ। সকলেরই ধারণা একটা কিছু হতে যাচ্ছে। সরকার হয়তো কোনো নতুন পদক্ষেপ নেবে।
সত্যি সত্যি সরকার নতুন পদক্ষেপ নিল। দেশে বিদেশে ক্ষমতা আইন জারি করা হলো। সংবাদপত্রের উপর কড়া নির্দেশ দেয়া হলো। শেষ পর্যন্ত দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলো। সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ হলো। সাপ্তাহিক অভিমত নিষিদ্ধ করা হলো। অভিমত-এর সম্পাদক শেখ আলী আশরাফকে গ্রেফতারের নির্দেশ জারি করা হলো। আমি তখন বাড়িতে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাড়ি যাওয়া হয়নি। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে বাড়ি ছেড়েছিলাম। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। দেশে ফিরলাম জানুয়ারির প্রথমে। কিন্তু ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বাড়ি যেতে পারিনি। একের পর এক ঝামেলা আমাকে ঢাকায় থাকতে বাধ্য করেছে। এছাড়া দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এলাকায় ছিল অস্বস্তিকর পরিবেশ। ক্ষুদে আওয়ামী লীগওয়ালারা রাতারাতি নেতা বনে গেল। যাদের কোনোদিন কোথাও দেখা যায়নি তারা মুক্তিযোদ্ধা বনে গেল। রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান হলো। কলেজ স্কুলের হর্তাকর্তা হয়ে বসল। এলাকায় গেলে এদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা সম্ভব নয়। সংঘাত অনিবার্য। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একটু অপেক্ষা করি। নতুন নেতৃত্বের উচ্ছ্বাস হ্রাস পাক। লুটপাট শেষ হোক। তারপর বাড়ি যাব। এমনকি ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময়ও বাড়ি যাইনি। আর এ সময় হলো এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। প্রকাশ্য দিবালোকে কোটালীপাড়ার মুক্তিযুদ্ধের নেতা কমলেশ বেদজ্ঞ, গোপালগঞ্জের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা লেবুসহ কয়েকজনকে হত্যা করা হলো। বাড়ি পৌঁছে শুনলাম জরুরি আইন জারি হয়েছে। বাড়ি থাকা হলো না। বরিশাল থেকে ঢাকা। দৈনিক বাংলার সম্পাদকীয় তখন বন্ধ করেছে। নির্দেশ দিয়েছে অনিকেত ছদ্মনামে নির্মল সেনের উপসম্পাদকীয় আর দৈনিক বাংলায় ছাপা হবে না।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে পড়লো অবজারভারের সহকারী সম্পাদক জোয়াদুর রহমানের কথা। জোয়াদুর রহমান আওয়ামী লীগের ঘোরতর সমর্থক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে দু’জন সাংবাদিক প্রেস ক্লাবে আওয়ামী লীগের কথা বলত তার মধ্যে একজন জোয়াদুর রহমান অপরজন আমিনুল হক বাদশা।
ক্ষমতায় যাবার পর আওয়ামী লীগের আচরণ জোয়াদুর রহমানকে ব্যথিত করেছে। জোয়াদুর রহমান বলত নির্মল দা, আপনি ও মিন্টু অর্থাৎ হলিডের এনায়েতুল্লাহ খান লিখে লিখে প্রমাণ করেছেন, দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে। দেশে কেউ কিছু লিখতে পারছে না। একদিকে সরকার অপরদিকে তাদের সন্ত্রাসী গ্রুপ। তাদের হাত থেকে সাংবাদিকদের রেহাই নেই। এ কথা সত্য, সেকালে আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত জনপদ পত্রিকায় মাঝে মাঝে সরকারের তীব্র সমালোচনা করা হতো। এমনকি দৈনিক বঙ্গবার্তায় ফয়েজ আহমেদও শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে লিখতেন। কিন্তু সকলের ধারণা এরা শেখ সাহেবের নিজের লোক। এরা সকালে লিখলে বিকেলে এদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দেখা হয়। কিন্তু বিপদ হয়েছিল আমাকে এবং এনায়েতুল্লাহ খানকে নিয়ে। আমার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দেখা হতো কিন্তু লেখালেখি সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তিনি করতেন না। শুনেছি দৈনিক বাংলায় আমার লেখা থাকলে তিনি ভোরবেলাই পড়তেন এবং তাৎক্ষণিক নির্দেশ দিতেন। এর প্রমাণ আমি বারবার পেয়েছি। জোয়াদুর রহমানের অভিযোগ আমি ও এনায়েতুল্লাহ খান লিখছি বলে সাধারণ মানুষের ধারণা দেশে সংবাদপত্রে স্বাধীনতা ছিল।
এ সময় ব্যবস্থা নেয়া হলো সাপ্তাহিক হলিডের বিরুদ্ধে। হলিডে বন্ধ করে দেয়া হলো। এনায়েতুল্লাহ খান আমাকে একদিন ফোনে জানালেন তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। আমার বিশ্বাস হলো না। আমি গিয়াস কামাল চৌধুরীকে বললাম, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করো। গিয়াস কামাল চৌধুরী ব্যবস্থা করল। কিন্তু আমাকে ওই দিন ভোরবেলা জানানো হলো–প্রধানমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন না। আমি বললাম, তবু যাব। সকাল ৯-১০টার দিকে বঙ্গভবনে পৌঁছালাম। আমি, গিয়াস কামাল, কামাল লোহানী, রিয়াজ উদ্দিন আহমদ ও এনায়েতুল্লাহ খান। আমাকে দেখে সচিব আবদুর রইস বললেন, আজ আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে না। আমি চেয়ে দেখলাম পেছনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী। বললেন, এসে গেছেন–আবার সাথে এনায়েতুল্লাহ খান। আমি বললাম, দোতলায় চলুন। পুরান গণভবনের দোতলায় উঠেই ডান দিকে কক্ষ। ওই কক্ষের কাছে একটি ছোট কক্ষ আছে। উপরে উঠে ওই কক্ষে গেলাম। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, আপনি ও এনায়েতুল্লাহ খান ওই কক্ষে যান। আপনাদের কথা শেষ করুন।
প্রায় আধঘন্টা পর প্রধানমন্ত্রী এবং এনায়েতুল্লাহ খান ওই কক্ষ থেকে বের হলেন। দেখলাম দু’জনের মুখ অপ্রসন্ন। এনায়েতুল্লাহকে বললাম, প্রেস ক্লাবে যান–আমরা আসছি।
প্রধানমন্ত্রী আমাকে তার কাছে বসালেন, তারপর হঠাৎ উত্তপ্ত হলেন। তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন, এই এনায়েতুল্লাহ খান কে! তার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয় না। সে পত্রিকা কী করে চলে? এ পত্রিকা জুলফিকার আলী ভুট্টোর। আমার পুত্রকে নিয়ে আমি মস্কো সফরে গিয়েছি। এটা কি কোনো সমালোচনার বিষয়বস্তু? পণ্ডিত নেহেরুর সাথে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী গেছেন তাতে কি কোনোদিন কেউ সমালোচনা করেছে? হলিডে আমাদের পক্ষে না লিখে মিথ্যাচার করে। তাদের জন্যে আপনি এসেছেন আমার কাছে। নিজে কোনোদিন আমার পক্ষে একটা লাইন লিখেননি।