কে আপনি? নাম কি?
বললাম তো, আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি কোর্ট থেকে বলছি। এডভোকেট শাহাদাত। আপনার বিরুদ্ধে গভরমেন্ট কেইস করেছে। অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়ে গেছে। আপনি বাড়ি থেকে আপাতত কোথাও চলে যান।
এই ফোনটি আমাকে ভাবালো। দুটি ভিন্ন লোক দুটি ভিন্ন জায়গা থেকে বলছে যে আমার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়েছে। তবে কি সত্যিই হুলিয়া জারি হয়েছে? তাই বা হবে কেন! মৌলবাদীদের মিছিল বেরোলে সরকার থেকে আমাকে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে, যদিও গোয়েন্দা পুলিশ আছেই পেছনে, কিন্তু বাড়ির সামনে তো কিছু পুলিশ অন্তত দাঁড় করানো হয় যখন মিছিল যায় আমার ফাঁসি চেয়ে! এই সরকার কেন আমার বিরুদ্ধে মামলা করবে? মামলা যদি করে কেউ, সে তো মৌলবাদীর দল। দ্বিতীয় লোকটি যখন কথা বলছিল ফোনে, প্রচুর লোকের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল। হতে পারে লোকটি যা বলছে, ঠিকই বলছে যে সে কোর্ট থেকে কথা বলছে। লোকটি যদি সত্যিই উকিল হয়ে থাকে, তবে তার পক্ষে হুলিয়ার খবরটি জানা কঠিন নয় মোটেও। কিন্তু তারপরও আমার বিশ্বাস হতে চায় না যে সরকার আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো আমাকে নিরাপত্তা দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে নিরবধি বলে যাচ্ছে। ফতোয়ার খবরটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। এখন সরকার আমাকে নিরাপত্তা না দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা করবে! আমি ধন্দে পড়ি। কিছুই ঠিকমত আমার মাথায় ঢুকছে না। অংকে মিলছে না কিছুই। নিচে এখন দুরকম পুলিশ বসে, গত একমাস থেকে পাহারা পুলিশ বসছে ইস্টার্নের গেইটের সামনে আর সাদা পোশাকের গোয়েন্দাগুলো তো হাঁটাহাঁটি করছেই বাড়ির চারপাশে। আবার আমি বারান্দা থেকে উঁকি দিই ভিড়ের রাস্তায়, কোথায় কিসের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে আততায়ী, খুঁজি। কোনও লোক তাকাচ্ছে কি না ঘন ঘন এই বাড়িটির দিকে, দেখি। রাস্তা থেকে চোখদুটো সরাতে নিলেই চোখ পড়ে রাস্তার ওপারের তিনতলা একটি বাড়ির বারান্দায় দুটো লোকের দিকে, আমাকে দেখছে লোক দুটো, দেখছে আর নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। আগে কখনও লোকদুটোকে দেখিনি ও বাড়িতে! ফোনের ওপারের লোকদুটোর সঙ্গে কি বারান্দার এই দুটো লোকের কোনও সম্পর্ক আছে! আছে হয়তো। আমাকে কৌশলে বারান্দায় বের করে চাইছে গুলি করতে! খুব সহজে ওই বারান্দা থেকে আমার দিকে তাক করে গুলি ছোঁড়া যায়! চকিতে একটি ঠাণ্ডা কিছু বুকের ভেতর উথলে ওঠে। দ্রুত সরে আসি বারান্দা থেকে। পর্দা টেনে দিই। কত রকমের আধুনিক অস্ত্র যে এখন মানুষের হাতে। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু ধনী দেশ থেকে এখানে অর্থ আর অস্ত্র প্রচুর পরিমাণে আসছে। আততায়ীর অভাব হওয়ার তো কথা নয়।
এ মুহূর্তে ঠিক কি করা উচিত আমার বুঝে পাই না। পায়চারি করি। শেষ পর্যন্ত ফোন করি ডক্টর কামাল হোসেনের আপিসে। ফোন ধরলেন সারা হোসেন। সারাকে বললাম, দুটো লোক কিছুক্ষণ আগে ফোনে আমাকে জানিয়েছে যে আমাকে অ্যারেস্ট করার জন্য ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে। কি অদ্ভুত ব্যাপার, তা কেন হবে!
তাই তো! সারাও বললেন, তা তো হওয়ার কথা নয়। এরকম কিছু তো সারাদিন শুনিনি। দেখি আমি খবর নিচ্ছি। কিছু খবর জানতে পারলে আপনাকে জানাবো। সারা নিজে দায়িত্বটি নিয়ে আমাকে নির্ভার করেন।
আমাকে আধঘন্টা পর ফোন করে জানালেন সারা যে তিনি আদালতে লোক পাঠিয়ে জেনেছেন খবরটি সত্য। মতিঝিল থানা থেকে নূরুল আলম নামের এক পুলিশ অফিসার মামলা করেছে আমার বিরুদ্ধে। আমাকে গ্রেফতার করার জন্য হুলিয়া জারি হয়েছে।
মাথা চরকির মত ঘুরে ওঠে। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কি করব। যে কোনও মুহূর্তে পুলিশ ঢুকবে ঘরে, হাতদুটোতে হাতকড়া পরাবে, কোমরে হয়ত রশিও বাঁধবে, টেনে নিয়ে যাবে নিচে, ঘাড় ধাককা দিয়ে পুলিশের ভ্যানে ওঠাবে।
–কী অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে?
— আপনি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন।
–এখন কী করা উচিত? সারাকে নিস্তেজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি।
সারা শান্ত গলায় বললেন, জামিন নিতে হবে। অন্যান্য উকিলের সঙ্গে কথা বলে জামিনের ব্যাপারটা দেখছি।
খানিকটা স্বস্তি জোটে। জামিন নেওয়ার পর মামলার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। কামাল হোসেনের মত উকিল থাকতে আমার মুষড়ে পড়ার কিছু নেই। কিছু নেই কিন্তু তারপরও একটি সংশয় আমার ভেতর থেকে যায় না। পুলিশ যদি আমাকে সত্যি সত্যিই গ্রেফতার করে নিয়ে যায়! আজকাল আদালতের বিচারকদের মধ্যেও মৌলবাদী থাকে, পুলিশের মধ্যেও নিশ্চয়ই মৌলবাদী আছে। আমাকে তো হাজতেই পিষে মেরে ফেলবে। সংশয়টি মাকড়শার জালের মত আমাকে আটকে ফেলে।
নানি আর ঝুনু খালা বেড়াতে এসেছেন, মা ওঁদের জন্য রান্না করছেন। মিলন আর ইয়াসমিনের দিকে ছুঁড়ে দিই হুলিয়া জারি হওয়ার খবরটি। ওরা তেমন গা করে না। অনেকদিন থেকেই অদ্ভুত অদ্ভুত সব খবর শুনতে শুনতে ওরা অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। হুলিয়া ব্যাপারটি যে ঠিক কি, তা সম্ভবত ওরাও অনুমান করতে পারে না। দুজনের কারও মুখে কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করি না। ওরা, যে কোনও খবরের মত খবরটি শুনে যে যার কাজে চলে যায়। ইয়াসমিন ভালবাসাকে ঘুম পাড়াতে, মিলন গোসল করতে।
মা, আমার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু হইছে। পুলিশ আইতাছে। শেষ পর্যন্ত মাকে বলি।
মা বলেন, কি কস এইসব আজে বাজে কথা!