- বইয়ের নামঃ সেইসব অন্ধকার
- লেখকের নামঃ তসলিমা নাসরিন
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
১. প্যারিসের ডায়রি – ০১
জিল গনজালেজ ফরস্টার যেদিন এল আমার বাড়িতে, সেদিন অষ্ট্রেলেশিয়া কাপের খেলা হচ্ছে, খেলছে ভারত আর পাকিস্তান। জিলকে ইশারায় বসতে বললাম সোফায়, আমার মতই সে মন দিয়ে খেলা দেখতে লাগল। এক ঘন্টা কেটে গেল খেলা দেখেই। এই একটি ঘন্টা আমি জিলের সঙ্গে কোনওরকম কথা বলিনি, বলিনি কারণ আমি নিশ্চিত যে খেলার মাঝখানে কথা বললে ছেলে বিরক্ত হবে। আমাদের বাড়িতে এরকমই নিয়ম, আর যেসময় বিরক্ত কর কর, খেলা দেখার সময় নয়, বিশেষ করে ক্রিকেট খেলার সময় নয়, আরও বিশেষ করে সে খেলা যদি ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে হয়। জাদেজা শূন্য করে বিদেয় হল। শচিনও বাইশ না তেইশ করে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেল। আজহার তিন করে শেষ। এরপর ধুত্তুরি বলে খেলা থেকে চোখ সরিয়ে জিল কোন দলের সমর্থক তা জানতে চাই। প্রশ্ন শুনে বোকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করে–এই খেলার নাম কি?
খেলার নাম কি মানে? তুমি জানো না কী খেলা এটি! আকাশ থেকে আমার সত্যিকার পড়া যাকে বলে।
জিল মাথা নাড়ে। সে জানে না। খেলার মাথামুণ্ডু কিছুই সে বোঝেনি।
বলে কি! ইউরোপের ছেলে, ইংলেন্ডের পাশের দেশে তার দেশ, আর সে কি না ক্রিকেট কি, কাকে বলে তার কিছুই জানে না! না, জানে না! ক্রিকেট খেলা জিল তার বাপের জন্মে দেখেনি, শোনেওনি ক্রিকেট বলে একটি খেলা আছে এই জগতে। একবার কবে কোথাও শুনেছিল ইংরেজরা একটি খেলা খেলে, যে খেলায় বেশির ভাগই খেলোয়াড়ই মাঠের মধ্যে ভূতের মত দাঁড়িয়ে থাকে, একজন বা দুজন কেবল দৌড়োয়; সেই উদ্ভট খেলাটির নামই যে ক্রিকেট, তা আজ সে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে।
তাহলে এক ঘন্টা যে মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখলে!
দেখলাম! কী আর করতে পারি! তুমি তো কথা বলছিলে না। তুমি ব্যস্ত।
হায় কান্ড।
আমি ভেবেছিলাম আমার চেয়ে জিলই বুঝি বেশি উপভোগ করছে খেলা। যাই হোক, যখন কথা বলার সময় হল, তখন বেচারার যাওয়ার সময়ও হল। হাতে মাত্র একঘন্টা সময় নিয়ে সে এসেছিল আমার বাড়িতে। বলল কাল সে আমাকে নিয়ে যাবে ফরাসি দূতাবাসে। এই দূতাবাসেই আমি আগে গিয়েছিলাম ভিসার জন্য। আমাকে পাঠানো রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স আর আর্তে টেলিভিশনের আমন্ত্রণ দেখেও দূতাবাসের লোকেরা কঠিন কণ্ঠে বলে দিয়েছে যে এসব আমন্ত্রণে কাজ হবে না, ভিসা হবে না। কেন হবে না, কী কারণ, তার কিছুই বলেনি। ভিসা হবেনার খবর শুনে রিপোর্টাস সাঁ ফ্রন্টিয়ার্সের লোকেরা জিলকে পাঠিয়ে দিয়েছে প্যারিস থেকে ঢাকায়, যেন ভিসার ব্যবস্থা করে আমাকে নিরাপদে নির্বিঘ্নে প্যারিস নিয়ে পৌঁছোয়।
জিল আমাকে পরদিন দূতাবাসে নিয়ে গিয়ে ভিসা পাইয়ে দিল। যে ভিসা দিতে চায়নি দূতাবাস, সেই ভিসাই কী চমৎকার দিয়ে দিল। যে জিনিসটি হবে না বলে জানি, সেটি কী যে কী অজ্ঞাত কারণে মাঝে মাঝে হয়ে বসে থাকে! জিল টিকিট নিয়ে এসেছে। ঢাকা থেকে থাই এয়ারলাইন্সে ব্যাংকক হয়ে এয়ার ফ্রান্সে প্যারিস। যে আমার পাসপোর্টই ছিল না, সে আমার পাসপোর্ট হয়েছে, দুর্লভ পাসপোর্টে দুর্লভ ভিসাও জুটে গেছে। পাসপোর্টটি কখনই হয়ত পেতাম না যদি না বিদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের সরকারকে চাপ দিত আমার পাসপোর্ট ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য। পাসপোর্ট ফেরত পাওয়ার আশা আমি আসলে একরকম ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু আমেরিকা নাক গলালে হুকুম নড়ে তো হাকিম নড়ে না প্রবাদটি বোধহয় অচল হয়ে যায়। আমার বিশ্বাস, এই অসম্ভবটি সম্ভব করার পেছনে লেখক সংগঠন পেন এর ভূমিকা আছে, পেন যদি প্যানপ্যান না করত, তবে আমেরিকার সরকার মোটে সজাগ হত না। ফতোয়ার খবর, মোল্লাদের আন্দোলনের খবর তো আছেই, নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখা আমার উপসম্পাদকীয়টিও সম্ভবত অনেকটা কাজ করেছে আমার ব্যাপারে আমেরিকার সরকারের উদ্যোগী হওয়ার। তা না হলে তাদের কি দায় পড়েছিল বাড়ি বয়ে এসে আমার পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে যাওয়ার! কত মানুষের ওপর এ দেশে অন্যায় হচ্ছে, কত নিরপরাধ মিছিমিছি জেলে পচে মরছে, কত মানুষকে উদ্বাস্তু বানানো হচ্ছে, দেশছাড়া করা হচ্ছে, কই তাদের সাহায্য করার জন্য আমাদের আমেরিকান অ্যান্ড্রু সাহেব কি দৌড়োদৌড়ি করছেন কিছু!
সুটকেসে কাপড় চোপড় গুছিয়ে নিলাম। এপ্রিলে এখানে গরমে সেদ্ধ হলেও ওখানে তো অন্তত শীত শীত আবহাওয়ার মধ্যে পড়তে হবে। তবু শাড়ি নিলাম কিছু। প্যান্ট সার্ট ভাল তেমন নেই আমার। লালমাটিয়ায় গিয়ে ছোটদার কাছ থেকে তাঁর একটি কোট নিয়ে এলাম। দু তিনটি সার্ট প্যান্টও নিলাম। গায়ে আমার ঢ্যালঢ্যাল করে ওসব, কিন্তু চলে। বাড়ি কেনার পর টাকা পয়সার অত ছড়াছড়ি নেই যে নতুন কাপড় কিনব।
জিল মোটা একটি বই নিয়ে এসেছে আমার জন্য। রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স বের করেছে। পৃথিবীর কোথায় কোথায় লেখক সাংবাদিকদের কলম কেড়ে নেওয়া আছে, কাকে জেলে ঢোকানো হচ্ছে, কাকে পেটানো হচ্ছে, কাকে মেরে ফেলা হচ্ছে, তার খবর। বাংলাদেশ সম্পর্কে লেখা, দেশটি অতি দরিদ্র। বন্যা ঘূর্ণিঝড় দারিদ্র পীড়িত এই দেশে একজন লেখক আছে, তাকে মৌলবাদীরা আক্রমণ করছে। সরকার তার বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, তার পাসপোর্ট আটক করেছে। জিল বলল,জ্ঞবাংলাদেশে এই আমি প্রথম এলাম। এ দেশ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না আমরা। কেবল তোমার কথা জানি। প্যারিসে তোমার সঙ্গে দেখা করতে অনেকেই আসবে, সবাই ওরা তোমার সম্পর্কে জানে। আমরা তোমাকে জানতে চাই। তোমার বই পড়তে চাই।’ জিল এখানকার কিছু সাংবাদিকদের সঙ্গে সংবাদপষেনর স্বাধীনতা বিষয়ে কথা বলেছে। জিলকে নিয়ে শামসুর রাহমানের বাড়ি ঘুরে এসে শেরাটন হোটেলের ক্যাফেতে বসে চা খেতে খেতে জানতে চাইলাম এখানকার সাংবাদিকদের তার কেমন লেগেছে? জিল পকেট থেকে কিছু নামের কার্ড বের করে বলল এদেঁর সঙ্গে সে কথা বলেছে। নামগুলোর মধ্যে একটি নামই আমি পেলাম চেনা। মুহম্মদ জাহাঙ্গীর।
–এ লোকটি নিশ্চয়ই আর সবার চেয়ে ভাল?
জিল কাঁধ নাড়িয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার মাত্র কয়েকমিনিট কথা হয়েছে, বললেন, তোমরা ধনী দেশ, তোমরা এই গরীব দেশের সাংবাদিকদের জন্য টাকা পাঠাচ্ছে! না কেন! টাকা পেলে এখানকার সাংবাদিকদের অনেক সুবিধে হবে। টাকা পাঠাও যদি সত্যিই সাংবাদিকদের জন্য কিছু করতেই চাও।’
জিলের সংগঠনটি, আমি যদ্দুর বুঝি যে কাউকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করার জন্য নয়। সাংবাদিকদের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করার জন্য সংগঠনটি। সাংবাদিকরা যেন স্বাধীনভাবে যে কোনও খবরই পরিবেশন করতে পারেন, তাঁদের যেন এ কারণে কেউ হেনস্থা করতে না পারে, তাঁদের যেন কেউ ঝামেলায় ফেলতে, জেলে ভরতে না পারে। তাঁদের যেন কণ্ঠরোধ করা না হয়, তাঁদের কলাম যেন কেড়ে নেওয়া না হয়। সংগঠনটির কাজ বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, সংবাদপষেনর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। এ দেশের সাংবাদিক সম্বন্ধে ধারণা দেওয়ার আগেই জিলের ধারণা জন্মে গেছে।
জিল যে বাড়িতে উঠেছে, বাড়িটি এক বাঙালি ভদ্রলোকের, বউ ফরাসি। এর আগে প্যারিসের গামা ফটো এজেন্সি থেকে জিল সসেয়ার এসেছিল, সেও গুলশানের এ বাড়িটিতে ছিল। সেই জিলের সূত্র ধরেই এই জিল এ বাড়িতে উঠেছে। সেই জিল কয়েক হাজার ছবি তুলে নিয়ে গেছে আমার, এমনকী আমাকে নিয়ে ময়মনসিংহে গেছে, অবকাশে পরিবারের সবার সঙ্গে ছবি তুলেছে, বিশেষ করে মার সঙ্গে। ছাদে। মার সঙ্গে ছবি? মা অপ্রস্তুত ছিলেন। মার তো কখনও এভাবে কখনও ছবি তোলা হয় না। মাকে গুরুত্ব দেওয়াটা বাড়ির সবাইকে তো বটেই, মাকেও অবাক করেছে। এখন এই জিল, জিল গনজালেজ গুলশানে। এ বাড়িতে সেদিন অনেককে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল, নিমন্ত্রিত বাঙালি অতিথিদের জিল বড় গর্ব করে বলেছে, তোমাদের তসলিমাকে আমি প্যারিসে নিয়ে যেতে এসেছি। ওখানে ওর অনুষ্ঠান আছে। আর্তে টেলিভিশনে ও প্রেস ফ্রিডম সম্পর্কে বলবে। শুনে, জিল বলল, ওরা মোটেও খুশি হয়নি, বরং বলেছে, ওর লেখা তো আমরা পছন্দ করি না।
জিল সাত ফুট লম্বা। মেদহীন ছিমছিমে শরীর। নীল চোখের সোনালি চুলের আশ্চর্য সুন্দর যুবক। ছবির দেশের কবিতার দেশের যুবক। জিল বলে, ফরাসিরা খুব সরল। জটিলতা কম বোঝে। এটি আমার খুব যে বিশ্বাস হয়েছে, তা নয়। এলিজাবেথকেই তো দেখেছি। ফ্রান্স থেকে এসেছিল আমার ওপর একটি তথ্যচিত্র করতে। বড় রহস্যময়ী। বিশাল বিশাল ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে এলিজাবেথের পেছন পেছন এসেছিল ফিলিপ। আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার মাঝখানে মাঝখানে ফিলিপ আর এলিজাবেথ আড়ালে গিয়ে ফরাসি ভাষায় কথা বলে। আমি সামনে গেলেই কথা বন্ধ করে ফেলে। আরে বাবা, বলে যাও, আমি কি আর ফরাসি ভাষা বুঝি! এলিজাবেথ আমাকে সিলেটের সাহাবা সৈনিক পরিষদের হাবীবুর রহমানের কথা জিজ্ঞেস করল, যা জানি তা জানালে বলেছিল যাবে সে সিলেটে। সিলেটে যাবে? কি করে ওখানে হাবীবুর রহমানকে খুঁজে পাবে? আমার প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে এলিজাবেথ আবার ফিলিপের সঙ্গে ফিসফিস করল। এরপর আমাকে একেবারে সাফ সাফ জানিয়ে দিল, আসলে তাদের সময় নেই সিলেটে যাবার, তারা যাচ্ছে না। আসলে কিন্তু সিলেটে তারা গিয়েছিল। পত্রিকায় দেখেছি খবর। আমার কাছে লুকোনোর কী কারণ থাকতে পারে আমার বোঝা হয়নি। জটিলতা হয়ত জিল কম বোঝে।
শেষ রাত্তিরে বিমান উড়বে আকাশে। আমাকে বিমান বন্দরে পৌঁছে দেবার জন্য সাহাবুদ্দিন আমার বাড়িতে রাত কাটালেন। জিলকে গুলশান থেকে তুলে নিয়ে বিমান বন্দরে গেলাম, রাত তখন তিনটে কি চারটে। গিয়ে শুনি সময় মত আমরা বিমানে চড়তে পারছি না, দেরি হবে তিন ঘন্টা। রাতে আমার ঘুম হয়নি, জিলেরও হয়নি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বিমানে ঘুমোবো। ক্লান্তিতে নুয়ে আসছিল শরীর, রেস্তোরাঁর এক কোণায় তিনটে করে চেয়ার সাজিয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম। এমন জায়গায় শুলেই তো ঘুম আসে না। দুজন গল্প করতে শুরু করলাম। জিল এই প্রথম এশিয়ার কোনও দেশে এসেছে। বিমান বন্দরটি সম্পর্কে বলল, ইস কী ছোট বন্দর, মাত্র কটা মাত্র বিমান! কেমন লেগেছে ঢাকা শহরটি দেখতে! বলল, খুব ভিড়, রিক্সার, মানুষের। বলল, প্যারিসে কেবল গাড়ি। গাড়ি আর গাড়ি। গাড়ির কথায় এও বলল যে ওখানে সবাই নিজে গাড়ি চালায়। ড্রাইভার রাখে না। খুব ভিআইপি হলে রাখে। যেমন? যেমন প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টার। আমার গাড়ির ড্রাইভার দেখে জিল বলেছিল, তুমি খুব ধনী। শুনে হেসে বাঁচি না। না, ধনী হতে হয় না। এখানে সবাই ড্রাইভার রাখে। ড্রাইভারের বেতন এখানে তো খুব বেশি নয়, তাই রাখতে পারে। আমার বাড়িতে, প্রথমদিনই জিল বলেছিল, জ্যোৎস্না নামের ন বছর বয়সী মেয়েটিকে দেখে, যে চা দিয়েছিল আমাদের, ও কি তোমার ভাই?
না, ও এখানে কাজ করে।
কাজ করে? জিল অবাক হয়। কাজ করার মানুষ যারা রাখে, তারা তো খুব ধনী হয়, জিলের ধারণা।
জ্যোৎস্নার ন্যাড়া মাথা দেখে জিল বলে, ওর মাথায় চুল নেই কেন?
চুল ফেলে দেওয়া হয়েছে, আবার ভাল চুল গজাবে বলে।
ভাল চুল গজাবে! জিলের নীল চোখদুটো অনেকক্ষণ বড় হয়ে ছিল বিস্ময়ে। কানাডার মেয়ে লীনাও অবাক হয়েছিল ভালবাসার ন্যাড়া মাথা দেখে। ওকে পরে আমি বুঝিয়ে বলেছি, এখানে এরকম একটি বিশ্বাস চালু আছে যে যত বেশি চুল কাটা হয় বাচ্চাদের, তত ঘন ও কালো চুল গজায়। এটির পেছনে কোনও বৈজ্ঞানিক কারণ আছে বলে আমার জানা নেই। জিলের আরও একটি ধারণা দেখে আমি হেসেছিলাম। মৌলবাদীদের একটি মিছিল দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, ওরা কি মুসলিম?
জিল মুসলিম বলতে মৌলবাদী বোঝে। ক্রিশ্চান মৌলবাদীদের ও ক্রিশ্চান বলে। ক্রিশ্চান শব্দটি উচ্চারণের সময় ওর নাক কুঁচকে ওঠে। মুসলিম শব্দটি ভয়ংকর একটি শব্দ, ওর উচ্চারণে আমি তা অনুমান করি।
রেস্তোরাঁয় চেয়ার পেতে শুয়ে আর কতক্ষণ থাকা যায়! উঠে হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটাতে থাকি। বিমান বন্দরের জানালায় দাঁড়িয়ে আমরা যখন দেখছিলাম বিমান উড়ছে, নামছে, সৌদিয়া, পিআইএ, বাংলাদেশ বিমান, জিল মন্তব্য করল, দেখেছো সব বিমানগুলোয় সবুজ রং!
তাতে কি?
সবুজ হচ্ছে ইসলামের প্রতীক। সব মুসলিম দেশের পতাকাতেই সবুজ রং থাকে।
আমি তো জানি সবুজ হচ্ছে তারুণ্যের রং। সবুজ হচ্ছে প্রকৃতির রং।
তুমি দেখো, সব মুসলিম দেশেরই পতাকায় সবুজ আছে। কিছু না কিছু সবুজ আছেই।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না। ঠিক বলনি। তুরস্কের পতাকায় নেই।
জিল মাথা চুলকোয়। এটি তার মাথায় ছিল না।
তুরস্ক ছাড়া সব মুসলিম দেশের পতাকায় সবুজ আছে।
খানিকক্ষণ ভেবে বলি, মালোয়েশিয়ায় নেই, তিউনেশিয়ায় নেই। কাতারের পতাকায় নেই।
অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে জিল বলে, গুনে দেখবে বেশির ভাগ দেশগুলোতেই আছে।
অনেক অমুসলিম দেশের পতাকায় সবুজে ভর্তি। ব্রাজিল। ভারত। বুলগেরিয়া। আয়ারল্যাণ্ড। ইতালি। মেক্সিকো। দক্ষিণ আফ্রিকা। আমি নিশ্চিত, আরও অনেক দেশে আছে।
হ্যাঁ থাকতে পারে। কিন্তু মুসলিম দেশের পতাকায় বেশি।
বাংলাদেশের পতাকার সবুজের ব্যাখ্যাটি করে দিলাম, বাংলাদেশ ইসলামিক দেশ নয়। এখনও দেশটির নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। পতাকার সবুজ হচ্ছে আমাদের সবুজ প্রকৃতি।
বাংলাদেশ ছাড়ার আগে জিল সাংবাদিকদের সঙ্গে তার অভিজ্ঞতার কথা বলে। বলে যে অনেক সাংবাদিকের সঙ্গেই তার কথা হয়েছে। আমার সম্পর্কে ওদের সে জিজ্ঞেস করেছে। ওরা অদ্ভুত করে নাকি হেসেছে। বলেছে, ও তো পুরুষ বিদ্বেষী। ও যে রকম নারী স্বাধীনতার কথা বলে, সেটি এ দেশের জন্য খাটে না। জিল আমাকে জিজ্ঞেস করে, সরল জিজ্ঞাসা, সাংবাদিকদের ভ্রূ কুঞ্চন হয় কেন আমার নাম শুনলে? জিল ওদের ভ্রূ কুঞ্চন দেখে বেশ আহত হয়েছে। কী জানি, মনে মনে ভাবছে বোধহয় যে আমাকে এতটা সম্মান জানাতে প্যারিস অবদি নিয়ে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। আমি সংকোচে চোখ ফিরিয়ে নিই। জিলের মুখখানার দিকে তাকিয়ে আমার বোঝা হয় না কোনও অনুশোচনা হচ্ছে কি না তার। বোধহয় হচ্ছে, বোধহয় হচ্ছে না। আমি এই হচ্ছে আর হচ্ছে নার মাঝখানে দুলতে থাকি একা একা। এখানকার সাংবাদিকদের চরিত্র আমি বেশ জানি, তারা কি বলল না বলল তা নিয়ে আমি মোটেও মাথা ঘামাই না। জিলের জন্য আমার মায়া হতে থাকে। সে কষ্ট পাক, চাই না।
ব্যাংককে পৌঁছে দেখি আমাদের ন কি দশ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে প্যারিসের বিমান ধরার জন্য। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বিমান বন্দরে দুটো ঘর নেয় জিল। জিল দুটো ঘর নেয় কেন? ছ ঘন্টায় একটি ঘর চল্লিশ ডলার করে। এত টাকা খরচা করার কোনও মানে নেই। একটি ঘরেই আছে দুটো বিছানা। এতেই তো দুজনের চলত। কি জানি এ বোধহয় সভ্য দেশের বিশেষত্ব। ঢাকা বিমান বন্দরে এক শাদা লোককে দেখিয়ে জিলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, লোকটি কি ফরাসি? জিল এক পলক দেখেই সোজা বলে দিল, না।
–না বললে কেন? কি করে বুঝলে যে লোকটি ফরাসি নয়? ফরাসিদের চেহারায় কি বিশেষ কোনও কিছু আছে?
নিশ্চয়ই, বলে রেস্তোরাঁয় কয়েকটি শাদা লোকের দিকে তাকিয়ে ফট করে একটিকে দেখিয়ে বলে দিল, ওই লোকটি ফরাসি।
তাই বুঝি!
ফিরে ফিরে তাকিয়ে কিছু একটা বিশেষত্ব খুঁজছিলাম চেহারায়, আচার, আচরণে। আছে কি? হুঁ, তা আছে বটে কিছু।
যদিও বিশ্রামের জন্য আমরা ঘর নিয়েছিলাম, ঘুম আমারও হয়নি, জিলেরও হয়নি। আমরা আবার সিদ্ধান্ত নিই, বিমানে ঘুমোবো। বন্দর ঘুরে জিলের জন্য চকলেট কিনেছি। দেখে খুশিতে ফেটে পড়ে। আমি যখন বিশ্রাম নিচ্ছিল!ম ঘরে, তখনই জিল দুজনের পাসপোর্ট আর টিকিট দেখিয়ে দুটো বোর্ডিং কার্ড নিয়ে নিয়েছে। পরে আমাকে মন খারাপ করে বলল, বোর্ডিং কার্ড দিচ্ছে যে মেয়েটি, জিজ্ঞেস করেছে জিলকে, আপনার হাতে বাংলাদেশের পাসপোর্ট কেন? কে এই বাংলাদেশি মেয়ে? একে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছি প্যারিসে। উত্তর শুনে মেয়েটি জিলের দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়েছে। অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছে, একে ওকে ডেকে এনে পাসপোর্ট দেখিয়েছে। এসব শুনে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীদের কী ভীষণ ঘৃণা করে মানুষ! তারা যে কোনও দেশেই অবৈধ ভাবে ঢুকে যেতে পারে, এই আশঙ্কা সবার। আমি সেই দেশেরই মানুষ বেরিয়েছি পৃথিবীর পথে, যার দিকে দেশে দেশে লোকেরা সন্দেহের চোখে তাকাবে। জিল অনেকবার গৌরব করে বলেছে যে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশ ফ্রান্স, সবচেয়ে সুন্দর শহর প্যারিস। সে জার্মানি পছন্দ করে না, কারণ বড় শক্ত শক্ত নিয়ম কানুন ও দেশে, আমেরিকাও তার পছন্দ নয়, কোনও সংস্কৃতি নেই বলে। তবে, জিল, না বললেও বুঝি, যে, বাংলাদেশকে পছন্দ করে না। আর তার অপছন্দের দেশের, প্রচণ্ড গরীব আর সভ্য না হওয়া দেশের মানুষ আমি, আমাকেও নিশ্চয়ই সে পছন্দ করছে না। যদি করে কিছু, সে করুণা।
যখনই বিমানের ভেতর ঢোকার জন্য লোকদের ঠেলাঠেলি ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল, জিল জোরে হেসে উঠে বলে, ‘এরা এমন পাগল হয়ে যাচ্ছে কেন আগে যাওয়ার জন্য, আগে গেলে কি ভাল জায়গায় বসতে পারবে নাকি?’ আমাদের মধ্যেই আগে যাওয়ার কোনও তাড়া ছিল না। আগে গেলেও পরে গেলেও ওই বাহান্নো নম্বর আসনেই বসতে হবে। বিমানের ভেতরে দুজন পাশাপাশি বসে এয়ার হোস্টেসদের দিয়ে যাওয়া কমলার রস পান করছি যখন, জিল বলল, জ্ঞখেয়াল করেছো, এয়ার হোস্টেসদের হাসিগুলো? কি রকম কৃত্রিম হাসি, দেখেছো! যেন রোবটের মুখে হাসি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ রসের গেলাস যখন নিতে এল আরেক এয়ার হোস্টেস, মোটেও না হেসে, জিল আমার কানের কাছে মুখ এনে আস্তে বলে, ‘এ এখনও ট্রেইনি, নকল হাসি রপ্ত করতে শেখেনি।’ ঘুম আমাদের, যা ভেবেছিলাম, হবে, হয়নি। ওরকম বসে বসে কি ঘুমোনো যায়! ঘুমোতে চেষ্টা করে আমারও ঘুম হয়নি, জিলেরও হয়নি। বিমান চলছে কাঠমুণ্ড দিল্লি হয়ে পাকিস্তান আফগানিস্তান পার হয়ে প্যারিসের দিকে। জানালা খুলে দিলে ঝাঁক ঝাঁক আলো এসে সম্ভাষণ জানায়। প্যারিসে যখন নামলো বিমান, চলমান সিঁড়িতে নয়, তুমি হাঁটছো চলন্ত কার্পেটের ওপর দিয়ে, ওতে আর সবার মত হাঁটতে গিয়ে যেহেতু অভ্যস্ত নও, হুমড়ি খেয়ে পড়তে নিয়েছো বেশ কবার। খুব দ্রুত এক দালান থেকে আরেক দালানে পারাপারের জন্য এই যান্ত্রিক ব্যবস্থাটি করেছে ফরাসিরা। কিন্তু বন্যা ঘূর্ণিঝড় আর দারিদ্রপীড়িত দেশের মানুষ এসব যান্ত্রিক জিনিসে কি করে য়চ্ছন্দ হবে! কোনও কারণ নেই। হাঁ হয়ে দেখি বন্দরটি। কি বিশাল! কি বিশাল! বন্দরের নাম শার্ল দ্য গোল। বন্দরটিতে হাজার হাজার মানুষ ছুটছে, মিনিটে মিনিটে বন্দরের উঠোনে বিমান নামছে, উঠোনে বসে থাকা বিমান উড়ে যাচ্ছে। এই আছে, এই নেই। চোখের পলকে দৃশ্যগুলো বদলে যাচ্ছে। ছোটোবেলায় দেখা বায়স্কোপের ছবির মত। এমন দৃশ্য সত্যিকার এই প্রথম দেখছি জীবনে। আমাকে স্বাগতম জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্সের প্রধান রবার্ট মিনার্ড। জিল যাকে হোবিয়া মিনা বলে, অন্তত আমার কানে এরকমই শোনা যায়। রবার্ট মিনার্ড আর হোবিয়া মিনা যে এক ব্যক্তি তা আমার পক্ষে প্রথম বোঝা সম্ভব হয়নি। আমি জানি যে ফরাসি উচ্চারণ ঠিক বানানের মত হয় না। বানানে রিমবাউড হলেও ফরাসি কবির নাম র্যাঁবো, তারপরও শুনি র্যাঁবোও ওরা আমাদের মত উচ্চারণ করে না, কান পাতলে শোনা যাবে খ্যাঁবো। ওদের সম্পর্কে পড়ে আর শুনে জানা এক জিনিস, আর ওদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওদের সম্পর্কে জানা আরেক জিনিস। হোবিয়া মিনা আমাকে জড়িয়ে ধরে দু গালে চুমু খেলেন। আমি ভীষণ অপ্রস্তুত। অনভ্যাসে কাঠ হয়ে ছিলাম। চকিতে সরিয়েও নিয়েছিলাম মুখ যখন তাঁর মুখ আমার মুখের দিকে এগিয়ে আসছিল। জানতাম ফরাসিরা গালে চুমু খায়, কিন্তু চুমুর সামনে পড়লে মাথার এই জানা বিদ্যেটা চড়ুই পাখির মত উড়ে যায়। হোবিয়া মিনা একটি অক্ষর ইংরেজি জানেন না। আমাদের মধ্যে দোভাষীর কাজ করছে জিল।
বন্দর থেকে বাইরে বেরোলেই তেরো ডিগ্রি সেলসিয়াস। একটি শীত শীত সুই আমার গায়ে বিঁধল এসে। জিল তার গায়ের কোটটি খুলে আমার পিঠে ছড়িয়ে দিল। আমরা গাড়ি করে প্যারিসের দিকে যাচ্ছি। গাড়ি খুব দ্রুত চলছে, সব গাড়িগুলোই খুব দ্রুত চলে এখানে। হোবিয়া মিনা আর জিল দুজন অনর্গল কথা বলছে, জিল দেখছি নোট করে নিচ্ছে যা যা কথা হচ্ছে, লম্বা একটি কাগজ ভরে গেল লিখতে লিখতে। মাঝে মাঝে জিল আবার অনুবাদ করে দিচ্ছে আমাকে, ‘তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে চাইছে, এডিশন দ্য ফাম থেকে, উনি আবার মন্ত্রীও।’ ফ্রান্সের মন্ত্রী দেখা করতে চাইছে! অবাক হই। আমি কি মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার যোগ্য! এরা হাজার বছরের শিক্ষিত। আর আমার বংশে আমার নানা দাদা দুজনই টিপসই এর চেয়ে বেশি যা পারতেন, তা নিজের নামখানা লিখতে কেবল। আমার বিশ্বাস হতে চায় না আমি এই জায়গায় এসে পৌঁচেছি। বিশ্বাস হতে চায় না পৃথিবীতে এমন সুন্দর কোনও শহর থাকতে পারে। নিজেকে ভুলতে থাকি আমি। আমার ভেতরে আর আমি নেই। যেন অন্য কেউ, অন্য কেউ অন্য কোনও গ্রহে। অথবা যেন ছবি সব। যেন এসব সত্য নয় প্যারিসের ভেতর যখন আমাদের গাড়ি চলছিল, ছবির মত লাগছিল। ছবিতে দেখেছি এমন সব দৃশ্য। প্যারিসে ঢোকা না তো আশ্চর্য সুন্দর একটি ছবির মধ্যে ঢুকে পড়া। এমন সুন্দর চারদিক, যে দেখতে দেখতে শ্বাস নিতে ভুলে যাচ্ছি। প্যারিসে শুনেছি বিখ্যাত অনেক যাদুঘর আছে, কিন্তু পুরো প্যারিসই যে আস্ত একটি যাদুঘর, তা আমার জানা ছিল না আগে।
আমার ঘোর কাটে না। আমার বিস্ময় কাটে না। যত দেখি প্যারিস, তত আরও দেখতে ইচ্ছে করে। শহরটিকে কুড়ি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কিছু এলাকাকে বলা হয় ধনী এলাকা, কিছু এলাকাকে গরিব এলাকা। বেলভিল নামের এক গরিব এলাকা যখন আমাকে দেখানো হল, আমি আতি পাতি করে দারিদ্র খুঁজছিলাম। বিশাল বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ি, বাড়িতে যারা থাকছে প্রায় সকলেরই গাড়ি আছে, সকলের পরনে সার্ট প্যান্ট, সকলের পায়ে জুতো, এরা আবার গরিব হবে কেন!
–গরিব এলাকা দেখাবে বলেছিলে? জিলকে জিজ্ঞেস করি।
–ওই তো দেখালাম। এতক্ষণ কি দেখলে!
–একে তোমরা গরিব এলাকা বল! আমি হেসে উঠি। আমার চোখে দেখা আর ফরাসিদের চোখে দেখা দারিদ্রে আকাশ পাতাল পার্থক্য।
জিল আমাকে নিয়ে গেল একটি ব্রাসারিতে দুপুরে খাওয়াতে। ব্রাসারির ভেতর একটি বার। তাকে সারি সারি মদের বোতল সাজানো। জিল জানি না কি খাবার দিতে বলেছে দুজনের জন্য। অদ্ভুত খাবার, কখনও খাইনি আগে। আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব হয় না। ক্ষিধে ছিল পেটে, কিন্তু মন এমন ভরে আছে প্যারিসের সৌন্দর্যে! পেটের ক্ষিধে যে কোথায় উবে গেছে কে জানে।
জিল আমাকে নিয়ে গেল শাঁ জার্মা দি প্রের একটি ক্যাফেতে। বিখ্যাত ক্যাফে। ক্যাফে দ্য ফ্লোর। জিলের বোন দোমিনিক অপেক্ষা করছিল ওখানে আমাদের জন্য। ক্যাফেটিতে একসময় জ্যাঁ পল সাষর্ন আর সিমোন দ্য বোভোয়া বসতেন, আড্ডা দিতেন, লিখতেন, সাহিত্য আর দর্শন নিয়ে বক্তৃতা করতেন। ওঁদের নাম লেখা আছে চেয়ারের পিঠে, যে চেয়ারে দিনের পর দিন বসে কাটিয়েছেন। দোমিনিক আর জিলের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব। একজন আরেকজনের প্রশংসা করছে, আড়ালে। আর সামনে খুনসুঁটিতে ব্যস্ত। দুজন বড় হয়েছে হিপি পরিবারে। মা স্প্যানিশ গনজালেজ আর বাবা জার্মান ফরস্টার পরিবারের। হিপিরা সমাজের কোনও নিয়ম মেনে চলত না। জিল আর দোমিনিক ছোটোবেলায় বাবা মার কোনও রকম শাসন পায়নি। কোনো নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে ওরা জীবন যাপন করত না। কেউ বলেনি ওদের নাও খাও, পড়তে বসো, ঘুমোতে যাও বা কিছু। যখন যা ইচ্ছে করে জিলরা তাই করেছে। বাবা মাও তেমন। যেমন ইচ্ছে তেমন জীবন যাপন করেছে। কোনও বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না কিছুতে। জিলের বাবা মা কখনও বিয়েই করেনি। ছেলেমেয়েরা বাবা মাকে নাম ধরে ডাকত। জিলও তার মাকে ক্লদিয়া বলে ডাকে। আশ্চর্য, ওই পরিবেশে বড় হয়েও জিল তার বাবা মা আর বোনের জন্য কি গভীর ভালবাসা পুষে রাখে। ওরাও জিলের জন্য।
যখন আমাকে জিজ্ঞেস করা হল, কী দেখতে চাই প্যারিসে। প্রথমেই আমি বললাম, মিউজিয়াম। র্যোঁদার ওপর একটি বই পড়া আছে আমার। র্যোঁদার ভাস্কর্যগুলো এখনও মনের ভেতর। জিল আর দোমিনিক আমাকে নিয়ে গেল র্যোঁদা মিউজিয়ামে। খুব সুন্দর এই মিউজিয়াম। র্যোঁদার ভাস্কর্যগুলো সামনে থেকে দেখি আর ভেবে কূল পাই না কি করে পাথর কেটে কেটে এমন সব আশ্চর্য সুন্দর মূর্তি গড়তে পারে কেউ। র্যোঁদার পুরো জীবনটি আমার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। কি করে তিনি তার মডেল কন্যাদের ব্যবহার করেছেন কাজে। কামি কদেলকে খুঁজি তাঁর কাজে। ইচ্ছে করে ছুঁয়ে দেখি। না, এখানে কিছুই স্পর্শ করা যাবে না। ক্যামেরায় ছবি তুললে ফ্লাশ বন্ধ করে তুলতে হয়, কারণ ওই আলোয় শিল্পকর্ম নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কোথাও কোথাও এমন আছে যে হাজার বছর আগের গুহার ছবিগুলো দেখাও এখন সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ, কারণ মানুষের শ্বাস প্রশ্বাসের কারণে ছবি মলিন হয়ে যায়। মিউজিয়ামের বাইরে রাখা আছে র্যোঁদার ভাবুক মূর্তিটি। হাঁটুর ওপর কনুই রেখে চিবুকের নিচে হাত রেখে ভাবছে মানুষটি। রাখা নরকের দ্বারও। র্যোঁদার ভাস্কর্য দেখা শেষ হলে জিল নিয়ে গেল ভিক্টর উগোর বাড়িতে। প্লাস দ্য বোজ এ। মাঝখানে একটি মাঠ, আর চার কিনারে একরকম সব বাড়ি। এলাকাটি ধনী এলাকা। ধনীরা থাকতেন একসময়, এখনও ধনীরাই থাকেন। বাড়িগুলো মোটেও আমাদের বাড়ির মত নয়। এসব বাড়িতে কোনও ছাদ নেই। কেউ বিকেলবেলা ছাদে ওঠে না। ছাদগুলো কালো ইস্পাত বা সবুজ কপারে মাথা মুড়ে আছে, মাথার তলে ছোট ছোট ঘুলঘুলিগুলো পাখির নীড়ের মত। একসময় ওপরতলার ছোট ছোট ঘরে কাজের মেয়েরা থাকত। ফরাসি রেভুলেশনের পর শ্রেণীর তফাৎটি দূর হয়েছে। তুমি প্রভু, আমি ভৃত্য–এই ব্যাপার আর নেই। আহা এরকম একটি সমাজ যদি আমাদের দেশেও হত। ভিক্টর উগোর বাড়িটিতে তাঁর আঁকা ছবি, তাঁর লেখা পান্ডুলিপি দেখলাম। একটি জিনিস আমার খুব অবাক লেগেছে, তাঁর মেয়ে সেইন নদীতে পড়ে মারা যাওয়ার পর উগো এমনই ভেঙে পড়েছিলেন যে মেয়ের আত্মার সঙ্গে তিনি কথা বলতেন বলে ভাবতেন। টেবিলে টোকা পড়ত আর তিনি টোকাগুলো অনুবাদ করতেন। মাসের পর মাস বসে বসে অপ্রকৃতিস্থের মত কেবল অনুবাদ করতেন। মোটা মোটা খাতা ভরে ফেলেছেন লিখে মেয়ের আত্মার সঙ্গে তাঁর কথোপকথন। রবীন্দ্রনাথও প্ল্যানচ্যাট করতেন। জানি না বড় বড় মানুষগুলো বেশি বয়সে এসে এমন নির্বোধ হয়ে যান কেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভিক্টর উগোর মিল অনেক। দুজনের মধ্যে বয়সে একশ বছরের তফাৎ। দুজনে সঙ্গীত ভালবাসতেন। দুজনে ছবি আঁকতেন। উগো প্রেমে পড়েছিলেন তাঁর দাদার প্রেমিকার, আর রবীন্দ্রনাথ প্রেমে পড়েছিলেন তাঁর দাদার স্ত্রীর। উগো কন্যার মৃত্যুতে শোকে বিহ্বল ছিলেন। রবীন্দ্রনাথও। দুজনই মানবতার কথা বলতেন।
ল্যুভর মিউজিয়ামটি সেইন নদীর পাড়ে। আশ্চর্য এই মিউজিয়ামটি বাইরে থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা দেখলেও দেখা ফুরোবে না। এমনই নিখুঁত স্থাপত্য এর। বিশাল এই বাড়িটির গায়ে গায়ে মূর্তি বসানো। হোটেল দ্য ভিলের গায়েও মূর্তি বসানো। প্রথম যখন চমৎকার বাড়িটির নাম জিল বলল হোটেল দ্য ভিল, আমি তো ভেবেইছিলাম এটি সত্যিই কোনও হোটেল, যেখানে লোকে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। আরে তা হবে কেন! ওটি টাউন হল। প্যারিস শহরের মেয়রের আপিস। সরকারি এরকম বাড়িগুলোকে ফরাসিরা হোটেল বলে। বেসরকারি কিন্তু বড় কোনও বাড়ি হলেও বলে, যেমন হোটেল পারতিকুলিয়ে।
জ্যাঁ শার্ল বারথেয়ার আর দোমিনিক আমাকে নিয়ে গেল ল্যুভর মিউজিয়াম দেখাতে। জ্যাঁ শার্ল এসেছিল হোটেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে। বারথেয়ার আমার অনুবাদক। লজ্জা বইটি অনুবাদের কাজ নিয়েছে সে। বারথেয়ার আর দোমিনিক আমার দুপাশে, আমি জগতের সকল বিস্ময় নিয়ে দেখছি ল্যুভর মিউজিয়াম। অর্ধেক দিন মিউজিয়ামে হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যথা হয়ে যায়, তবু মিউজিয়ামের হাজার ভাগের এক ভাগও দেখা হয় না। পুরোনো তেলচিত্রগুলো সেই সতেরো আঠারো শতাব্দির, প্রধানত যীশুর ছবি। যীশুর মুখমাথা থেকে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। আধন্যাংটো যীশুই দখল করে আছেন তখনকার শিল্পকলা। আজদাহা সব ক্যানভাস। আর কি যে নিখুঁত সব কাজ! একটি ছবিতে যীশু আর তাঁর পাশে অনেকগুলো লোক, কেউ খাচ্ছে, কেউ গান গাইছে, কারও কারও আবার ভীষণ রকম উদ্বিগ্ন মুখ। দোমিনিককে জিজ্ঞেস করি, এই দৃশ্যের গল্পটি বলতে। দোমিনিক বলল যে ধর্ম সম্পর্কে খুবই কম জানে সে। আমি যখন প্রশ্ন করে উত্তর পাচ্ছি না, তখন ভিড় থেকে এক লোক এসে বলল, মানুষগুলো সবসময় যে বাইবেলের চরিত্র তা নয়, শিল্পী যীশুর আশেপাশের লোকজনের মুখে তখনকার নামকরা সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মুখ বসিয়ে দিতেন। কখনও কখনও আবার দেখা যায় ভিড়ের মধ্যে ধর্মের লোকজনের মধ্যে আকারে ছোট একটি মানুষ, সে মানুষটি হয়ত তিনি, যিনি শিল্পীকে দিয়ে এই ছবি আঁকিয়েছিলেন। পয়সার বিনিময়ে ছবি আঁকতে গেলে অনেক অনুরোধ মেনে চলতে হয়। রাজা বাদশারা বা ধনী লোকেরা শিল্পীদের দিয়ে ছবি আঁকাতেন, শর্ত থাকত যীশুর পায়ের কাছে কোনও কিনারে যেন তাঁরা খানিকটা শোভা পান। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে সেই সব মুখ এখনও শোভা পাচ্ছে ক্যানভাসে, ধর্মের গল্পের অংশীদার হয়ে।
দোমিনিকের সঙ্গে শিল্প সংস্কৃতি নিয়ে কথা হয়, বারথেয়ারের সঙ্গে তেমন হয় না। বারথেয়ার না জানে ইংরেজি, না জানে বাংলা, যদিও সে দাবি করে যে সে বাংলা জানে। এ পর্যন্ত একটি বাংলা শব্দও আমি তার মুখে উচ্চারিত হতে শুনিনি। আমি বেশ কয়েকবার বাংলায় কথা বলতে চেয়েছি, জিজ্ঞেস করেছি, আপনি কি অনুবাদ শুরু করে দিয়েছেন? বাংলা ভাষা শিখেছেন কোথায়? এসবের উত্তরে আচমকা ঠা ঠা করে হেসে উঠেছে সে। এখন তার যা বলার ইচ্ছে তা সে ফরাসি ভাষায় দোমিনিককে বলছে, দোমিনিক তা অনুবাদ করে আমাকে শোনাচ্ছে। আমার ভয় লাগে ভেবে যে এই বাংলা না জানা লোকটি লজ্জা বইটি বাংলা থেকে ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করবে, কেবল করবে না, অনুবাদ নাকি শুরুও করে দিয়েছে। আমি নিশ্চিত, লোকটির দ্বারা আর যাই হোক, অনুবাদ হবে না। যাই হোক, ওতে আমি আপাতত মন দিচ্ছি না, মন দিচ্ছি শিল্পে। চারদিকে যীশুর এত ন্যাংটো ন্যাংটো ছবি দেখে তাকে কিন্তু ধর্মের লোক বলে মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে পর্নোগ্রাফির চরিত্র। শেষে একটি মন্তব্য করলাম, ধর্মের প্রয়োজন শিল্পের জন্য, জীবনের জন্য নয়। দোমিনিক সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিল আমার কথা। বলল, ধর্ম মানুষকে নানারকম কল্পনা দিয়েছে। কল্পনাকে ভিত্তি করেই এইসব আঁকাআঁকি।
–দোমিনিক, তুমি কি বাহবাটা শেষ পর্যন্ত ধর্মকে দিতে চাইছো? আমি কিন্তু মানুষকে দিতে চাইছি সবটুকু কৃতিত্ব। মানুষই ধর্ম সৃষ্টি করেছে। মানুষই ধর্ম নিয়ে ছবি একেঁছে, বই লিখেছে। মানুষের ভেতর প্রতিভা ছিল বলেই না এসব করতে পেয়েছে।
১. প্যারিসের ডায়রি – ০২
রাতে জঁ শার্ল বারথেয়ার খাওয়াবে আমাকে। জিল চলে গেছে জিলের বান্ধবীর বাড়ি। সে ক্লান্ত। বারথেয়ার, দোমিনিক আর আমি মোঁপারনাসে ক্লজারি দ্যা লিলা নামের একটি বিখ্যাত রেস্তোঁরায় খেতে গেলাম। এটি বিখ্যাত এই জন্য যে, এখানে একসময় কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা আড্ডা দিতেন। উনিশ শতকের শুরুর দিকে আমেরিকায় মদ নিষিদ্ধ করার ফলে অনেক আমেরিকান লেখক প্যারিসে চলে এসেছিলেন। তাঁরা এই বাধানিষেধহীন স্বপ্নপুরীতে বসে মহানন্দে মদ খেতেন। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তো এই রেস্তোরাঁয় বসে পুরো একটি বই লিখেছেন। প্যারিসে এরকম বহু ক্যাফে আছে, যেখানে শিল্পী সাহিত্যিক দার্শনিকরা ক্যাফে সংস্কৃতির শুরু করেছিল।
রেস্তোরাঁটিতে দেখছি ছেলেমেয়েরা মদ খাচ্ছে, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরছে, চুমু খাচ্ছে। কেউ ওদের দিকে তাকাচ্ছে না। আমি তাকাই। চোখ মেলে দেখি সব। কি চমৎকার পরিবেশ। ইচ্ছেগুলোকে কেউ দমন করছে না। চুমু খেতে ইচ্ছে করছে, খাচ্ছে। চোখ কপাল কুঁচকে মুখে রাগ ঘৃণা হিংসা নিয়ে বসে থাকা ঝগড়া করা মানুষ দেখার চাইতে তো হাসি মুখের খুশি মুখের প্রেম দেখা চুমু দেখা অনেক ভাল। মন ভাল হয়ে যায়। পৃথিবীকে বড় সুন্দর মনে হয়। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়।
বরফের থালায় আমাদের জন্য ঝিনুক এল। দেখে আঁতকে উঠি। কি রে বাবা ঝিনুক খাবে কে! বারথেয়ার আর দোমিনিক ওয়াও ওয়াও বলে একের পর এক ওগুলো খেতে শুরু করল। ভেবেছিলাম ওয়াও শব্দটির পর বলবে কি বাজে। কিন্তু বলল ওয়ান্ডারফুল। কি করে এই বিদঘুটে জিনিসটি ওয়াণ্ডারফুল হয় জানি না। বহু কষ্টে গলায় উঠে আসা বমি আটকে রাখি। দুজনই আমাকে সাধাসাধি করে খেতে। আমি সোজা না বলে দিই। আমার না এ কাজ হয় না। দোমিনিক আমাকে যে করেই হোক ঝিনুকের স্বাদ নেওয়াবেই। আমার চোখ বন্ধ করল ওরা, নাক বন্ধ করল, এরপর মুখটি হাঁ করিয়ে ঢুকিয়ে দিল একটি আস্ত ঝিনুক। গলা বেয়ে সুরসুর করে চলে গেল জিনিসটি, যেন কারও একদলা থিকথিকে সর্দি গিলে ফেললাম। বারথেয়ারের অনেক খরচ হয়ে গেল এই রেস্তোরাঁয়। আমি টাকা দিতে চাইলে, বারথেয়ার আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোমার বই অনুবাদ করার জন্য ম্যালা টাকা পেয়েছি আমি।
রাত দেড়টায় আমরা বেরোলাম রেস্তোরাঁ থেকে। রেস্তোরাঁ তখনও জমজমাট। প্যারিস কি ঘুমোয় রাতে! আমার মনে হয় না। বিদায় নেওয়ার সময় দোমিনিক আর বারথেয়ার জড়িয়ে ধরে চুমু খেল গালে। একদিনের পরিচয়ে গালে চুমু খাওয়া এ দেশে কোনও ব্যাপারই নয়। দোমিনিক আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে যায়। রাতে ভাল ঘুম হয় আমার। আন্তয়ান দ্য গুডমারকে ফোন করেছিলাম। আমি প্যারিসে শুনে খুশিতে চেঁচিয়ে বলল, ইনক্রিডবল। ইনক্রিডবল শব্দটি এরা খুব ব্যবহার করে। ক্রিশ্চান বেসকে ফোন করলেও ও বলেছে, ইনক্রিডবল, তুমি প্যারিসে! সকালে আন্তোয়ান এল হোটেলে। আমাকে নিয়ে কাছেই একটি ক্যাফেতে গেল নাস্তা খেতে। ঝকঝকে রোদ উঠেছে। আন্তোয়ান রোদ দেখে বারবারই বলছে, আহ, কি চমৎকার দিন আজ। কি সুন্দর রোদ!
উফ, রোদ আমার ভাল লাগে না। আমি রোদ থেকে গা বাঁচিয়ে ছায়া ধরে হাঁটি।
কি বল! রোদ ভালবাসো না তুমি!
–নাহ।
–আমাদের এখানে উৎসব শুরু হয়ে যায় রোদ উঠলে। বসন্তের প্রথম রোদ। তুমি যেন তোমার দেশের চমৎকার রোদ এই ঠাণ্ডা মেঘলা স্যাঁতসেঁতে প্যারিসে নিয়ে এলে! তোমাকে ধন্যবাদ।
–রোদ নিয়ে কী ভীষণ উচ্ছাস তোমাদের। আমি রোদের দেশের মানুষ। রোদ আমাদের গা পুড়িয়ে দেয়।
–আমাদের সূর্য ভাল লাগে।
–আমাদের চাঁদ ভাল।
–এখানে রোদ মানে আনন্দ। রোদ মানে সুখ।
–ওখানে রোদ মানে জ্বালা পোড়া, রোদ মানে অশান্তি। ছায়া আমাদের প্রাণ জুড়োয়।
কি পার্থক্য তাই না! আবহাওয়া নিয়েই গুডমার কথা বলল আধঘন্টা। বৃষ্টি ভাল লাগে আমার। বৃষ্টি অসহ্য গুডমারের। মেঘলা দিনকে গুডমার,কেবল গুডমার নয়, এখানকার সবাই, বলে খারাপ দিন। আমি বলি চমৎকার দিন। গুডমার আমাকে তার পত্রিকা দিল, লিবারেশন। এটি ফ্রান্সের বামপন্থী পত্রিকা। লিবারেশনে আমার প্যারিসে আসার খবর ছাপা হয়েছে। গুডমার ঢাকায় গিয়ে আমার যে সাক্ষাৎকার নিয়েছিল, সেটি যে দু পাতা জুড়ে বিশাল করে ছাপা হয়েছিল এ পত্রিকায়, সে লেখাটিও দিল। পত্রিকা খুলে নিজের ছবি আর নাম ছাড়া কোনও কিছু আমার পক্ষে চেনা সম্ভব হয় না। ভাষা রোমান হরফে, কিন্তু ভাষার খুব বেশি কিছু উদ্ধার করতে আমি পারি না। ক্যাফে থেকে হোটেলে ফিরে দেখি ক্রিশ্চান বেস আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। ক্রিশ্চানের বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে, অত্যাধুনিক পোশাক পরা সোনালী চুলের মাদাম, ফরাসি অ্যারিস্টোক্রেট। কিন্তু গাম্ভীর্যের বিন্দু মাত্র কিছু নেই। হই হই করা মানুষ তিনি। চকাশ চকাশ করে দু গালে চুমু খেয়ে তিনি আমাকে কাছের আরেকটি ক্যাফেতে নিয়ে গেলেন নাস্তা খেতে। ক্যাফের ভেতরে যেতে চাইলে না না করে উঠলেন ক্রিশ্চান। বাইরের রোদে বসবেন তিনি। ক্যাফের সামনে রাস্তার ওপরের ফুটপাতে চেয়ার পাতা, ওখানে রোদ পড়েছে, রোদে বসে গুডমারও খেয়েছে, ক্রিশ্চানও খেলেন। প্যারিসের এই হল সৌন্দর্য। গরম শুরু হতে না হতেই ক্যাফে রেস্তোরাঁগুলোর বাইরে পাতা চেয়ার টেবিলে খেতে বা পান করতে কিলবিল ভিড় লেগে যাবে।
লম্বা একধরনের রুটি আছে, ফরাসিরা এই রুটিকে বাগেত বলে। এটি তাদের খুব প্রিয় রুটি। বগলে করে একটি বাগেত নিয়ে লোকেরা রাতে বাড়ি ফেরে। অথবা সকালে ঘুম ঘুম চোখে বেরিয়ে মোড়ের বুলোনজরি থেকে একটি সবে বানানো গরম বাগেত কিনে বগলে করে বাড়ি যায়। বাগেত খেতে আর যে কোনও রুটির মতই স্বাদ। আমি জানি না, কেন ছোট রুটি না বানিয়ে দু হাত লম্বা রুটি বানাতে হয় এদের। ট্রাডিশন বলে একটি ব্যাপার আছে, ফরাসিরা তা সহজে হারাতে চায় না। কত রকম যে রুটি আছে এই দেশে! ক্রিশ্চান সকালে ক্রোসোঁ বলে একটি শঙ্খের মত দেখতে রুটি খাচ্ছেন, সঙ্গে কালো কফি। এই হল তাঁর সকালের নাস্তা। অনর্গল বকতে পারেন তিনি। ইংরেজি বলেন কড়া ফরাসি উচ্চারণে। বার বার করে জানতে চাইছেন আমার ফ্রান্সের প্রোগ্রাম। কবে হবে, কখন হবে, কোথায় হবে, কী হবে — সব তিনি জানতে চান। আমি, সত্যি কথা বলতে কি জানিও না আমার কখন কোথায় কি অনুষ্ঠান আছে। ক্রিশ্চানকে বড় আন্তরিক মনে হয়। দুজন খেয়ে দেয়ে হোটেলে ফিরে দেখি বারথেয়ার অপেক্ষা করছে। মোটা একটি বই এনেছে রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের আঁকা একটি ছবি দেখালো, এটি নাকি লজ্জার পঈচ্ছদ হবে। এরপরই জিল এল আমাকে নিতে। বারথেয়ারকে বিদায় দিয়ে জিল ট্যাক্সি ডাকল, সোজা আমাকে নিয়ে গেল রেডিও ফ্রান্সে। রেডিওতে সাক্ষাৎকার দিতে হল। জিল বলল যে তিন তারিখে রেডিওতে নাকি আমার আরেকটি সাক্ষাৎকার আছে। জিল জানে সব।ও জানে কখন কোথায় আমাকে যেতে হবে। রেডিও থেকে নিয়ে গেল একটি পত্রিকা আপিসে। সুন্দর গোছানো ছিমছাম আপিস। বড়। গাদাগাদি করে বাংলাদেশের পত্রিকা আপিসে যেমন সাংবাদিকরা বসে, সেরকম নয়। ওখানেও সাক্ষাৎকার। এরপর দুজন বেরিয়ে ক্যাফের বাইরে বসে দুপুরের খাবার খেলাম। খেয়ে হোটেলে ফেরার পর দেখি সিগমা নামের ফটো এজেন্সি থেকে ফটোগ্রাফার এসে বসে আছে, ফটো তুলবে আমার। হোটেলে তুলবে না, বাইরে তুলবে। বাইরের রোদে। ফটোগ্রাফার তার গাড়ি করে আমাদের নিয়ে গেল ল্যুভর মিউজিয়ামের সামনের বাগানে। কচি কলাপাতা রঙের সবুজ ঘাসে ফুটে আছে শাদা শাদা ফুল। গায়ে অনেক পাপড়ি। প্রেমিক প্রেমিকারা এই ফুলের পাপড়িগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে একটি খেলা খেলে। পাপড়ি ছেঁড়ে আর বলে, তোমায় আমি ভালবাসি, খুব ভালবাসি, পাগলের মত ভালবাসি, ভালবাসি না। ছিঁড়তে ছিঁড়তে যে পাপড়িটি একদম শেষে গিয়ে ছিঁড়বে সেটিই হবে মনের কথা। ছবির জন্য বিভিন্ন মূর্তির সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে, আর আমার থেকে থেকে চোখ চলে যাচ্ছে ফুলের দিকে। বাগানের ভেতর যুবক যুবতী চুমু খাচ্ছে। খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। গভীর চুমু। এই চুমুর নামই বোধহয় ফরাসি চুমু। দীর্ঘক্ষণ এত ঘন হয়ে বসে এইযে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে গভীর করে চুমু খাচ্ছে, খেয়েই যাচ্ছে, তড়িঘড়ি কোনও কর্ম সারার কথা, দেখে মনে হয়, মোটেও ভাবছে না। পাশ দিয়ে এত লোক হেঁটে যাচ্ছে, কেউ একবার ফিরেও তাকাচ্ছে না চুমু খাওয়া জোড়ার দিকে। বাংলাদেশে হলে ভিড় লেগে যেত। জোড়া তো ছাড়াতোই লোকে, দুজনের হাত পায়ের জোড়াও ভেঙে দিত মেরে।
আমরা জোন অব আর্কের ঘোড়ায় বসা সোনালী মূর্তির কাছেই একটি ক্যাফেতে বসি। এও বাইরে। ফটোগ্রাফার ভাল ইংরেজি জানে না। আধো আধো করে বলার চেষ্টা করল কিছু। এখানে, ফ্রান্সে, বেশির ভাগ মানুষই ইংরেজি ভাষাটি জানে না। সভ্য হতে গেলে যে ইংরেজি জানতে হয় না, তা ফ্রান্সে এসে আমার বেশ ভাল করেই বোধ হয়। উপমহাদেশেই এই ধারণাটি বদ্ধমূল, দুশ বছর ইংরেজ শাসনে থেকে এই হয়েছে মানসিকতা। প্রভুর ভাষা শিখে জাতে ওঠার তপস্যা।
সন্ধেটা হোটেলে বিশ্রাম নিতে গিয়ে দেখি ঘুমে ঢলে পড়ছি। কিন্তু অসময়ে ঘুমোলে চলবে কেন! এখানকার সময়ের সঙ্গে আমার শরীরকে মানিয়ে নিতে হবে। রাত নটায় জিল এসে ডেকে নিয়ে গেল। হোটেল থেকেই ট্যাক্সি ডাকে জিল। দু মিনিটের মধ্যে ট্যাক্সি এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়। আমরা চলে যাই দূরে কোথাও। ঝলমলে রেস্তোরাঁ এলাকায়। খেতে খেতে দুজন রাজ্যির গল্প করি। বিকেলে ক্রিশ্চান এসেছিল হোটেলে, আমাকে পায়নি। চিঠি লিখে গেছে, যে ভিলেজ ভয়েজ এর এক সময়ের মোস্ট ইম্পর্টেন্ট নারীবাদী লেখক মারিন ওয়ারনার আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। শুনে জিল বলে, কিছু হলেই বলে ফেলে মোস্ট মোস্ট মোস্ট। ওই লেখকের নাম আমি কখনও শুনিনি। ক্রিশ্চানের সব উচ্ছাসকে জিল বলে, সব টাকার জন্য, সব ব্যবসার কারণে। যারা আন্দোলন করছে, নারীর জন্য লড়াই করছে, বই তাদের দেওয়া উচিত, আদর্শ বলে কথা। ব্যবসায়ী প্রকাশককে তোমার বই দিও না। জিল যখন ক্রিশ্চানের সামনে বলেছিল যে আমাকে স্ট্রাসবুর্গ যেতে হবে, ক্রিশ্চান লাফিয়ে উঠেছিল আনন্দে, জিল ওই আনন্দকেও বলেছে, ছো! সব টাকার জন্য। তোমাকে খুশি করে তোমার কাছ থেকে বই বাগাতে চাইছে। এই উদ্দেশ্য। টাকা টাকা টাকা। জিল হেসে, হঠাৎ বলল, আমি এই নতুন চাকরিতে ভাল করতে পারছি না।
–নতুন চাকরি?
–হ্যাঁ তোমার প্রাইভেট সেক্রেটারির চাকরি।
জিলের মপোলিয়েঁ ফিরে যাবার কথা ছিল। কিন্তু আমার জন্য চার তারিখ পর্যন্ত থেকে যাচ্ছে ও প্যারিসে। রাত তখন সাড়ে বারো। ভিড় উপচে পড়ছে রেস্তোরাঁগুলোয়। ছেলে মেয়েরা হাতে হাত ধরে রাস্তায় হাঁটছে। ঝলমলে আনন্দ চারদিকে। হঠাৎ দেখি নাকের সামনে একটি তাজা লাল গোলাপ। গোলাপটি বাড়িয়ে ধরে থাকা লোকটিকে দেখি। চোখে চোখ পড়ে। লোকটিকে বাঙালি মনে হচ্ছে। ফুল কিনব কি কিনব না তা না জেনেই লোকটি দ্রুত সরে গেল সামনে থেকে। লক্ষ করি, দূর থেকে আবার পেছন দিকে তাকাল আমার দিকে। লোকটি কি চিনতে পারল আমাকে! সম্ভবত! অথবা আমি যে তার দেশ অথবা তার পাশের দেশ থেকে এসেছি, সে সম্পর্কে সে নিশ্চিত। –লোকটি কি বাংলাদেশি! জিল জিজ্ঞেস করে।
–আমার কিন্তু তাই মনে হচ্ছে।
চারদিকে কলকলে আনন্দের মধ্যে, শাদা শাদা হাস্যোজ্জ্বল ফরাসিদের মধ্যে একটি বিষণ্ন বাদামী মুখ, ফুলঅলাটির মুখটি মনে পড়তে থাকে।
–আমার খুব খারাপ লাগে, খুব কষ্ট হয় যখন দেখি আমাদের দেশের ছেলেরা ইওরোপ আমেরিকায় এসে রেস্তোরাঁয় বাসন মাজে, রাস্তায় ফুল বিক্রি করে। শিক্ষিত লোকেরাও সোনার হরিণের সন্ধানে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
জিল চোখ বড় বড় করে বলে, বাহ! খারাপ লাগবে কেন! তুমি তো পছন্দ কর দেশের বাইরে যাওয়া।
বললাম, সে তো বেড়াতে। এরকমভাবে, বাসন মাজতে, ঝাড়ু দিতে, ময়লা পরিষ্কার করতে আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকেরা ধনী দেশগুলোয় দৌড়োচ্ছে।
জিল বলল, বোধহয় কাজ নেই দেশে, তাই।
একটু জোরেই বলি, দেশে থেকে কাজ করার জন্য চেষ্টা তো করতে হবে। কাজ যেন পাওয়া যায় দেশে, সেরকম অবস্থা করার জন্য সংগ্রাম তো করতে হবে। যে লোকটিকে দেখলাম, সম্ভবত সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার ডিগ্রি করে এ দেশে এসেছে, এখন ফুল বিক্রি করছে। ফুল বিক্রি করার জন্য কি পদার্থবিজ্ঞান জানার দরকার হয়! মেধাগুলো পাচার হয়ে যাচ্ছে গরিব দেশ থেকে ধনী দেশে। দেশে থেকে দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য কে তবে চেষ্টা করবে যদি যুব সমাজ কি করে খানিকটা বেশি টাকা কামাবে, সেই কারণে যদি বিসর্জন দেয় সব আদর্শ!
জিল মাথা নাড়ল। সায় দিল আমার কথায়।
কথা ছিল আমি আর জিল নৌকো নিয়ে সেইন নদীতে ঘুরে বেড়াবো। কিন্তু আর ইচ্ছে করেনি সেইনে ভাসতে।
পরদিন উনত্রিশ তারিখ। উনত্রিশে এপ্রিলের ডায়রি আমাকে লিখতে হবে প্যারিসের বিখ্যাত পত্রিকা লা নভল অবজারভেতর এর জন্য। পত্রিকাটির সম্পাদক জঁ দানিয়েল ঢাকায় আমাকে অনেকগুলো ফ্যাক্স পাঠিয়েছেন ডায়রি লেখার জন্য অনুরোধ করে। পৃথিবীর বিখ্যাত সব লেখক ওতে লিখবেন। উনত্রিশ তারিখটি তাঁরা কেমন কাটিয়েছেন, তার বর্ণনা করে। এই দিনটিতেই আমাকে স্ট্রাসবুর্গে যেতে হবে। ক্রিশ্চান সকালেই ফোন করেছিল। শুভসকাল জানিয়ে বললেন কাল আসবেন তিনি আমাকে নিতে আরেকটি টিভি প্রোগ্রামের জন্য। সিগমার আরেকজন ফটোগ্রাফার আবার আসবে। সকালে গরম জলে গোসল করে গোলাপি একটি শাড়ি পরে নিই। প্যারিসে এই প্রথম আমার শাড়ি পরা। শাড়ি পরে শেষ করিনি, নিচ থেকে ফিলিপ ডেমেনএর আসার খবর দেওয়া হল। লা ভি নামে এক পত্রিকার সাংবাদিক এই ফিলিপ। হোটেলের নিচতলায় একটি ক্যাফে আছে, ক্যাফেতে বসি দুজন। নাস্তা খেতে খেতে সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিই। একই রকম প্রশ্ন, একই রকম উত্তর। এর মধ্যে জিল আসে বড় একটি লিস ফুলের তোড়া নিয়ে। কি যে ভাল লাগল চমৎকার ফুলগুলো দেখে। ফুল দেখলেই আমার নাক কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নেওয়ার অভ্যেস। লক্ষ করেছি, ফরাসিরা ফুলের সৌন্দর্য দেখে, ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য নাক বাড়ায় না তেমন। এখানকার ফুলে ঘ্রাণও খুব কম থাকে। বাণিজ্যিক কারণে ফুল ফোটানো হলে তাতে ঘ্রাণ কোথায় থাকবে! ফিলিপ তখনও যায়নি, এল লা ফিগারো পত্রিকার সাংবাদিক সঙ্গে ফটোগ্রাফার নিয়ে। হোটেলের কাছের রাস্তায় ছবি তুলল ফটোগ্রাফার। আমার হোটেলের নাম মারসেলিয়র অপেরা, অবশ্য যদি আমি উচ্চারণ করি। আমার উচ্চারণ শুনে একটি ফরাসিও বোঝে না কি বলছি আমি। আমাকে বানান করে দিতে হয় হোটেলের নাম। ওরা মাসেই অপেয়া জাতীয় কিছু একটা বলে। ফিগারোর সাংবাদিক মারি এমিলি লোমবার্ড সঙ্গে কথা বলার আমার সময় নেই, কারণ আমাকে যেতে হবে স্ট্রাসবুর্গ। জিল যাচ্ছে না স্ট্রাসবুর্গে, যেহেতু অন্য সাংবাদিকরাও যাচ্ছেন টিভি প্রোগ্রামের জন্য। তাছাড়া মারি এমিলি যাচ্ছে আমার সঙ্গে। জিল বলে দিল, অবশ্যই যেন স্ট্রাসবুর্গের ক্যাথিড্রালটি দেখি। মারি এমিলি আর আমি প্যারিসের অরলি বিমানবন্দর চলে গেলাম। মারিকে পথে জিজ্ঞেস করলাম, তোমারও কি কোনও প্রোগ্রাম আছে টিভিতে?
মারি হেসে বলল, না, আমি কেবলই তোমার সাক্ষাৎকার নেবার জন্য যাচ্ছি। তুমি এত ব্যস্ত যে যদি অন্য সময় সময় না পাও, তাই বিমানে বসে সাক্ষাৎকার নেব। বিমান বন্দরেই পরিচয় হয় আলজেরিয়ার আর ক্যামেরুনের সাংবাদিকের সঙ্গে। ক্যামেরুনের বিশাল দেহী সাংবাদিকটি কিছু ইংরেজি জানলেও আলজেরিয়ার সাংবাদিক একটি ইংরেজি শব্দও বলতে পারেন না। ভেবেছিলাম বিমানের জানালা দিয়ে দেখতে দেখতে যাবো পাখির চোখে ফ্রান্স। কিন্তু মারির প্রশ্নের জ্বালায় তা সম্ভব হয় না। ভেবেছিলাম প্যারিসের বাইরে কোনও এক ছোট মফঃস্বল শহর স্ট্রাসবুর্গ, তেমন আহামরি কিছু দেখতে হবে না। কিন্তু পৌঁছে চারদিক দেখে আবারও বিস্ময় জাগে। নিখুঁত শহর। রূপের কোনও কমতি নেই। দুটো গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বিমান বন্দরে। একটিতে আমি, মারি, আর ক্যামেরুনের সাংবাদিকটি। আরেকটিতে বাকিরা। ক্যামেরুনের লোকটি লম্বা একটি রঙিন আলখাল্লা পরেছে, মাথায় একটি রঙিন টুপিও লাগিয়েছে। বলল, পোশাকটি ক্যামেরুনের মুসলমানদের পোশাক, যদিও সে খ্রিস্টান, এ পোশাক তার ভাল লাগে বলে পরেছে। বিমানে বসে জ্যঁ শার্ল বারথেয়ারের দেওয়া প্যাকেটটি খুলি, সকালেই জ্যঁ শার্ল হন্তদন্ত হয়ে প্যাকেটটি হাতে দিয়ে বলে গেছেন, এটি বিমানে উঠে খুলবে, তার আগে নয়। প্যাকেটের ভেতরে একটি নিনা রিচি নামের সুগন্ধী, আরেকটি চকোলেটের বাক্স। চকোলেটের বাক্সটি কাউকে দিয়ে দেব, চকোলেট আমার পছন্দ নয়। ফরাসিদের তিনটে জিনিস খুব প্রিয়, এবং এই তিনটে জিনিসই আমার একদম সয় না, কফি, চকোলেট, চিজ। ওদের আমি বলেছিও তোমাদের তিনটে জিনিস আমার কাছে অখাদ্য, তিনটিই শুরু সি দিয়ে। নামগুলো বললে ওরা ভিমড়ি খায়। আমাকে আদৌ মানুষ বলে ভাবে কি না কে জানে।
টেলিভিশনের বাড়িটি চমৎকার। আমাদের জন্য ওখানেও অপেক্ষা করছিল অনেকে। একজন হাত বাড়িয়ে বলল, আমি ফ্রেড্রিক গারডেল। ফ্রেড্রিকই তো আমাকে আর্তে টেলিভিশন থেকে আমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছিলেন। দুজন বাঙালি মেয়ে দেখি গুটি গুটি হেঁটে আসছে আমার দিকে। কাছে এসে বলল, আমরা আপনার অনুবাদক। এতদিন পর কারো মুখে স্পষ্ট বাংলা শুনলাম, মন নেচে ওঠে, কলকল করে আমি বাংলায় কথা বলে উঠি, পাখি যেমন মনের আনন্দে বসন্ত এলে গান গাইতে থাকে, তেমন। প্যারিসে কার মুখে শুনব বাংলা! বারথেয়ার দাবি করছে সে বাংলা জানে। এখনও শোনা হয়নি একটি শব্দও। মেয়ে দুজনকে প্যারিস থেকে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ আনিয়েছেন। ফ্রেড্রিক ফরাসিতে বলে যাচ্ছেন পুরো অনুষ্ঠানটি কি হবে, কি জিজ্ঞেস করা হবে, কোন কোন তথ্যচিত্র দেখানো হবে মাঝখানে, কে আমাদের প্রশ্ন করবে, সব। দোভাষীদুজন −ফ্রড্রিকের কথাগুলো অনুবাদ করে দিল। দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হল ওখানে। খাবার বলতে এক হাত লম্বা একটি স্যান্ডুউইচ। ওটি আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব হয়নি। মেকআপ রুমে নিয়ে যাওয়া হল আমাকে। ওখানে এসে অনুষ্ঠানের প্রযোজক দেখা করে গেলেন। ফ্রেড্রিক আমার জন্য, যেহেতু কফি খাই না, চা নিয়ে এলেন, আর দেখে শুনে ছোট আর নরম রুটির স্যান্ডুউইচ। মেকআপ শেষ হতেই স্টুডিও। আলোয় ফেটে পড়ছিল ঘরটি। এই প্রথম ইউরোপের কোনও স্টুডিওতে বসে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা। দানিয়েল লাকন্ত বসলেন মাঝখানে। দানিয়েল অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন। তাঁর বাঁ পাশে আমি। ডানে আলজেরিয়ার সাংবাদিক। আমার বাঁ পাশে ক্যামেরুনের সাংবাদিক। ক্যামেরুন সরকার যাঁকে সরকারের বিরুদ্ধে লেখার কারণে জেলে পাঠিয়েছিল। আলজেরিয়ার সাংবাদিককে মুসলিম মৌলবাদীরা দিয়েছিল হত্যার হুমকি, গুলিও করেছিল। অবশ্য প্রাণে বেঁচে গেছেন তিনি। একজন কার্টুনিস্ট বসেছেন সামনে। কার্টুন এঁকে যাচ্ছেন আপন মনে। তাঁর আঁকা কার্টুনগুলো আমরা আবার সামনে রাখা মনিটরে দেখতে পাচ্ছি। সবার কানে কানফোন লাগানো আছে। আমার কানফোনে বাংলায় শুনতে পাচ্ছি যারা যে কথাই বলছে। হোবিয়া মিনা বসেছে আমাদের থেকে দূরে, এক কোণে। জার্মানি থেকে এসেছে এক সাংবাদিক, নাম ক্রিশ্চিনা। অনুষ্ঠানের সকলে ফরাসি বলছে। ক্রিশ্চিনা জার্মান বলছে, আমি বাংলা। কিন্তু সবার কথাই আমরা নিজের ভাষায় শুনতে পাচ্ছি। তড়িৎ গতিতে অনুবাদের আয়োজন। ক্রিশ্চিনার আর আমার কথাগুলো ফরাসি ভাষায় অনুবাদ হয়ে যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে। প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ে প্রশ্ন শুরু হল। মাঝে মাঝে তথ্যচিত্র দেখানো হচ্ছে। মেক্সিকোতে এক সাংবাদিক ড্রাগ মাফিয়ার বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে ভয়ংকর অসুবিধেয় পড়েছে, কারণ মেক্সিকোর সরকার ড্রাগ ব্যবসায় জড়িত। মোট তেষট্টি জন সাংবাদিককে সারা বিশ্বে মেরে ফেলা হয়েছে। ১২৪ জন সাংবাদিক হুমকির সম্মুখিন। আলজেরিয়ার সাংবাদিক বলল, ওখানে সাংবাদিকরা মৌলবাদিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। মৌলবাদিরা যখন তখন যাকে তাকে মেরে ফেলছে। বিশেষ করে সেইসব সাংবাদিকদের যারা মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লিখছে।
এরপর প্রশ্ন হল, যেহেতু এটি বাক্ স্বাধীনতার প্রশ্ন, মৌলবাদীদের স্বাধীনতা থাকা উচিত কি না যা কিছু বলার।
আমি আপত্তি করলাম। বললাম-–‘না, মৌলবাদীদের বেলায় আমি এই ছাড় দিতে রাজি নই। আমাদের দেশের মৌলবাদীরা ধনী আরব দেশগুলোর টাকা পেয়ে এখন অস্ত্রবান হয়েছে। সমাজটাকে নষ্ট করে ফেলছে। দেশজুড়ে এক ভয়াবহ অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষকে বিনা দ্বিধায় মেরে ফেলছে, হাত পায়ের রগ কেটে দিচ্ছে। অবাধে ধর্ম প্রচার করে যাচ্ছে। নিরীহ মানুষগুলোকে ধর্মের বাণী শুনিয়ে বোকা বানিয়ে দলে ভেড়াচ্ছে। একসময় আমাদের দেশে এদের কোনও অধিকার ছিল না রাজনীতি করার। এখন তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার অধিকার পেয়ে দেশজুড়ে তান্ডব চালাচ্ছে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে এখন ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উন্মাদ হয়ে গেছে। ধর্মীয় শিক্ষা ছড়িয়ে ধর্মীয় আইন জারি করে দেশটিকে ধ্বংস করে দিতে চাইছে। সময় থাকতে এই সর্বনাশকে রুখে দাঁড়াতে হবে।’ এরপর আলজেরিয়ার সাংবাদিকের কাছে একই প্রশ্ন রাখা হল। তিনি বললেন, জ্ঞআগে তসলিমার মত এরকম আমাদের দেশেও ভাবা হত। কিন্তু এখন এই ভাবনার পরিবর্তন হয়েছে। আমরা যারা মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, তারাই বলছি, মৌলবাদীদেরও স্বাধীনতা থাকা উচিত মত প্রকাশের জন্য। গণতন্ত্রের নিয়মই তো এই।’ আরও অনেকক্ষণ প্রশ্নোত্তর চলল। শেষ প্রশ্নটি আমাকে করা হয়, ফ্রান্স আর জার্মানির বাকস্বাধীনতা নিয়ে এই যে তথ্যচিত্র দেখলে, যেখানে বলা হচ্ছে এখানেও সাংবাদিকরা অনেক কিছু বলছে না বা বলতে পারছে না, কারণ সংবাদপষেনর বিজ্ঞাপনদাতাদের অনুমতি না পেলে সমাজের অনেক অন্যায় সম্পর্কে মুখ খোলা যায় না। এটি আমাদের দেশের তুলনায় কেমন? আমি বললাম, ‘এখানেও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হচ্ছে, অবশ্যই। তবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা আরও বেশি কম। রেডিও টেলিভিশন সরকারি মালিকানায় থাকায় এগুলো সরকারি প্রচারের জন্য ব্যবহৃত হয়। সংবাদপত্র বেশির ভাগ যদিও ব্যক্তি মালিকানাধীন, তারওপরও কোনও সংবাদপষেন যদি সরকার বিরোধী কিছু প্রকাশ পায়, সরকার সময় সময় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে,তাদের গ্রেফতার করতে, এমন কী পত্রিকা বন্ধ করে দিতে দ্বিধা করে না। বেসরকারি পত্রিকাগুলোকেও বাঁচতে হয় সরকারি বিজ্ঞাপনে, সুতরাং বিজ্ঞাপনের জন্য অনেক সংবাদপত্রই সরকারি আদেশ মান্য করতে বাধ্য হয়।’
অনুষ্ঠান শেষে জার্মানির ক্রিস্টিনা আমাকে একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য অনুরোধ করল। সময় নেই। অল্প কিছুক্ষণ কথা বলে দৌড়ে অপেক্ষমান গাড়িতে চড়ে বসতে হল। সোজা বিমানবন্দর। ম্যারিও ফিরল প্যারিসে আমার সঙ্গে। আঠার মত লেগে থেকে আমার কিছু কবিতা ফটোকপি করে নিল। ঘুমে আমার শরীর ভেঙে আসছিল। এই হচ্ছে প্রতি বিকেলে। প্যারিসের সময়ের সঙ্গে শরীর খাপ খাইতে চাইছে না। এখনও দেশের সময়ে শরীর নেতিয়ে পড়ছে, শরীর আড়মোড়া ভাঙছে। জিল ফোন করলে বলে দিই, না বাবা, এখন কোথাও যাবো না, ঘুমোবো।
জিলের দশটায় আসার কথা থাকলেও সে তার বান্ধবী নাতালিকে নিয়ে আগেই চলে আসে হোটেলে। আইফেল টাওয়ার দেখতে যেতে হবে। নাতালি মেয়েটির ডাগর ডাগর চোখ, মুখে মিষ্টি মিষ্টি হাসি। মেয়েটিকে আমার বেশ ভাল লাগে। জিল বলেছিল যদিও তারা একসঙ্গে থাকে, এখনও নাকি তার সঙ্গে নাতালির গভীর কোনও ভালবাসা হয়নি। এ খুবই সত্য কথা যে একসঙ্গে থাকলেই এক বিছানায় ঘুমোলেই ভালবাসা গড়ে ওঠে না। আমরা কিছুদূর হেঁটে একটি ট্যাক্সি নিয়ে আইফেল টাওয়ারের কাছে গেলাম। তিনতলা বন্ধ হয়ে গেছে টাওয়ারের, উঠলে তিনতলায় ওঠাই ভাল। আমার কিন্তু অত চুড়োয় ওঠার কোনও তীব্র ইচ্ছে নেই। দূর থেকেই দেখি না কেন! আলো ঝলমল পরিবেশটি আমার ভাল লাগে। আজদাহা টাওয়ারটি লোহা লককরের একটি স্তম্ভ। জানি না কেন লোকে এটি পছন্দ করে। প্যারিসের লোকেরা অবশ্য এটিকে জঘন্য একটি জিনিস বলে ছো! ছো! করে। ১৮৮৯ সালে প্যারিসের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর জন্য গুস্তাব আইফেল নামের এক লোক এটি বানিয়েছিলেন, তিনশ মিটার লম্বা টাওয়ারটি, সাত হাজার টন ওজন। কথা ছিল প্রদর্শনীর পর এটি তুলে ফেলা হবে। কিন্তু শেষ অবদি তোলা হয়নি, রয়ে গেছে। এলাকাটি, জিল বলে, ধনী। ধনীর ছেলেরা একটুকরো চাকাঅলা কাঠের ওপর চড়ে ভয়ংকর ভাবে দৌড়োচ্ছে। গরম পড়তেই নাকি এখানে এমন শুরু হয়ে যায়। আমরা নৌকো চড়ব বলে নদীর কাছে গিয়ে দেখি নৌকো নেই। এ কারণে যে মন খারাপ হবে তা নয়। আমার ওরকম হাঁটতেই ভাল লাগছিল। পাশাপাশি তিনজন। ভাল লাগছিল রকমারি মানুষের ভিড়। আনন্দিত মুখ। হাঁটতে হাঁটতে আমরা আর্ক দ্য ট্রায়াম্ফএর কাছে পৌঁছে যাই। জিল আর নাতালি দুজন বাড়িতে খেয়ে এসেছে। আমার রাতের খাওয়া তখনও হয়নি বলে শাঁর্লস এ লিজের এক রেস্তোরাঁয় বসি। ভেতরে নয়, বাইরে, তেরাসে। অনেক রাত অবদি। রাত গভীর হলেও বোঝার উপায় নেই। হৈ হুল্লোড়, মানুষের ভিড়, যানবাহনের ভিড়। কি অদ্ভুত এক অন্যরকম জগতের মধ্যে আমি!
পরদিন। সকালে ক্যামেরুনের সাংবাদিকের সঙ্গে নাস্তা খাওয়ার কথা। ধুৎ কি নাস্তা খাব। সকালে বিছানায় বসে চা খাচ্ছি আরাম করে। ক্যামেরুনের কথা আপাতত ভুলে যাই। ক্রিশ্চান বেস অপেক্ষা করছেন নিচে। আবার জিলের ফোন। ক্রিশ্চান এসেছে খবরটি দিলে জিল বলল, ‘তাহলে তুমি ক্রিশ্চানকে নিয়েই রেডিওতে চলে যাও। আমি তোমাকে নিয়ে আসতে গেলে দেরি হয়ে যেতে পারে। আমি আমার এখান থেকেই তাহলে সোজা রেডিওতে চলে যাচ্ছি।’ খানিক পর আবার জিলের ফোন। জ্ঞপ্রযোজক নেই এখন রেডিওতে, তোমার ওখানে গেছে কী না, খানিকক্ষণ অপেক্ষা কর।’ ক্রিশ্চানের সঙ্গে চা কফি নিয়ে বসলাম আধঘন্টা মত। ক্রিশ্চান বার বারই একটি কথা বলল, ‘আমি তোমার নামের জন্য তোমার বই ছাপতে চাইছি না। ছাপতে চাইছি তোমার সাহিত্যের জন্য। লেখক হিসেবে তোমাকে চাইছি। তোমাকে ফতোয়া দিয়েছে, তোমার এখন চারদিকে নাম, সেজন্য তাড়াহুড়ো করে তোমার একটি বই ছেপে হটকেকের মত বিক্রি করে তোমায় ভুলে যেতে চাইছি না। সত্যি কথা বলতে কী, তুমি যে লেখক, তুমি যে ভাল একজন লেখক, তা মানুষকে জানাতে চাইছি।’ রেডিওর লোকের জন্য বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। আমরা উঠে পড়ি। ক্রিশ্চান আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছেন। ছোট্ট একটি লাল গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁর প্রেসিডেন্ট উইলসন রোডের বাড়িতে। অসম্ভব রকম কর্মঠ তিনি, অবসর বলতে কিছু তাঁর জীবনে নেই। ক্রিশ্চান অনর্গল কথা বলেন। কোনও একটিও কিন্তু বাজে কথা নয়। ফরাসিরা কথা বলতে গেলে হাত পা মুখ মাথা ঠোঁট চোখ খুব নাড়ে। এটা ওদের সম্ভবত জাতীয় অভ্যেস। এডিশন দ্য ফামের মহিলা মিশেল ইডেল ফোন করছে, দেখা করতে চাইছে শুনে ক্রিশ্চান নাক সিঁটকে বলল, জ্ঞনারীবাদ নারীবাদ নারীবাদ। উফ! অসহ্য। নারীবাদ নিয়ে যারা লাফায়, আমি তাদের সহ্য করতে পারি না। এ হচ্ছে একধরনের সীমাবদ্ধতা। এও আরেক ধরনের মৌলবাদ। যে কোনও কিছুতেই আমরা নারী আমরা নারী। নারীর এই হয়নি সেই হয়নি। এই চাই সেই চাই। এই হতে হবে সেই হতে হবে। এ আবার কী! মানুষের কথা ভাব, মানুষের জন্য বল, মানুষের জন্য কর, নারী পুরুষ শিশু সবার কথা ভাব! কেবল নারীরই কি সব সমস্যা? শিশুদের নেই? পুরুষের নেই? হু!নারীবাদীদের উদ্দেশ্য নারী নিয়ে ব্যবসা করা, আর কিছু নয়।’
ক্রিশ্চান রাস্তার কিনারে গাড়ি রেখে তাঁর বাড়ির সামনের সড়কদ্বীপে বাজার বসেছে, সেখানে যায়। বাজারটি এই দ্বীপে বুধবার আর শনিবারে বসে। দুপুরের মধ্যেই বাজারটি উঠে যাবে। আবার সব ঝকঝকে তকতকে আগের মত। বিকেলে দেখলে কারও বোঝার উপায় থাকবে না এখানে একটি জমজমাট বাজার ছিল সকালবেলা। আমাদের কাঁচা বাজারের মত নয় এটি। সবকিছুর এখানে নির্ধারিত দাম। আমাদের দেশের মত চিৎকার করে দরদাম করতে হয় না। ক্রিশ্চান ফুল কেনে। লিলি অব দ্য ভ্যালি। চমৎকার ঘ্রাণ ফুলের, ছোট শাদা ফুল। ক্রিশ্চানের বাড়িটি তিনতলায়। এমন সুন্দর বাড়ি আমি জীবনে কমই দেখেছি। যেন বাড়ি নয়, আস্ত একটি মিউজিয়াম। সাতশ সিসি মেফেয়ার গাড়িটি দেখে মনেই হয়নি তাঁর বাড়িতে আছে খৃষ্টপূর্ব চারশ শতাব্দির প্রাচীন মূর্তি, ব্যাবিলিয়ন, সুমেরিয়ান সভ্যতার অমূল্য সব সম্পদ। প্রাচীন সব রঙিন পাথরের অলংকার। মিশরের গুহা থেকে তুলে আনা সেই আমলের জিনিসপত্র। আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি মূর্তিগুলোর সামনে, যেমন থ হয়ে ছিলাম ল্যুভরে। বাড়িটির দেয়ালে দেয়ালে যত তেলচিত্র আছে, সবই বড় বড় শিল্পীর। সবই আসল, নকল বলতে কিছু নেই। বাড়ির আসবাবপত্রগুলোও শিল্পীর তৈরি। যে কাপে চা খেতে দিল, সেটিও কয়েকশ বছর আগের। অ্যান্টিকে বাড়িটি ভর্তি। একটি অ্যান্টিক ল্যাণ্ডও আছে। অমিতাভ ঘোষের অ্যান্টিক ল্যাণ্ড বইটি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন ক্রিশ্চান নিজে। বইটির নামে ইজিপ্ট দেখে আমি ধন্দে পড়ি। ক্রিশ্চান বললেন বাণিজ্যিক কারণে তিনি নামটি পাল্টে দিয়েছেন। বাণিজ্যিক শব্দটি উচ্চারণ করতে এখানে কারও কোনও গ্লানি নেই। আমার চা খাওয়া শেষ হয়নি। টেলিভিশনের লোকেরা এল। জ্যঁ শার্ল বারথেয়ারও এল। একবার বাংলায় একবার ইংরেজিতে সাক্ষাৎকার নিল ওরা। এরপর নিচে, খানিকটা হেঁটে গিয়ে মডার্ন মিউজিয়ামের বারান্দায় আরেক দফা সাক্ষাৎকার। হাঁটছি, কথা বলছি, ক্যামেরা আমার প্রতি অঙ্গভঙ্গি তুলে রাখছে।
প্যারিস কেমন লাগছে?
এত সৌন্দর্য প্যারিসের, তা আমি আগে কল্পনাও করিনি।
জ্যঁ শার্ল বারথেয়ারকে অনুবাদক হিসেবে নিয়েছে টিভির লোকেরা। একসময় আমি মনিক আতলাঁকে, সাংবাদিক পরিচালক দুটোই তিনি, বলি যে বাংলা থেকে ফরাসিতে অনুবাদ হলে, আমি ইংরেজিতে একই প্রশ্নের উত্তরে যা বলেছি, সেটির সঙ্গে যেন মিলিয়ে দেখে নেন বক্তব্য ঠিক আছে কি না। লক্ষ করিনি জ্যঁ শার্ল আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, আপনি বিসওয়াস খরেন না? চমকে উঠি। তাকিয়ে বারথেয়ারের মুখ দেখি বিষণ্ন মুখ। বড় অপ্রস্তুত হই! বলি, ‘না না আপনাকে আমি বিশ্বাস করি। তবু এই আর কী! আপনার তো কিছু ভুল হতে পারে। যেমন ধরুন অনেক কঠিন কঠিন বাংলা শব্দ যদি না বুঝতে পারেন, তাই।’ আমার এই সান্ত্বনায় বারথেয়ারের বিষণ্নতা দূর হয় না। মায়া হয় মানুষটির জন্য। এমন ভাবে বলাটা বোধহয় উচিত হয়নি। ক্রিশ্চান বেস আর মনিক আতলাঁ হাঁটছি কথা বলতে বলতে, ফাঁকে ফাঁকে আমার ব্যাগ আর চশমা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বারথেয়ারের বিষণ্ন মলিন মুখটি দেখছি। নীল চোখ তার, ঘাড় অবদি সোনালী চুল, পরনে জিনসের জ্যাকেট — খানিকটা গবেট গবেট মনে হয় তাকে, বারথেয়ারকে, এত স্পর্শকাতর হবে ভাবিনি। কোনও ফরাসি পুরুষ এমন অভিমান করে মলিনতার চাদরে নিজেকে ঢেকে ফেলতে পারে, এই প্রথম দেখলাম। ক্রিশ্চানের গাড়ির কাছে যেতে যেতে সবার থেকে নিজেকে আলগোছে সরিয়ে দু কদম পিছিয়ে নিয়ে বারথেয়ারের সঙ্গে কথা বলতে থাকি আমি। এমনি কথা। ছোটোখাটো কথা। এতদিন আসলে বারথেয়ারকে বিষম এড়িয়ে চলেছি। ক্রিশ্চান যখন আমাকে নিয়ে গাড়িতে উঠবে, বারথেয়ারকে বললাম, আপনিও চলুন আমাদের সঙ্গে, আমরা দুপুরের খাবার খেতে যাচ্ছি, চলুন। বারথেয়ারের মুখটি মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু ক্রিশ্চান তাকে ফরাসিতে কিছু বলল, কি বলল জানি না। সঙ্গে সঙ্গে বারথেয়ার আমাকে থতমত ঠাণ্ডা গলায় বলে দিল যে সে যেতে পারছে না, জরুরি কিছু কাজ আছে তার। তবে তিনি বারথেয়ার অপেরায় নিয়ে যাবেন আমাকে, অপেরার টিকিট কেটে এনেছিলেন। তিনি বললেন, সাতটায় হোটেলে যাবেন আমাকে অপেরায় নিয়ে যেতে। ক্রিশ্চান আমাকে লেবানিজ একটি রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলেন। মুরগির কাবাবমত, আর কাঁচা বাধাকপি, নানা রকম কাঁচা পাতা, যা কখনও কাঁচা খাওয়া যায় বলে আমার ধারণা ছিল না। খেতে খেতে ক্রিশ্চানের সঙ্গে কথা বলি ফরাসি সাহিত্য নিয়ে। ফরাসি সাহিত্যিকরা কেমন লিখছেন, কী লিখছেন! ক্রিশ্চান সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট উল্টে বললেন, বাজে বাজে বাজে। নতুন প্রজন্মের সবাই আমবিলিকাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে সবই তো আছে তাদের। তারাই তো জনক শিল্পের সাহিত্যের। সুতরাং নতুন কিছুর আর কী দরকার! ক্রিশ্চান খুবই হতাশ ফরাসি লেখকদের নিয়ে। বললেন, জ্ঞআমি অনেক পাণ্ডুলিপি পাই ফরাসি লেখকদের। সবই অখাদ্য। কেবল বর্ণনা। কিছুই নতুন নয়। নতুন ভাষা নেই। নতুন বক্তব্য নেই।’
১. প্যারিসের ডায়রি – ০৩
ক্রিশ্চান জ্যঁ শার্লকে দিয়ে লজ্জা অনুবাদ করাচ্ছেন। এখন লজ্জা নিয়ে তিনি আর ভাবছেন না। ভাবছেন আমার অন্য বই নিয়ে। জ্যঁ শার্ল লন্ডন থেকে আমার বাংলা বই কিনে এনেছে। শোধ, নিমন্ত্রণ, ভ্রমর কইও গিয়া সবই তাঁর পড়া হয়ে গেছে। শোধের গল্পটি সে ক্রিশ্চানকে শুনিয়েছেন। খাতা কলম বের করে ক্রিশ্চান লিখে নিলেন কি কি বই এ পর্যন্ত লিখেছি আমি। কি কি তাঁকে আমি এখন দিতে পারব ছাপতে। এ পর্যন্ত আমি যা লিখেছি সবই তিনি চান এবং এখন যেটি লিখছি, কোরানের নারী, সেটিও তাঁর চাই। সব তাঁর চাই, যা আছে। কবে পাঠাতে পারব সব। কখন। সব তাঁর জানা চাই। বাংলায় পাঠাই, ইংরেজিতে পাঠাই তাঁর কোনও অসুবিধে নেই। ইংরেজিতে পাঠালে তিনি নিজে অনুবাদ করে নেবেন। বাংলায় হলে বাংলা জানে এমন কাউকে দিয়ে প্রাথমিক অনুবাদ করিয়ে নিয়ে নিজে তিনি সংশোধন করবেন। আমি প্যারিসে থাকাকালীনই তিনি আমাকে দিয়ে কনট্রাক্ট ফর্ম সই করাতে চান। বারবারই বললেন, ‘তসলিমা, তোমার নামকে নয়, আমরা তোমার লেখাকে ছাপতে চাই।’
টেলিভিশনের জন্য ক্রিশ্চানের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। জিজ্ঞেস করিনি, নিজেই বললেন যে আমার সম্পর্কে জরুরি যে কথাটি বলেছেন তা হল, ‘তসলিমার হাতে একটি অস্ত্র আছে, অস্ত্রটির নাম কলম।’
আমার ঘড়িটি প্যারিসে আসার পথেই বন্ধ হয়ে আছে। ক্রিশ্চানও ঘড়ি পরতে পছন্দ করেন না। এদিকে দিন দেখে বোঝার উপায় নেই কটা বাজে। যে দেশে রাত দশটা অবদি আলো থাকে, কি করে অনুমান করব কখন সে দেশে দুপুর হয়, কখন বিকেল আর কখন সন্ধে। হোটেলে ফিরতে হবে, এডিশন স্টক থেকে ফটোগ্রাফার আসবে ছবি তোলার জন্য। দ্য ফাম প্রকাশনীর মিশেল ইডেল আসবেন। মিশেলএর সঙ্গে আমার দেখা করার ইচ্ছে কারণ মিশেলই প্রথম ফরাসি প্রকাশক আমার সঙ্গে ঢাকায় যোগাযোগ করেছিলেন। দ্য ফাম থেকেই আমার বই চাওয়া হয়েছিল সবার আগে। ওদেরই প্রথম আমি কথা দিয়েছিলাম লজ্জা বইটি ওদেরই দেব। শেষ পর্যন্ত লজ্জা আমি এডিশন স্টককে, ক্রিশ্চানের প্রকাশনীকেই দিই। মিশেল ওদিকে বইয়ের জন্য ফোন করছেন রাত দিন। জ্ঞদেখ তসলিমা আমরাই প্রথম তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, আর তুমি কেন চুপ করে আছ, কেন বার বার ফোন করেও তোমাকে পেতে পারি না। কেন তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছ না। টাকার প্রয়োজন তোমার? কত টাকা চাও? এডিশন স্টক কত টাকা দিতে চাইছে তোমায়, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা আমরা দেব। তবু লজ্জা ছাপার অনুমতি আমাদের দাও।’ লজ্জা ছাপবেন বলে কনট্রাক্ট ফর্ম পাঠিয়েছেন, নিজেদের ছাপানো বই পত্র পাঠিয়েছেন যেন দেখে সিদ্ধান্ত নিই। বলেছেন, ‘দেখ তসলিমা দয়া করে আমাদের অনুমতি দাও লজ্জা ছাপার। আমরা আং সাং সুচির বই ছেপেছি, সুচি ইউনেস্কো পুরস্কার পেয়েছে। আন্তোনেত ফুক তোমার জন্যও ইউনেস্কো পুরস্কারের ব্যবস্থা করবেন।’ শুনে ভীষণ বিব্রত আমি। আমাকে কি লোভ দেখানো হচ্ছে! আমি তো লোভে পড়ছি না, টোপমাখা বাক্য শুনে বরং লজ্জায় পড়ছি। লজ্জার জন্য দুটো প্রকাশনী এমনই উন্মাদ হয়ে উঠেছে যে মাঝখানে পড়ে আমি লজ্জায় মুখ লুকোই। দুজনকেই আমি বোঝাতে চেষ্টা করেছি, দেখ লজ্জা এমন একটা বই নয় যেটা তোমাদের পাঠকের আদৌ ভাল লাগবে,বইটি বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যা নিয়ে লেখা, তার ওপর বইটি তথ্যভিত্তিক বই। ফরাসি পাঠকের এই বই মোটেও ভাল লাগবে না, ওরা বুঝবেও না। না, আমার কথা কেউ মানবেন না। তাঁদের বই চাই, চাইই, যে করেই হোক চাই। ক্রিশ্চানের চাপে আর তাপে বইটি তাঁকে ছাপার অনুমতি দেওয়ার পর মিশেলের জন্য সত্যিই আমার কষ্ট হতে থাকে। লজ্জার মত অসাধারণ একটি বই তিনি পেলেন না বলে নয়, তাঁর ইচ্ছের আমি মূল্য দিইনি বলে তিনি যে কষ্ট পেয়েছেন, সে কারণে। হোটেলে সাড়ে পাঁচটায় পৌঁছে দেখি চারটা থেকে অপেক্ষা করছে এডেন, ছবি তোলার মেয়ে। অপেক্ষা করছে মিশেল ইডেল। মিশেলের বয়স চল্লিশের ওপর। আমাকে আমার দেশে লম্বা মেয়ে বলা হয়, আমার চেয়েও দেড় হাত লম্বা মিশেল, নিখুঁত সুন্দরী। মুখে হাসি লেগেই আছে। ডানে ক্রিশ্চান বামে মিশেলকে নিয়ে আমি তখন কী করি, কোথায় যাই বুঝতে পারছি না। সত্যি, এমন অস্বস্তিকর অবস্থায় আমি আর পড়িনি। সারাপথ ক্রিশ্চান বলে বলে এসেছেন, ‘প্রকাশক একজন থাকা উচিত তোমার এ দেশে। দুজন প্রকাশক থাকবে কেন! কারণ কি বল! এখানে কোনও লেখকই একাধিক প্রকাশককে বই দেন না। তুমি দেখ আমাদের প্রকাশনীটিকে! দেখ আমরা কী ধরনের বই প্রকাশ করছি। কী মানের বই তুমি নিজে এসে দেখে যাও। আজে বাজে ছোট প্রকাশকের সঙ্গে তোমার দেখা করাই উচিত নয়। আমি অবাক হয়ে যাই তোমার রুচি দেখে। দ্য ফাম!! তারা? তাদের তুমি পছন্দ করলে কি করে? তারা সব বাজে। জঘন্য। নারী নারী নারী বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলল! যত্তসব। এইসব বাজে জিনিস দেখেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রকাশনায় যাওয়ার। তসলিমা, কোনও কিছুর জন্য আমি তোমাকে চাপ দিতে চাই না। দেব না। তোমার অধিকার আছে যা কিছু করার, যাকে খুশি বই দেবার। কিন্তু তোমার তো রুচি থাকা উচিত। অন্তত সামান্য রুচি তো তোমার কাছে আশা করি। তুমি কি করে ওদের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলে? উফ, ভাবতেই পারি না। ভাল যে আমি এসে বাঁচিয়েছিলাম তোমাকে ওদের হাত থেকে। এখন আবার বলছ যে তুমি ওদের সেমিনারে যাবে? তোমার কি মাথা টাথা খারাপ হয়েছে? থার্ড ক্লাস। থার্ড ক্লাস। গেলেই বুঝবে। শোনো, মাথায় যদি তোমার সামান্য ঘিলু থেকে থাকে, তবে আমার কথা তুমি রাখবে, আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, যেও না। যেও না ওদের সেমিনারে। নিজের মানটা নষ্ট কেরো না। হাস্যকর পরিবেশে গিয়ে নিজেকে হাস্যকর কোরো না।’ একটি প্রার্থনাই আমি মনে মনে করেছি হোটেলে ফেরার পথে, মিশেল ইডেল আমার জন্য হোটেলে অপেক্ষা করতে করতে আমি ফিরছি না বলে যেন তিনি বিরক্ত হয়ে ফিরে যান। আমার প্রার্থনা কোনও খোদা বা ভগবানের কাছে নয়, এই জগতের রহস্যময় জটিল প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতি আমার ডাকে সাড়া দেয় না। মিশেল ইডেল তাঁর হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা নিয়ে হোটেলের দরজায় দণ্ডায়মান। আমি আর ক্রিশ্চান মুখোমুখি মিশেলের। আমি এখন কাকে সামলাবো। ক্রিশ্চান মোটেও মিশেলের দিকে ফিরে না তাকিয়ে একদমে বলে যান, ‘তসলিমা, তোমাকে এখন ছবি তুলতে হবে, এডেন বসে আছে অনেকক্ষণ। তাড়াতাড়ি চল। ছবি তুলে তারপর তো তোমাকে অপেরায় যেতে হবে, জানো তো! জ্যঁ শার্ল আসবে ঠিক সাতটায়। মনে আছে তো! তাড়াতাড়ি কর।’
আমি মরা কণ্ঠে এডেনকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কি ঘরে ছবি তুলবে, না কি বাইরে? সুন্দরী এডেন মধুর হেসে বলল, বাইরে।
বাইরে?
ইতস্তত করি।
এডেন আবারও হেসে বলল, দূরে নয়। কাছেই। কাছেই পেলে দ্য রয়াল। ওখানকার বাগানে।
খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে কিন্তু। বেশি সময় নেই আমার। কারণ.. ক্রিশ্চানের দিকে যতটা সম্ভব না তাকিয়ে বলি, কারণ মিশেল এসেছে আমাকে নিতে, সেমিনারে যেতে হবে।
ক্রিশ্চান হা হা করে উঠল, কিসের সেমিনার? কোন সেমিনার? তুমি না অপেরায় যাচ্ছ! জ্যঁ শার্ল তোমাকে নিতে আসবে। ও টিকিট করে রেখেছে।
এবার আমাকে একটি পক্ষ নিতে হবে। ক্রিশ্চান বিদেয় হলে এখন আমি বাঁচি। এ সময় মিশেলকে ফিরিয়ে দেওয়া আমার উচিত নয়। এত বড় অমানবিক কাজটি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমি সেমিনারে যাবো, কথা যখন দিয়েছি, যাবই।
ক্রিশ্চানকে এড়িয়ে আমি বলি, চল একটা ট্যাক্সি ডাকি, এডেন মিশেল আর আমি একসঙ্গেই চল বাগানটিতে যাই। ওখান থেকে মিশেল আর আমি চলে যাব।
ক্রিশ্চান গাড়ির দিকে যাচ্ছে, যেন আমার কথা শোনেনি, বলল, চল চল বাগানে চল, আমি তোমাদের দুজনকে নিয়ে যেতে পারব। এডেন এসো, তসলিমা এসো।
আরে বাবা মিশেল কোথায় যাবে! মিশেলের কি হবে? মিশেল হতভম্ব দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি তাঁর হাত ধরে বললাম, আপনিও চলুন।
মিশেল গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন, ক্রিশ্চান বলেন, আমার গাড়িতে তো দুজনের বেশি জায়গা হবে না।
হবে হবে। আমি বলি, সামনে আমি বসছি। পেছনে ওরা দুজন বসবে, জায়গা হবে না কেন! ঠিকই হবে।
ক্রিশ্চান ভেতরে গজগজ করছেন তা ঠিকই বুঝি। বাগানে ফটাফট কটি ছবি তুলে আর সময় দিতে পারব না বলে কেটে পড়ি। মিশেল একটি ট্যাক্সি ডেকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, ওতে উঠে পড়ি। দুজনে কথা বলতে থাকি বিরতিহীন, যেন অনেককালের সম্পর্ক আমাদের। আমাকে মিশেল নিয়ে গেলেন অনুষ্ঠানে, বিশাল সেমিনার কক্ষটির মঞ্চের দিকে, যে মঞ্চে বসে আছেন কয়েকজনের সঙ্গে হুইল চেয়ারে একজন, সেই একজনের দিকে, আন্তোয়ানেত ফুকের দিকে। ষাট দশকের নারী আন্দোলনের নেষনী এই ফুক। এখন ইউরোপীয় পার্লামেণ্টে সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য। এডিশন দ্য ফাম নামের প্রকাশনীর মালিক প্রকাশক তিনিই। তাঁকেই মিশেল ইডেল গুরু মানেন। ফুকের সঙ্গে করমর্দন হল। হাসি বিনিময় হল। চুমোচুমি হল। মঞ্চ থেকে ঘোষণা করে দেওয়া হল আমার আগমন বার্তা, তসলিমা শব্দটি শুধু চিনতে পারলাম একগাদা ফরাসি শব্দের ভিড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বিশাল ঘর ভর্তি নারী পুরুষ প্রচণ্ড হাততালি দিতে শুরু করলেন, হাততালি দিতে দিতে দাঁড়িয়ে গেলেন সকলে। এমন দৃশ্য আগে কখনও দেখিনি। এত মানুষ আমাকে অভিবাদন জানাচ্ছেন। আমি অভিভূত। বিস্মিত। শিহরিত। কিছুটা বিব্রতও। চোখে আমার জল চলে এল। আজ কি সত্যিই এখানে এসে পৌঁছেছি আমি! এ কি আমার জন্য অতিরিক্ত নয়! এত আমার প্রাপ্য ছিল না। আমাকে কিছু বলতে বলা হল মঞ্চে দাঁড়িয়ে। কী বলব! কী কথা বলা যায় এখানে। সকলের চেয়ারের সামনে লেখার জন্য টেবিল। নারীবাদের ওপর দামি দামি কথাবার্তা হচ্ছিল এখানে, সকলে লিখে নিচ্ছিলেন আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো। সব থামিয়ে দেওয়া হল আমি বক্তৃতা দেব বলে! কোনও কিছু কি আমি বলতে পারবো যা এঁদের কাছে নতুন! মিশেল আর আন্তোয়ানেতকে মিনমিন করে বললাম, দেখ আমাকে তো আগে বলা হয়নি যে আমাকে বক্তৃতা করতে হবে! আমার তো কোনও প্রস্তুতি নেই, তাছাড়া আমি ক্লান্ত, আমাকে যেতেও হবে এক্ষুনি। এত অপ্রতিভ বোধ করছিলাম যে বেরিয়েই এলাম। বেরিয়ে এসে মনে হল আহা ওই অভিবাদনের উত্তরে অন্তত ধন্যবাদ জানানো উচিত ছিল।
আমার আর মিশেলের পেছন পেছন কয়েকজন তরুণী বেরিয়ে এল। মিশেলকে বললাম, আমার কিছু বলা উচিত ছিল ওখানে। সবাই নিশ্চয়ই মন্দ বলবে।মিশেল হেসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘কী যে বলছ তসলিমা। সবাই ভীষণ খুশি তোমাকে দেখে। তোমার উপস্থিতিটাই বড়। বলতেই যে হবে এমন কোনও কথা নেই।’ সবাই আমরা কাছের একটি ক্যাফেতে গিয়ে বসলাম। এক ফরাসি তরুণী কাঁপা কাঁপা হাতে আমার হাত ছুঁয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি ধন্য হলাম। ক্যাফেতে আমাকে ঘিরে বসে সবাই আমি কেমন আছি, কি করছি, কি ভাবছি, সবই জানতে চাইছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানে না তারা, জানে কেবল আমাকে। আমার জন্য সবাই দুশ্চিন্তা করছে। ফতোয়ার খবর পাওয়ার পর প্যারিসের রাস্তায় নেমেছিল নারীবাদীরা, বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে আমরা তসলিমার সমর্থক লেখা বড় বড় প্ল্যাকার্ড নিয়ে। তারা আমার লেখা পড়তে চায়। কবে বেরোবে বই জানতে অস্থির হয়ে ওঠে। হবেই তো। পৃথিবীর অপর প্রান্তে কোনও এক বন্যা আর ঘূর্ণিঝড়ের দেশের এক মেয়ে নারী স্বাধীনতার কথা লিখতে গিয়ে ফতোয়ার শিকার হয়েছে, কী লিখেছে সে যে এত লোক ক্ষেপে গেল, তা জানার আগ্রহ তো এদের থাকবেই। মনে মনে ভাবি, এই যে লজ্জা বইটির জন্য এমন অপেক্ষা করে বসে আছে পড়বে বলে, লজ্জায় তো নারীবাদের কথা নেই। কেউ যদি ভেবে থাকে ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বলেছি বলে লজ্জা বাজেয়াপ্ত করেছে বাংলাদেশ সরকার অথবা ইসলামি মৌলবাদীরা আমার মাথার মূল্য ধার্য করেছে তবে তা যে সম্পূর্ণ ভুল তা আমি কী করে কাকে বোঝাবো! ক্যারোল টাং ও অপেক্ষা করছেন আমার বই পড়ার জন্য। ক্যারোল টাং ইওরোপীয় পার্লামেণ্টের মন্ত্রী। তিনিই উদ্যোগ নিয়েছিলেন কুড়ি দফা দাবি পেশ করার, আমার পাসপোর্ট যদি ফেরত না দেওয়া হয়, নিরাপত্তা যদি না দেওয়া হয় আমাকে তবে ইউরোপ থেকে বাংলাদেশের কোনও অর্থ-সাহায্য পাওয়ার বারোটা বাজবে ইত্যাদি। রেসোলুশনটি পাশ হয়েছে এপ্রিলের একুশ তারিখে।
ফ্রান্স থেকে কদিন পরই দেশে ফিরে যাচ্ছি শুনে সকলে অবাক হয়। বিস্ফারিত চোখ একেকজনের।
–ওখানে তো আপনাকে মেরে ফেলবে। দেশে ফেরা আপনার উচিত হবে না।
–দেশে কি আর আমি একা লড়াই করছি। আমার পাশে অনেকে আছেন।
–আপনার জীবন মূল্যবান। আপনাকে লিখতে হবে। দেশে যদি আপনাকে মেরে ফেলে তাহলে লিখবেন কি করে? আপনি ফ্রান্সে থাকুন। লিখতে হলে বেঁচে থাকতে হবে তসলিমা।
–লেখালেখি দেশে বসেই করব। দেশ ছাড়ব না।
–এ কোনও কথা হল? আপনার ভয় করে না?
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকদিন থেকে আছি, এভাবে থাকাটাই এখন অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। লড়াই করে বাঁচতে চাই। পালিয়ে নয়। যদি মরতে হয়, মরে যাবো। এ আর এমন কী! কত লোকে মরছে।
সকলের বিস্মিত চোখের সামনে সাতটা বেজে গেলে আমি উঠে পড়ি। মিশেল আমাকে হোটেলে পৌঁছে দেবার সময় বার বার করে বললেন যেন আন্তোয়ানেতের জন্য কোনও একদিন সময় রাখি। আমাকে নিয়ে তাঁরা প্যারিসের বাইরে কোথাও যেতে চান। আরও অনেক কিছুর ইচ্ছে আছে। সেজেগুজে পাটবাবুটি হয়ে যথারীতি হোটেলে অপেক্ষা করছিলেন জ্যঁ শার্ল। আমার যে অপেরায় যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল তা নয়, অনেকটা জ্যঁ শার্লকে আহত না করার জন্য, যেহেতু যথেষ্টই করা হয়েছে ইতিমধ্যে, আর কিছুটা জিলকে এড়াবার জন্য আমার এই অপেরায় যাওয়া। জিল বারবারই বলেছে, আমি যেন একটু ফাঁক পেলেই তাকে ফোন করি, ফোন করলেই চলে আসবে সে। আমি চাইছিলাম না জিলকে ফোন করতে। থাকে সে মপঁলিওতে। ফ্রান্সের দক্ষিণ প্রান্তের এক শহরে। আর তার প্রেমিকা বাস করে প্যারিসে। নাতালির সঙ্গে তার সময় কাটানো নিশ্চয়ই আনন্দের, অন্তত আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর চাইতে। তাছাড়া জিলকে আমার এত ভাল লাগে যে, তার জন্য মন কেমন করা থেকে নিজেকেও একরকম বাঁচাতে চাই। নাহ, জিল নাতালির সঙ্গে সময় কাটাক, আমার জন্য তার সারাদিনটি নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। জিল নাতালিকে ভালবাসে, বাসুক। আমার মন যেন এত জিলে পড়ে না থাকে। আসলে, এত চমৎকার না হলেও সে পারত। আমার চেয়ে বয়সে সে চার বছরের ছোট। আশ্চর্য, কখনও কোনওদিন আমার চেয়ে অল্প বয়সের কারও জন্য আমার মন কেমন করেনি। জিলের জন্য কেন করে বুঝিনা।
প্যারিসের নতুন অপেরাটি আধুনিক স্থাপত্যের একটি উদাহরণ বটে। ফরাসি লেখক জর্জ পেরেক এটিকে অবশ্য বড় মাপের পাবলিক টয়লেটের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ফরাসিরা শহর ভর্তি চমৎকার পুরোনো স্থাপত্যের মধ্যে হুট করে একটি বেঢপ দালান তুলতে মোটেও রাজি ছিল না। রাস্তায় নেমে রীতিমত আন্দোলন করেছে নতুন অপেরাটির নির্মাণের বিপক্ষে। আন্দোলনে কাজ হয়নি, শেষ অবদি ফরাসি নন্দনতাত্ত্বিকদের বিচারে যে বস্তুটি একটি কুৎসিত স্থাপত্য, সেটিই আধুনিক অপেরা হিসেবে ঠিক ঠিক দাঁড়িয়ে গেল। অপেরায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল জ্যঁ শার্লের স্ত্রী নাতাশা। আমাকে মাঝখানে বসিয়ে দু পাশে বসে গেল দুজন। নাতাশা নাদুস নাদুস মেয়ে। তার হাঙ্গেরিয়ান মা ওয়ার এণ্ড পিস পড়ে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে কন্যা জন্মালে নাম রাখলেন নাতাশা। নাতাশা আর জ্যঁ শার্ল তাদের ছেলের নাম রেখেছে সত্যজিৎ। শুনে এত ভাল লাগে। প্যারিসের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সেদিন দেখেছি সত্যজিৎ রায়ের ছবি চলছে, সাতদিনের সত্যজিৎ উৎসব। আনন্দে এমনই ভেসেছিলাম যে চোখে জল চলে এসেছিল। হয় এমন।
এখানকার নাটক থিয়েটারের শেষে যে জিনিসটি হয়, তা আমাদের দেশের নাট্যমঞ্চে দেখিনি। নাটকের শেষে শিল্পীরা যখন সবাই মঞ্চে এসে দাঁড়ায় বিদায় জানাতে, দর্শকরা তাদের করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানায়। কিন্তু দর্শকের যদি কোনও নাটক খুব ভাল লাগে, সেই করতালি আর সহজে থামে না। যতক্ষণ না থামে ততক্ষণ বার বারই শিল্পীদের মঞ্চে এসে এসে অভিনন্দন গ্রহণ করতে হয়। অপেরা থেকে রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেতে গিয়ে রেস্তোরাঁয় একটি টেবিল পেতেই আমাদের অপেক্ষা করতে হয় এক ঘন্টা। অনেক রাত অবদি রেস্তোরাঁয় বসে তরুণ তরুণীর পরস্পরকে যথারীতি জড়িয়ে ধরা, একশ লোকের সামনে চুমু খাওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে গল্প করতে থাকি। গল্পে গল্পে এইডসের প্রসঙ্গ ওঠে। নাতাশা আর জ্যঁ শার্ল দুজনেই বলল, প্রায় প্রতিদিনই এই রোগে কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে ফ্রান্সে। তিরিশ হাজার ফরাসি এইডস রোগে ভুগছে। ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্সেই সবচেয়ে বেশি এইডস রোগী। ফরাসিদের মধ্যে এখন সচেতনতা বেড়েছে। এইডসের ভয়ে অনেকে আগ্রহ হারাচ্ছে যৌনসম্পর্কে, এমনকী প্রেমেও। এইডসের রোগীরা ক্রমে ক্রমে নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে, কেউ মিশতে চাইছে না, কাজ করতে চাইছে না তাদের সঙ্গে। এসব মন খারাপ করা ঘটনা শুনে হোটেলে যখন ফিরে আসি আমি, বড় ক্লান্ত। শরীরটিকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে আসার আগে চোখ পড়ে জিলের দেওয়া লিস ফুলে। কি সুন্দর ফুটে আছে ফুলগুলো। জিল কেমন আছে। কী করছে! নিশ্চয়ই ঘরে নেই। শনিবার রাতে কেন সে ঘরে থাকবে! নাতালিকে নিয়ে নিশ্চয়ই রাতের প্যারিস জুড়ে আনন্দ করছে। যারা যারা ফোন করেছিল, হোটেলের লোক কাগজে লিখে রাখে। নামগুলোর ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে জিলের নাম খুঁজি। নেই।
১. প্যারিসের ডায়রি – ০৪
পরদিন পয়লা মে। ঘুম ভাঙে ফোনের কর্কশ শব্দে। জিল হলে শব্দটি হয়ত এত কর্কশ মনে হত না, ক্যামেরুনের সাংবাদিক পিয়েস বলেই হয়। আজও তার একসঙ্গে নাস্তা খাওয়ার আবদার। এক হোটেলে পাশের ঘরে থাকছে, অথচ দেখা হচ্ছে না, কথা হচ্ছে না। কাল চারটের সময় চা খাওয়ার কথা ছিল, ফিরতে পারিনি চারটেয়। নটায় নিচতলায় নেমে পিয়েসএর সঙ্গে নাস্তা করলাম। আমার পরনে ছিল সার্ট প্যান্ট, খাচ্ছিল!ম শখের সিগারেট। পিয়েস বলল, তুমি কি মুসলিম দেশে এরকম পোশাক পরতে পারো, সিগারেট খেতে পারো? আমি বললাম, সার্ট প্যান্ট পরা যায়, তবে রাস্তাঘাটে খুব য়চ্ছন্দে চলাফেরা করা যায় না। আর মেয়ে হয়ে সিগারেট খেলে লোকে ছি ছি করে। পিয়েস হেসে বলল, ক্যামেরুনে এসবে কোনও অসুবিধে নেই। পিয়েসের আরেকটি আবদার, আমার একটি সাক্ষাৎকার তার চাইই চাই। জ্ঞচলুন আমার ঘরে যাই, ওখানে আমার রেকর্ডার আছে। বাড়তি শব্দ কম হবে ঘরে।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে পিয়েসের আবদার নাকচ করে দিই। যদিও তাকে রজার মিল্লারের মত দেখতে লাগে, তবু দানবের মত বিশাল দেখতে লোকটির ঘরে গিয়ে সাক্ষাৎকার দিতে আমার মোটেও ইচ্ছে হয় না। কী জানি, ভয় ভয়ও হয়ত করে। এটি কি, আমি জানি না, মস্তিষ্কের গোপন কোনও কোষে, বিশ্বাসের মত আছে, কালো কুচকুচে কিছু মানেই ভূত বা ওই জাতীয় ভয়ংকর কিছু। জ্যঁ শার্ল আসার আগে, জিলকে করব না করব না করেও ফোন করি।
ফোন পেয়ে জিল বলল, কি খবর তোমার! তোমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি এখন ক্লান্ত হয়ে গেছি।
–আমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিলে! কেন তুমি নিজে একবার ফোন করোনি।
–তুমি কখন হোটেলে থাকো না থাকো তার ঠিক নেই। তার চেয়ে, আগেই তো বলেছি, তুমি যখন ব্যস্ত থাকবে না, আমাকে ফোন করো। আমি চলে যাবো তোমার কাছে। এখন বল, কি প্রোগ্রাম তোমার আজকে? আমি চাইছি তুমি আমার সঙ্গে প্যারিসটা ঘুরে দেখ!
–না হবে না। জ্যঁ শার্ল আসবে এখন। বেরোবো। তারপর বিকেলে মিশেল আসবে নিতে।
–এত ব্যস্ততা!
আমি হেসে ফোন রেখে জ্যঁ শার্ল এলে বেরিয়ে পড়ি। জ্যঁ শার্ল গাড়ি আনেনি আজ। রাস্তায় মিছিল মিটিং হচ্ছে, পুলিশ সব জায়গায় গাড়ি চলতে দিচ্ছে না, তাই। মে দিবস আজ। দোকান পাট বন্ধ। অন্যরকম প্যারিসের চেহারা। আমরা হেঁটে হেঁটে জোন অব আর্কের মূর্তির পাশে গেলাম। মূর্তির সামনে প্রচুর ফুল পড়ে আছে। খুব অবাক হলাম শুনে যে চরম ডানপন্থী দল মে দিবসে জোন অব আর্কের পাদদেশে ফুল দেয়, এবং জোন অব আর্ককে ডানপন্থীরাই নিজেদের প্রতীক হিসেবে নিয়ে নিয়েছে। জোন অব আর্কের মূর্তিতে ফুল দিতে চাইলে জ্যঁ শার্ল না না করে উঠল, বলল এতে ফুল দেওয়া মানে তুমিও ফ্যাসিস্ট দলের মত আচরণ করলে।
–বল কি!
–ফ্যাসিস্ট ছাড়া আর কেউ ফুল দেয় না জোন অব আর্কের মূর্তিতে?
–না।
–জোন অব আর্ক তো ফ্রান্সের গৌরব। কেন নয়?
–কারণ চরম ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী লিপেনের দলের রানী সে।
–কেন এরকম হল?
–হল কারণ জোন অব আর্ক ফ্রান্সের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। লিপেনও ভাবছে, তারাও তাই করছে। এই চরমপন্থীরা সব বিদেশি ইমিগ্রেন্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এ হচ্ছে জঘন্য জাতীয়তাবাদ।
–জাতীয়তাবাদ তো আমাদের উপমহাদেশে পজেটিভ একটি শব্দ।
–হিটলার জাতীয়তাবাদী ছিল। ইউরোপে জাতীয়তাবাদ শব্দটি খুব নিগেটিভ। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে নিজের দেশকে মুক্ত করার জন্য শোষিতদের জাতীয়তাবাদী হওয়া আর স্বদেশে বসে ইউরোপীয় ঔপনিবেশবাদী শাসককুলের ভিন্ন জাতের প্রতি ঘৃণা পোষা, তাদের দূর দূর করে তাড়ানো আর নিজের জাতের অহংকারে জাতীয়বাদী হওয়া দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।
জ্যঁ শার্ল পেশায় সায়কোএনালিস্ট। তাকে বাইরে থেকে দেখলে মানসিক রোগী মনে হলেও ভেতরে মানুষটি বুদ্ধিমান। আমি ফরাসি ভাষা জানলে অথবা জ্যঁ শার্ল ভাল বাংলা জানলে আমাদের আড্ডা চমৎকার জমতে পারতো, পরস্পরকে আমরা আরও বুঝতে পারতাম নিশ্চয়ই। হাঁটতে হাঁটতে অচিরে আমরা দেখতে পেলাম ল্যুভর মিউজিয়ামের পেছনে একটি খোলা জায়গায় লিপেনের দলের বিশাল সভা। লাল নীল সবুজ হলুদ বেলুন উড়ছে, মঞ্চে বসে আছে কিছু লোক, মঞ্চের সামনে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে শুনছে বক্তৃতা। বক্তা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সোশ্যালিস্ট দলের নেতা ফ্রাঁসোয়া মিতেরোঁর কথা কিছু বলছে, আর শুনে খুশিতে লাফাচ্ছে শ্রোতা। জ্যঁ শার্লকে জিজ্ঞেস করি, মিতেরোঁকে কি বলছে?
–গালি দিচ্ছে।
–কী বলে গালি দিচ্ছে?
জ্যঁ বলল, শুয়োর।
মঞ্চে কেবল পুরুষ নেতাই নন, নারী নেষনীও বসে আছেন। আশ্চর্য, তাঁরা কি গণতন্ত্রের চর্চা করছে মঞ্চের ওপর! এই ডানপন্থী দলটিই তো মেয়েদের চাকরি বাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা বলছে, বলছে ঘরে ফিরে যেন মেয়েরা শাদা শাদা সন্তানের জন্ম দেয়, কারণ কালো আর বাদামীরা জন্মে জন্মে পৃথিবী দখল করে নিচ্ছে। সুতরাং এই চরম ডানপন্থী বর্ণবাদী ফ্যাসিস্ট দলের উপদেশ হল, মেয়েরা এতকাল ধরে সংগ্রাম করে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তা যেন দেশের স্বার্থে শাদা বর্ণের স্বার্থে বিসর্জন দেয়! মিশেল ইডেল বলেছেন সেদিন, লিপেনের দল এরকম একটি আইন তৈরি করতে চাইছে, যে বাচ্চা বিয়োলে মেয়েরা কাজ করে যে টাকা উপার্জন করত, সেই পরিমাণ অথবা তারও চেয়ে বেশি টাকা কাজ না করেই ঘরে বসে পেয়ে যাবে। চাকরি বাকরি করার জন্য মেয়েরা সন্তান জন্ম দিতে আগ্রহী হচ্ছে না, এটি নিয়ে লিপেনের খুব মাথা ব্যথা। তাহলে তো সর্বনাশ গো। মিশেলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মেয়েরা কি এখন সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হওয়ার আদিম ব্যবস্থায় ফিরে যাবে বসে বসে টাকা পাওয়ার লোভে? মিশেল বলেছেন, জ্ঞনাহ! ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন এমন কিছু ভাল নয়। এটি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। মেয়েরা বেকার হওয়ার ঝুঁকি নেবে না। ভাল যে লিপেন ক্ষমতায় নেই।’ আমার আশঙ্কা কবে না জানি আবার লিপেনের দল ভোটে জিতে যায়! ফ্রান্সে ভোট দিতে যাওয়ার লোক খুব কম। ভোটের দিন তারা হয় দূরে কোথাও বেড়াতে চলে যায়, নয়ত ঘরে বসে আরাম করে। ভোটের প্রতি সাধারণ মানুষের এই অনীহার এই সুযোগে আবার লিপেনের দল কোনও দিন না জিতে যায়! তখন কালো বাদামী মানুষের জন্য তো সমস্যাই, শাদা মেয়েদের জন্যও সমস্যা।
বয়স্ক কিছু লোক তাদের এককালের বুকে ব্যাজ লাগানো মেডেল লাগানো সেনা- পোশাক পরে এসেছে লিপেনের সভায়। আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছি, তার বাঁ পাশেই এক ইয়া মোচঅলা লোক সেনা পোশাকে দাঁিড়য়ে ছিল, জ্যঁ বলল, লোকটি আলজেরিয়ায় যুদ্ধ করেছে। লোকের সঙ্গে একটি বুড়ো কুকুর। দেখে জ্যঁ চোখ বড় বড় করে বলে, কুকুরটিরও ট্রেনিং আছে আলজেরিয়ানদের কামড়ানো। বলে কি! তাই নাকি? জ্যঁ নিশ্চিত স্বরে বলল, নিশ্চয়ই। লোকটির হাতে একটি বড় পোস্টার, ফরাসি ভাষায় কি লেখা আছে জানতে চাইলে জ্যঁ বলল, ইওরোপ এক হওয়ার বিরোধী। জাতীয়তাবাদ যাকে বলে। আমরা ফরাসি, আমাদের জাত অন্য জাতের চেয়ে ভাল। আমরা অন্য কোনও জাতের সঙ্গে এক হব না।
সামনে নির্বাচন ফ্রান্সে। আমি জ্যঁ শার্লকে জিজ্ঞেস করি, এরা যদি জিতে যায়!
জ্যঁ ঠোঁট উল্টে বলল, আরে না! এরা খুবই ছোট দল।
যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে সরে ল্যুভরের বারান্দায় ধরে হাঁটতে গিয়ে লক্ষ করি, কিছু লোক তীক্ষ্ণ চোখে আমাকে দেখছে। হঠাৎ জ্যঁ আমাকে টেনে উল্টো দিকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ওদিকে যেও না।
–কেন যাবো না?
–বিদেশিদের ওপর ওদের খুব রাগ। গালাগাল করতে পারে।
–গালাগাল করবে? আমি তো বুঝবও না গালি।
–তুমি না বুঝলেও আমি তো বুঝব।
–কী বলে গালি দেবে?
–বলবে নিজের দেশে ফিরে যা। এখানে এসেছিস আমাদের দেশের সুযোগ সুবিধে ভোগ করতে। আমাদের চাকরি খেতে!
–আমি তো সে কারণে আসিনি। আমাকে তো আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছে, আমি তো অতিথি।
–তোমার গায়ে তো লেখা নেই যে তুমি অতিথি।
–গালাগাল করলে আমার কী! চল হাঁটি ওদিকে, লোকেরা জট পাকিয়ে কি করছে, দেখে আসি।
–দরকার নেই বাবা। চল এ জায়গা থেকে সরে যাই।
জ্যঁ বড় বড় পা ফেলে উল্টোদিকে হাঁটতে থাকে। জ্যঁকে থামিয়ে বলি, আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে কি হচ্ছে এখানে। জ্যঁ আমার হাত ধরে টেনে বলছে, চল সরে যাই! হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমি ধমকে উঠি, — গালাগালকে তোমার এত ভয়!
–গালাগাল তো তেমন কিছু না। এরা মেরেও ফেলতে পারে তোমাকে।
–বল কি!
–ঠিকই বলছি। এদের সম্পর্কে তোমার স্পষ্ট ধারণা নেই। এরা খুব ভয়ংকর।
জ্যঁ জোরে হেঁটে হেঁটে বামপন্থীদের মিছিলে আমাকে নিয়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু মিছিল ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। মিছিল আর সভা ছাড়া রাস্তায় খুব লোক নেই। এসময় নাকি প্রতিবছরই ডামে আর বামে কিছু মারপিট হয় রাস্তায়। মারপিট হয়? মারপিট দেখব। গোঁ ধরলে জ্যঁ বলল, ‘ও আশা ছেড়ে দাও। বামের সভা শেষ হয়ে গেছে।’ অগত্যা কাছেই এক ক্যাফেতে দুজন বসে চা কফি খেতে খেতে দেখতে থাকি রাস্তার কিনারের দৃশ্যগুলো। এক লোক মূর্তি সেজে দাঁড়িয়ে আছে, নড়ন চড়ন নেই, সামনে মাথার টুপি উল্টো করে রাখা, কেউ যদি পয়সা দেয়। তিনটে ছেলে মূকাভিনয় করছে। তাদেরও সামনে টুপি। জ্যঁ বলল, ‘এরা সম্ভবত পোলান্ডের ছেলে। ছাত্র। ফ্রান্সে বেড়াতে এসেছে। এভাবেই পয়সা তুলে চলছে।’ বাহ। বেশ তো। বসন্তের প্রথম থেকে একবারে গ্রীষ্মের শেষ অবদি ছাত্র ছাত্রীরা বেড়াতে যায় বিভিন্ন দেশে। যাদের টাকা পয়সা নেই ঘুরে বেড়াবার, তারা রাস্তায় গান গেয়ে, অভিনয় দেখিয়ে, মূর্তি সেজে টাকা উপার্জন করে সেই টাকায় রেলের টিকিট কাটে, থাকা খাওয়ার খরচা মেটায়। আমি ওদের দেখতে দেখতে ভাবি আমাদের দেশের তরুণ তরুণীরা এভাবে বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর জন্য মোটেও আগ্রহী নয় কেন! পকেটে টাকা পয়সা না নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ার ঝুঁকি কেউ নিতে চায় না কেন! অনেকে এখানে স্কুল কলেজ ছুটি হলেও রেস্তোরাঁয় বাসন মাজার কাজ নিয়ে নেয়, তা থেকে যা উপার্জন করে, তা দিয়ে অন্য দেশে বেড়াতে যায়। মধ্যবিত্ত কোনও ছেলে কি আমাদের দেশে বাসন মাজার কাজ করবে? আমি নিশ্চিত তা করবে না। এতে তাদের মান যাবে। কিন্তু ইউরোপ আমেরিকায় এসে আমাদের শিক্ষিত আদরের দুলালেরা কিন্তু তাই করছে, এতে মান যায় বলে মনে করছে না। আবার এও ঠিক, দেশের রেস্তোরাঁয় বাসন মাজলে কত টাকা আর পাবে! রাস্তায় সং সেজে দাঁড়ালেই বা তাদের কে দেবে টাকা! এখানে ছোট ছোট কাজেও ম্যালা টাকা মেলে। ছোট কাজ বলে ঠকানোর তেমন কোনও রাস্তা নেই। খুব কম করে হলেও ঘন্টায় পঞ্চাশ ফ্রাঁ। বাংলাদেশি টাকায় চারশ টাকা। ঘন্টায় কোন বাসনমাজনেওয়ালাকে চারশ টাকা দেবে আমাদের লোকেরা! তা ই বা দেবে কোত্থেকে! কজনের হাতে টাকা আছে দেশে! চাকরি করে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়াররাই যে টাকা রোজগার করে, তা দিয়ে বাড়িভাড়া তো দূরের কথা, প্রতিদিন দুবেলা খাবারও জুটবে না। তাইতো দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হয় সবাইকে। পুলিশের দুর্নীতির কথা লোকে হামেশাই বলে! ঘুষ কেন খাবে না একজন পুলিশ! মাসে বেতন কত পায় সে! যে টাকা বেতন পায়, সেই টাকায় তার বউ বাচ্চা নিয়ে তার কি বেঁচে থাকা সম্ভব! দুর্নীতি দমন নিয়ে কত বড় বড় কথা লোকে বলে, কিন্তু দুর্নীতি কোনওদিন ঘুচবে না যতদিন না সকলের উপার্জন এমন হয়, যে উপার্জন দিয়ে থাকা খাওয়া পরার ব্যবস্থা করা যায়। আবার এও ভাবি, বড় দুর্নীতিগুলো বড় বড় লোকেরাই করে। যাদের অনেক আছে। গুটিকয়েকের হাতে অঢেল টাকা। বেশির ভাগ কায়ক্লেশে জীবন চালায়। কোনওমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই আর দিনে দুবেলা ভাতের জোগান হলেই আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ খুশি। ধনী দেশেই অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের পর আরেকটি জিনিসের প্রয়োজন অনুভব করে সবাই, তা হল আনন্দ, স্ফূর্তি। আনন্দ স্ফূর্তিকে আমাদের দেশে মোটেও প্রয়োজনীয় বলে ভাবা হয় না, ভাবা হয় বিলাসিতা। এটি কেন! দর্শনের এই তফাৎ কি দারিদ্র্যের কারণে! নাকি অন্য কোনও কারণ আছে। একবার ভাবি জ্যঁ র সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করি। পরেই আবার উৎসাহ দেখাই না। ভাবনাগুলো আমার মাথায় যায় আসে। আসে যায়। ভাবনাগুলো কোথাও স্থির হয়ে থাকে না। বাতাসে ধুলোর মত ওড়ে, তুলোর মত ওড়ে। খেই হারিয়ে যায়, আবার ফিরে ফিরে আসে। মানুষ নামের জাতি একটিই। অথচ কী বিভেদ এই মানুষের মধ্যে। কেউ পাবে, কেউ পাবে না। কেউ খাবে, কেউ খাবে না। কেউ সুখে থাকবে, কেউ থাকবে না। কারও সব হবে, কারও কিছুই হবে না। কারও কাছে জীবন মানে আনন্দ, কারও কাছে জীবন দুর্বিসহ। যে শিশুটি জন্মাচ্ছে আজ ফ্রান্সে, আর যে শিশুটি জন্মাচ্ছে বাংলাদেশে, কী তাদের মধ্যে পার্থক্য! মানুষ হিসেবে কোনও পার্থক্য নেই, অথচ কী ভীষণ রকম ভিন্ন অবস্থায় পরিবেশে দুটো শিশু দু দেশে বড় হচ্ছে। আবারও ভাবি খুব কি পার্থক্য? আমি যে প্যারিসের ধনী ক্রিশ্চান বেসের বাড়ি গেলাম, আর ঢাকার গুলশানে এনায়েতুল্লাহ খানের বাড়ি গিয়েছিলাম, কী এমন পার্থক্য দুবাড়ির মধ্যে? কি এমন তফাৎ দু জনের জীবন যাপনে? না, খুব একটা নেই। ধনীরা, সে যে দেশেই হোক, একই রকম আরামে থাকে। তবে গরিবের অবস্থা হয়ত ভিন্ন। বাংলাদেশের গরিব আর ফ্রান্সের গরিব তো একরকম অবস্থায় থাকে না! গরিবের যে চেহারা দেখেছি বেলভিলে, এই যদি গরিব হয়, তবে তেজগাঁর বস্তিকে কি বলা যাবে! দুর্গন্ধ পাগারের ওপর বাঁশ পুঁতে ওর ওপর একখানা তক্তা বিছিয়ে ঘর বানিয়ে গু মুতের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে। তেজগাঁ বস্তির দুর্গন্ধটি প্যারিসের ক্যাফেতে বসেও হঠাৎ আমার নাকে এসে লাগে। চারদিকে বিশ্বায়ন নিয়ে কথা হচ্ছে। কার জন্য বিশ্বায়ন! পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে বলা হয়। কিন্তু কাদের কাছে ছোট? বাংলাদেশের একজন সাধারণ লোকের কাছে বিশ্বায়নের অর্থ কি! তাকে তো কেবল শ্রম দিতে হবে ধনীর ধন বাড়াতে। বিশ্বায়নে কেবল তো পণ্যদ্রব্যই এক দেশ থেকে আরেক দেশে অবাধে যাবে। গরিব দেশ থেকে কটা জিনিস বিদেশের বাজারে পৌঁছবে! গরিব দেশের কটা লোক ইচ্ছে করলেই দেশের সীমানা পেরোতে পারবে! গরিব হলে হাত পা কেমন বাঁধা পড়ে যায়। সীমানা কত মাপা হয়ে যায়! স্বাধীনতা কত সীমিত হয়ে যায়! সবাই পৃথিবীরই সন্তান, কিন্তু কারও কারও জন্য এক নিয়ম, কারও কারও জন্য অন্য। কারও জন্য বেঁচে থাকা, কারও জন্য মৃত্যু। কারও জন্য সুখ, কারও জন্য দুঃখ। হঠাৎ সুখ শব্দটি আমাকে দোলাতে থাকে। সুখ কি ধন দৌলত হলেই হয়! তেজগাঁর বস্তির এক মেয়েকে দেখেছি গায়ে ছেড়াঁ কাপড় পায়ে জুতো নেই, মায়ের চুলে বিলি কেটে কেটে উকুন আনছে আর খিলখিল করে হাসছে, রেললাইনের ধারে একটি মাটির চুলোয় শুকনো ডাল পাতা জ্বালিয়ে মেয়ের মা’টি ভাত ফুটোচ্ছে, মাও হাসছে। ওই সময়টিতে মা আর মেয়ে দুজনেই খুব সুখী ছিল। আর এখানে এই প্যারিসে ক্রিশ্চানের বাড়িতে তার অঢেল সম্পদের মালিক স্বামী টনিকে দেখেছি একটি একলা ঘরে বিষণ্ন বসে থাকতে, মোটেও মনে হয়নি তিনি খুব সুখে আছেন।
জ্যঁ শার্ল আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে চলে যায় টেলিভিশনে। ওখানে আমার দেওয়া বাংলা সাক্ষাৎকারের ফরাসি অনুবাদ করার দায়িত্ব পেয়েছে সে। জিল হোটেলে খবর দিয়ে রেখেছে আমি যেন ফিরেই একবার তাকে ফোন করি। ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকি। ইচ্ছে করেই জিলের ফোন নম্বরটি আমি ভুলে যাই। ক্রিশ্চান ফোন করে, ‘উফ তোমাকে তো পাওয়াই যায় না সুন্দরী, করছ কি সারাদিন! বল, সেদিনের সেমিনার কেমন হল? নিশ্চয়ই খুব হাস্যকর! নিশ্চয়ই তোমার ভাল লাগেনি।’
আমি শান্ত গলায় বলেছি, আমার ভাল লেগেছে।
–বল কি?
–হ্যাঁ ভাল লেগেছে। আমি বেশিক্ষণ ছিলাম না ওখানে। তবে যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, খুব ভাল মানুষ তারা।
ক্রিশ্চান হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘তুমি এখনও ভাল করে চেনোনি ওদের।’
আমি আর কথা বাড়াইনি। ক্রিশ্চানের আন্তরিক কণ্ঠ বার বার ধ্বনিত হচ্ছে, বল, তোমার –কিছু লাগবে কি না বল।
–না, আমার কিছু লাগবে না।
–কেন লাগবে না! যা কিছুই লাগে, আমাকে বলবে। আমি তোমার সেবায় নিয়োজিত। ভুলো না কিন্তু।
মিশেল ইডেল এলে মিশেলকে আমার হোটেলের ঘরে চলে আসতে বলি। ঘরে বসে দুজন খানিকক্ষণ গল্প করে ক্যাফে দ্য ফ্লোরএ যাই, ওখানে বসে দুদেশের মেয়েদের অবস্থা নিয়ে কথা বলি। কথা হয় ভোট নিয়ে। পঞ্চাশ বছর আগে ফ্রান্সের মেয়েরা ভোটের অধিকার পেয়েছে। মিশেল জানতে চান কবে আমাদের ওদিককার মেয়েরা পেয়েছে এই অধিকার। খুব সোজা, সাতচল্লিশ সালে ব্রিটিশ দূর হল ভারতবর্ষ থেকে, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হল, পুরুষ এবং নারী উভয়েই ভোটের অধিকার পেল। মিশেলের একটি কথায় আমি বিস্ময়ে দুমিনিট কথা বলতে পারি না। সুইৎজারল্যাণ্ডের মেয়েরা নাকি ভোটের অধিকার পেয়েছে উনিশশ একাত্তর সালে।
সে রাত আমার কাটে আন্তোয়ানেত ফুকের বাড়িতে। বিশাল বাড়ি। আন্তোয়ানেতের এক অনুসারী, তাঁরও মিশেল বলে নাম, আমার সাক্ষাৎকার নিলেন ভিডিওতে। আমার বড় অস্বস্তি হচ্ছিল। এত প্রশ্ন এত উত্তর আমার আর সইছিল না। বার বারই শেষ করতে চাইছিলাম, কিন্তু আন্তোয়ানেত ফুকের ইচ্ছে আমার যাবতীয় কথাবার্তা তিনি রেকর্ড করে রাখবেন। কিন্তু কেন? কাজে লাগবে। কি কাজে? তোমার ওপরই একটি তথ্যচিত্র করছি আমরা! আমার অস্বস্তি উত্তরোত্তর বাড়ে।
পরদিন। সকাল নটায় জিল এল হোটেলে। খবর পেয়ে গোসল করে শাদা একটি সার্ট আর বাদামী রঙের একটি প্যান্ট পরে ফুরফুরে মেজাজে নিচে যাই। চা নাস্তা নিয়ে দুজন বসি মুখোমুখি। জিল দাড়ি কামায়নি। আগের সেই কালো জিনস পরনে তার। অমল হাসি ঝলমল করে জিলের মুখে।
–কেমন আছ তসলিমা।
–ভাল। তুমি?
–ভাল। জিল হেসে ওঠে বলে।
কাল রাতে জিল বলেছিল আজ সে কাঁটায় কাঁটায় নটায় আসবে। নটার এক মিনিট দেরি হলে আমি নাকি বেরিয়ে যেতে পারি। মনে মনে বলেছিলাম, যাবোই তো। তোমার জন্য আমি কেন অপেক্ষা করব জিল?
–তোমাকে দুদিন সময় দিলাম জিল। যেন নাতালির সঙ্গে সময় কাটাতে পারো। যেন আমার চাকরি করতে না হয়।
–ওহ না। তসলিমা কি বলছ তুমি! আমি সবসময় অপেক্ষা করেছিলাম তোমার ফোনের।
–তুমি তো ফোন করনি!
–হ্যাঁ করেছি। তুমি নেই।
–সে তো আমি ইচ্ছে করেই নেই। যেন তুমি নাতালির সঙ্গে..
–কি বলছ তুমি!
–হ্যাঁ, সত্যি।
–নাতালির সঙ্গে, তুমি জানো, আমার কোনও গভীর সম্পর্ক নেই। ওর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটাতে, বিশ্বাস কর, আমার ভাল লাগে না। সময়ই কাটতে চায় না।
তবে কি আমার সঙ্গে ভাল লাগে? মনে মনে বলি তাহলে চলে এলে না কেন!
জিলের নীল দুটি চোখে চোখ রেখে বলি, তিনবার ফোন করেছো। এ কোনও ফোন করা হল? জিল হেসে বলে, ‘ঠিক আছে যাও, প্রতি দশ মিনিট পর পর এখন থেকে ফোন করব। ঠিক আছে?’
আমি বুঝিনা জিলকে দেখলে কেন মনে হয় আমি খুব ভাল আছি। যেন সব ক্লান্তি কেটে গেছে, সব দুর্ভাবনা দূর হয়েছে। আমরা বসে থাকতে থাকতেই নাতালি এল। কাল সে ফোন করেছিল, আজ আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে বলেছে। এই নাতালি জিলের প্রেমিকা নাতালি নয়। নাতালি বনফুরা প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শেখে। আমার খবর পেয়েছে শিশির ভট্টাচার্যের কাছে। শিশির বাংলাদেশের ছেলে, প্যারিসে কয়েক বছরের জন্য বাংলা পড়াতে এসেছেন। নাতালির কাছে খবর পেয়ে তার প্রায় লেজে লেজেই এসেছে নীলরতন, ভোলার ছেলে, প্যারিসে লেখাপড়া করছে। নাতালি মেয়েটি চমৎকার। আমার খুব ভাল লাগে ওকে। যেন ওর অনেকদিনের বন্ধু আমি। নাতালি সুন্দর বাংলা বলে, সুন্দর বাংলা লেখেও। জিল আমার বাংলা লেখা দেখে বলে, এ তো কোনও ভাষা নয়, এ হচ্ছে আর্ট। নাতালি হঠাৎ বলে আমাকে সে ফরাসি ভাষা শেখাবে।
–বাহ বেশ তো শেখাও।
–কি শিখতে চাও প্রথম?
–আমি তোমাকে ভালবাসি।
–জ তেম।
এক এক করে সে লিখল, কেমন আছ, ভাল আছি। কামা সাবা? সাবা। ধন্যবাদ। ম্যারসি। জিলকে বললাম, জিল, জ তেম।
জিলের চোখ মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উত্তরে সে ফরাসি ভাষায় কি বলল বুঝিনি। নাতালি লিখে যাচ্ছে আরও কিছু ফরাসি শব্দ। জিল বলল, ‘আজ সারাদিন কিন্তু তোমার সঙ্গে থাকব। আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া আজ তোমার চলবে না। চলবে না।’ এর মধ্যেই জ্যঁ শার্ল এসে উপস্থিত। গতকাল তিনি ন ঘন্টা টেলিভিশনে কাটিয়েছেন আমার বাংলা অনুবাদ করতে। জিলকে বিগলিত হেসে কেলিয়ে বলে দি আমাকে নিয়ে তিনি অপেরায় গিয়েছিলেন।
জিল বলল, কি ব্যাপার তুমি তো বলনি তুমি যে অপেরায় গিয়েছিলে!
হেসে বলি, মনে ছিল না।
মনে ছিল না?
জিল হেসে ওঠে। শিশুর হাসির মত হাসি।
বারোটা বেজে গেল। সকালেই ক্রিশ্চান হোটেলে ফ্যাক্স পাঠিয়ে জানিয়েছেন যে আমাকে তিনি সাড়ে বারোটায় এসে নিয়ে যাবেন, ফেরত দিয়ে যাবেন তিনটেয়। অষ্ট্রেলিয়ার টেলিভিশন থেকে পিটার নামের এক লোক চার পৃষ্ঠা লম্বা ফ্যাক্স পাঠিয়েছেন, কোত্থেকে যে এই লোক খবর পেলেন আমি কোথায় আছি, জানি না। জিলকে বলি ফ্যাক্সটি পড়ে শোনাতে, আমার পক্ষে অত লম্বা জিনিস পড়া সম্ভব নয়। জিল বাধ্য ছেলের মত শোনায়। ক্রিশ্চান এলে জিলকে সঙ্গে নিই। সোজা এডিশন স্টক, ক্রিশ্চানের প্রকাশনীতে। কি বিশাল প্রকাশনীর বাড়িটি। সকলে আমাকে দেখে বিষম উচ্ছঅজ্ঞসত। দু গাল যে কত বার কতজনের কাছে পেতে দিতে হল চুমু খেতে। অভ্যস্ত নই এসবে। কিন্তু ওদের অভ্যেসের কাছে আমার গালদুখানি বিসর্জন দিতে হয়।
রাতে এলিজাবেথ আসে। তার তথ্যচিষেনর ভিডিও ক্যাসেট দিল আমাকে, যা ও তৈরি করেছিল ঢাকায় গিয়ে। বলল, বাইশটি দেশ এই তথ্যচিত্রটি কিনে নিয়েছে। সুইৎজারল্যাণ্ড, ইতালি, স্পেন, ইংলেণ্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, আমেরিকা..। এলিজাবেথ ঢাকায় যেমন রহস্যে মোড়া ছিল, এবার আর তা নয়। বলল, ঢাকায় তার ঝামেলা হয়েছিল। তিরিশ জন পুলিশ তার পেছনে যখন সে শাখারিপট্টিতে পৌঁচেছে। কি করে তার যাবার খবর পুলিশ জানে, তা এখনও তার কাছে রহস্য। ফৈয়াজ নামে যে ছেলেটি তাকে বাংলা থেকে ফরাসিতে অনুবাদ করে দিয়েছিল, এলিজাবেথ চলে আসার পরই তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ, থানায় নিয়ে কয়েক হাজার প্রশ্ন করেছে। পুলিশের কারণে এলিজাবেথের আর শাখারিপট্টিতে ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। জিজ্ঞেস করলাম, বাইশটি দেশ তোমার এই ছবি কিনে নিল? আশ্চর্য! –হ্যাঁ। ভীষণ পছন্দ করেছে ওরা। প্রচুর চিঠি আসছে আমার কাছে। ওরা তোমাকে সহমর্মিতা জানাতে চায়। তোমার ঠিকানা চাইছে ।
–আর যাবে না ঢাকায়?
এলিজাবেথ হেসে বলল, আমার জন্য ঢাকা যাওয়ার পথ বোধহয় বন্ধ হয়ে গেল। আমাকে আর ঢুকতে দেবে বলে মনে হয় না।
এলিজাবেথ চলে যাবার সঙ্গে নাতালি এল, সঙ্গে নীলরতন আর শ্যামল চক্রবর্তী নামে একটি ছেলে। শ্যামল নীলরতনের বন্ধু। নীলরতন রান্না করে নিয়ে এসেছে। মুরগি, ফুলকপি আর বাসমতি চালের ভাত। নীল চামচ দিয়েছিল থালায়। সরিয়ে দিয়ে হাত ডুবিয়ে দিই ভাতে। কতদিন পর ভাতের স্বাদ পাওয়া! আহা। শ্যামল বার বারই বলছে, দিদি আপনার সঙ্গে পরিচিত হবার ইচ্ছে সেই কতদিনের। কি যে ভাল লাগছে দিদি!
নাতালি এসে কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে বাংলা গান শুনতে বসে গেছে। নাতালি, আপাদমস্তক ফরাসি মেয়ে, কি চমৎকার বাংলা বলে, বাংলা লেখে। বাংলা গানের পাগল। জিজ্ঞেস করি, এই তুমি শাড়ি পরতে পারো?
মাথা নেড়ে বলল, না।
ওকে একটা লাল শাড়ি দিলাম। নীলরতনকে শার্ট।
‘নিয়ে নাও। আমার লাগবে না।’ সে যে খুশি দুজন।
শ্যামল মেট্রোতে বাদাম বিক্রি করে। সে এখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছে। জানেনা, ফরাসি সরকার তাকে আশ্রয় দেবে কি না। না দিলে তাকে দেশে চলে যেতে হবে। বাদাম বিক্রি করে দিনে একশ ফ্রাঁ জোটে তার।
–এখানে জিনিসের সে যে কি আগুনে দাম, এই টাকায় কি চলতে পারো!
–কষ্ট করে চলি দিদি।
শ্যামল বড় করুণ স্বরে বলতে থাকে, –এক ঘরে সাত আটজন গাদাগাদি করে থাকি। বাঙালিরা মেট্রো স্টেশনে বাদাম বিক্রি করে, কাপড় বিক্রি করে, ফুল ফল বিক্রি করে। এসব বিক্রি করা মেট্রোতে নিষিদ্ধ। পুলিশ প্রায়ই ধরে নিয়ে যায়। মারধোর করে।
খেতে খেতে শ্যামলের গল্প শুনি।
–পনেরো তারিখে আপনার ওপর একটা অনুষ্ঠান হয়েছে টেলিভিশনে। দু ঘন্টা আগে থেকেই বিজ্ঞাপন দিচ্ছিল। বসে ছিলাম আপনাকে দেখব বলে। কী যে ভাল লেগেছে দিদি।
নীলরতন বলল, এখানকার কাগজে সেদিন পড়লাম ফ্রান্সের ইস্কুল কলেজগুলো আপনার ওপর একটি বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান হচ্ছে। গর্বে বুক ভরে গেছে। খাওয়া শেষ হলে আমরা সবাই মিলে বাইরে যাই। অনেকটা পথ রাতের প্যারিস জুড়ে হাঁটি। বাংলায় কথা বলতে বলতে হাঁটি। রাতে অষ্ট্রেলিয়া টেলিভিশন থেকে ফোন, আমার ওপর একটি তথ্যচিত্র বানাতে ওরা বাংলাদেশে যেতে চায়। আমি রাজি কি না জানতে চাইছে। এসব কাণ্ড যত দেখছি, তত অবাক হই। আমি তো সেই আমিই! সেই অবকাশের আমি।
নাতালি রাতে থেকে যায় আমার ঘরে। অনেকটা রাত গল্প করে কাটায়। সকালে ঘুম ভেঙে যায় টেলিফোনের শব্দে। নিচে ফটোগ্রাফার অপেক্ষা করছে। গামা নয়ত সিগমা ফটোএজেন্সি থেকে এসেছে। বলে দিই যে নিচে যেতে পারব না, চাইলে ওপরে যেন চলে আসে। মেয়েটি আমার ঘরে চলে এসে পাগলের মত ছবি তুলতে থাকে। ছবি তোলা তখনও শেষ হয়নি, তুলুজ থেকে এলেন ক্যারোলিন ম্যাকোনজি। তখন চা খাচ্ছি। ফটোগ্রাফার অপেক্ষা করছে। ক্যারোলিন খুব কাছে মুখোমুখি বসে বললেন, ‘একটা উপন্যাস আমাকে ছাপতে দিন।’
‘উপন্যাস তো কিছু নেই বাকি। এডিশন স্টককে দিয়ে দিয়েছি।’
‘উপন্যাস যদি না দিতে পারেন, অন্তত একটা গল্পের বই দিন।’
‘কিছু তো নেই। গল্প যা আছে, তা স্টককে দেব বলে কথা তো দিয়ে ফেলেছি।’ ‘কিন্তু আমরা যে চাইছি। সেই কতদিন থেকে আমরা ঢাকায় আপনার কাছে ফোন করছি, ফ্যাক্স করছি। কিছু একটা আমাদের দিতেই হবে তসলিমা। দয়া করুন আমাদের। আপনার লজ্জা বেরোবে সেপ্টেম্বরে। এই সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আমাকে ছোট গল্পের পাণ্ডুলিপি দিন। দিতেই হবে।’
না বলতে আমি পারি না। জানি না, না বলতে আমার কষ্ট হয় কেন। বড় করে একটি না বলে দেব, পারি না। কণ্ঠে স্বর ওঠে না। লজ্জা হয় না বলতে। কেমন যেন মায়া হয় মানুষটির জন্য। আমি খুব ভাল করেই জানি যে আমি এমন কিছু লিখিনি যা কি না ফরাসি ভাষায় প্রকাশ পেতে পারে। লজ্জা তো নয়ই। ক্রিশ্চান যখন আমার কাছে যা কিছুই এ পর্যন্ত লিখেছি সবই চেয়েছে, আমি সত্যিই লজ্জায় পড়েছি। আন্তোয়ানেত ফুক আর মিশেল ইডেল যখন চেয়ে মরেছে, লজ্জা আমার কম হয়নি। তবু বড় দ্বিধায় নির্বাচিত কলামটি দিয়েছি। যে স্বাধীনতার কথা বলেছি নির্বাচিত কলামে, সে স্বাধীনতা এখানকার মেয়েরা বহু আগেই পেয়ে গেছে। আমার নারীবাদ এদের কাছে নিতান্তই পুরোনো জিনিস। আর যে কটি লেখাই লিখেছি, সবই তো আমাদের দেশ আর সমাজ সম্পর্কিত, কতটুকুই বা ফরাসিরা অত দূর দেশের নিত্যদিনের সমস্যার সঙ্গে জড়িত! ক্যারোলিন কনট্রাক্ট ফরম নিয়ে এসেছেন। বলেছি, এখন সই করব না, আগে দেশে ফিরে দেখি আদৌ কোনও গল্প আমার কাছে আছে কি না। থাকলে কোন কোনটি আপনাকে পাঠানো যায়। ক্যারোলিন একটি প্যাকেট আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটা তোমার জন্য। খুলে দেখি একটি ঘড়ি। বললেন, জ্যঁ শার্ল বলেছে, তোমার একটি ঘড়ি দরকার।
জ্যঁ শার্লকে আমি বলিনি, আমার ঘড়ি দরকার। নিশ্চয়ই সে লক্ষ করেছে যে আমার হাতে ঘড়ি নেই। প্যারিসের অনেক মেয়েই দেখেছি রঙিন ঘড়ি পরে। রঙিন ঘড়ি আমার পক্ষে পরা সম্ভব নয়, মনে মনে বলি, কেমন যেন বাচ্চা বাচ্চা লাগে। তখনও আমি জানি না সোয়াচ ঘড়ি, সে রঙিন হলেই কি, না হলেই কি, এর মূল্য অনেক। এদিকে ফটোগ্রাফারের মেশিনগান চলছে। ক্যাটক্যাটক্যাটক্যাটক্যাট। থামাথামি নেই। এত ছবি তুলে কি হবে গো? কি করবে এত ছবি!
নাতালি পরে বলেছে, বোঝো না কি করবে এসব ছবি? বিক্রি করবে।
বিক্রি? কোথায়?
ফ্রান্সের কাগজে। কেবল কি ফ্রান্সের! বিভিন্ন দেশের পত্রিকায়। কেবল কি পত্রিকায়! বইয়ের প্রকাশনী আছে, পোস্টার কোম্পানী আছে. টেলিভিশন আছে..।
এই ক্যাটক্যাট যেতে না যেতেই লা হিউমানিতের সাংবাদিক এলেন। লা হিউমানিতে বামপন্থীদের পত্রিকা। সাংবাদিকের সঙ্গে সমাজতন্ত্র বিষয়ে বিস্তর কথা হল। সমাজতন্ত্রে কেন আমি বিশ্বাস করি। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর আমি কি আশাবাদী, যদি আশাবাদী, কেন আশাবাদী। সাক্ষাৎকার যখন চলছিল, তখনই জিল এল। যেতে হবে রেডিওতে। নাতালিকেও সঙ্গে নিলাম। জ্যঁ শার্ল আগেই গিয়ে বসে আছে ওখানে। আমি আর সাংবাদিক মেয়েটি, যে আমার সাক্ষাৎকার নেবে, গিয়ে বসলাম একটি গোল টেবিলের ঘরে, টেবিল ঘিরে মাইক্রোফোন, কাচের দেয়ালের ওপাশে একটি ঘর। ইংরেজিতে প্রশ্ন করা হবে, আমি বাংলায় উত্তর দেব, জ্যঁ শার্ল সঙ্গে সঙ্গে আমার বাংলা ফরাসিতে অনুবাদ করে দেবে। নাতালিও বসেছে একটি চেয়ারে। কাচের দেয়ালের ওপাশে ঘরটিতে রেকর্ডিং কন্ট্রোল হচ্ছে, ও ঘরটিতেই দাঁড়িয়ে আছে জিল। এক একটি প্রশ্নের উত্তর দিই আর জিলের দিকে তাকাই। জিল মিষ্টি করে হাসে। চোখ টিপে বাহবা জানায়। জিলকে আমার এত আপন মনে হয় যে ভুল করে তার সঙ্গে আমি প্রায়ই বাংলায় কথা বলে ফেলি। রেডিও থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে পিকাসো মিউজিয়ামে যাই। পিকাসো মিউজিয়াম দেখব এরকম একটি ইচ্ছে প্যারিসে নামার পর থেকেই ছিল। জিল বলল, বোধহয় বন্ধ, তবু চল। গিয়ে ঠিক ঠিকই দেখা গেল বন্ধ। প্যারিসের মিউজিয়ামগুলো কোনওটি সোমবার, কোনওটি মঙ্গলবার বন্ধ থাকে, এরকম নয় যে সপ্তাহের দুটোদিন শনি রবিবার মিউজিয়ামগুলোও বন্ধ থাকবে। হাঁটতে হাঁটতে কোথাও খাবো বলে একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকি। জিল বলল, এটা ইহুদিদের রেস্তোরাঁ, এদের খাবার খুব ভাল হয়। রেস্তোরাঁর চেহারাটি অন্যরকম। যেন ধ্বংসস্তূপ। অথবা কোনও গুহা। এরকম করেই বানানো হয়েছে। আমাদের দেশে যেমন বাড়িঘর রং করলে ভাবা হয় সুন্দর, এখানে কিন্তু সব সময় তা নয়। যত পুরোনো বাড়ি, যত প্রাচীন, মলিন, তত তার মর্যাদা বেশি। প্যারিসের বড় বাড়িগুলো সব পাথরে বানানো, কোনও রঙের প্রয়োজন হয় না, সেগুলোই প্যারিসের সৌন্দর্য। ইট সিমেণ্টের বাড়িগুলোকে, উঁচু হোক, ঝকঝকে হোক, মোটেও সুন্দর বলে মনে করা হয় না। আমি আমাদের কথাই ভাবি, পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি বানানোর ধুম চলে। আমাদের অবকাশ খুব পুরোনো বাড়ি। বিশাল বিশাল দরজা জানালা, উঁচু সিলিং, দেয়ালের কারুকাজকে মোটেও ভাবা হয় না সুন্দর কিছু। অবকাশ ভেঙে নতুন ডিজাইনের বাড়ি করার ইচ্ছে বাড়ির প্রায় সবারই। তার ওপর সেই পুরোনো কাঠের কারুকাজ করা আসবাবপত্রগুলোকে পারলে ভেঙে খড়ি বানানোর ইচ্ছে সবার। সিংহের মুখ অলা খাটের পায়াগুলোকে পুরোনো পচা ভাবা হয়, তার চেয়ে কোনও পায়াহীন বাক্সের মত খাটগুলোকে মনে করা হয় সুন্দর, আধুনিক। আধুনিক আসবাবপত্র, বাড়িঘরের প্রতি ওখানে আকর্ষণ প্রচণ্ড। প্যারিসে ঠিক তার উল্টো। বিশাল ঝকঝকে তকতকে অত্যাধুনিক দোকানের জানালায় দেখেছি সাজানো আছে চটের বস্তা, পোড়া খড়ি, ভাঙা ইট, মরা ডাল। ওগুলোই এখানে সৌন্দর্য। এসব দেখে আমার একটি জিনিস মনে হয়, আধুনিকতার শীর্ষে উঠে এদের আর আধুনিকে আকর্ষণ নেই, আর প্রাচীনতম দেশগুলোয় পা পা করে যেখানে আধুনিকতা উঁকি দিচ্ছে, সেখানে মানুষ হুড়মুড় করে গিয়ে আঁকড়ে ধরছে সেটি। আধুনিকতা মানে কি? নিজের কাছেই প্রশ্ন করি। স্থাপত্যে, আসবাবে, পোশাকে নতুন ঢংএর নামই কি আধুনিকতা! মনের আধুনিকতাকে যদি সত্যিকার আধুনিকতা বলি, তবে ধনী দরিদ্র নতুন প্রাচীন সব দেশেই আছে সেই আধুনিকতা। দেশ বা সমাজ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু আমরা যারা পুরোনো মূল্যবোধ পেছনে ফেলে নতুন দিকে নতুন করে নতুন ভাবে নতুন সময়ের কথা ভাবছি, তাদের ভাবনাগুলো এক। আর যারা ধর্মান্ধতা, অজ্ঞতা, হিংস্রতা ইত্যাদি নিয়ে আছে, তাদের আচরণগুলোও এক।
ইহুদিদের খাবার খুব আলাদা স্বাদের। জিল বলে।
আমি বলি, তা কেন হবে? কোনও খাবারই ধর্মভিত্তিক নয়। এগুলো দেশভিত্তিক, এলাকা ভিত্তিক।
জিল সবেগে মাথা নেড়ে আমাকে অস্বীকার করে বলে, না, ইহুদিদের খাবার অন্যরকম।
–কী বলছো আবোলতাবোল! কোনও খাবারকে তুমি বলতে পারো না এই খাবার ইহুদিদের, এই খাবার মুসলমানদের বা খ্রিস্টানদের। ফ্রান্সে যে ইহুদিরা হাজার বছর থেকে বাস করছে, তাদের খাবার ইহুদি-খাবার হবে কেন, হবে ফরাসি খাবার! বাংলাদেশের মুসলমানের খাবার আর ইরাকের মুসলমানের খাবার এক নয়। ভারতের খ্রিস্টানদের খাবার আর ইতালির খ্রিস্টানদের খাবার এক নয়। আরবের ইহুদি আর জার্মানির ইহুদির খাবারও এক নয়।
জিল বলে, এক।
এক হওয়ার তো কারণ নেই।
জিল আবারও বলে, এক। এক, কারণ সব দেশেই তাদের বিশেষ খাবারগুলো তারা এক রকম করে তৈরি করে।
না, আমি তোমার কথা মানতে পারলাম না।
না মানতে পারলে আমার কিছু করার নেই। কিন্তু আমি যা বলছি, তা ঠিক। ইহুদিরা প্রতিটি দেশেই একরকম করে খাবার তৈরি করে।
আমি সজোরে মাথা নেড়ে বললাম, ধর্মের সঙ্গে খাবারের কোনও সম্পর্ক নেই, থাকতে পারে না। আমি নিশ্চিত ভারতের ইহুদি আর ফ্রান্সের ইহুদি একরকম খাবার তৈরি করে না। ভারতের উত্তরাঞ্চলের হিন্দু আর দক্ষিণাঞ্চলের হিন্দুদের খাবারই ভিন্ন। এসব নির্ভর করে এলাকার ওপর। নির্ভর করে সেই এলাকার সংস্কৃতির ওপর।
জিল তার মত ফেরায় না। আমিও না।
যে কটি খাবারের কথা বলা হয়েছে, এক এক করে সব আসে। সবগুলোর মধ্যে কিছু না কিছু বেগুন আছে, তাও আবার বিস্বাদ। ঝাল। জিলের থালায় বড় একটি মরিচ সেদ্ধ। শাকপাতার ভেতর ভাত ভরে মুড়ে দিয়েছে। কি অদ্ভুত খাবার বাবা! আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব হয় না। আমার থাল থেকে জিল খেল, আমি জিলের থেকে খানিকটা। ব্যাস।রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যখন হাঁটছি, হঠাৎ দেখি একটি রেস্তোরাঁর নাম ভলতেয়ার রেস্তোরাঁ, ভলতেয়ারের নামে রাস্তা।
এখানে কি ভলতেয়ার থাকতেন?
জিল বলে, না, সম্মান জানানো হচ্ছে।
জ্যঁ শার্ল বলে, তসলিমার নামেও একদিন প্যারিসে রাস্তা হবে।
হো হো করে হেসে উঠি।
মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামটি বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে আস্ত একটি তেলের কারখানা। নানারকম নল দিয়ে বানানো মিউজিয়ামের দেয়ালটি। এলাকাটিতে লোকের ভিড়, কিছু না কিছু লেগেই আছে। নাতালি বলল এখানে নাকি বেশ কিছু বাঙালি কাজ করে। পথে কোনও বাঙালি দেখলেই সে হেসে আমার দিকে তাকায়, কানে কানে বলে, দেখলে বাঙালি। কিছু বাঙালি দেখলাম, রাস্তায় দাঁড়িয়ে চালের মধ্যে নাম লিখে লকেট বিক্রি করছে। অত ছোট চালের মধ্যে কি করে নাম লেখা যায়, তা আমার মাথায় ঢোকে না। মেট্রোয় রেল চড়া হল, কোনও বাদামঅলা বাঙালি চোখে পড়ল না। নাতালি বলল, গরম পড়ে গেছে, ওরা বাইরে চলে এসেছে।
১. প্যারিসের ডায়রি – ০৫
একটি পার্কার কলম কেনার শখ হল হঠাৎ। ভীষণ দাম।
–জিল, আমাদের দেশেও পার্কার কলম পাওয়া যায়। কিন্তু এত দাম নয় তো ওগুলো!
–ওগুলো নিশ্চয়ই আসল নয়, নকল। তাই দাম কম। তুমি প্যারিস থেকেই পার্কার কেনো। এগুলো আসল।
–পার্কারের গায়ে ঠিক এরকমই তো লেখা থাকে, কেন আসল হবে না আমাদের দেশেরগুলো?
জিল বলে, হয়ত নিবটা এত ভাল না, এগুলোর যেমন ভাল।
জিল তার মত পাল্টাবে না কিছুতেই। শেষ অবদি দাম দিয়েই একটি পার্কার কলম কেনা হয়। যে কোনও দাম দেখলেই আমি আট দিয়ে গুণ করে ফেলি। বইয়ের দোকানে ঢুকেও কিছু আর কেনা সম্ভব নয়। বিশাল একখানা বই ল্যুভরের ওপর। দামেও কুলোতে পারব না, ওজনেও না। তাই বাদ। আরও কিছুক্ষণ বইয়ের দোকানগুলোয় সময় কাটাবো, তার সময় নেই। টেলিভিশনে যেতে হবে, জিল তাড়া দিল।
–ধ্যুৎ এত টেলিভিশন আমার ভাল লাগে না। হলই তো কত।
–এটিই শেষ। জিল মিনতি করে।
একপ্রশ্ন, এক উত্তর। আর ভাল লাগে না। লজ্জা কেন সরকার বাজেয়াপ্ত করল, ফতোয়া দিল কেন, আমার কেমন লেগেছে ফতোয়ার পর, কোনও সমর্থন আছে কি না দেশে, এসবই তো। ফরাসিরা তো শুনেছেই এসব, আর কত শুনবে! আমার ভাল লাগে না।
জিল বলে, বুঝি আমি। আমি যদি তুমি হতাম, আমারও এমন লাগত, যেমন লাগছে তোমার। কিন্তু ওরা এমন করে ধরেছে, এবারটিই শেষ, তোমাকে আর কষ্ট দেব না। আমি শান্ত গলায় বলি, জিল, আমি সাধারণ একজন মানুষ। খুব সরল ভাষায় খুব সাধারণ জিনিস লিখি। আমাকে নিয়ে এত হৈ চৈ কেন! আমি তো ভেবেছিলাম স্ট্রাসবুর্গে অনুষ্ঠানটি করে ফিরে যাবো দেশে। মাঝখান থেকে প্যারিসটা দেখব। প্যারিস দেখারইচ্ছে আমার বহুদিনের। এইসব রেডিও টেলিভিশন এত না করে প্যারিসটা ঘুরে বেড়ালে ভাল লাগত। অথবা তোমাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে।
জিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জিলও সম্ভবত বাঁধা তার এই সংগঠনের চাকরিতে। তারও কিছু করার নেই। আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স আর আর্তে টেলিভিশন, এত খরচ করছে এরা আমার পেছনে, না হয়, যা অনুরোধ করছে, মেনেই নিলাম কিছু। কালই তো চলে যাবো। হোটেলে পৌঁছে জিল বলল, তোমাকে তিন মিনিট সময় দিলাম। এর মধ্যে তৈরি হয়ে নাও।
জিলের কাছে আবদার করে দশ মিনিট সময় নিয়ে স্নান করে একটি বালুচরি শাড়ি পরলাম। গাঢ় খয়েরি রঙের। জিলের এই রংটি খুব পছন্দ। আগেই এই শাড়িটি দেখে বলেছিল, এটি তোমাকে একদিন পরতে হবে,অন্তত আমার জন্য। শাড়িটির আঁচলে একটি মেয়ে কলসি হাতে, একটি ছেলে ঘোড়া চালাচ্ছে এসব দেখে বলেছিল, প্রেমের গল্প বুঝি!
আমি নিচে নেমে এলে জিল শাড়ির আঁচলটি হাতে নিয়ে মিষ্টি করে হাসে। চোখদুটোও হাসে তার। টেলিভিশনে গিয়ে দেখি প্রচণ্ড সব ব্যক্তিত্বের মহিলা। আমার খুব ভাল লাগে মেয়ে-সাংবাদিক আর মেয়ে-ফটোগ্রাফারদের দেখতে। আমাদের দেশে হাতে গোনা মেয়ে সাংবাদিকতার কাজ করে। করবেই বা কি! লেখাপড়া শেষ করতে না করতেই তো তাদের বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়, আর প্রভু স্বামীরা যা আদেশ করে মেয়েরা তো তাই মাথা নত করে পালন করে। পুরুষের পাশাপাশি বসে লেখালেখি করা, খবর যোগাড় করতে ছুটোছুটি করার কাজ মেয়েদের মানাবে না সিদ্ধান্তই নিয়ে নেওয়া হয়। যে মহিলাটি আমার সাক্ষাৎকার নেবেন, তিনি আমাকে বাংলায় প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ফরাসিরা ইংরেজি পছন্দ করে না। ইংরেজি জানলেও পারতপক্ষে বলতে চায় না। মাতৃভাষাটিই এদের কাছে পছন্দ। কথা বললে আমি আমার মাতৃভাষায় কথা বলব, অনুবাদক তারা যত খরচা হোক আনিয়ে নেবে, তবু আমাকে ইংরেজিতে কথা বলতে দেবে না। ইংরেজি ভাষাটি ফরাসিরা মোটেও পছন্দ করে না। ইংরেজের সঙ্গে এদের দীর্ঘ দীর্ঘ কালের বিরোধ এর পেছনে কাজ করে সম্ভবত।
কাকে ডাকবে বাংলা থেকে ফরাসি অনুবাদের জন্য? জ্যঁ শার্ল দাঁতের ডাক্তারের কাছে গেছে, আসতে পারেনি। সাড়ে ছটায় এটি প্রচার হবে, সুতরাং এক্ষুনি লাগবে। অতএব নাতালি, তুমি পারবে? নাতালি ভয়ে নীল হয়ে, তার ওইটুকু বাংলা বিদ্যে নিয়ে মোটে ভরসা পায় না। অতএব আমাকেই বাংলায় বলে বাংলাটুকুর ইংরেজি অনুবাদ লিখে দিয়ে আসতে হয়, নাতালি ও থেকে ফরাসি করে নেবে। সে রয়ে যায় টিভিতে। হোবিয়া মিনা বলবেন আমাকে নিয়ে, আমার পরই।
জিল এবার আমাকে নিয়ে গেল, প্রায় দৌড়ে, শার্লস এ লিজের ফন্যাকে। ফন্যাককে সাহিত্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বলা যায়। বই পত্র, গানের যন্ত্র, ক্যাসেট সিডি সব বিক্রি হয়, পাশাপাশি সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি হয়। প্রায়ই লেখকরা তাঁদের বই থেকে পড়েন। আন্তর্জাতিক প্রেস ফ্রিডম দিবস পালন হচ্ছে ফন্যাকে। বড় একটি প্রদর্শনী হচ্ছে। রিপোটার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স এখানে আয়োজন করেছে আলোচনা সভার। জিল বলল, তোমার এখানে ইংরেজিতেই বলতে হবে মনে হচ্ছে। জ্যঁ শার্ল তো আসতে পারছে না। বাংলা থেকে ফরাসি করার কেউ নেই। আমার ইংরেজির যে হাল, পছন্দ মত কোনও শব্দই খুঁজে পাওয়া যায় না। রেডিও টিভিতে যা হোক ফরাসিতে তক্ষুনি তক্ষুনি অনুবাদ হয়ে যায় যা বলি। কিন্তু একেবারে দর্শক শ্রোতার সামনে! একটি চেয়ারও খালি নেই। ঘরটি পুরো ভরে গেছে। ফরাসিরা ভাল ইংরেজি জানে না, এটিই আমার ভরসা। এরকম যখন ভাবছি, তখনই দেখি এক ঝাঁক বাঙালি। ঝাঁকের মধ্যে নীলরতন, পার্থপ্রতিম মজুমদার। পার্থ বাংলাদেশের ছেলে, মূকাভিনয়ে পাকা। ঢাকায় আমার সঙ্গে দেখা করতে আমার বাড়িতে গিয়েছিলেন, তখনই আলাপ। পার্থর সঙ্গে প্যারিসের অভ্যেসে হাত মেলালাম।
–একজন বাঙালি খুঁজছিলাম, আপনাকে পাওয়া গেল।
বাঙালিরা ততক্ষণে আমাকে ঘিরে ধরেছে, কবে এসেছি, কোথায় উঠেছি, কতদিন থাকব, ইত্যাদি হাজার রকম প্রশ্ন। উচ্ছঅজ্ঞসত সব।
পার্থপ্রতিম, যেন আমার হাজার বছরের বন্ধু, বারবারই বলতে লাগলেন, ‘কেন আমাদের খবর দাওনি যেদিন এলে? সেদিনই ফোন করে দেওয়া যেত না! আমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে পারতাম!’ পার্থর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোক বললেন, ‘চলুন আমাদের বাড়িতে যাবেন আজকে, একবেলা অন্তত খাবেন।’ কালই চলে যাবো শুনে ইস ইস আহা আহা করে ওঠে সবাই। কেন আগে থেকে ওরা জানল না, কোথায় আছি আমি। তাহলে তো আমাকে হোটেল থেকে তুলে নিয়ে যেতে পারতেন। আগে জানলে আমরা তো একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারতাম। এখানে বাঙালিদের ছোটখাটো সংগঠন আছে, সব সংগঠনের পরিচালকরাই চুক চুক করে দুঃখ করছেন। সকলকেই আমার বিনীত স্বরে জানাতে হল, এখন তো আর সময় নেই ভাই। কালই চলে যাবো। কেন আর কটা দিন থাকছি না। এভাবে প্যারিসে এসে তাদের বাড়িতে না গিয়ে দুটো বাঙালি খাবার না খেয়ে বিদায় নেব, এ কেমন কথা হল!
গপ্প করলে চলবে না, মঞ্চে বক্তারা বসে গেছেন। আমাকে ডাকা হচ্ছে। মঞ্চে আমাকে নিয়ে বসালেন রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্সের সভানেষনী, অনুষ্ঠানের উপস্থাপকপি রচালক। সভানেষনীর বাঁ পাশে বসনিয়ার সাংবাদিক, ডান পাশে আমি, আমার পাশে ক্যামেরুন, ক্যামেরুনের ডানে আলজেরিয়া। ফ্রান্সের লোকেরা আফ্রিকার খবর খুব ভাল রাখে। আলজেরিয়া তো বলতে গেলে ফ্রান্সের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। বসনিয়ার খবরও বেশ রাখে। কেবল ভারতবর্ষ সম্পর্কে আগ্রহ খুব নেই। জানেও না খুব বেশি কিছু।
এক এক করে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন সাংবাদিকরা। সকলেই ফরাসি ভাষায় বলছেন। আমাকেই কেবল ইংরেজিতে বলতে হবে। ইংরেজি থেকে ফরাসিতে অনুবাদ করে দেবে কেন। যেহেতু এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনুবাদ করতেই হবে, তখন বাংলা থেকেই নয় কেন। বাঙালির দলটির দিকে যেই না প্রস্তাবটি দেওয়া হল, প্রীতি সান্ন্যাল নামের এক বাঙালি মহিলা মঞ্চে এলেন আমার অনুবাদ করতে। একটি উত্তরের অনুবাদ করে তিনি দর্শকের আসনে বসা কাউকে দেখে আমার চেয়ে ভাল অনুবাদক একজনকে দিচ্ছি বলে নিজে কেটে পড়ে যাঁকে পাঠালেন, তিনি অমিতাভ চক্রবর্তী। প্রীতি সান্ন্যালের নিজের ওপর আস্থা কিছুটা কম। জিল দাঁড়িয়ে আছে, চেয়ার একটিও খালি নেই যে বসবে। বার বার তার দিকে আমার চোখ চলে যায়। জিলের চেয়ে সুদর্শন আর কোনও ফরাসিকে কি আমি এ অবদি দেখেছি! নাহ! দেখিনি। জিল গলগল করে ফরাসিতে কথা বলে, শুনতে বেশ লাগে। তার ইংরেজি বলাও বেশ মজার, বেশির ভাগ বাক্যই সে শুরু করে আই অ্যাম গোয়িং দিয়ে। আই অ্যাম গোয়িং টু কাম টু ইয়োর হোটেল, আই অ্যাম গোয়িং টু গো টু নাতালিস হাউস, আই অ্যাম গোয়িং টু বাই এ টিকেট এরকম। হঠাৎ নাতালিকে দেখি, নীলরতনকেও। নীলরতন আমার দেওয়া শার্টটি পরে এসেছে। অমিতাভ চক্রবর্তী অনর্গল আমার কানের কাছে মুখ এনে বলে যাচ্ছেন মঞ্চের বক্তারা কে কি বলছেন। বক্তাদের বক্তব্য শেষ হলে দর্শকদের মধ্য থেকে প্রশ্ন শুরু হল। মূলত ফরাসি-ভিড় থেকে প্রশ্ন। একজন জার্মান ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, ইউরোপ থেকে তাঁরা কি করে আমাকে সাহায্য করতে পারেন। আমি বললাম, দেশ ও বিদেশের যুক্তিবাদী বিবেকবান সচেতন মানুষের সহযোগিতা ছাড়া আমার পক্ষে পাসপোর্ট পাওয়া সম্ভব হত না। পশ্চিমের দেশগুলো যে দেশগুলো বাক স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারে বিশ্বাস করে, অনেকে আমার পাসপোর্ট ফেরত দেবার জন্য, আমার নিরাপত্তার জন্য, লজ্জা বইটির ওপর থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার জন্য প্রচুর চিঠি লিখেছেন। তাদের আন্দোলনের ফলেই আমি আমার পাসপোর্ট ফেরত পেয়েছি। আপনাদের কাছে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। হয়ত একদিন আমি নিরাপত্তা পাবো দেশে। হয়ত লজ্জা বইটির ওপরও আর নিষেধাজ্ঞা থাকবে না।
একসময় দেখি লাল একটি জামা পরে নাতালি ঢুকছে, জিলের নাতালি। নাতালি ঢুকেই জিলকে নিয়ে দরজার বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল। জিল কি এখন নাতালির সঙ্গে চলে যাচ্ছে কোথাও! আমার মন খারাপ হয়ে যায়। জিল, তুমি তো বলেছো নাতালির সঙ্গে তোমার গভীর কোনও প্রেম নেই! তবে যাচ্ছে! কোথায়!
মিশেল ইডেলের সংগঠনের মেয়ে তেরেসকে দেখি । মিশেল ফোন করেছিলেন হোটেলে, আমাকে নিতে আসবেন সন্ধ্যা সাতটায়। আন্তোয়ানেত ফুকের বাড়িতে নেমন্তন্ন। জিল উদয় হয়। মন ভাল হয়ে যায়। হোবিয়া মিনার হাসি-মুখটিও পলকের জন্য চোখে পড়ে। লোকটি আমার ছায়া মাড়ান না। ভাষার অসুবিধের জন্য এই দূরত্ব তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। ইচ্ছে করে ফরাসি ভাষাটি শিখে নিতে, কিন্তু কি করে সম্ভব! নাতালির সঙ্গে চেষ্টা করে দেখেছি, হয় না। জিভকে গোল করে পেঁচিয়ে গলার তল থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ ওরা বের করে, ওরকম শব্দ শত চেষ্টা করলেও আমার গলা থেকে বেরোবে বলে মনে হয় না। অনুষ্ঠান শেষ হতেই আমাকে ঘিরে ধরলো অনেকে। জার্মানি থেকে এসেছেন এক নারী সংগঠনের নেষনী। তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন জার্মানির অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার।
আমি বলে দিই, দেশে গিয়ে জানাবো আপনাকে। এখনই কথা দিতে পারছি না। অনুষ্ঠানের ফরাসি দর্শকরা আমার কাছে ভিড় করেন অটোগ্রাফ পেতে।
আপনার বই কবে বেরোবে?
সম্ভবত সেপ্টেম্বরে।
আমরা অধীর আগ্রহে বসে আছি আপনার বই পড়ব বলে।
আমি বিষণ্ন হাসি। আমার দিকে বড় মায়ায় তাকিয়ে একটি মেয়ে বলল, আপনি কি ফ্রান্সেই থাকবেন এখন থেকে?
না, আমি কাল দেশে ফিরে যাচ্ছি।
দেশে কেন ফিরবেন? ওখানে যদি আপনাকে মেরে ফেলে!
আমি দেশে ফিরছি শুনে আরও পাঁচ ছজন ফরাসি মেয়ে বিস্ময়ের ঘোরে বলতে থাকে, না না না দেশে ফিরবেন না। দেশে আপনি কি করে বেঁচে থাকবেন ফতোয়া নিয়ে! এমন একটা ফতোয়া দিয়ে দিল, আর আপনি ফেরার কথা ভাবছেন, কি করে ভাবছেন!
তাই বলে নিজের দেশ ছাড়ব! অসম্ভব।
আপনার বুঝি প্রাণের মায়া নেই? যে করেই হোক বেঁচে থাকতে হবে তো। বেঁচে না থাকলে লিখবেন কি করে!
মানুষগুলোর চোখের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা মায়া মমতাগুলো আমি অনুবাদ করে নিই।
এরপর যে কজন বাঙালি এসেছিলেন অনুষ্ঠানে, আবার ঘিরে ধরলেন আমাকে। চলুন আমাদের বাড়ি চলুন।
আজ তো পারছি না ভাই। রাতে নেমন্তন্ন আছে।
তবে কাল!
কাল চলে যাবো।
আমরা কি কিছুই করতে পারবো না আপনার জন্য?
এবার তো হল না। পরের বার এলে নিশ্চয়ই যাবো আপনাদের বাড়িতে।
পার্থ প্রতিম পরিচয় করিয়ে দিলেন শিশির ভট্টাচার্যের সঙ্গে। শিশির কালো মত খাটো মত বাচ্চা বাচ্চা চেহারার এক লোক। শিশিরকে বললাম, শুনেছি ভাল অনুবাদ করেন, আপনার কথা আমি আমার প্রকাশককে বলব, এখানকার ফরাসিদের বাংলায় আমার খুব একটা আস্থা নেই।
সকলেই খুশি হল যে বাঙালিদের কাউকে দিয়েই অনুবাদের কাজ হবে বলে। খানিক পর পার্থ আমাকে খানিকটা দূরে সরিয়ে প্রলয় রায় নামের এক লোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, প্রলয় রায় চট্টগ্রামের ছেলে। বহুদিন থেকে আছেন এদেশে। প্রলয় বেশ ভাল অনুবাদ করতে পারবে। কিছু অনুবাদও করেছে। তুলনা হয় না। কোনও বাঙালিই ওর মত ভাল ফরাসি লিখতে পারে না।
প্রলয় আর শিশির দুজনের নম্বরই পার্থর কাছ থেকে নিলাম। জ্যঁ শার্ল এর বাংলায় আমি মোটেও সন্তুষ্ট নই। প্রলয়ের নামই না হয় ক্রিশ্চান বেসের কাছে প্রস্তাব করব, ভাবি মনে মনে। এক জাপানি দাঁড়িয়ে ছিল হাঁ করে। কাছে এসে বললেন, জাপান থেকে তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান। আমি যেন কী একটা বিশাল কিছু হয়ে গেছি। কিন্তু আমি কি হয়েছি কিছু? খুব ভাল জানি যে আমি কিছুই হইনি। যে আমি, সে আমিই আছি, অবকাশের আমি, গোবেচারা আমি, খানিকটা বোকা বুদ্ধু, খানিকটা আদর্শ মানা, খানিকটা স্রোতে গা ভাসানো, কিছু বোঝা, কিছু না বোঝা মেয়ে।
জিলের সঙ্গে বাকিটা সময় কাটানো সম্ভব হয়নি। মিশেল ইডেল আর আন্তোয়ানেত ফুকের সঙ্গে মধ্যরাত অবদি কাটাতে হয়।
১. প্যারিসের ডায়রি – ০৬
এপ্রিলের চার তারিখ। আমার চলে যাবার দিন। এয়ারফ্রান্সে প্যারিস থেকে ব্যাংকক, থাই এয়ারলাইন্সে ব্যাংকক থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানে কলকাতা, কলকাতায় কদিন কাটিয়ে আবার ঢাকা। যারা আমাকে প্যারিসে এনেছেন, তাদের আজ প্যারিসের দিকে হাত নেড়ে আমার বলতে হবে, প্রিয় প্যারিস, তোমাকে বিদায়, প্রিয় প্যারিস, জ তেম। ত্রিশ্চান বেস আমার যাবার খবর শুনে হোটেলে চলে এলেন। সই করার জন্য কনট্রাক্ট ফরম এনেছেন ক্রিশ্চান। সই করার পর বললেন, পৌঁছেই যেন তাঁকে কোরানের নারী যে বইটি মাত্র লিখে শেষ করেছি, পাঠিয়ে দিই। নাতালি আমার কাপড় চোপড় সুটকেসে ভরে দিচ্ছে। অনেকের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল, হল না। সময়ের অভাবে হল না। ক্রিশ্চান বেস কে পই পই করে বলে দিয়েছি, আমার লেখা কোনও ফরাসি জানে এমন বাঙালিকে দিয়ে অনুবাদ করাবেন। ক্রিশ্চান কথা দিয়েছেন যে তিনি তাই করবেন, তবে লজ্জার অনুবাদ জ্যঁ শার্ল প্রায় শেষ করে এনেছেন, এটি নতুন করে অনুবাদ করার সম্ভবত প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই, এ কথা আমি ঠিক মেনে নিই না।
প্যারিস ছেড়ে চলে যাবো, ভাবতেই বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে। জানি না আর কখনও আসা হবে কী না প্যারিসে, হয়ত কোনওদিনই আর হবে না। অথবা হলেও এত ভালবাসা এত আদর হয়ত পাবো না।
ক্রিশ্চান বললেন, কাল তোমার আর্তে অনুষ্ঠান দেখলাম। কে ছিল তোমার অনুবাদক?
— না। ওরাই যোগাড় করে নিয়েছিল। তবে শুনেছি যে মেয়েটি অনুবাদ করেছে, ওর বাবা ফরাসি, আর মা বাঙালি। খুব ভাল বাংলা যে বলতে পারে তা নয়। শক্ত শক্ত শব্দ বুঝতে পারে বলে মনে হয়নি।
ক্রিশ্চান বলল, তোমার আসলে ইংরেজিতে বলা উচিত।
আমার ইংরেজির যে হাল! কোনওরকম কাজ চালাই। এ দিয়ে কোনও সাক্ষাৎকার চলে না। ওরাই বলে আমাকে বাংলায় বলতে।
–কী বল তোমার ইংরেজির হাল খারাপ। সেদিন দুপুরে নোভেল অবজারভেটরের জ্যঁ দানিয়েলের সঙ্গে বেশ গুছিয়ে তো বললে। তোমার লেখালেখি, তোমার সংগ্রাম। সময় পেলে তুমি বেশ সুন্দর বলতে পারো। এখন থেকে সিদ্ধান্ত নাও তুমি ইংরেজিতে দেবে যে কোনও সাক্ষাৎকার।
–দেখ, আমাদের দেশে ইংরেজি চর্চা একেবারেই নেই। মুখে বলতে গেলে দেখি অভ্যেস না থাকায় শব্দ খুঁজতে হয়।
–তোমার বক্তব্য যেন সব জায়গায়, যেখানেই কথা বলছ, স্পষ্ট হয়, সে কারণেই বলছি। কারণ অনুবাদক, ধরো হঠাৎ করে একজন অনুবাদক পেলে, তোমার চিন্তাচেতনাবিশ্বাস সম্পর্কে যার কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই, সে তোমাকে, তুমি যাই বল, ভাল বুঝতে পারবে না। অনুবাদও করতে পারবে না।
ক্রিশ্চান গম্ভীর হয়ে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছেন আমাকে। তাঁর ব্যবসাবুদ্ধি যেমন ভাল, তাঁর সহমর্মিতাও দেখার মত। সুটকেস গোছাতে গোছাতেই কথা বলছিলাম ক্রিশ্চানের সঙ্গে।
হঠাৎ পার্কার কলমটি খুঁজে পাচ্ছি না। ক্রিশ্চান ঢুকে গেল তাঁর ওই মিনিস্কার্ট পরা শরীর নিয়ে খাটের তলে, নাতালি আতি পাতি করে খুঁজছে, আর চুক চুক করে দুঃখ করছে, ক্রিশ্চান খুঁজছে আর বলছে, কি রকম রং বল, আমি দৌড়ে দোকানে গিয়ে এক্ষুনি কিনে নিয়ে আসছি। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। শেষ অবদি পাওয়া গেল কলম যে শার্টটি পরা ছিলাম, তার পকেটে।
আবারও টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের কথা ওঠালেন ক্রিশ্চান। বললেন, তোমার বিশ্বাস আর আদর্শ সম্পর্কে আমি জানি। কিন্তু আর্তের অনুষ্ঠানে তোমার বক্তব্য খুব বলিষ্ঠ মনে হয়নি। আরেকটি কথা, তুমি যখন মৌলবাদিদের বাকস্বাধীনতা বন্ধ করার জন্য প্রস্তাব কর, এর পেছনে তুমি কোনও ভাল যুক্তি দেখাতে পারো না। আমি বললাম, কেন, আমি তো বলেইছি যে মৌলবাদীরা সমাজকে পেছন দিকে টানছে। নারী পুরুষের সমান অধিকার মানে না তারা। মেয়েদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিচ্ছে, ওদের পুড়িয়ে মারছে, পাথর ছুঁড়ে মারছে। মুক্ত বুদ্ধির যে কোনও মানুষের ওপর হুমকি আসছে। ধনী আরব দেশগুলো থেকে টাকা আসে তাদের কাছে, হাতে তাদের অস্ত্র। মাদ্রাসা গড়ে উঠছে প্রচুর, আর মাদ্রাসা থেকে প্রতিবছর বেরোচ্ছে অগুনতি মৌলবাদী। এরা দেশের সর্বনাশ ছাড়া আর কিছুই করছে না। একসময় আমাদের দেশে তো ছিলই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ। সেরকম তো আবার হতে পারে!
ক্রিশ্চান, মনে হয়নি, আমার যুক্তিতে তুষ্ট। কাটিয়ে নিয়ে বললেন, অনুবাদক যেভাবে বলেছে, তাতে যুক্তিটি বলিষ্ঠ হয়নি।
আমি বুঝি যে ক্রিশ্চান গণতন্ত্রের কথা ভাবছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সকলের অধিকার থাকা উচিত রাজনীতি করার। এটা নিষিদ্ধ ওটা নিষিদ্ধ এসব শুনলে ইউরোপের মানুষ পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়নের চিত্র কল্পনা করে শিউরে ওঠে। সোভিয়েতের ভয় সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পরও যায়নি। কিন্তু মৌলবাদীরা যদি গণতন্ত্র ব্যবহার করে ক্ষমতায় এসে যায় কোনও দিন, তবে তো প্রথম যে কাজটি করবে তা হল কবর দেবে গণতন্ত্রের, কবর হয়ে যাবে মুক্তচিন্তার, বাক্ স্বাধীনতার। নির্বাচনে জেতা খুব কি কঠিন হবে ওদের জন্য! ধর্মকে ব্যবহার করছে যাচ্ছেত!ই ভাবে। অশিক্ষিত অজ্ঞ মূর্খ মানুষগুলো আল্লাহ খোদার মান রক্ষা করতে গিয়ে এদের দলে যোগ দিলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ক্ষমতায় না এসেই সরকারের আশকারা পেয়ে মৌলবাদ বিরোধী নেতাদের গলা কাটতে দ্বিধা করছে না। এরকম তো নয় যে তারা কোনও আলোচনায় যেতে চায়। আমি কলম ব্যবহার করেছি আমার মৌলবাদ বিরোধী লড়াইয়ে, মৌলবাদীরা কি আমার যুক্তি কলম ব্যবহার করে খণ্ডাতে চায়? না, তা চায় না। তারা তলোয়ার নিয়ে পথে নামে। কোমরে তাদের রাম দা। ক্রিশ্চান যদি মনে করেন গণতন্ত্র মানেই হল যে কোনও আদর্শ নিয়েই রাজনীতি করার অবাধ অধিকার, তবে ইউরোপের অনেক দেশেই তো নাৎসি রাজনীতি নিষিদ্ধ। এমনকী রাস্তায় সোয়াস্তিকার চিহ্ন নিয়ে দাঁড়ালে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তবে? এখানে গণতন্ত্র কোথায় গেল। আর গণতন্ত্রই যদি এত সবকিছুর উর্ধ্বে, তবে হিটলারের নাৎসি দল তো বিপুল ভোটেই জিতেছিল জার্মানির নির্বাচনে!হিটলার তো ক্যু করে ক্ষমতায় আসেনি।
ভাবতে ভাবতে সিগারেট ধরাই। নাতালি ধমকে বলল, সিগারেট রাখো, খেতে হবে না।
–এই শেষ।
–না, ফেলে দাও। খেও না।
নাতালির চোখে আদর, শাসন।
নীলাঞ্জনা সুন্দরীটি এত আপন হয়ে উঠছে কেন আমার! তাঁর নীল চোখে আমার জন্য ভালবাসা স্থির হয়ে আছে। কেন নাতালি আমাকে ভালবাসে! আমি বাঙালি বলে, যেহেতু সে বাংলা শিখেছে? নাকি আমার কথা পত্রিকায় ছাপা হয় বলে, আমাকে রেডিও টেলিভিশনে ডাকে বলে সে ভেবেছে আমি বিখ্যাত মানুষ, তাই? নাকি আমার ওপর ফতোয়া জারি হয়েছে বলে করুণায়? নাকি আমার কিছু পদ্যের ফরাসি অনুবাদ পড়ে তার ভাল লেগেছে বলে? কোনটি? আমি অনুমান করার চেষ্টা করি। স্থির হতে পারি না কোনও একটি কারণে। এর মধ্যে জিল চলে এসেছে, সেও গুছিয়ে নিয়ে এসেছে তার ব্যাগ। আজ সে চলে যাচ্ছে মপোঁলিও।
নাতালিকে বলি, প্যারিসের শেষ সিগারেট আমাকে খেতে দাও।
নাতালি অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, না।
নাতালিকে যত দেখি, অবাক হই। বাংলায় কবিতা লেখার ইচ্ছে তার। জিলকে বলেছিলাম নাতালি বেশ ভাল বাংলা বলে। জিল বলেছিল, তবে নিশ্চয়ই ওই নীলরতনের প্রেমে পড়েছে সে, প্রেমে পড়লেই ভাষা শেখার আগ্রহ হয়, প্রেমিকের সঙ্গে বাংলা চর্চা করছে বলেই ভাল বাংলা বলছে। অবশ্য নাতালির বেলায় তা হয়নি। ও বলেছে সেদিনই নীলরতনকে প্রথম দেখেছে। নাতালি বাংলাকে ভালবেসেই বাংলা শিখেছে, বাঙালি ছেলের প্রেমে পড়ে নয়। নীলরতনের জন্য মায়া হয়, আমাকে বড় কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছিল, ‘দিদি আমাকে তো তাড়িয়ে দেবে এ দেশ থেকে, লেখাপড়া শেষ, পাশ করে বেরোচ্ছি আর দু মাস পর, এখন তো আর থাকার উপায় নেই। আপনি যদি চেষ্টা করেন, তাহলে আমার হয়ত থাকা হবে এখানে। কারণ দেশে যে ফিরে যাবো, দেশে গিয়ে কি করব? ওখানে তো চাকরি নেই, কিছু নেই।’ নীলকে বলেছি, কিন্তু আমি কি করে চেষ্টা করব, কোথায় কার কাছে কি বলব? নীলরতন চুপ করে ছিল। কতটা অনিশ্চয়তা আর দুর্ভাবনা থেকে আমাকে অনুরোধ করেছে সে, বুঝি! জিলকে বলেছি যদি সম্ভব হয় নীলরতনকে যেন সাহায্য করে। জানিনা জিলের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে কি না। হবে না হয়ত। নীলরতন কেন প্যারিসেই থেকে যেতে চায়! আমি নীলরতন হলে দেশে ফিরে যেতে চাইতাম। নিজের দেশের জন্য যা হোক কিছু ভাল করতে চাইতাম। কিন্তু আবারও ভাবি, দেশের জন্য চাইলেই কি কিছু করা সম্ভব! নীলরতন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করে, তবে কি খুব সহজে সে শিক্ষকের চাকরিটি পাবে? হিন্দু হওয়ার অপরাধে তাকে কি দুর্ভোগ পোহাতে হবে না! হবে! মুসলমান নামের মানুষেরা যে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে না, তা নয়। আসলে ক্ষমতাসীনদের পেয়ারের লোক না হলে দুর্ভোগ পোহাতে হয়ই কোনও না কোনওভাবে। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ, এই যে বলি এত, বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলি, আসলেই কি এটি কোনও গণতন্ত্র। ভোটের বাজারে কিছু টাকা খাটিয়েই গরিবের ভোট যদি কেনা যায়, তবে তাকে গণতন্ত্র বলি কি করে! সত্যিকার গণতন্ত্র কোনওদিন আমরা পাবো না যতদিন না দারিদ্র্য মোচন হচ্ছে, যতদিন না শিক্ষার প্রসার হচ্ছে, যতদিন না সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক সচেতনতা আসছে। ততদিন পর্যন্ত কি? গণতন্ত্রের চর্চা তো চলতেই হবে নাকি কোনও একনায়ক বা একনায়িকার শাসন চাও? প্রশ্নটি ক্রিশ্চান হয়ে আমি আমাকে করি। আপাতত নিশ্চুপ থাকি আমি। গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদ মৌলবাদ এসবের মধ্যে মানবাধিকার বাক্ স্বাধীনতা ব্যক্তি স্বাধীনতা এক চিমটি করে করে দিতে থাকি আর ভাবতে থাকি। আমার ভাবনার সুতো হারিয়ে যায় নাতালির সুরে।
–আমি ঢাকায় যাবো আগস্টে।
–হ্যাঁ নিশ্চয়ই যাবে। আমার বাড়িতে থাকবে।
–আমার জন্য কিছু কবিতা পড়ে দেবে? আমি ক্যাসেটে তুলে রাখব।
নাতালি মহাখুশিতে আমার পড়া বাংলা কবিতাগুলো তুলে নেয়। নারীদ্রব্য কবিতাটি তার খুব ভাল লাগে বার বার বলল। এরপর আমার হাতদুটো ধরে সে বলল, আমার জন্য তো অনেক করলে, এবার একটি জিনিস করতে পারো আমার জন্য?
–নিশ্চয়ই করব। তোমার জন্য আমি সব করতে পারি। বল কি চাই?
–আমার জন্য তুমি সিগারেট ছাড়ো।
আমি হেসে উঠি। বলি, আমি তো ভাই ধরিনি সিগারেট যে সিগারেট ছাড়ব! এ আমার শখের খাওয়া।
জিল আমার ভারি সুটকেসটি নিয়ে নিচে নেমে যায়। আমিও নিচে নেমে আনমনে একটি সিগারেট ধরাই। নাতালি আমার হাত থেকে সিগারেট নিয়ে ফেলে দিয়ে বলল, সিগারেট খেলে কি হয় জানো?
শান্ত কণ্ঠে বলি, জানি। ক্যান্সার।
সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে শুদ্ধ বাংলায় বলল, আমার বাবা আকাশে থাকে। কেন জানো?
সিগারেটের কারণে?
হ্যাঁ। কি হয়েছিল বল তো!
ব্রংকোজেনিক কারসিনোমা। সে জানি।
জানো?
হেসে বলি, হ্যাঁ।
তারপরও খাও?
আমি ম্লান হাসি।
নাতালি তার জ সুই লিব্রে লেখা ব্রোজটি তার জামা থেকে খুলে আমার শার্টে লাগিয়ে দেয়।
চিঠি লিখবে তো!
হ্যাঁ লিখব।
নাতালির চোখ ছলছল করে।
জিল বলে, নাতালি তো আছেই তোমার সঙ্গে। তুমি না হয় এয়ারপোর্টে ওর সঙ্গে চলে যাও। আমি যাবো অন্য এয়ারপোর্টে, অরলিতে।
হেই জিল, আজ শেষ দিন, আজও পালাতে চাও!
নাতালি বলল, ও আসলে নাতালির সঙ্গে সময় কাটাতে চায়।
ঠিক বলেছো।
জিল ধমকে ওঠে, পাগল হয়েছো। আমি ওর বাড়িতে যাবো না। আমি তো অরলিতে যাবো।
তিনজন আমরা ট্যাক্সিতে উঠে বসি। জিল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, কাল রাতে খুব ইচ্ছে ছিল তোমার সঙ্গে কাটাই। কিন্তু তুমি তো চলে গেলে ওদের সঙ্গে।
–তুমিও যেতে পারতে।
–আমাকে নেমন্তন্ন করেনি, আমি যাবো কেন!
–তাতে কি!
–নাহ, তোমাদের ব্যবসায়িক কথাবার্তায় আমাকে মানাতো না।
— মোটেও ব্যবসায়িক কথাবার্তা ছিল না। ছিল নারীবাদী আলোচনা।
অনেকটা পথ গিয়ে নাতালি বলল, বিমান বন্দরে গিয়ে কী লাভ। আমার খুব খারাপ লাগে প্রিয়জনদের চলে যাওয়া দেখতে। আমাকে বরং এখানে নামিয়ে দাও। আমি সরবনে যাবো, দুদিন ক্লাস করি না।
নাতালি নেমে গেলে আমরা ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে বিমানবন্দরে যাওয়ার বাসে উঠে পড়ি। প্যারিসে মেট্রো চড়া হল, বাস চড়া হবে না কেন! তাই বাস চড়ার আবদার আমার। বাসটি সোজা বিমানবন্দর যাবে। বাসে দুজন পাশাপাশি বসি। জিল বলে, তুমি যখন বন্ধুবেষ্টিত থাকো, আমার তখন তোমার সঙ্গে থাকতে ভাল লাগে না। তুমি যখন একা থাকো, তখন আমার ভাল লাগে, দুজন বসে গল্প করতেই তো ভাল।
–কবে তুমি প্যারিসে আসবে জিল?
— জুলাইয়ের শেষ দিকে। তখন একটি বাড়ি ভাড়া নেব প্যারিসে।
— বাড়ি ভাড়া কেন? নাতালির বাড়িতেই তো থাকতে পারবে।
–আরে না। তোমাকে তো বলেছি যে নাতালির সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে যাচ্ছে।
–যাহ আমার বিশ্বাস হয় না। কেন শেষ হবে সম্পর্ক! খুব চমৎকার মেয়ে নাতালি।
–কেন তোমার বিশ্বাস হয় না? আমি কি মিথ্যে বলছি? নাতালিকে আমি ভালবাসি না।
জিল আজ আমার ঘরে ঢুকতেই বলেছিলাম, জিল কাল নাতালিকে আমি বলেছি জিলের সঙ্গে আমার একটি ব্যাপারে মিল আছে। জিল এক নাতালির সঙ্গে থাকছে, আমি থাকছি আরেক নাতালির সঙ্গে। জিল লাজুক হেসেছে। ্উদাস তাকিয়ে থাকি জানালায়। জিল বলে, তুমি যদি জুলাইয়ের আগে জার্মানিতে আসো, তবে জার্মানি থেকে সোজা চলে যাবে মঁপেলিয়েতে। ওখানে আমার বাড়িতে থাকবে। সামনে সমুদ্র। তোমার খুব ভাল লাগবে। দুজন আমরা স্পেনে বেড়াতে যাবো। স্পেন খুব সুন্দর দেশ।
মঁপেলিয়ে। মঁপেলিয়ে। জিল মঁপেলিয়ের স্বপ্নে বিভোর।
আর তা যদি না হয়!
আর যদি না হয়, তবে কী?
তুমি তো সেপ্টেম্বরে আসছোই। ক্রিশ্চান বেস তোমাকে তো নিয়ে আসছেন তোমার বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে। তখন তো আমাকে চিনবেই না। বলবে জিল, কোন জিল? জিল নামে কাউকে তো চিনি না।
জিলের পেটে কনুইয়ের গুঁতো পড়ে, বাজে বোকো না তো!
—বাজে বকছি না। যা সত্যি তাই বলছি। আমি দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি তোমাকে ঘিরে থাকবে সাংবাদিকরা, প্রকাশকরা। এডিশন স্টক ফ্রান্সের খুব বড় প্রকাশনী। তাছাড়া ক্রিশ্চান বেসের তো টাকার অভাব নেই। ওকে বোলো তোমাকে যেন ক্রিয়োঁতে রাখে। বলবে ক্রিয়োঁ ছাড়া আমি থাকব না। তখন ক্রিশ্চান কিছুতেই না বলতে পারবে না। তাছাড়া তার লোক দেখানোও হবে, বলবে দেখ দেখ আমার লেখককে আমি ফ্রান্সের সবচেয়ে দামি হোটেলে রেখেছি। এটা তার প্রচারের কাজেও দেবে। ক্রিয়োঁতে যদি থাকো, আর জিল নামের এই বেচারাকে যদি চিনতেই পারো, তবে এরকম টি শার্ট পরে তোমার সঙ্গে দেখা করতে গেলে সোজা বলে দেবে, সুট টাই পরে এসো, তাছাড়া দেখা হবে না।
—না জিল। বড় বড় হোটেলে আমার থাকতে ইচ্ছে করে না। আমার ইচ্ছে করে খুব সাধারণ ভাবে থাকি আর ঘুরে ঘুরে জীবন দেখি মানুষের। পুরো জগতটা দেখি। মানুষের চেয়ে আকর্ষণীয় আর কী আছে। বিশাল দামি হোটেলে থেকে কি আমি মানুষের সত্যিকার জীবন দেখতে পারি!
জিল মাথা নাড়ে। ঠিক বলেছো।
বিমান বন্দরে নেমে আমার সুটকেসখানি ট্রলিতে উঠিয়ে ঠেলছিল যখন, জিলকে অপলক দেখছিলাম। জিলের জন্য আমার হৃদয়ে রিন রিন করে একটি বীণা বাজে, বেজেই চলে।
যখন বিমানের পথে যাবো, জিল দাঁড়ায় আমার মুখোমুখি। বলে, আমি তোমাকে চিঠি লিখব। তুমি অবশ্যই অবশ্যই লিখবে। মনে থাকবে তো!
বিষণ্নতার ওপাশ থেকে আমি মাথা নাড়ি। লিখব।
বিদায় বলেছি। চলে যাচ্ছি। জিল বলে, আর পাঁচমিনিট থাকো। মনে মনে বলি, কী হবে আর এই পাঁচ মিনিটে?
জিল হঠাৎ আমাকে আলতো করে জড়িয়ে দু গালে গাল ছুঁইয়ে চুমু খেলো। এ ফরাসিদের অভ্যেস। সবার সঙ্গে ফরাসিরা এই করে। এমনকী একদিনের পরিচয়েও করে। তবুও জিলের এই স্পর্শ, এই চুম্বন আমাকে অদ্ভুত এক ভাল লাগা দেয়। জিলের হাত ছুঁয়ে বলি, কষ্ট ছুঁয়ে কণ্ঠ খানিক কাঁপে, বলি, যাই।
চলমান সিঁড়ি যখন আমাকে ক্রমশ এক একাকীত্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, পেছনে ফিরে আর দেখিনি জিল দাঁড়িয়ে আছে কি নেই।
২. তাণ্ডব – ০১
ডায়রি লেখার অভ্যেস আমার মোটেও নেই। নতুন বছরের আগে আগে বেশ অনেক ডায়রি মেলে। প্রতিটি নতুন বছর আসার আগে ভাবি নিয়মিত রোজনামচা লিখব। এমন নয় যে শুরু করি না। প্রথম দিন লিখতে গিয়ে পুরো পাতা ভরে গেল, এমনকী মার্জিনেও লিখতে হল, এত কথা মনে। দ্বিতীয় দিনেও তাই। তৃতীয় দিনে মার্জিনে লেখার প্রয়োজন হল না। চতুর্থ দিনে পাতা অর্ধেক ভরল। পঞ্চম দিনে ভুলে গেছি লিখতে। ষষ্ঠ দিনের দিন বসে পঞ্চম আর ষষ্ঠ দুদিনের কথা লিখতে গিয়ে দেখা যায় কিছু খুঁজে পাচ্ছি না লেখার। অর্ধেকের চেয়ে কম ভরল পাতা। এরপর পুরো তিন দিন রোজনামচা লেখার কথা বেমালুম ভুলে বসে থাকি। হঠাৎ তিন দিন পর দুটো বাক্য লেখার পর তৃতীয় বাক্যটি অসমাপ্ত রেখে তখনকার জন্য ডায়রির চেয়ে অধিক জরুরি কোনও একটি বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ক্রমে ক্রমে ডায়রির খাতাটির ওপর আরও বই খাতা জমে খাতাটি অদৃশ্য হয়ে থাকে কয়েক সপ্তাহ। তার পর একদিন টেবিল ঝেড়ে মুছে গোছাতে গিয়ে ধুলোর আস্তর জমে ওঠা ডায়রিটি হাতে পড়তে এক ঝলক আলো নাচে চোখে, মনে মনে বলি জ্ঞওহ তাই তো, আমার তো কথা ছিল প্রতিদিন এতে লিখব।’ কথা তো কত কিছুই থাকে। কটি কথা আর মানা হয়! টেবিল শেষ পর্যন্ত গোছানো হয় না, ডায়রির পাতা উল্টে উল্টে লেখাগুলো পড়ি। পড়তে পড়তে ভাবি, এখন থেকে বাকি দিনগুলোর কথা লিখে রাখব, জীবনের কত কথা ভুলে যাচ্ছি দিন দিন । যেদিন মনে হল, সেদিনের কথা দু ছষেন লিখে রেখে দিই, এর পর দিন লেখা আর হয় না। ভাবি এক সময় লেখা যাবে, এ আর এমন কী! মনে তো আছেই সব কিছু। মনে থাকবে। যে সব কাণ্ড ঘটে গেল, তা কি আর ভোলার মত। কিন্তু, আমার মস্তিষ্কটি আমার সঙ্গে প্রতারণা করে খুব। যে ঘটনাটি কখনও ভোলার নয় বলে বিশ্বাস করি, সেটিই কদিন পর মনেই পড়ে না কখনও ঘটেছিল। মন এক আশ্চর্য জিনিস। কোনও এক দুপুরে একটি লাল জামা পরে জামগাছের তলে দাঁড়িয়ে জাম খাচ্ছিল!ম, সেটি স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু কোন বছর আমি ডাক্তারি পাশ করেছি, সেটি দিব্যি ভুলে বসে আছি, এর ওর কাছে জিজ্ঞেস করতে হয়। প্রয়োজনের কথাটি মনে থাকে না, অপ্রয়োজনীয় কথায় মন বোঝাই হয়ে থাকে। মন জিনিসটি অদ্ভুত। কী জিনিস মন নেবে, কী নেবে না, তা আমার সাধ্য নেই অনুমান করি।
প্যারিসের দিনগুলির কিছু কিছু কথা জানি না কি কারণে লিখে রেখেছিলাম। কলকাতার দিনগুলির গল্প লিখে রাখলে সে গল্প শেষ হত না সহজে। কলকাতা প্যারিস নয়, কলকাতা আমাকে চেনে বেশি, প্যারিসের চেয়ে অনেক আপন এই কলকাতা, কলকাতা আমাকে নির্ভুল অনুবাদ করে। সবচেয়ে বড় কথা কলকাতাকে কখনও আমার বিদেশ বলে মনে হয় না। কলকাতায় পৌঁছে দেশে ফেরার মত আনন্দ হয় আমার। হোটেলে পৌঁছে সুটকেসটা রেখে বেরিয়ে যাবো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে এরকম ইচ্ছে নিয়ে হোটেলের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি ঘরের দরজায় লোহা লককর লাগানো, দরজার কাছে পুলিশ বসা।
–এ কী রে বাবা, এসব কেন?
–মেটাল ডিটেকটর লাগানো হয়েছে। এ তোমার নিরাপত্তার জন্য।
–কলকাতায় আমাকে কে কি করবে? কলকাতার মত নিরাপদ জায়গা পৃথিবীর আর কোথায় আছে?
–কলকাতায় মুসলমান মৌলবাদীর সংখ্যা কম নয়, তাদের মনে কী আছে কে জানে, সাবধানে থাকা ভাল।
মেটাল ডিটেকটর, পুলিশ পাহারা এসব আমাকে এমন লজ্জায় ফেলে যে মুখ গুঁজে বসে থাকি ঘরে। যেদিকে দু চোখ যায় সেদিকে যাবার, টই টই করে বাইরে ঘুরে বেড়াবার ইচ্ছেজ্ঞটর পায়ে একটি রূপোর শেকল পরানো হয়েছে। কিন্তু শেকল আমার ভাল লাগবে কেন! পুলিশের দরকার নেই আমার, এ কথাটি জোর গলায় বলার পরও কেউ আমার কথা মানলেন না। দরজার পুলিশদের আমি চাইলেও বিদেয় করতে পারি না।
আমার কলকাতায় থাকার আয়োজনটি আনন্দবাজার থেকে করা হয়েছে। যেদিন পত্রিকা আপিসে যাই চেনা পরিচিতদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য, অভীক সরকারের সঙ্গে দেখা হয়। খুব ব্যস্ত মানুষ তিনি। গণ্ডা গণ্ডা পত্রিকার মালিক হলে ব্যস্ততা থাকেই। অভীক সরকারের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা কখনও হয় না, সম্ভব নয়। তাঁর সময় নেই। দুমিনিট কী তিনমিনিটের জন্য তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় পাওয়াটাই সৌভাগ্য, সেটিরই ব্যবস্থা করতে অনেকদিন লেগে যায়। অভীক সরকার আমাকে একটি পরামর্শ দেন, কোনও সাংবাদিকের সঙ্গে যেন কথা না বলি। এদিকে কিন্তু সাংবাদিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, যেন আর কোনও কাজ নেই জগত সংসারে, এক আমার সঙ্গে কথা বলাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। আমার ওপর এমন আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার মূল কারণটি হল ফতোয়া। পবিত্র কোরান ও মহানবী হযরত মুহম্মদ সম্পর্কে আমার বইগুলোতে যেসব কথা আছে, সেসব পছন্দ হয়নি বলে সিলেটের হাবীবুর রহমান আমার মাথার মূল্য ঘোষণা করেছেন। এছাড়া কলকাতায় আমি এখন জনপ্রিয় এক লেখক, আমার লজ্জা বইটি নিয়ে বিতর্ক চলেছে বছর ভর। এত সব কারণের পর সাংবাদিকরা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে না এ ভাবাই যায় না। বেশি কিছু নয়, একটি সাক্ষাৎকার চায় তারা, আধ ঘন্টা না হলে কুড়ি মিনিট, তা না হলেও অন্তত পাঁচ মিনিট। কিন্তু গণহারে সকলকে বিদেয় করা হল। কী বলতে আবার কী বলে ফেলি, কী লিখতে তারা আবার কী লিখে ফেলে, ওদিকে বাংলাদেশের হাওয়া তেতে আছে আগে থেকেই, সুতরাং মৌলবাদী থেকে তো সাবধান থাকতেই হবে, সাংবাদিক থেকেও সাবধান।
একদিন টেলিভিশনের লোক এল, সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার সাক্ষাৎকার নেবেন। তাঁকে না বলে দিই কী করে! আনন্দবাজারের কর্তারাও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম শুনলে না বলতে পারেন না। আমি শরমে মরে যাই, আমি তো এত বড় হইনি যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার সাক্ষাৎকার নেবেন! কিন্তু তিনি যখন নেবেনই, এবং আমার সাধ্য নেই তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া, অতএব প্রশ্নোত্তর (আমি কি জানি নাকি সব প্রশ্নের উত্তর!) বা সাক্ষাৎকারের মত না হয়ে আমিই প্রস্তাব করলাম এটি একটি আড্ডা হতে পারে। হল। দুই লেখকের আলাপচারিতা, এভাবেই ব্যাপারটিকে ধরে নেওয়া হল। কেবল তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ই বন্ধু নন, সাংবাদিকদের মধ্যেও তো বন্ধু আছেন, তাঁদের যখন একের পর এক তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, বড় অপ্রতিভ বোধ করছিলাম। কতদিন পর দেখা, সাক্ষাৎকার না হোক, দুটো কথা হোক না! কবি গৌতম ঘোষ দস্তিদার প্রতিদিন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করছেন, চোখের সামনে তাঁকেও তাড়ানো হল। বাহারউদ্দিনকে তো নিচ তলা থেকে ওপরে উঠতেই দেওয়া হয় নি। এ কি কাণ্ড। বন্ধুরাই তো তবে শষনু হয়ে যাবে! এভাবে গণহারে তাড়ানো হচ্ছে সাংবাদিকদের! গৌতম ঘোষ দস্তিদার, যে আমার বিষম প্রশংসা করে লজ্জা বইটির সমালোচনা লিখেছিলেন, তিনিই কিন্তু এরপর চোখ উল্টে দিলেন। এ নিতান্তই ভুল বোঝাবুঝি। সাক্ষাৎকার না দিলে পত্রিকায় আমার সম্পর্কে লেখালেখি বন্ধ থাকবে, তা তো নয়, বরং বানিয়ে লেখা হবে। কথা বললে বরং বানানো গল্প থেকে নিস্তার পাওয়া যায়। নিখিল সরকারকে জানাই ঘটনা। তিনি বললেন, দুএকটি ভাল পত্রিকায় তাহলে দাও সাক্ষাৎকার। টাইমস অব ইণ্ডিয়া, টেলিগ্রাফ। স্টেটসম্যানও যোগ হল। ফোন আসছে মিনিট পর পর, অন্যান্য সাংবাদিকরা পাগল হয়ে যাচ্ছেন। দিল্লি বোম্বে থেকে এসে বসে আছেন। মায়া তাঁদের জন্যও হয়। হাতে গোনা জিনিস আর হাতে গোনার মধ্যে থাকে না। সাংবাদিকদের সঙ্গে একই রকম আলোচনা আর তাঁদের প্রায় একই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। ক্লান্তি কাটে বন্ধুদের সঙ্গে সাহিত্যিক আলোচনা আর আড্ডায়। হোসেনুর রহমান কলকাতা ক্লাবে নিয়ে গেলেন একদিন, ওখানে তাঁর লেখক বুদ্ধিজীবী বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ হল। হোসেনুর রহমান ঢাকায় আমার বাড়ি গিয়েছিলেন একবার, তখনই তাঁর সঙ্গে পরিচয়। ঢাকা শহরে দিব্যি তিনি ধুতি পরে ঘুরে বেরিয়েছেন। কলকাতার যে কজন মুসলমান নামের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে আমার, সকলকেই দেখেছি জাত ধর্ম না মানা মানুষ, বড় গৌরব বোধ করি তাঁদের নিয়ে। যে ইলা মিত্রকে কোনওদিন দূর থেকে দেখারও আমার সৌভাগ্য হবে বলে ভাবিনি, সেই ইলা মিত্র হঠাৎ একদিন হোটেলে এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে, অনেকক্ষণ ছিলেন, মন খুলে কথা বলতে পারিনি, একের পর এক সাক্ষাৎপ্রার্থী এসে ভিড় করলে কথা কারও সঙ্গে ঠিক হয় না। দশ রকম মানুষের সঙ্গে একই সঙ্গে কথা বলা যায় কি! রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, নারীবাদী, শিল্পী, অনুরাগী পাঠক, এই পাঠকদের মধ্যে ব্যবসায়ী থেকে বিজ্ঞানী সকলেই আছেন– একজনের সঙ্গে কিছু কথা হল তো আরেকজনের সঙ্গে হল না। আমার ইচ্ছে করে সবার সঙ্গে কথা বলতে। কাউকে আমার ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে না। কত কিছু জানার আছে শেখার আছে ওঁদের থেকে। ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতাগুলো, জীবনদর্শনগুলো শুনতে ইচ্ছে করে। নারীবাদী লেখিকা মৈষেনয়ী চট্টোপাধ্যায় আমাকে অবাক করলেন আমাকে জড়িয়ে ধরে, ভেবেছিলাম তিনি বুঝি আমার মুখদর্শন কোনওদিন করবেন না। বললেন তিনিও পথে নেমেছেন আমার সমর্থনে। অন্নদাশংকর রায়ের বাড়িতে গেলাম এক সন্ধেয়, ওখানে অপেক্ষা করছিলেন অপরাজিতা গোপ্পীসহ তাঁর দল। সকলেই দেখা করতে চান, সকলেই কথা বলতে চান। কিন্তু সময়ের অভাবে কারও সঙ্গে খুব বেশি কথা বলা হয় না। এক রাতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে নেমন্তন্ন, সৌমিত্র মিত্র, মুনমুন মিত্র, বাদল বসু, কুমকুম বসু সহ খানা পানা গানা ভানায় রাত গভীর হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মদ খেতে খেতে হাত মাথা নেড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে থাকেন একের পর এক। গলাটা যেমন তেমন, সুর ভাল। স্বাতী, সুনীলের স্ত্রী বলেন, সুনীল তো রবীন্দ্রসঙ্গীত বানায়, কেউ ধরতেও পারে না। তা ঠিক, কত আর মুখস্ত থাকে সব গানের সব কলি, কোথাও ভুলে গেলে গান থামিয়ে না দিয়ে তিনি বানিয়ে গেয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে কী ধরনের শব্দ ব্যবহার করতেন, তা তো খুব অজানা নয়! ঘটে রবিজ্ঞান কিছু থাকলে য়চ্ছন্দে চালিয়ে নেওয়া যায়। কলেজের পরীক্ষার খাতাতেও রবীন্দ্রনাথ এই লিখেছেন সেই লিখেছেন বলে পাতার পর পাতা নিজের কথা লিখে যেতেন। কোন পরীক্ষকের সময় আছে খুঁজে দেখার রবীন্দ্রনাথ তাঁর কোন বইয়ে কোন কথাটি লিখেছিলেন! কেবল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্য সময় খরচ করে ফেললেই তো চলে না। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাড়িতে একবার যেতেই হয়। যাই। নিখিল সরকারের বাড়িতে নেমন্তন্ন, ওখানে শান্ত হয়ে বসো, ধীরে সুস্থে কথা বলো, লেখালেখি কেমন হচ্ছে বলো, দেশের অবস্থা বলো, দেশের বন্ধুরা এই দুঃসময়ে পাশে আছে কী না বলো। জীবনের সব কথা খুলে বলি নিখিল সরকারকে। তিনি আপন। খুব আপন। এত আপন আমার আর কাউকে মনে হয় না। আসলে আপন হতে গেলে আত্মীয় হতে হয় না। না হয়েও নিজের বাবার চেয়ে ভাইয়ের চেয়ে আপন হতে পারে কেউ কেউ। নিখিল সরকারের একটি ছেলে ছিল, পাপু নাম। পাপু যখন তার মাত্র আট বছর বয়স, রাস্তায় খেলতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছে। অসম্ভব প্রতিভাবান ছেলে ছিল পাপু। ওই বাচ্চা বয়সেই ছবি আঁকত, ছড়া লিখত। আজও মীরা সরকার, নিখিল সরকারের স্ত্রী পাপুর কথা ভেবে চোখের জল ফেলেন, প্রতিদিন। প্রতিদিন তিনি দেয়ালে পাপুর ছবি আর পাপুর আঁকা ছবিগুলোর ধুলো নিজের আঁচল দিয়ে মোছেন। এখনও। এখনও প্রদীপ জ্বেলে দেন প্রতি সন্ধেবেলা পাপুর ছবির সামনে। হ্যাঁ এখনও। মীরা সরকারের বেদনা আমাকে এমনই স্পর্শ করেছিল যে একদিন বলেছিলাম, ধরে নিন আমিই আপনাদের পাপু, পাপু তো বেঁচে থাকলে আমার বয়সীই হত। পাপুর লেখা ছড়া আর ছবির একটি বই জ্ঞানকোষ প্রকাশনীকে দিয়ে বাংলাদেশে বের করেছি। বইটি নিখিল সরকারের হাতে দিয়ে আমার আনন্দ হয় খুব। নিখিল সরকার, ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার ছেলে এখন কলকাতা বিশেষজ্ঞ, অনেকগুলো বই লিখেছেন কেবল কলকাতা নিয়েই। যত নিখিল সরকারকে দেখি, তত আমি মুগ্ধ হই। বাড়িভর্তি বই, পড়ছেন, কেবল পড়ছেন। নানা বিষয়ে আগ্রহ তাঁর। দেশি বিদেশি ইতিহাস ভূগোল সাহিত্য শিল্পকলার কোনও ভাল বইএর নাম শুনলেই তিনি তা যে করেই হোক যোগাড় করে পড়ে নেন। তাঁর এই একটিই নেশা, পড়া। নিখিল সরকারের কাছে এলে নিজের অজ্ঞানতা মূর্খতা দাঁত মেলে প্রকাশিত হয়, তবু তিনি আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেন না। মহীরূহর পাশে তুচ্ছ তৃণ, তবু আমি ভালবাসা পাই তাঁর। ভালবাসা পেয়েছি অন্নদাশংকর রায়ের, শিবনারায়ণ রায়ের, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের। নিজের সৌভাগ্যের দিকে মাঝে মাঝে বড় বিস্ময়-চোখে তাকাই। সবই অলীক বলে মনে হয়, যেন সত্যি নয়, যেন এ ঘটছে না, যেন এ কেবলই একটি স্বপ্ন। জেগে দেখব আমি সেই আমি, লোকের থু থু খাচ্ছি, লাথি খাচ্ছি, ঘৃণা আর নিন্দার কাদার তলে অর্ধেক ডুবে আছি। বাংলাদেশের জন্য নিখিল সরকারের অদ্ভুত এক ভালবাসা কাজ করে। বাংলাদেশের ভাল সাহিত্যিকরা যেন আনন্দ পুরস্কার পান, সে ব্যবস্থা তিনি তৈরি করে দিতে চান। ডক্টর আনিসুজ্জামানকে পুরস্কার কমিটির সদস্য করার পেছনে তিনিই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ঐতিহ্যের অঙ্গীকার নামে অনেকগুলো অসাধারণ ক্যাসেট করার জন্য যে বছর নরেন বিশ্বাস এবং আনিসুজ্জামানকে আনন্দ পুরস্কার দেবার সিদ্ধান্ত হল, এক ঝড়জলের রাতে বহু কষ্টে বাড়ি খুঁজে খুঁজে সুখবরটি দিয়ে এসেছিলাম নরেন বিশ্বাসকে। যেবার শামসুর রাহমান পেলেন, সেবার যে কী ভীষণ আনন্দ হয়েছিল! দৌড়োদৌড়ি লেগে গেল আমার,খবর নিচ্ছি, দিচ্ছি। শামসুর রাহমানের পাসপোর্ট নাও, ভিসা কর। বিমান বন্দরে পৌঁছে দিয়ে এসো। তখন নিজের পাসপোর্টটি থাকলে আনন্দ পুরস্কার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঠিকই চলে আসতাম কলকাতায়। তিনি যোগ্য এই পুরস্কার পাওয়ার। আমি যে এ পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ছিলাম না, সে আমি জানি। আনন্দ পুরস্কার পাওয়ার আনন্দ যত ছিল, এটি পাওয়ার লজ্জা আমার কিছু কম ছিল না। আনন্দ পুরস্কার নয়, এই পশ্চিমবঙ্গে আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া কিছু অসামান্য মানুষের স্নেহ আর ভালবাসা। এটি অমূল্য সম্পদ। আনন্দ পুরস্কারের টাকা খরচ হয়ে যাবে হাবিজাবিতে, পুরস্কারের সনদ ধূসর হতে থাকবে দিন দিন, কিন্তু ভালবাসা থেকে যাবে, বন্ধুত্ব উজ্জ্বল হতে থাকবে যত দিন যাবে।
স্টেটসম্যানে আমার সাক্ষাৎকারটি যেদিন ছাপা হল, সেদিন সকালেই নিখিল সরকার আমার হোটেলে ফোন করলেন। বেশ রুষ্ট হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি স্টেটসম্যানের সাংবাদিককে বলেছো যে তুমি কোরান সংশোধন করতে চাও?
— না তো!
–লিখেছে তো!
–কি বলছেন এসব! কোরান সংশোধন? কোরান আবার সংশোধন করা যায় নাকি? এরকম উদ্ভট কথা আমার মাথায় কোনওদিন আসেনি। বলার প্রশ্ন ওঠে না। আমি কোরান বিশ্বাস করি না, আমি কেন এর সংশোধন চাইব! কোরান বিশ্বাস করলে তো কোরান সংশোধনের প্রশ্ন আসে।
–বলনি, তাহলে লিখল কেন? নিশ্চয়ই এধরনের কিছু বলেছো!
–শরিয়া আইনের কথা বলেছিলাম। না এর সংশোধন চাইনি। কারণ সংশোধনে কাজের কাজ সত্যিকার হয় না। বলেছিলাম শরিয়া আইন পাল্টাতে চাই। মানে একে বিদেয় করতে চাই। এই আইনের বদলে নারী পুরুষে সমান অধিকার আছে এমন আইনের কথা বলেছিলাম।
–কী বলতে যে কী বল!
–কী বলতে কী নয়। আমি যা বলেছি, স্পষ্ট করে বলেছি। এটা কোনও নতুন কথা নয়। এ কথা আমি দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছি। লিখে আসছি। আমি নিশ্চিত, যে মেয়েটি সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিল, সে জানেনা কোরান আর শরিয়ার মধ্যে পার্থক্য। শরিয়া বলতে সে কোরান বুঝেছে।
–যাই হোক, দেরি কোরো না। এক্ষুনি একটা সংশোধনী পাঠিয়ে দাও।
–এরকম কত ভুল লেখে পত্রিকায়, তার জন্য সংশোধনী তো কোনওদিন পাঠাইনি!
–এ যে সে ভুল নয়। এই মন্তব্য নিয়ে বিপদ হতে পারে।
দেরি না করে নিখিল সরকারের আপিসে গিয়ে স্টেটসম্যান সম্পাদকের কাছে চিঠি লিখে দিই যে আমি কোরান সংশোধনের কথা বলিনি, এ কথা বলার প্রশ্নও ওঠে না কারণ আমি ধর্মে বিশ্বাস করি না। সব ধর্মগ্রন্থই আমি মনে করি এ যুগের জন্য অচল। সব রকম ধর্মীয় আইন সরিয়ে, যেহেতু ধর্মীয় আইনে নারী তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্যহীন একটি আইন ব্যবস্থার দাবি আমি দীর্ঘ দিন থেকে করছি। ধর্মই যদি না মানি, তবে কোরান সংশোধনের বিষয়টি সম্পূর্ণই অপ্রাসঙ্গিক। — এটি লিখে আমার স্বস্তি হয়। স্টেটসম্যানের লেখাটি পড়ার পর সত্যি আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, একটি ভুল বাক্য আমাকে কী রকম আস্তিক বানিয়ে ছাড়ল। ধর্মে বিশ্বাস করলেই তো প্রশ্ন আসে ধর্মগ্রন্থ সংশোধনের। একটু পাল্টে পুল্টে একে মেনে চল, একে মাথায় তুলে রাখো। ছিঃ, আমি কি তাই বিশ্বাস করি নাকি! এতকাল ধরে তবে কিসের সংগ্রাম করছি আমি! আমি কি ক্রমাগতই বলে চলছি না যে পুরুষতন্ত্র আর ধর্মের শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা না পর্যন্ত মেয়েদের সত্যিকার মুক্তি নেই!
আবৃত্তিলোক থেকে একটি অনুষ্ঠান করা হল, সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান বলা যায় একে। কবিতা পাঠ হবে। কে কবিতা পড়বে? আমি। আর কেউ? না, আর কেউ নয়, একা আমি। এর কোনও মানে হয়! ওঁরা বললেন, মানে হয়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় বসলেন আমার বামে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ডানে। আপনারাও পড়ুন কবিতা, আমি কাতর অনুরোধ করি। না, আজ আমরা তোমার কবিতা শুনব। শক্তি বলেন। আমি সংকোচে মরি। বাংলা সাহিত্যের দুজন শ্রেষ্ঠ কবির মাঝখানে বসে কবিতা পড়তে যে মনের শক্তি লাগে, সেটি আমার নেই। নেই, তবু বসতে হয় কবিতা পড়তে। মুখে পড়ছি কবিতা আর মনে মনে বলছি ধরণী দ্বিধা হও। ধরণী দ্বিধা হয়নি। আমাকে বোধহয় আকাশে ছুঁড়ে না দিয়ে ধরণীর শান্তি নেই। কবিতা পাঠের পর খাওয়া দাওয়া, খাওয়া দাওয়ার আগে অবশ্য চিরাচরিত মদ্যপান। সন্ধের পর এই মদ্যপানটি কলকাতার উμচজ্ঞবত্ত আর মধ্যবিত্তের অনেকটা নিয়মিত ব্যাপার। ঘরে ঘরে মদ নিয়ে বসে যাচ্ছেন স্বামী, এমনকী স্ত্রীও। অতিথি এলে তো কথাই নেই, আর কিছু না চলুক, মদ চলবেই। সন্ধের অতিথিকে ঢাকার শিল্পাঙ্গনের মধ্যবিত্তরা সম্ভবত এখনও চা দিয়েই আপ্যায়ন করেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় সামান্য মদ্যপান করেই, লক্ষ্য করি, আমার পেছন পেছন হাঁটছেন আর বলছেন, তসলিমা তোমাকে আমি এত ভালবাসি কেন, বল তো! এই সেরেছে। এই তুচ্ছ মানুষটিকে এত আদর যত্ন করা হচ্ছে, এমনকী আকাশে তোলা হচ্ছে, তারপর কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় যদি এখন এই ভরা আসরে এমন হুট করে আমার প্রেমে পড়ে যান, তবে এত আমি সামলাবো কি করে! কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। লজ্জায় আমি কোথায় মুখ লুকোবো তার জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না। আমি শক্তিদা কিছু খাবেন, আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসি, বলে তাঁর পাশ থেকে দ্রুত সরে যাই, যেন এর মধ্যে তিনি তাঁর প্রেমকে আপাতত স্থগিত রাখার প্রয়াস পান। তাঁর জন্য খাবার আনতে যাই, যেন মুখে খাবার পুরতেই তিনি ব্যস্ত থাকেন, যেন প্রেমের বাক্য আওড়ানোর কোনও সময় তাঁর না জোটে। কিন্তু পেছন পেছন আবার তিনি, ফিসফিস করে বলছেন, তোমাকে কেন এত ভালবাসি আমি! খাবারের থালাটি তাঁর হাতে দিই, তিনি বাধ্য শিশুর মত বসে খেতে শুরু করলেন। লক্ষ করি ঠিকমত তিনি খেতে পাচ্ছেন না, খাবারগুলো মুখে তুলতে গেলে ছড়িয়ে পড়ছে এদিক ওদিক। মীণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, শক্তির স্ত্রী ছিলেন খানিকটা দূরে। তাঁর কাছেই দৌড়ে যাই, বৌদি, শিগগিরি আসুন, শক্তিদা কেমন যেন করছেন। খেতে পাচ্ছেন না।
ও কিছু না! বলে মীণাক্ষী যার সঙ্গে মন দিয়ে গল্প করছিলেন, করতে লাগলেন। শক্তির কেমন করাকে তিনি মোটে পাত্তাই দিলেন না। আমি এদিকে মহা মুশকিলে পড়েছি। একা আমি শক্তির প্রেম সামাল দিতে পারছি না। তিনি তো খাওয়া দাওয়া ফেলে আবার আমাকে বলতে শুরু করেছেন যে তিনি আমাকে খুব ভালবাসেন। কেন আমাকে তিনি এত ভালবাসেন, তা বারবারই আমাকে জিজ্ঞেস করছেন। আমি কি করে জানব তা! আমার কাছে তো উত্তর নেই। এ এমনই এক অস্বস্তিকর ব্যাপার যে আমি না পারছি বসে বসে শুনতে তাঁর প্রেমের প্রলাপ, না পারছি কাউকে বলতে। এমন বোকা কি যেখানে সেখানে মেলে! বুঝতে আমার দুদিন লেগেছে যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় সত্যি সত্যিই আমার প্রেমে পড়েননি। পেটে মদ পড়লে তিনি একটু উল্টো পাল্টা বকেন, এই যা।
কলকাতায় সময় ফুরোতে থাকে দ্রুত, খুব দ্রুত। ইচ্ছে করে আঁচলের খুঁটে বেঁধে রাখি দুরন্ত সময়টিকে, পারি না। সময় কর্পুরের মত হাওয়ায় উড়ে যায়। দেশে ফিরে যাওয়ার আগে আগে কলকাতায় সময় সত্যিই দ্রুত ফুরোয়। কলকাতাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না, কিন্তু যেতে হয়।
ঢাকায় ফেরার পর দেখি তাণ্ডব শুরু হয়েছে সারা দেশে। স্টেটসম্যান পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছে বাংলাদেশের পত্রিকায়। আমি কোরান সংশোধন করতে চাই, এ খবরটি ফলাও করে প্রচার করে মৌলবাদীরা এক ভয়ংকর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ হচ্ছে কি! আমি তো কোরান সংশোধনের কথা বলিনি। আমার কথা কে শোনে! ভেবেছিলাম লজ্জা বাজেয়াপ্ত হওয়ার পর মৌলবাদীদের পালে যে হাওয়া লেগেছিল, ফতোয়া জারির পর সরকারের নিষিক্রয়তা যেমন উসকে দিয়েছিল আগুন, সে হাওয়ার জোর, সে আগুনের তাপ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কমেওছিল কিছু। পুলিশ পাহারাও অনেকটা আছে আছে নেই নেই রকম ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে হাওয়া ক্ষিপ্ত, তপ্ত, নতুন করে দ্বিগুণ তেজে ত্রিগুণ বেগে ধাবিত হচ্ছে! আমার কত বড় স্পর্ধা যে আমি পবিত্র কোরান শরীফে কাঁটাছেড়া করতে চাইছি, স্বয়ং আল্লাহর বাণী সংশোধন করতে চাইছি! এর মানে এই যে আমি মনে করছি আল্লাহ সঠিক কথা বলেননি, আল্লাহ ভুল বলেছেন, আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখি, আমি আল্লাহর চেয়ে নিজেকে বেশি ক্ষমতাবান মনে করছি। মৌলবাদীদের কাছে এর চেয়ে বড় অস্ত্র আর কী থাকতে পারে! দেশী বিদেশি সাংবাদিকদের ভিড়, প্রশ্নের পর প্রশ্ন, আদৌ কি আমি বলেছিলাম কোরান সংশোধনের কথা? আমি কি পাগল হয়েছি যে কোরান সংশোধন করতে চাইব! ধরুন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটি বই লিখেছেন। সেটির আমি সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু সেটি আমি সংশোধন করতে পারি না। আমার বইয়ের কথাই বলছি, আমার বই সংশোধন করার অধিকার একমাত্র আমার আছে, অন্য কারওরই নেই। আমার মৃত্যু হলেও আমার বই যে সব ভুল ষনুটি নিয়ে আছে, সেভাবেই থাকবে। এরকমই তো নিয়ম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে লিখেছিলেন, আমরা কেউ কি চাইব ভেঙে মোর ঘরের চাবির বদলে ভেঙে মোর ঘরের তালা করে দিতে? না। চাইব না। প্রশ্নই ওঠে না। কোরানে তো লেখাই আছে যে এর কোনও শব্দও পরিবর্তন করা যাবে না। কোরান একটি বহুল পঠিত গ্রন্থ, আমি কোন ছার যে এটি সংশোধনের দাবি করব! এ ব্রহ্মাণ্ডের কেউ এ দাবি করতে পারে না।
আমি আর যে সব বইয়ের উদাহরণ দিলাম, তা মানুষের লেখা, কিন্তু কোরান তো আল্লাহ তায়লার লেখা। আমি তুলনা করি কি করে কোরানের সঙ্গে মানুষের লেখা বইয়ের? তুলনা করি এই জন্য যে কোরানও মানুষেরই লেখা। ক্ষমতালোভী, স্বার্থা−ন্বষী, নারীবিদ্বেষী,নিষ্ঠুর নির্দয় পুরুষের লেখা। এ মানুষের নির্বুদ্ধিতা যে মানুষ বিশ্বাস করে আল্লাহ জিবরাইলকে পাঠিয়েছেন মুহম্মদের কাছে তাঁর কথাগুলো পৌঁছে দিতে। মুহম্মদ জিবরাইলকে দেখতে পেতেন না, কিন্তু আওয়াজ শুনতেন জিবরাইলের গমগমে কণ্ঠস্বরের। তিনি যা শুনতেন, তা লিখে নিতেন। নিজে তো লিখতে পড়তে জানতেন না, অন্যকে লিখতে বলতেন। সে যুগে, আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে অন্ধতা, অজ্ঞানতা, মূর্খতা চারদিক ছেয়ে ছিল, তখন অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস করত লোকে, এ কোনও অবাক করা ব্যাপার নয়। কিন্তু এই বিংশ শতাব্দির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে, এই বিজ্ঞানের যুগে, যখন মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি যুক্তি চিন্তা অনেক অগ্রসর, মানুষ কী করে বিশ্বাস করে এসব রূপকথা?
তবে কিসের সংশোধনের দাবি করছেন? শরিয়া নামের বর্বর আইনকে বিদেয় করার দাবি করছি। এই আইনের সংশোধন এ যাবৎ অনেক হয়েছে, কোনও সংশোধনই নারী পুরুষের বৈষম্য দূর করেনি। নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা শরিয়া আইনের মূল লক্ষ্য নয়, বরং এর উল্টো। কোনও সংশোধনই মূল লক্ষ্যের পরিবর্তন ঘটাবে না। যদি আমরা রাষ্ট্রের সংবিধানটি অক্ষত রাখি, যে সংবিধান বলে যে সব মানুষের অধিকার সমান, তবে আইনটি রক্ষা করার কোনও যুক্তি নেই।
সব পত্রিকায় আমার বিবৃতি ছাপা হয়েছে যে আমি কোরান সংশোধনের কথা বলিনি তারপরও তাণ্ডব থামার কোনও লক্ষণ নেই। মৌলবাদীরা আর্তনাদ করছে, ইসলাম ভেসে গেল, কোরান ধ্বংস হয়ে গেল। কে ভাসাচ্ছে, কে ধ্বংস করছে? তসলিমা। সুতরাং জ্বালাও পোড়াও, ফাঁসি চাও, আন্দোলনে নামো। মুসলমান তোমরা যে যেখানে আছো বেরিয়ে পড়ো, বজ্রকণ্ঠে স্লোগান দাও, তসলিমার ফাঁসি চাই। তসলিমার মৃত্যু চাই। হ্যাঁ, আমার মৃত্যু চাওয়ার লোকের সংখ্যা বাড়ছে। মিছিলে লোক আগের চেয়ে অনেক বেশি। সময় গেলে বেশির ভাগ আন্দোলনের তেজ এ দেশে কমে আসে জানতাম। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে, তত বাড়ছে তেজ। চারদিকে কেবল একটিই হুংকার, তসলিমাকে হত্যা কর, ইসলাম বাঁচাও। রাজনৈতিক অরাজনৈতিক যত ইসলামী সংস্থা সংগঠন আছে দেশে, সবখানেই ফুঁসে ওঠা লোকের ভিড়, জোট বাঁধো, পথে নামো, ইসলাম বাঁচাও। প্রতিদিন আমার ফাঁসি চেয়ে জঙ্গী মিছিল বেরোচ্ছে। প্রতিদিন। লিফলেট বিলি হচ্ছে, হাজার হাজার লিফলেট —
২. তাণ্ডব – ০২
সম্মানিত দেশবাসী!
আসসালামু আলায়কুম,
কেন তসলিমার বিরুদ্ধে আন্দোলন? তসলিমার এজেন্ট এবং ইসলাম বিদ্বেষী শক্তি জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যে এ প্রশ্ন তুলছে। এদেশের সর্বস্তরের জনগণ তার মৃত্যুদণ্ড দাবী করেছে। স্মরণাতীতকালের সর্বত্মক হরতাল পালিত হয়েছে এ দাবীতে। তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা রয়েছে। বিশ্ব ইহুদি-খ্রিস্টান চক্রের আশ্রয়ে দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে সে ইসলামের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালিয়েছে। সম্প্রতি আবার ফিরে আসায় স্বাভাবিকভাবেই দেশপ্রেমিক ইসলামী জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এবারে দেশী-বিদেশী ইসলাম বিরোধী চক্রটি তাকে কেন্দ্র করে মাথা চারা দিয়ে উঠবার চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক এক বক্তব্য তাদের ইসলাম ও দেশ বিরোধী কর্মকাণ্ডের বৈধতা ও উৎসাহ যুগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, তসলিমার বিরোধিতাকারীরা বাড়াবাড়ি করছে। অথচ তসলিমা আল্লাহ রাসুল ও কুরআনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে, বাংলাদেশের মানচিত্রকে অন্য দেশের সাথে মিশিয়ে না দিয়ে স্বস্তি পাচ্ছে না। সে অবাধ যৌন সংসর্গের প্রকাশ্য ইন্ধন যোগাচ্ছে, বিয়ের শৃঙ্খল ভাঙবার জন্যে নারীদের আহবান জানাচ্ছে আর অকথ্য, অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেছে আলেম উলামা পীর মাশায়েখ ও মসজিদের ইমামকে। মসজিদকে বলছে বৈষম্যের প্রতীক। শেখ হাসিনা কেন মাথায় ঘোমটা দেয় এজন্যে যার আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হয় —- এই দেশদ্রোহী ও ধর্মদ্রোহীর জন্যে একটি চিহ্নিত মহলের উকালতি নিঃসন্দেহে উদ্দেশ্যমূলক। একটা ভদ্র সমাজের মানুষ, স্বাধীন দেশের গর্বিত নাগরিক কি তা মেনে নিতে পারে? ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মূল্যবোধকে নিয়ে কটাক্ষ ও উপহাস করার অধিকার তাকে কে দিল?
সম্মানিত দেশবাসী! তসলিমার অসংখ্য অশ্লীল ও অসভ্য বিষোদগার থেকে নিম্নের কয়েকটি উদ্ধৃতি লক্ষ করুনঃ
০ আমি ছোটখাটো কোনও পরিবর্তনের পক্ষে নই। এর দ্বারা কোনও উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। কুরআনের পুরোপুরি সংশোধন করা প্রয়োজন। (০৯/০৫/৯৪ তারিখে কলিকাতা থেকে প্রকাশিত The Statesman পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তসলিমার উক্তি) উপরোক্ত বক্তব্যের প্রতিবাদ করলে ১১/০৫/৯৪ তারিখে ঝবন জঢ়তঢ়নড়লতশ পত্রিকায় তার একটি চিঠি ছাপা হয়। তা পূর্বের চাইতে মারাত্মক এবং ভয়ংকর। তসলিমার কথায়, এই ব্যাপারে আমার মত পরিষ্কার এবং সুস্পষ্ট। আমার মত হলো কুরআন, বেদ, বাইবেল এবং এ ধরণের যাবতীয় গ্রন্থ যা তাদের অনুসারীদের জীবন পরিচালনা করে তা আজকের স্থান ও কালের সঙ্গে সঙ্গতিহীন। যে সমাজ ইতিহাসের পটভূমিতে এগুলো লেখা হয়েছিল, তা আমরা অতিক্রম করে এসেছি। সুতরাং এই সবের দ্বারা পরিচালিত হবার আমাদের কোনও প্রয়োজন নেই। আংশিক বা পুরোপুরি সংশোধনের কথা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। আমরা যদি উন্নতি করতে চাই তাহলে এই পুরোনো গ্রন্থগুলোকে পরিত্যাগ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
০ এখানে হাসান হোসেন থেকে শুরু করে মুহম্মদ পর্যন্ত কেউই পুতপবিত্র মানুষ নয়। সকলেই দোষে গুণে লোভে মোহে, হিংসায় এজিদ মাবিয়ার মত অর্থাৎ অন্ধকার সমাজের আর সব মানুষের মত। ( ছোট ছোট দুঃখ কথা)
০ আমি নামাজ বা কোরান বিশ্বাস করি না। আমি যখন কোরান পড়ছিলাম, তখন তাতে দেখেছি, কোরানে বলা হয়েছে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। আমি তখন আমার মাতৃদেবীকে বলেছিলাম আমি বিজ্ঞানের বই পড়ে জেনেছি যে, সূর্যেরই চারদিকে পৃথিবী ঘুরছে। কাজেই আল্লাহ একজন মিথ্যাবাদী। (বোম্বে থেকে প্রকাশিত ফ্যাশন ম্যাগাজিন Savvy র নভেম্বর ৯২ সংখ্যায় প্রকাশিত তসলিমার আত্মকথা)
০ রবীন্দ্রনাথকে আমি ঈশ্বর বলে মানি। আমার চোখের সামনে ঈশ্বরের যে ছবিটি ভেসে ওঠে, সে তার রক্তমাংস শিল্পসহ কেবলই রবীন্দ্রনাথ। এই আমার ধর্ম, আমি এই এক ঈশ্বরের কাছে পরাজিত। আর কোনও ঈশ্বর দোষ, আর কোনও লৌকিক বা পারলৌকিক মোহ আমার নেই। জগতে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কোনও দেয়াল রাখিনি। আর কোনও গন্তব্য নেই আমার। ( নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য পৃঃ ৮০)
০ এইসব আখেরাত, পুলসেরাত, দোযখ, বেহেস্ত এগুলো আমার বিশ্বাস হয় না। আল্লাহ টাল্লা আবার কি? সব বাহানা। ( নিমন্ত্রণ পৃঃ ২৯)
০ হ্যাঁ আমি ইসলামকে আঘাত করে থাকি। কারণ ইসলাম নারী স্বাধীনতা দেয় না। (জতৎৎঁ নভেম্বর ৯২)
০ ইসরাফিলের জ্বর হয়েছে/ জিবরাইলের কাশি/মুনকার আর নাকির গেছে হুরের নিমন্ত্রণে/ফেরেশতারা যে যার মত সাত আকাশে ঘোরে/ইসরাফিলের জ্বর হয়েছে শিঙ্গা ফুঁকবে কে?/পুলসেরাতে একলা বসে শেষ বিচারক কাঁদেন/আর, আখেরাতের দাড়িপাল্লা কব্জা খসে পড়ে। ( কবিতাঃ ইসরাফিলের জ্বর হয়েছে, সূত্র সাপ্তাহিক পূর্ণিমা ১৭ নভেম্বর ৯৩)
০ এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমি লজ্জা লিখেছি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী পরিস্থিতিকে ভিত্তি করে। আমি বাবরি সম্পর্কে লিখেছি, কারণ এটা বৈষম্যের এক প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। ( পূর্ণিমাঃ ১৭ নভেম্বর ৯৩)
০ চরিত্র গঠনের জন্য খাদিজা কেন অপরিহার্য এই দেশে? হযরতের তের বা চৌদ্দজন বিবির জীবনী পড়ে স্কুলের মেয়েরা কোন আদর্শে দীক্ষিত হচ্ছে তা আমার জানবার প্রয়োজন বৈ কি!..তাদের কেন জোন অব আর্ক, মেরি ওল্টস্টনক্রাফটের জীবনী, বাংলার মাতঙ্গিনী হাজরা, সরোজিনী নাইডু, বেগম রোকেয়া, ননীবালা দেবী, লীলা নাগ, ইলা মিষেনর সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে কোনও ধারণা দেয়া হয় না? ( নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য পৃ: ১২১)
০ এদেশে নানা জাতের অসাধু পুরুষ আছে, তাদের মধ্যে পীর অন্যতম। .. দেশের আনাচে কানাচে হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা পীর নামে পরিচিত মানুষগুলোর মূল পেশা অসাধুতা। লম্বা চুল, দাড়ি, জোব্বার আড়ালে অর্থ ও নারী লিপ্সাই পীর চরিষেনর প্রধান দিক। .. পীর বলতে এখন আর সিদ্ধ সাধু পুরুষের ভাবমূর্তি মনে আসে না। পীর মানেই দুশ্চরিত্র, লম্পট, পীরমাত্রই ঝাঁক ঝাঁক যুবতী বেষ্টিত প্রচণ্ড কামুক পুরুষ। ( নির্বাচিত কলাম পৃঃ ২৭)
০ আমাদের মত সমাজে মেয়েদের কখনও বিয়ে করাই উচিত নয়। কারণ তার ফলে তারা পুরুষের ক্রীতদাসীতে পরিণত হবে। .. যৌনতার ব্যাপারে বলি আমি অবাধ যৌন সংসর্গে বিশ্বাস করি তার জন্য আপনাকে বিয়ে করার দরকার নেই। (জতৎৎঁ নভেম্বর ৯২)
০ জরায়ুর স্বাধীনতা নারী মাষেনরই প্রয়োজন। সে পতিতা হোক কী অপতিতা হোক। (সাক্ষাৎকার পাক্ষিক সোনার তরী ১-১৫ ডিসেম্বর ৯৩)
০ নারী ধর্ষণ করতে শিখুক, ব্যাভিচার করতে অভ্যস্ত হোক। (নির্বাচিত কলাম পৃ: ১১৮/কলিকাতা ১৯৯২)
০ শালা শুয়োরের বাচ্চা বাংলাদেশ। ( লজ্জা পৃষ্ঠা ৫৭)
০ স্বৈরাচারী সরকার এই দেশের জন্য একটি রাষ্ট্রধর্ম তৈরি করেছে। যে ধর্ম দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মানুষ ভারত বিরোধিতায় ভোগে এবং দেশে একটি ইসলামতন্ত্র চালু করতে চায়। ( যাবো না কেন, যাবো , পৃঃ ৪৯)
০ বাঙালি বলতে আমি উনিশ কোটি মানুষকে বুঝি। দেশ বলতে বঙ্গদেশ বুঝি। আমরা তোমরা বলে কথা বলতে আমি পছন্দ করি না। আজ না হয় ধর্মের দেওয়াল উঠেছে। আমাদের মাঝে এ তো সূর্যের মত সত্য যে একদিন এই দেওয়াল ভাঙবে। ধর্ম নির্বাসিত হবে, বাঙালি ফিরে পাবে তার পূর্ব পুরুষের মাটি, দিগন্ত অবধি অবাধ সবুজ ধানক্ষেত, আম জাম কাঁঠালের বন। মাটির মূর্তির পায়ে ফুলপাতা রেখে কেউ নমো নমো বলবে না, পাপী আর সন্তপ্ত মানুষ মসজিদে পাঁচবেলা কপাল ঠুকবে না। একদিন নিশ্চয়ই বাঙালিরা হাতে হাত ধরে হাঁটবে বনগাঁ থেকে বেনাপোল, রংপুর থেকে কুচবিহার, মেঘালয় থেকে হালুয়াঘাট, শিলং থেকে তামাবিল, ভাটিয়ালি গাইতে গাইতে বৈঠা বাইবে মাঝি পদ্মা থেকে গঙ্গার উত্তাল জলে। এরকম একটি স্বপ্ন বুকে নিয়ে আমি বাঁচি। (বন্দি আমি — তসলিমা নাসরিন ঃ আনন্দবাজার পত্রিকা ৩১ অক্টোবর, ৯৩)
০ দেখুন, যেটুকু নিরাপত্তা এখন পাচ্ছি সেটাতো বিদেশি সংস্থাগুলো দিয়েছে বলে। (সাক্ষাৎকার সোনার তরী ১-১৫ ডিসেম্বর ৯৩)
০ ভারতবর্ষ কোনও বাতিল কাগজ ছিল না / যে, তাকে ছিঁড়ে/টুকরো করতে হবে/সাতচল্লিশ শব্দটিকে আমি রাবার দিয়ে মুছে ফেলতে চাই/সাতচল্লিশ নামের কাঁটা আমি গিলতে চাই/উগড়ে দিতে চাই/উদ্ধার করতে চাই আমার পূর্ব পুরুষের অখণ্ড মাটি। ( কলকাতা, দেশ ১২ মার্চ ৯৪ঃ কবিতা – অস্বীকার, তসলিমা নাসরিন)
সম্মানিত ভাইয়েরা,
ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে কারো উপর কোনও জোর জবরদস্তি নেই। তেমনি কেউ ইচ্ছে করলে অন্য দেশের নাগরিকত্বও নিতে পারে। কিন্তু ইসলামের নাম পরিচয় ব্যবহার করে ইসলামের মূল আক্বিদা বিশ্বাসকে অস্বীকার করা, বাংলাদেশের নাগরিকত্বের সুবিধা ভোগ করে এর স্বাধীন মানচিত্রকে অন্যদেশের সাথে মিশিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র বিশ্বের কোনও ধর্মীয়, নাগরিক এবং মানবীয় আইনেই স্বীকৃত নয়। অনেক দেশেই ধর্মীয় মূল্যবোধের অবজ্ঞাকারী শাস্তির জন্য ব্লাসফেমি আইন আছে। কিন্তু আশ্চর্য, বাংলাদেশে অনুরূপ কোনও আইন নেই। অথচ বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল ও বিশ্বাস সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অন্যতম। এদেশের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ ইসলামের অনুসারী। তসলিমা প্রকাশ্যে এসবকে অশ্লীল, অশিষ্ট ও অনাগরিক ভাষায় পদদলিত করেছে। তার সামগ্রিক কর্মকাণ্ড ইসলাম ও দেশের স্বাধীনতা বিরোধী। অথচ এদেশে এতসব কিছুর পরও তসলিমাকে সরকার আশ্রয় ও শেল্টার দিচ্ছে। তাহলে কি এদেশে আমরা মুসলমান পরিচয় নিয়ে সম্মানের সঙ্গে বসবাস করতে পারবো না? আমরা আমাদের ঈমান ও দেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে আপোস করতে পারি না। রাসুল (সঃ) বলেছেন, তোমরা কোনও অন্যায় দেখলে তৎক্ষণাৎ তা শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ কর। অবস্থা এখন যা দাঁিড়য়েছে তাতে তসলিমাদের এই অন্যায় ঔদ্ধত্যের প্রতিরোধ শুধু মুখের প্রতিবাদ ও নিছক অন্তরের ঘৃণা দিয়ে সম্ভব নয়। সরাসরি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
আসুন! দেশ প্রেমিক ধর্মপ্রাণ ভাইয়েরা! ঈমান ও দেশ রক্ষার জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুলের মর্যাদাকে সর্বোচ্চে বুলন্দ করি এবং আওয়াজ তুলি।
মুরুরতাদদের মৃত্যুদণ্ডের আইন পাস কর
তসলিমার মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে দিয়ে দাও
ই স লা মী ঐ ক্য জো ট
অস্থায়ী কার্যালয়ঃ ৪৪/১ পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত
২. তাণ্ডব – ০৩
সোনার তরী আর পূর্ণিমা খাঁটি মৌলবাদীদের পত্রিকা। এসব পত্রিকায় আমি কখনও কোনও সাক্ষাৎকার দিইনি। কিন্তু যখন তাদের কোনও প্রয়োজন হয় আমার মুখে কিছু বাক্য বসাবার, তারা নিজ দায়িত্বে সেসব বসিয়ে ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করে। এ দেশের মানুষ মুদ্রিত যে কোনও লেখাকে খুব বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাসটিই ইনকিলাব গোষ্ঠীর মূলধন। মুখে ফেনা তুলে ফেলছে কোনও একটি কথা বলে বলে, কারও কানে ঢোকে না তা, আর যখনই লিখে দিচ্ছে সে কথা, পড়তে গিয়ে লোকের মস্তিষ্কে তা সুরুৎ করে ঢুকে যায়। মস্তিষ্কগুলোই এখন এই গোষ্ঠীর খুব প্রয়োজন। এই জাতির মস্তিষ্কের ওপরের আবরণটি খুব পাতলা, খুব য়চ্ছ, খুব সহজে যে কোনও মাল আবরণ ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যায়, গোবর ঢোকালে গোবরও ঢুকে যায়, ধর্ম ঢোকালে ধর্মও। আমার বিবৃতিটিই কেবল ঢোকেনি। আমি যে লিখেছি কোরান সংশোধনের কথা আমি বলিনি, সেটির দিকে কেউ ফিরে তাকাচ্ছে না। অথবা তাকালেও মনে মনে বলছে, তুমি কোরানের সংশোধনের কথা এখন হয়তো না বলতে পারো, তাতে কি! কোরান সম্পর্কে কম বাজে কথা এ যাবৎ বলেছো ! এখন জল ঘোলা করোনি, কিন্তু আগে তো করেছো। ভাল যে বলেনি, তুমি জল ঘোলা না করলেও তোমার বাপ ঘোলা করেছে, বাপ না করলেও তোমার বাপের বাপ করেছে, তাই তোমাকে আমরা চিবিয়ে খাবো।
চিঠি আসছে বিদেশ থেকে। নভেম্বরে নরওয়ের লেখক সম্মেলনে যাবার আমন্ত্রণ, অক্টোবরে ফ্রান্সের বই মেলায়, সুইডেনের লেখক-সংগঠন থেকে আমন্ত্রণ, আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন মাসের জন্য লেখালেখির ওপর বিদ্যে নেওয়ার আমন্ত্রণ, নিউ ইয়র্কে মেরেডিথ ট্যাক্স এর নারীবাদী লেখক সভায় আমন্ত্রণ। আমি নিজেই অবাক হই এমন সামান্য লেখকের জন্য এত বড় সম্মান দেখে। বিদেশি কেউ কেউ আমাকে বলেন, আমাদের আশংকা হয় কবে কখন কে আপনাকে মেরে ফেলে। আপনি বরং অন্য কোনও দেশে চলে যান। বাংলাদেশ আপনার জন্য নিরাপদ নয়। আমি হেসে উড়িয়ে দিই এমন অলক্ষুণে প্রস্তাব। এ দেশ আমার, এ দেশ ছেড়ে আমি অন্য কোথাও চলে যাবো কেন? আমি কি পাগল হয়েছি নাকি যে এমন কথা ভাবব? যতদিন বাঁচি এ দেশেই থাকবো। এ দেশে মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আমি একা লড়াই করছি না। মৌলবাদ-বিরোধী একটি বড় শক্তি এ দেশে আছে, আমরা সবাই মিলে দেশটিকে মৌলবাদ মুক্ত করতে চাইছি, সবাই মিলে দেশটির মঙ্গলের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছি। অন্য দেশে গিয়ে নিরাপদে জীবন যাপন করার কুৎসিত ভাবনাটি আমার দুঃস্বপ্নের মধ্যেও মুহূর্তের জন্যও কখনও উঁকি দেয় না।
তাণ্ডবের মধ্যেও জীবন যাপন করছি। শ্বাস নিচ্ছি, ফেলছি। লড়াকু বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি, আলোচনা করছি, প্রেরণা পাচ্ছি, প্রেরণা দিচ্ছি, ভাবছি, লিখছি, পড়ছি, প্রতিবাদ করছি, মিছিলের মুখে পড়ছি, উল্টোদিকে দৌড়োচ্ছি, মিছিল চলে গেলে বেরোচ্ছি, আবার দৌড়োচ্ছি। গন্তব্য অনেক দূর, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছতেই হবে আমাদের। কিছু একটা করা শক্ত, কিন্তু কিছু একটা করতেই হবে। শামুকের মত গুটিয়ে থাকলে চলবে কেন! শান্ত হও, বাঁধন মানো, ধীরে বল, চিৎকার কোরো না। কিন্তু আমি শান্ত হচ্ছি না, বাঁধন মানছি না, ধীরে বলছি না, আমি চিৎকারই করছি। একটি সম্ভাবনাকে পিষে ফেলা হচ্ছে, সেই সম্ভাবনাকে ছিনিয়ে নিতে চাইছি দুর্বৃত্তদের হাত থেকে। আমি কি একা? না, আমার সঙ্গে অনেকেই আছেন। সরব এবং নীরব অনেকে। কাছের এবং দূরের অনেকে।
হঠাৎ একদিন অভাব এসে আমার দরজায় কড়া নাড়ে। অনেকদিন থেকেই আসছি আসছি করছিল, এবার এসেই পড়ে, ঢুকেই পড়ে চৌহদ্দিতে। না, এমন অভাবকে বরণ করলে চলবে না। আমার অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে, এই খবরটি চাউর হয়ে গেলে আমাকে খুবলে খাওয়ার জন্য শকুনের ভিড় বাড়বে। এতদূর এসে এখন কোনওভাবেই মাথায় হাত দিয়ে আমার বসে গেলে চলবে না। আমাকে সাহায্য করার জন্য কোথাও কোনও প্রাণী অপেক্ষা করে নেই। যত রকম মেরুদণ্ড আছে, সব মেরুদণ্ডই শক্ত করে আমাকে স্রোতের বিপক্ষে বৈঠা বাইতে হবে। কলাম লিখে টাকা রোজগারের একটি পথই এখন অবশিষ্ট। কিন্তু কলাম থেকে আসা টাকা দিয়ে সংসার চলে না। আমার লেখা থাকে বলে পত্রিকা আপিসে হামলা হয়, পত্রিকাগুলোও এখন লেখায় সরকার বা ধর্ম বিষয়ে কোনও মন্তব্য থাকলে ছাপছে না। ভয়। ভয় সরকারি বিজ্ঞাপন হারাবার। সরকারি রোষানলের শিকার হবার ভয়, মৌলবাদীদের হামলার ভয়। ইয়াসমিন আর মিলন সংসারের বাজার খরচ দিচ্ছে, তার ওপর ভালবাসার জন্য ওদের খরচ আছে। আমার টেলিফোনের বিল বাকি, বিল বাকি বিদ্যুৎএর। প্যারিস ছাড়ার পর ফরাসি প্রকাশক ক্রিশ্চান বেস আমার ঠিকানায় লজ্জা বইটির জন্য অগ্রিম রয়্যালটির চেক পাঠিয়েছিলেন। চেকটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম আমি।
চেক আসে না, কিন্তু ফোন আসে ক্রিশ্চান বেস এর। মাঝে মাঝে ফোন করে ভাল আছি কি না, নিরাপদে আছি কি না, কোনওরকম কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না ইত্যাদি জানতে চান। তাণ্ডবের খবর তো সবখানেই যাচ্ছে। তিনি স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন। টাকা পয়সা নিয়ে কথা বলতে আমার এমনিতে লজ্জা হয়, কিন্তু ক্রিশ্চানকে আমি লজ্জার মাথা খেয়ে একদিন জিজ্ঞেস করেই বসি যে তাঁর যে চেক পাঠানোর কথা ছিল, তা কি তিনি পাঠিয়েছেন? ক্রিশ্চান আকাশ থেকে পড়েন শুনে। –বল কি? আমি তো সেই কবেই তোমার ঠিকানায় রেজিস্ট্রি ডাকে চেক পাঠিয়েছি। সেই চেক তুমি নিশ্চয়ই জমা দিয়েছো তোমার ব্যাংকে। কারণ আমাদের ব্যাংক থেকে সে টাকা অনেক আগেই চলে গেছে।
–অসম্ভব। এ হতে পারে না। আমি কোনও রেজিস্ট্রি ডাকে আসা কোনও চিঠি পাইনি, কোনও চেক পাইনি। কোনও চেকই ব্যাংকে চেক জমা দেবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমি জোর দিয়ে বলি।
ক্রিশ্চান ব্যাপারটির তদন্ত করবেন বলে ফোন রেখে দেন।
এর কদিন পর আবার ফোন করে বলেন –দেখ, আমি ব্যাংকের ম্যানেজারকে বলেছি আমাকে তোমার চেক এর কপি পাঠাতে। ওরা চেক এক কপি যোগাড় করে আমাকে পাঠিয়েছে। আমার কাছে আছে, চেক এর পেছনে তোমার সই আছে।
আমি বলি, ক্রিশ্চান, আমি কোনও চেক পাইনি। কোনও চেক এর পেছনে আমি সই করিনি।
ক্রিশ্চান বলেন, এ কি করে হবে! তুমি না দাও, তোমার অ্যাকাউণ্টে অন্য কেউ জমা দিয়েছে। তুমি খোঁজ নাও তোমার ব্যাংকে।
আমি কূল কিনারাহীন ভাবনায় ডুবতে থাকি। যে চেক আমার হাতে পৌঁছেনি, সেই চেক আমার অ্যাকাউণ্টে কেউ জমা দিয়েছে। কিন্তু কারও হাতে যদি পড়ে আমার চেক, কি করে সে জানবে কোন ব্যাংকে আমার অ্যাকাউন্ট আছে?
আমি ব্যাংকে খোঁজ নিই। ব্যাংক থেকে জানানো হল, আমার অ্যাকাউণ্টে কেউ কোনও চেক জমা দেয়নি।
তবে কার হাতে চেক পড়েছে? কে রেজেস্ট্রি ডাকের চিঠি রিসিভ করেছে? যদি অন্য কেউ রিসিভ করেই থাকে, তবে চেক ভাঙাবে কি করে, আমার নামের চেক আমার অ্যাকাউন্ট ছাড়া জমা হবে না। যদি আবদুল জলিল নামের কোনও চোর আমার চিঠি চুরি করে, চিঠির ভেতরে একটি চেক ও পেয়ে যায়, তবে চেকটি তো তার কোনও কাজেই লাগবে না।
এর মধ্যে ক্রিশ্চান আমাকে চেকএর কপিটি ফ্যাক্স করে পাঠান। যেহেতু আমার নিজের ফ্যাক্স মেশিন নেই, ইয়াসমিনের আপিসের ফ্যাক্স নম্বর দিয়েছিলাম তাঁকে। জরুরি কোনও চিঠি পত্র তিনি ফ্যাক্সে পাঠাবেন বলেছেন। চেক পেলাম বটে। তবে এ সত্যিকারের চেক নয়, আসল চেকটির ফটোকপির ফ্যাক্সকপি। চেক এর পেছনে বাংলায় তসলিমা নাসরিন লেখা। লেখা বটে, কিন্তু আমার হাতের লেখা নয়। এটি সই বটে, কিন্তু আমার সই নয়।
ভাবনার জলে ডোবা আমি পাশের অ্যাপার্টমেণ্টের দরজায় কড়া নাড়ি। অ্যাপার্টমেন্টটি একজন ব্যাংকারের। তাঁর কাছেই সাহায্য চাই চেক এর জট খোলার। তাঁকে সব বলি, চেকটি দেখাই। তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন, খুব সোজা ব্যাপার। যে আপনার চেক পেয়েছে, সে আপনার নাম দিয়ে যে কোনও ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে নিয়েছে।
— কিন্তু সে কি করে প্রমাণ করবে সে তসলিমা নাসরিন?
–এটি তো আরও সোজা, এই নামের একটি আইডি করে নেবে।
–যদি কোনও পুরুষ এটি পায়? তসলিমা নামের আই ডি কি করে করবে?
এর মত সহজ জিনিস আর হয় না। লোকটির বউ কিংবা বোনের ছবি দিয়ে নাম তসলিমা নাসরিন বলে একটি মিথ্যে আইডি করে নিল। কে এখানে খোঁজ নিচ্ছে কার আসল নাম কী! আর যদি সিঙ্গাপুরে হয়..
সিঙ্গাপুরে?
হ্যাঁ ওখানে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল দল আছে, এদের কাজই ডাকে পাঠানো চেক চুরি করা। ওখানে বা অন্য কোনও দেশে চেক ভাঙালে তসলিমা নামটি যে কোনও মেয়ের নাম, তাও তো বুঝবে না।
আমি আঁতকে উঠছি এসব শুনে। এত জটিল কথা ব্যাংকার এমন ভাবে বলছেন, যেন এসবের মত সহজ সরল জিনিস আর হয় না।
‘একটি প্রশ্ন। আমার ঠিকানায় তো চিঠিপত্র আসছে। কোনও চিঠি তো মার যায় না। কিন্তু চেকঅলা চিঠিটি মার গেল কেন?’
জ্ঞপোস্টাপিসে অভিজ্ঞ লোকেরা থাকে, খাম দেখলেই বোঝে কোন খামের ভেতর চেক আছে।’
‘কিন্তু আমি এখন কি করে টাকা পাবো?’
‘আপনি পাবেন না।’ গলাটি এখন আরও শান্ত। নিশ্চিন্ত।
হলুদ হলুদ লাগে সবকিছু। সর্ষেফুলও বুঝি কারও চোখে এত হলুদ লাগে না।
‘তাহলে টাকাটা কিছুতেই আমার আর পাওয়া হচ্ছে না?’
মাথা নাড়লেন, ‘না’।
ব্যাংকারের ব্যাখ্যার পরও আমার ইচ্ছে করে না কোনও অন্যায় চুপচাপ মেনে নিতে। জাতীয় ডাকঘর আপিসে নিজে গিয়ে এর মাথার কাছে আমার শান্তিনগরের বাড়ির ঠিকানার চিঠি যে চুরি হয়েছে বলি। তিনি আমাকে লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন। তাও দিই। মাথার কোনও মাথাব্যথা নেই আমার চিঠি আর চিঠির পেটের চেক চুরি হওয়া নিয়ে। তদন্তের কোনও রিপোর্ট আমার কোনওদিনই পাওয়া হয় না। তদন্ত করতে কেউ ডাকঘরে যান না, তবে তদন্ত করতে আমার বাড়িতে আসেন। যখন হতাশা আমাকে ভাসাচ্ছে ডোবাচ্ছে, অভাবের হুলঅলা হিংস্র মশকরা আমাকে নিয়ে নিরবধি মশকরা করছে,তখন ইনকাম ট্যাক্সএর আপিস থেকে দুজন লোক এলেন আমার বাড়িতে। ঘরে ঢুকে ঘরের জিনিসপষেনর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে বললেন, কমপ্লেইন এসেছে, আপনার বাড়িতে নাকি দামি ফার্নিচার আছে। আমরা তদন্ত করতে এসেছি।
আমি যে অকারণে অপদস্থ হচ্ছি, অপমানিত হচ্ছি, আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আমাকে যে পাঁকে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে, আমি বুঝি। এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার যে শক্তি আর সাহস ছিল আমার, সেটি টেনে ছিঁড়ে টুকরো করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে মানুষ। আমি আমার মাটিতে শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইছি, আমাকে ধাককা দিয়ে গভীর খাদে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে। খাদে পড়ে যেন আমি মরি অথবা যদি না মরি আমি যেন কেঁচোর মতো পড়ে থাকি, আর সব কেঁচোর সঙ্গে কেঁচোর জীবন যাপন করি। আমি মুঠোবন্ধ করি দুই হাত। আমার শেষ শক্তিটুকু কেড়ে নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠছে লোকে। আমার অক্ষমতার জন্য আমার রাগ হয়। লজ্জায় ঘৃণায় হতাশায় আমি কুঁকড়ে থাকি। আমার শক্তি সাহস সব উবে যেতে থাকে। মনে হতে থাকে আমি কোনও গর্তের মধ্যে পড়ে গেছি। গর্তে আর সব কেঁচোর সঙ্গে কেঁচোর জীবন যাপন করছি।
কেঁচো তার গর্ত থেকে শুনতে পাচ্ছে বাইরের চিৎকার, ফাঁসি চাই, দিতে হবে।
৩. অতলে অন্তরীণ – ০১
চার, জুন। শনিবার
ফোন এল। একটি কণ্ঠস্বর। কণ্ঠস্বরটি অচেনা।
–আপনার নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট হয়েছে। আপনি বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে।
–আপনি কে বলছেন?
–আমাকে আপনি চিনবেন না।
–নাম বলেন।
–আমার নাম শহিদ। আমি আপনার শুভাকাঙ্খী। আপনার বাড়িতে পুলিশ যাচ্ছে, আপনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। দেরি করবেন না।
কি কারণে হুলিয়া জারি এসবের কিছুই না বলে ফোন রেখে দিল লোকটি। শহিদ নামের কোনও লোকের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। ভাবি, কী কারণ থাকতে পারে এই ফোনের! লোকটি যে ই হোক, লোকটি চাইছে আমি যেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। কোনও ষড়যন্ত্র এর পেছনে লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই। ভাবতে ভাবতে আমি বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে থাকি সামনের রাস্তায় কোথাও কেউ সন্দেহজনক দাঁড়িয়ে আছে কি না। সম্ভবত আশে পাশের কোথাও থেকে লোকটি ফোনটি করেছে, আমি বেরিয়ে গেলে সে তার দলের লোক নিয়ে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কৌশলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে আমাকে মেরে ফেলার ফন্দি এঁটেছে লোক। বাইরে বেরোবার দরজা দুটো একবার দেখে নিই খিল আঁটা আছে কি না। কদিন আগে একটি ফোন এসেছিল এরকম, সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সোজা বলল, আপনার বাড়িতে পুলিশ আসছে। কেন পুলিশ আসছে, কি করতে আসছে কিছুই জানায়নি সেই সাংবাদিক। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় বসে ছিলাম। কিছুক্ষণ বাদে যাদুকর জুয়েল আইচ ফোন করলে পুলিশ আসছে এই খবরটি দিই। জুয়েল আইচ তক্ষুনি ভীত উত্তেজিত স্বরে বললেন, তসলিমা আপনি এক্ষুনি বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে।
–কোথায় যাবো এ সময়?
–কোথাও কারও বাড়িতে চলে যান। আপনি বুঝতে পাচ্ছেন না, কি ভয়ংকর কাণ্ড যে হয়ে যেতে পারে। পুলিশের ওপর কোনও বিশ্বাস নেই।
–এ সময়ে কার বাড়িতে যাবো! রাত হয়ে গেছে..। মিনমিন করি।
–রাত হয়েছে তাতে কি! আশে পাশের ফ্ল্যাটে কোথাও চলে যান।
–কাউকে তো চিনি না।
–আমার এক চেনা লোক আছে দু নম্বর বিল্ডিংএ। আমি তাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি। আপাতত তার বাড়িতে চলে যান।
–কিন্তু গিয়েই বা কি লাভ। ফিরে তো আসতেই হবে নিজের বাড়িতে। কারও বাড়িতে লুকিয়ে থেকে কি আর অ্যারেস্ট এড়ানো যাবে। পুলিশ আজ না হোক কাল আমাকে খুঁজে পাবেই। তার চেয়ে যেখানে আছি সেখানেই থাকা ভাল।
জুয়েল আইচ আরও কয়েকবার আমাকে বাড়ি ছাড়ার জন্য অনুরোধ করে ফোন রাখলেন দু নম্বরের চেনা লোককে ফোন করতে। আমি যাইনি বাড়ি ছেড়ে। পুলিশও আসেনি আমার বাড়িতে।
এ ধরনের কোনও ফোনের খবরকে বিশ্বাস করার কোনও মানে হয় না। এটি নেহাত ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। ফোনে আমাকে হুমকি দেওয়া হয়, গলা কেটে রাস্তায় ফেলে রাখবে, মুণ্ডু উড়িয়ে দেবে, কিন্তু বলাই সার, হাতে নাতে আততায়ীরা আমাকে কখনও পায়নি। এবার বোধহয় এই ফন্দিই এঁটেছে, পুলিশ আসছে বলে ভয় দেখিয়ে বাড়ির বার করবে, আর সঙ্গে সঙ্গেই খপ করে ধরে ফেলে গলাটি আল্লাহু আকবর বলে কেটে সওয়াব কামাবে। চলে যাই আমার লেখার ঘরে, যে লেখাটি লিখছিলাম লিখতে থাকি। এরপর আধঘন্টা পর আবার ফোন। এবারের লোকটিও অচেনা। এবারের লোকটিও বলল, আমাকে আপনি চিনবেন না।
কে আপনি? নাম কি?
বললাম তো, আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি কোর্ট থেকে বলছি। এডভোকেট শাহাদাত। আপনার বিরুদ্ধে গভরমেন্ট কেইস করেছে। অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়ে গেছে। আপনি বাড়ি থেকে আপাতত কোথাও চলে যান।
এই ফোনটি আমাকে ভাবালো। দুটি ভিন্ন লোক দুটি ভিন্ন জায়গা থেকে বলছে যে আমার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়েছে। তবে কি সত্যিই হুলিয়া জারি হয়েছে? তাই বা হবে কেন! মৌলবাদীদের মিছিল বেরোলে সরকার থেকে আমাকে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে, যদিও গোয়েন্দা পুলিশ আছেই পেছনে, কিন্তু বাড়ির সামনে তো কিছু পুলিশ অন্তত দাঁড় করানো হয় যখন মিছিল যায় আমার ফাঁসি চেয়ে! এই সরকার কেন আমার বিরুদ্ধে মামলা করবে? মামলা যদি করে কেউ, সে তো মৌলবাদীর দল। দ্বিতীয় লোকটি যখন কথা বলছিল ফোনে, প্রচুর লোকের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল। হতে পারে লোকটি যা বলছে, ঠিকই বলছে যে সে কোর্ট থেকে কথা বলছে। লোকটি যদি সত্যিই উকিল হয়ে থাকে, তবে তার পক্ষে হুলিয়ার খবরটি জানা কঠিন নয় মোটেও। কিন্তু তারপরও আমার বিশ্বাস হতে চায় না যে সরকার আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো আমাকে নিরাপত্তা দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে নিরবধি বলে যাচ্ছে। ফতোয়ার খবরটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। এখন সরকার আমাকে নিরাপত্তা না দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা করবে! আমি ধন্দে পড়ি। কিছুই ঠিকমত আমার মাথায় ঢুকছে না। অংকে মিলছে না কিছুই। নিচে এখন দুরকম পুলিশ বসে, গত একমাস থেকে পাহারা পুলিশ বসছে ইস্টার্নের গেইটের সামনে আর সাদা পোশাকের গোয়েন্দাগুলো তো হাঁটাহাঁটি করছেই বাড়ির চারপাশে। আবার আমি বারান্দা থেকে উঁকি দিই ভিড়ের রাস্তায়, কোথায় কিসের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে আততায়ী, খুঁজি। কোনও লোক তাকাচ্ছে কি না ঘন ঘন এই বাড়িটির দিকে, দেখি। রাস্তা থেকে চোখদুটো সরাতে নিলেই চোখ পড়ে রাস্তার ওপারের তিনতলা একটি বাড়ির বারান্দায় দুটো লোকের দিকে, আমাকে দেখছে লোক দুটো, দেখছে আর নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। আগে কখনও লোকদুটোকে দেখিনি ও বাড়িতে! ফোনের ওপারের লোকদুটোর সঙ্গে কি বারান্দার এই দুটো লোকের কোনও সম্পর্ক আছে! আছে হয়তো। আমাকে কৌশলে বারান্দায় বের করে চাইছে গুলি করতে! খুব সহজে ওই বারান্দা থেকে আমার দিকে তাক করে গুলি ছোঁড়া যায়! চকিতে একটি ঠাণ্ডা কিছু বুকের ভেতর উথলে ওঠে। দ্রুত সরে আসি বারান্দা থেকে। পর্দা টেনে দিই। কত রকমের আধুনিক অস্ত্র যে এখন মানুষের হাতে। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু ধনী দেশ থেকে এখানে অর্থ আর অস্ত্র প্রচুর পরিমাণে আসছে। আততায়ীর অভাব হওয়ার তো কথা নয়।
এ মুহূর্তে ঠিক কি করা উচিত আমার বুঝে পাই না। পায়চারি করি। শেষ পর্যন্ত ফোন করি ডক্টর কামাল হোসেনের আপিসে। ফোন ধরলেন সারা হোসেন। সারাকে বললাম, দুটো লোক কিছুক্ষণ আগে ফোনে আমাকে জানিয়েছে যে আমাকে অ্যারেস্ট করার জন্য ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে। কি অদ্ভুত ব্যাপার, তা কেন হবে!
তাই তো! সারাও বললেন, তা তো হওয়ার কথা নয়। এরকম কিছু তো সারাদিন শুনিনি। দেখি আমি খবর নিচ্ছি। কিছু খবর জানতে পারলে আপনাকে জানাবো। সারা নিজে দায়িত্বটি নিয়ে আমাকে নির্ভার করেন।
আমাকে আধঘন্টা পর ফোন করে জানালেন সারা যে তিনি আদালতে লোক পাঠিয়ে জেনেছেন খবরটি সত্য। মতিঝিল থানা থেকে নূরুল আলম নামের এক পুলিশ অফিসার মামলা করেছে আমার বিরুদ্ধে। আমাকে গ্রেফতার করার জন্য হুলিয়া জারি হয়েছে।
মাথা চরকির মত ঘুরে ওঠে। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কি করব। যে কোনও মুহূর্তে পুলিশ ঢুকবে ঘরে, হাতদুটোতে হাতকড়া পরাবে, কোমরে হয়ত রশিও বাঁধবে, টেনে নিয়ে যাবে নিচে, ঘাড় ধাককা দিয়ে পুলিশের ভ্যানে ওঠাবে।
–কী অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে?
— আপনি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন।
–এখন কী করা উচিত? সারাকে নিস্তেজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি।
সারা শান্ত গলায় বললেন, জামিন নিতে হবে। অন্যান্য উকিলের সঙ্গে কথা বলে জামিনের ব্যাপারটা দেখছি।
খানিকটা স্বস্তি জোটে। জামিন নেওয়ার পর মামলার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। কামাল হোসেনের মত উকিল থাকতে আমার মুষড়ে পড়ার কিছু নেই। কিছু নেই কিন্তু তারপরও একটি সংশয় আমার ভেতর থেকে যায় না। পুলিশ যদি আমাকে সত্যি সত্যিই গ্রেফতার করে নিয়ে যায়! আজকাল আদালতের বিচারকদের মধ্যেও মৌলবাদী থাকে, পুলিশের মধ্যেও নিশ্চয়ই মৌলবাদী আছে। আমাকে তো হাজতেই পিষে মেরে ফেলবে। সংশয়টি মাকড়শার জালের মত আমাকে আটকে ফেলে।
নানি আর ঝুনু খালা বেড়াতে এসেছেন, মা ওঁদের জন্য রান্না করছেন। মিলন আর ইয়াসমিনের দিকে ছুঁড়ে দিই হুলিয়া জারি হওয়ার খবরটি। ওরা তেমন গা করে না। অনেকদিন থেকেই অদ্ভুত অদ্ভুত সব খবর শুনতে শুনতে ওরা অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। হুলিয়া ব্যাপারটি যে ঠিক কি, তা সম্ভবত ওরাও অনুমান করতে পারে না। দুজনের কারও মুখে কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করি না। ওরা, যে কোনও খবরের মত খবরটি শুনে যে যার কাজে চলে যায়। ইয়াসমিন ভালবাসাকে ঘুম পাড়াতে, মিলন গোসল করতে।
মা, আমার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু হইছে। পুলিশ আইতাছে। শেষ পর্যন্ত মাকে বলি।
মা বলেন, কি কস এইসব আজে বাজে কথা!
–আজে বাজে না। ঠিকই কইতাছি।
–পুলিশ আইব কেন? কি করছস তুই?
–জানি না কি করছি। সরকার নাকি মামলা করছে। মতিঝিলের কোন এক পুলিশ অফিসার নাকি কইছে যে আমি তার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিছি।
–তরে কত কইছি আল্লাহ রসুল নিয়া কিছু লেখিস না। আমার কথা ত শুনছ না।
মাও সম্ভবত বিশ্বাস করছেন না যে সত্যি সত্যিই পুলিশ আসছে আমাকে গ্রেফতার করতে। এর আগে বাঘ আসছে বাঘ আসছের মত পুলিশ আসছে তিনি শুনেছেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে পুলিশ আসেনি। কিন্তু সত্যি সত্যিই যখন পুলিশ আসছে, তখন বিশ্বাস করতে কেউ চায় না। অসহায় রাখালের মত নিজেকে লাগে। এবারের পুলিশ আসছে রবটি যে কোনও গুজব নয় তা কি করে কাকে বোঝাবো!
নানি এই প্রথম এসেছেন আমার বাড়িতে। বাড়ি কেনার পর মাকে বলেছিলাম যেন একবার নানিকে নিয়ে আসেন ঢাকায়। নানি তাঁর ময়মনসিংহের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে চান না। তাকেঁ এ পর্যন্ত নিয়ে আসা ঝুনুখালার দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফল। নানির সঙ্গে বসে খাবো আমি, মা খাবার দিচ্ছেন টেবিলে। খেয়ে দেয়ে পানের বাটা খুলে নানির হাতের বানানো একটি পান খাবো, পাশাপাশি শুয়ে গল্প করব, কত দিন পর আমাদের দেখা! নানি বারবারই বলছেন, নাসরিন, আমার কাছে আইসা ব একটু, ক কেমন আছস। খবর টবর ক।
মাথায় আমার হুলিয়া, স্থির হয়ে কি করে বসব আমি!
মা ডাকছেন খেতে। ক্ষিধে উবে গেছে অনেকক্ষণ। অস্থিরতা আমাকে ফোনের কাছে টেনে নেয়। একটি ফোন করি চেনা একজন আইনজীবীকে, সেই একজনের নাম ধরা যাক ক। ককে জানালাম বৃত্তান্ত। ক সব শুনে আমাকে বললেন, এক্ষুনি বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে।
–কোথায় যাবো আমি? কিছু তো বুঝে পাচ্ছি না..
–কোনও আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়িতে চলে যান।
–কিন্তু..
–কিন্তু কি? –পালাবো কেন! বাড়িতে থাকাই তো ভাল।
–উফ আপনি বুঝতে পারছেন না। আপাতত আমার বাড়িতে চলে আসুন। এখানে বসে ঠিক করেন কোথায় যাবেন।
–এখনও তো পুলিশ পাহারা আছে। পুলিশ একদিকে আমাকে যদি নিরাপত্তা দেয়, তবে আবার গ্রেফতার করবে কেন?
–কি মুশকিল! পুলিশ যদি আমাকে গ্রেফতার করতে চায়, তবে তো কোনও বাড়িতে গিয়েও কোনও লাভ হবে না। খুঁজে তো আমাকে পাবেই।
–এসব ভেবে সময় নষ্ট করবেন না তো। বাড়ি থেকে বেরোন তাড়াতাড়ি।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপদেশটি আমার পছন্দ হয়নি। কিন্তু এ সময় নিজের বুদ্ধিতে কিছু করার চেয়ে আইন অভিজ্ঞ মানুষের উপদেশই পালন করা উচিত, পছন্দ না হলেও। মিলন গোসল সেরে বেরোতেই মিলনকে বাইরে যাওয়ার জন্য দ্রুত তৈরি হতে বললাম।
–কই যাইবেন?
–তাড়াতাড়ি চল। কথা কওয়ার সময় নাই।
মিলন লুঙ্গি পাল্টে প্যান্ট পরে নিল। আমি যে কাপড়ে ছিলাম, সেটি পরেই।
মার মুখ মুহূর্তে পাল্টে গেল যখন দেখছেন আমি দরজার দিকে এগোচ্ছি।
কই যাইতাছস? কখন ফিরবি? মার কাঁপা কণ্ঠ।
জানি না। বলে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকি নিচে।
পেছনে দরজায় হতভম্ব দাঁড়িয়ে আছেন মা, নানি, ঝুনুখালা, ইয়াসমিন।
দৌড়ে গাড়িতে উঠি। মিলনও। সাহাবুদ্দিনকে দ্রুত পার হতে বলি ইস্টার্ন পয়েন্ট। যেন বাইরে থেকে গাড়ির ভেতরে বসা আমার চেহারাটি কারও দেখার সুযোগ না হয়, যেন আমাকে চিনে ওঠার আগেই আমার গাড়ি দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়। যেন কারও সময় এবং সুযোগ না হয় গাড়িটি থামানোর। গেটের কাছে পাহারার দুটো পুলিশ বসে আছে। সাহাবুদ্দিন কখনও গাড়ি দ্রুত চালান না। সাহাবুদ্দিন তো বটেই আমিও পছন্দ করি ধীর গতিতে গাড়ি চালানো। আজ আমার তাড়া দেখে তিনি ঝড়ের বেগে চালালেন। ক তাঁর বাড়িতে বসে ছিলেন আমার অপেক্ষায়। গাড়িটি যদি পুলিশের চোখে পড়ে তাহলে জেনে যাবে যে আমি এখানে। সুতরাং বাড়ির সামনে থেকে গাড়িকে বিদেয় করতে হবে। ব্যাপারটি আমার মাথায় আসেনি, এসেছে কর মাথায়। ক-ই মিলনকে বললেন চলে যেতে। পই পই করে বলে দিলেন,কাউকে যেন সে না জানায় আমি কোথায়, কার বাড়িতে ইত্যাদি কোনও কিছু। ক ইতিমধ্যে তাঁর কজন আইনজীবী বন্ধুকে ফোন করে জেনেছেন এ সম্পর্কে। দণ্ডবিধির ২৯৫ (ক) ধারাটি, দেড়শ বছর আগের পুরোনো আইন, ব্রিটিশের তৈরি, এই প্রথম কারো বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হল। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে যদি কেউ আঘাত করে, তবে এর শাস্তি দু বছরের কারাদণ্ড আর জরিমানা। কিন্তু সবচেয়ে বাজে ব্যাপারটি হল, এই মামলায় জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়।
তার মানে কি? জামিন হবে না?
ক মাথা নাড়েন। হবে না।
এ কোনও কথা হল? সবারই তো শুনি জামিন হয়।
হ্যাঁ হয়। খুনীর বিরুদ্ধে মামলা হলেও তো জামিন হয়।
খুনীদের হয়! তবে আমার জামিন হবে না কেন?
ক হেসে মাথা নাড়তে নাড়তে বলেন, আপনাকে হয়ত খুনী বদমাশের চেয়েও ভয়ংকর কিছু ভাবছে সরকার।
পুলিশ অফিসার মামলা করেছে, এই মামলা ব্যক্তির না হয়ে সরকারের হবে কেন? কর কাছে জানতে চাই।
ক বলেন, পুলিশ অফিসার যখন মামলা করেন, তবে তা সরকারি মামলাই।
আরেকটি অদ্ভুত নিয়ম, সরকারি অনুমোদন ছাড়া এ মামলা কেউ করতে পারে না। তার মানে আমি যদি এই আইনে শায়খুল হাদীসকে ফাঁসাতে চাই, বলি যে শায়খুল হাদীস আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে, হবে না। সরকারের অনুমোদন লাগবে। প্রধানমন্ত্রী অথবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সই চাই। সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনও আদালতই এই মামলা নেবে না।
কর মা খ ঢোকেন আমাদের আলোচনায়। ক তাঁর মাকে আগেই জানিয়েছেন ঘটনা।
খ বললেন, এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে জামিনের জন্য চেষ্টা করা।
আমি বলি, কিন্তু জামিন নাকি হবে না!
খ বলেন, খুব বিদঘুটে ব্যাপার। কিন্তু অন্য কোনও উপায় তো নেই। তোমার উকিল এসব ব্যাপারে জানবেন ভাল। তাঁরা হয়ত কোনও ফাঁক ফোকর পেতে পারেন।
নাকি পুলিশের কাছে ধরা দেব? আমি জিজ্ঞেস করি।
ক বলেন, ধরা দেওয়া ঠিক হবে না। ধর্মীয় অনুভূতির ব্যাপার, পুলিশের মধ্যেই মৌলবাদী থাকতে পারে।
খ ও এই ব্যাপারে এক মত। তিনি বললেন, তোমাকে গ্রেফতার করার জন্য মৌলবাদীরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে। তুমি গ্রেফতার হলে তাদের জয় হবে। সরকারকে চাপ দিয়ে তারা এই মামলা পর্যন্ত করিয়ে নিতে পেরেছে। চাপ দিয়ে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থাও করতে পারে।
ক গম্ভীর গলায় বললেন, সময়টা বড় খারাপ তসলিমা। খুব ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। হুট করে কিছু করা চলবে না। জামিন না হওয়া পর্যন্ত আপনি কোথাও লুকিয়ে থাকুন, কোনও নিরাপদ জায়গায়।
কিন্তু কোথায় লুকোবো?
এ বাড়িতে আপনি লুকিয়ে থাকতে পারতেন, কিন্তু..
খ বললেন, এ বাড়িতে সম্ভব নয়। ওর গাড়ি ওকে নামিয়ে দিয়ে গেছে এ বাড়িতে। ওর গাড়ি তো এমনিতেই পুলিশ ফলো করে। তাছাড়া অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট পেয়ে পুলিশ এখন ওর নিজের বাড়িতে ওকে না পেয়ে যে সব বাড়িতে ওর যাতায়াত ছিল সেসব বাড়িতে ওকে খুঁজতে যাবে, এবাড়িতেও আসতে পারে।
এত কথা আমার মাথায় আসেনি। ক এবং খ দুজনে নিজেদের মধ্যে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে এ বাড়ি থেকে যত শীঘ্র সম্ভব চলে যেতে হবে। কিন্তু কোন বাড়িতে আমি লুকোতে যাবো! কারও বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে থাকার ব্যাপারটি আমার কাছে বিচ্ছিজ্ঞর লাগছে। কিন্তু ক এবং খর কাছে লুকিয়ে থাকার বিষয়টি যেন বিষয়ই নয়। বাড়ি নিয়ে ভাবনার দায়িত্ব ক এবং খ নিলেন।
রাত নামার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। রাত ঘন না হলে রাস্তায় বেরোনো যাবে না। ওদিকে পুলিশ আমাকে খুঁজছে নিশ্চয়ই। এদিকে পুলিশের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য রাতের আশ্রয় খোঁজা হচ্ছে। খ কারও সঙ্গে কথা বললেন ফোনে, বললেন যে তিনি যাচ্ছেন তাঁর বাড়িতে, একটি বিস্ময় অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য। বিস্ময়টি কি ওপাশ থেকে জানতে চাওয়া হয়। খ কিছুই ভেঙে বলেননি। রাত ঘন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর এক আত্মীয়কে ফোন করে ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে তাঁর বাড়ির দরজার সামনে আসতে বললেন। খ নিজের গাড়িতে আমাকে নিয়ে কোথাও যাবেন না। কারণ পুলিশ যদি এর মধ্যে জেনে যায় যে আমি খর বাড়িতে এসেছি, তবে খ র গাড়ি কোথায় যাচ্ছে না যাচ্ছে তার খোঁজ নেবে। আত্মীয়ের গাড়িটি এসে থামার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে উঠিয়ে নেওয়া হয়। পেছনের আসনে আমাকে বসিয়ে দু পাশে ক এবং খ বসেন। আত্মীয় সামনে। ক আর খ দুজনই আমার মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে দিতে বললেন। আঁচল টেনে অভ্যেস নেই আমার, পারি না টানতে। লজ্জায় হাত যায় না আঁচলে। খ নিজে আঁচল উঠিয়ে দেন। মুখ ঢেকে রাখতে হল আঁচলে যেন রাস্তার আলো আমার মুখে পড়লেও কেউ বাইরে থেকে চিনতে না পারে যে এ আমি, খুনের আসামীর চেয়েও বড় আসামী। ক, খ এবং খ এর আত্মীয় অনেকক্ষণ কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন না। সকলের এক চোখ ভেতরে, আরেক চোখ বাইরে, ভিড়ের রাস্তায় গাড়ির গতি স্লথ হলে চঞ্চল হয়ে ওঠেন তিনজনই। না, এভাবে স্তব্ধ বসে থাকলে চলবে না। চলবে না বুঝেই সম্ভবত খ কথা বলতে শুরু করলেন। এমনি কথা, ঘর সংসারের কথা। বাইরে থেকে পুলিশের যদি চোখে পড়ে গাড়িটি, যেন না ভাবতে পারে যে এই গাড়ির ভেতরের মানুষগুলো ঠিক স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। গাড়ি থামালে সর্বনাশ। পাঁচটা টুপি পরা লোক হনহন করে এগিয়ে আসছে ফুটপাত ধরে, গাড়ি থেমে আছে রিক্সার ভিড়ে, ক আমার মুখটি তার মাথা দিয়ে ঢেকে রাখতে চাইছেন। এরপর খ আমার পিঠে ধাককা দিয়ে শরীর উপুড় করে দিলেন। রিক্সা কাটিয়ে গাড়ি কিছুদূর সামনে এগোনোর পর মাথা তুলি, ভয় কেবল আমার হৃদপিণ্ডে হাতুড়ি পেটাচ্ছে না, ক এবং খকেও নিস্তার দিচ্ছে না, বুঝি। মাথা তোলার পরই দেখি দু গজ দূরেই দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের গাড়ি। খ গলা চেপে বললেন, শুয়ে পড়। ওটুকু জায়গা শুয়ে পড়ার জায়গা নয়। চোখ নামিয়ে রাখি, নাক মুখের ওপর আঁচল টেনে দিই, মাথা ঢাকা। ক খ সকলেই নিজ নিজ মাথায় আঁচল বা ওড়না তুলে দেন। খর আত্মীয়ও তাই করেন। গাড়ির চারজনের মধ্যে একজন পর্দানশীন হলে পুলিশের সন্দেহ হতে পারে। সকলে আমরা মুহূর্তের মধ্যে ভদ্র ঘরের পর্দানশীন মহিলা বনে যাই। মৌলানা বরকতউল্লাহর দুই বিবি আর দুই কন্যা কোনও আত্মীয়র বাড়ি যাচ্ছে, পুলিশকে এরকম একটি সাধারণ কিছু ভাবার সুযোগ দেওয়া হয়। পুলিশ পার হলে গাড়ির ভেতরের মানুষগুলোর মাথা থেকে আঁচল খসে না। বলা যায় না, আবার কোন মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের লোক। গাড়ি নিঃশব্দে পথ পেরিয়ে গুলশানের একটি বাড়ির দরজায় থামে। আমরা গাড়ি থেকে নেমে অন্ধকারে মিশে বাড়ির সামনের মাঠে এসে থামি। পর্দার তলায় একটি কালো মিশমিশে ভয় দাঁত মেলে আছে। গালে দুটো শক্ত চড় কষিয়েও এর দাঁত লুকোতে পারি না।
বাড়ি থেকে ঘেউ ঘেউ করে একটি কুকুর বেরিয়ে এল। কুকুরের ঘেউ ঘেউ থামাতে একজন ভদ্রলোক পেছন পেছন দৌড়ে এলেন। ভদ্রলোক কুকুর নিয়ে ভেতরে ঢুকে বারান্দার আলো নিবিয়ে দিলেন। অন্ধকারের পেছন পেছন আমরা। ভদ্রলোকের স্ত্রী, ধরা যাক তিনি গ, আমাদের ভেতর ঘরে নিয়ে ক এবং খ র মুখে ঘটনার অতি সামান্য শুনেই গ ঘরের আলো কমিয়ে দিলেন। দরজা জানালা সব বন্ধ করে আমাদের সামনে চিন্তিত মুখে আইনের একটি বই হাতে নিয়ে বসলেন। আইন নিয়ে ক এবং গর মধ্যে কথা হয়। খুব নিচু স্বরে কথা হয়। কারও মুখ তেমন স্পষ্ট করে আর দেখা যায় না। কথা যা হয়, বেশির ভাগ কথাই আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না। গর সঙ্গে কথা শেষ করে ক আমাকে বললেন যে কাল তিনি আমার উকিলের সঙ্গে জামিনের ব্যাপার নিয়ে কথা বলবেন, জানতে চাইবেন কোনও রকম ফাঁক ফোকর আছে কি না জামিন নেওয়ার। আজ রাতটি গ রাজি হয়েছেন আমাকে তাঁর বাড়িতে রাখতে। এক রাতের বেশি তিনি রাজি নন, কারণ, তাঁর ভয় আশেপাশে দূতাবাস থাকার কারণে প্রচুর পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তায়, যে কোনও সময় তারা জেনে যেতে পারে যে আমি এ বাড়িতে আছি। এ বাড়ির চাকর বাকর আমার বদনখানি দেখলেই চিনে ফেলবে আমি কে, বাইরে গিয়ে কারও কাছে যদি বলে দেয় অতিথির পরিচয়, তবেই জানাজানি হয়ে যাবে। ক আরও বললেন, জামিন পেতে যদি দেরি হয়, তবে কোথায় আমি লুকিয়ে থাকব, সে ব্যবস্থা যেন আমি করে নিই। তিনি মিলনকে খবর দেবেন, মিলন আমাকে এ বাড়ি থেকে নিয়ে যাবে কোনও গোপন জায়গায়। গোপন জায়গাটির কথা যেন আমি ভেবে রাখি।
জায়গা তো কতই আছে। কিন্তু গোপন কোনও জায়গা তো আমার নেই। কার বাড়িতে আমি যাবো নিজেকে লুকিয়ে রাখতে, ভাবি। খ জিজ্ঞেস করলেন আমার কোনও আত্মীয় আছে কি না ঢাকায়। মামা আর খালা আছেন, বলি। বন্ধু আছে? কোনও বন্ধুর বাড়িতে যাওয়া যায় না? তা নিশ্চয়ই যায়। বন্ধুরা খবর শুনলে তো আমাকে সব রকম সাহায্য করবে। ক বললেন, পুলিশ ওসব জায়গায় আপনাকে খুঁজতে যেতে পারে। এমন কেউ আছে যাদের আপনি চেনেন কিন্তু তাদের বাড়িতে আগে যাননি?
অসহায় বালিকা মাথা নাড়ি। মনে হচ্ছে মাথা পাথর হয়ে আছে, মাথায় কিছু ঢুকছে না, মাথা থেকে কিছু বেরোচ্ছে না।
গ বললেন, এ সময় তো ওকে কোনও অ্যামবেসিতে পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম দিতে পারে। কারও বাড়িতে থাকার চেয়ে অ্যামবেসিতে থাকা নিরাপদ। কোনও অ্যামবেসিতে ঢুকে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারে না।
আমি তৎক্ষণাৎ বলে উঠি মনে মনে তুড়ি বাজিয়ে, আমার সঙ্গে আমেরিকান অ্যামবেসির ফার্স্ট সেক্রেটারির পরিচয় আছে। তিনিই তো আমার পাসপোর্ট নিয়ে দিলেন।
বাহ! ক,খ, গ নিশ্চিন্তের শ্বাস ফেললেন।
গ বললেন, আপনি আজ রাতেই ফোন করুন অ্যামবেসির লোককে। এরকমও হতে পারে আজ রাতেই আপনাকে ওরা নিয়ে যাবে।
গ আমেরিকার দূতাবাসের ফোন নম্বর যোগাড় করে আমাকে দেন। দূতাবাসে ফোন করলে একজন রক্ষী ফোন ধরেন। অ্যাণ্ড্রুর খোঁজ করলে রক্ষী জানান, অ্যাণ্ড্রু এখন বাড়িতে। রক্ষীকে অনুরোধ করি যেন অ্যাণ্ড্রুর বাড়িতে ফোন করে জানান যে আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই, চাই আজ রাতেই। আধঘন্টা পর আবার ফোন করে রক্ষীর কাছ থেকে অ্যাণ্ড্রুর বাড়ির টেলিফোন নম্বর নিই। রাত তখন অনেক, অ্যান্ড্রু শুয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে হুলিয়ার খবরটি দিয়ে কোনও রকম রাখ ঢাক না করে আমাকে যেন দূতাবাসে তিনি আশ্রয় দেন, সেই অনুরোধ করি। অ্যান্ড্রু বললেন এই রাতে এখন কিছুই করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, আমি যেন কাল সকালে তাঁকে আপিসে ফোন করি।
ক, খ এবং আত্মীয় চলে গেলেন, আমাকে বলে গেলেন, আমি যেন ভুলেও ফোন না করি আমার বাড়িতে। কারণ বাড়িতে ফোন নিশ্চয়ই ট্যাপড হচ্ছে, পুলিশ জেনে যাবে আমি কোথায় আছি।
সারারাত একটি অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকি। এক ফোঁটা ঘুম আসে না।
৩. অতলে অন্তরীণ – ০২
পাঁচ জুন, রবিবার
সকালে গ অনেকগুলো পত্রিকা সামনে নিয়ে বসেছিলেন। প্রতিটি পত্রিকায় প্রথম পাতায় আমার ছবি সহ গ্রেফতারি পরোয়ানার খবর। আমি পত্রিকাগুলো দেখতে চাইলে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন যে সকালে তিনি কাজের লোককে দেখেছেন মন দিয়ে পত্রিকা পড়ছে। লোকটি লেখাপড়া জানে, সুতরাং কেবল ছবি দেখেই শেষ করেনি, খবরও পড়েছে। এ বাড়ির অতিথির দিকে কাল রাতে তার চোখ না পড়লেও আজ তো চোখ পড়বে। তাকে, কাজের লোককে হঠাৎ করে তিনি এখন ঘরবন্দি করতে পারেন না। বাইরে পাঠিয়ে দিতেও পারেন না। তাহলে সন্দেহ আরও ঘন হবে।
প্রতিটি পত্রিকায় গ্রেফতারি পরোয়ানার খবর।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনার অভিযোগ এনে তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি
লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ঢাকার মতিঝিল থানার ওসি মোঃ নুরুল আলমের দায়েরকৃত মামলার প্রেক্ষিতে গতকাল ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম শহীদউদ্দিন আহমেদ এই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দিয়েছেন। বাদী তার আরজিতে উল্লেখ করেন, তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও সাম্প্রতিককালে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে ইসলাম ধর্ম ও ইসলাম বিদ্বেষী বহু কটূক্তিপূর্ণ মন্তব্য করছেন যা বহুলভাবে প্রচারিত হচ্ছে। বিবাদী সজ্ঞানে ইচ্ছাকৃতভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এইরূপ দুরভিসন্ধিমূলক কাজে লিপ্ত আছেন। বাদী তার আরজিতে বলেন, গত ৯ মে তসলিমা নাসরিন তাঁর দেওয়া কলকাতার ইংরেজি দৈনিক দি স্টেটসম্যান পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পবিত্র কোরান শরীফ মানব সৃষ্ট গ্রন্থ। তিনি কোরান শরীফের আমূল পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন চান। ১১ মে উক্ত পত্রিকায় তাঁর লেখা একটি চিঠি বেরিয়েছে, চিঠিতে তসলিমা নাসরিন পবিত্র কোরান শরীফকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুগোপযোগী নয় বলে মন্তব্য করেন এবং কোরান অনুযায়ী পরিচালিত না হবার জন্য মতামত প্রকাশ করেন। বাদী আরও উল্লেখ করেন, তসলিমা নাসরিন তাঁর ধর্ম বিরোধী য়েচ্ছ!চারমূলক ও বিকৃত মতামত, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে সকলের ধিককারের পাষনী হিসাবে পরিগণিত হয়েছেন ও বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ২৯৫ (ক) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। উল্লেখ্য, তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার জন্য বাদী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের স্মারক নং ৩৩৮/ বিবিধ ৪৮/৯৪ (আইন) তারিখ ৬.৪.৯৪ ইং মোতাবেক মঞ্জুরিপ্রাপ্ত হয়েই গতকাল আদালতে মামলাটি দায়ের করেন। আদালতে অভিযোগকারীর পক্ষে এপিপি বোরহানউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। মামলায় ১১ ব্যক্তিকে সাক্ষী করা হয়েছে, তাঁরা হলেন মেজর জেনারেল (অবঃ) আনিস ওয়াইজ, প্রিন্সিপাল বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ; মুফতি মাওলানা ফজলুল হক আমিনী, প্রিন্সিপাল লালবাগ আলিয়া মাদ্রাসা; এডভোকেট এবিএম নূরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার কোরবান আলী, অধ্যাপক আবু আহমেদ চৌধুরী, প্রফেসর এজিএম চৌধুরী, আলহাজ্ব মেজবাউর রহমান চৌধুরী, মাওলানা জুমায়েত আল হাবীব, মাওলানা আবদুল জব্বার, মাওলানা মহীউদ্দিন খান, মাওলানা আবদুল লতিফ। মামলার পরবর্তী তারিখ আগামী ৪ঠা জুলাই। এদিকে তসলিমা নাসরিনকে গ্রেফতার করার জন্য মতিঝিল থানার ২টি স্কোয়াড ছাড়াও গোয়েন্দা পুলিশের একটি বিশেষ স্কোয়াড গতকাল থেকেই তাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। তসলিমা নাসরিন যেন আকাশপথে বা সীমান্তপথে দেশের বাইরে যেতে না পারে সে ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্যে পুলিশের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে বলে পুলিশ সূষেন জানা গেছে।
বাকি খবরগুলো আমার বিরুদ্ধে মিছিলের, বিবৃতির। ১২৯ জন আলেম বিবৃতি দিয়েছেন, (তখনও তাঁরা জানেন না যে আমার বিরুদ্ধে সরকার মামলা করেছে) ইহুদি নাসারাচক্র তসলিমা নাসরিনদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে এই দেশ থেকে ইসলাম মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। সরকারের কাছে বারবার দাবি জানাবার পরও সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। পরন্তু পুলিশি পাহারা বসিয়ে তাদের নাস্তিকতা প্রচারে সহায়তা করছে। অবিলম্বে মুরতাদদের ফাঁসি না দিলে তৌহিদী জনতার হাতেই তাদের চূড়ান্ত ফয়সালা হবে। ইয়ং মুসলিম সোসাইটি বিশাল ব্যানার নিয়ে আমার ফাঁসি চেয়ে শহরে বিক্ষোভ মিছিল করে। মিছিল শেষে সভায় ডাঃ নুরুল ইসলাম বলেন, তসলিমা নাসরিনের মত নির্লজ্জ মহিলা আমার সত্তর বছর বয়সে একজনও দেখিনি। এই মহিলাকে শাস্তি না দিলে দেশবাসী বিএনপি সরকারকে ক্ষমা করবে না।
তসলিমার শাস্তির দাবিতে গোটা জাতি ফুঁসে উঠেছে, এই হল শিরোনাম। জামাতে ইসলামি, জাতীয় যুব কমাণ্ড, খেলাফত আন্দোলন, সচেতন যুব সমাজ, ওলামা কমিটির বিবৃতি, বিক্ষোভের খবর এর তলায়। এছাড়া আরও খুঁটিনাটি, কাল কটার সময় আমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। কটা পর্যন্ত বাড়ি ফিরিনি। কি রঙের গাড়িতে করে বেরিয়েছি। গাড়ির নম্বর কি ছিল। উত্তরে গেছি নাকি দক্ষিণে। পুলিশ কবার গেছে আমার বাড়িতে, কটা থেকে কটা পর্যন্ত ছিল। কাকে কাকে জেরা করেছে। কাকে বেঁধেছে, কাকে ছেড়েছে।
গ আজ আমার কারণে আপিস কামাই দিয়েছেন। সকালে এক কাপ চা খাবার তৃষ্ণাটি তাঁকে জানালে তিনি নিজে চা বানিয়ে দেন। কোনও কাজের লোককে আমার আশেপাশে ভিড়তে দিচ্ছেন না। বড় ফটকে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন। কাজের লোকদের কেউ যেন বাড়ির বাইরে যেতেও না পারে। সারা শহরে পুলিশ যাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজছে, তিনি তাকে লুকিয়ে রেখেছেন তাঁর বাড়িতে। গ স্থির হয়ে কোথাও বসতে পারছেন না। আমার দিকে বিরক্ত-চোখে খানিক পর পর তাকাচ্ছেন। আমি যেন এ বাড়িতে এসে একটি মহা অপরাধ করে ফেলেছি। চা এ চিনি দেওয়া হয়নি, চিনি ছাড়াই চায়ে চুমুক দিই, গর কাছে চিনি চেয়ে তাঁকে আর বিরক্ত করতে ইচ্ছে করে না। ঘড়ির কাঁটার দিকে চোখ আমার, নটা বাজতেই উঠি অ্যাণ্ড্রুকে ফোন করতে। তাঁকে নতুন করে কিছু বলতে হয় না আজ, তিনি পত্রিকায় সব খবরই পড়েছেন।
আমাকে আশ্রয় দিন আপনাদের দূতাবাসে। এ শহর বা শহরের বাইরে আমার এমন কেউ নেই যে আমাকে নিরাপদ কোনও আশ্রয় দিতে পারে। দূতাবাস ছাড়া আর কোথাও নিরাপত্তা নেই। দ্রুত বলি, কণ্ঠ আমার কাঁপে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আশংকা, নিরাপত্তাহীনতায়।
অ্যান্ড্রু বললেন, দূতাবাস হুলিয়া মাথায় নিয়ে ঘোরা কোনও আসামীকে আশ্রয় দিতে পারে না।
অ্যান্ড্রুর ওপর যে বড় ভরসাটি ছিল আমার, মুহূর্তে মুখ থুবড়ে পড়ে।
–আমি শুনেছি দূতাবাসে আশ্রয় চাওয়া যায়। এ সময় আশ্রয় আমাকে দিতেই হবে। আপনি কেন বুঝতে পারছেন না! আমাকে জেলে পোরা হবে, জেলে তো আমাকে মেরে ফেলবে। আপনারা আমার নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন, পাসপোর্ট পাইয়ে দিলেন। এখন আমার জীবন বাঁচাবার জন্য কেন চেষ্টা করবেন না! পাসপোর্টের চেয়ে তো জীবনের মূল্য বেশি! নাকি না!
অ্যাণ্ড্রু নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন, আপনি আপনার উকিলের সঙ্গে কথা বলুন। আপনার উকিলকে বলুন জামিনের জন্য চেষ্টা করতে।
–জামিন যদি না হয়! এই মামলায় তো জামিন হয় না। আর জামিন যে কদিন না হবে, ততদিন কি হবে? কে আমাকে আশ্রয় দেবে।
—সে ব্যাপারে আমরা কিছু বলতে পারছি না।
—আপনারা তাহলে কোনও সাহায্যই করবেন না?
—শুনুন তসলিমা, আপনাকে পাসপোর্টের জন্য সাহায্য করেছিলাম। তা আপনি পত্রিকায় লিখে দিয়েছেন। ওটা তো জনগণকে জানানোর ব্যাপার ছিল না। একটা ডিপ্লোমেটিক ব্যাপার এরকম পাবলিক করে দিয়ে খুবই অনুচিত কাজ করেছেন আপনি।
অ্যান্ড্রু আমাকে অবাক করেন। তাঁকে বরং আমি প্রশংসা করছি পাসপোর্ট পাইয়ে দিয়েছেন বলে। প্রশংসা করলে কই খুশী হবে তা নয় ব্যাটা রাগ করছে।
—আমি খুবই দুঃখিত। আমি জানতাম না যে জানানো উচিত নয়। এখন আপনার শরনাপন্ন হলাম এই কারণে যে বিদেশি দূতাবাসের অন্য কাউকে আমি চিনিনা, এক আপনাকে ছাড়া। এখন আমি কি করব বলুন। আমি কি আশ্রয় চাইতে পারি না! শুনেছি রাজনৈতিক আশ্রয় নাকি চাওয়া যায় যখন দেশে বিপদ ঘটে!
–তা নিশ্চয়ই যায়। কিন্তু এভাবে কাজ হবে না। এ দেশের আইনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা দেখাতে হবে তসলিমা। বিশেষ করে হুলিয়া যখন জারি হয়ে গেছে।
রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে হলে আপনাকে এ দেশ থেকে বেরোতে হবে। আপনি ভারতে চলে যান। ভারতে গিয়ে আপনি আশ্রয় চান। এ দেশের আইনে আপনি এখন আসামী। কোনও দূতাবাসই এখন আপনার জন্য কোনও কিছুই করতে পারে না। আপনার বিরুদ্ধে হুলিয়া না থাকলে আমরা হয়ত আপনাকে সাহায্য করতে পারতাম।
–ভারতে যাবো? কি করে যাবো? আমার জন্য সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমার তো এ দেশ থেকে এখন বেরোবার উপায় নেই।
–আমি খুবই দুঃখিত তসলিমা। আপনাকে আমরা কোনও সাহায্য করতে পারছি না এখন। আমি আপনার উকিলের সঙ্গে কথা বলব মামলা নিয়ে। আপনার পরিবারের কাউকে, আপনার কোনও এক ভাইকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবেন। আপনার খবরাখবর নেওয়া যাবে।
— আমি মরে গেলে আমার খবর দিয়ে আর কি করবেন আপনারা?
আমি ফোন রেখে দিই। কণ্ঠের কাছে যে কষ্ট জমাট বেঁধে ছিল, সেটি বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসে। বাচ্চা মেয়ের মত কেঁদে উঠি। আমার জন্য আরেকটি বুক ভাঙা কান্না অপেক্ষা করছিল। আমি জানতাম না যে অপেক্ষা করছিল। না, তা আমার জানার কথা নয়। রাজনৈতিক আশ্রয়ের চেয়ে বড় একটি আশ্রয় আমার আছে, তিনি শামসুর রাহমান। সেই আশ্রয়কে, সেই নিরাপত্তাকে, সেই নির্ভয়কে, ঝড়ে ঝঞ্ঝায় আগুনে রোদ্দুরে যিনি ছাতার মত, তাঁকে আমি ফোন করি। তিনিই ফোন ধরেন।
আমি শুধু বলি, রাহমান ভাই, আমি। ওপাশে এক মুহূর্ত নীরবতা। পরের মুহূর্তেই তাঁর ব্যস্ত কণ্ঠস্বর, শোন, কোনও কথা বলা যাবে না। আমার টেলিফোন ট্যাপড হচ্ছে।
ওপাশে ফোন রেখে দেওয়ার খটাশ শব্দ।
শব্দটি বুকে এসে লাগে। বুকে যেন বজ্রপাত হল। যেন বুকের মাংস ছিদ্র হয়ে ঢুকে গেল তীরের মত কিছু। ফোন তো ট্যাপড হবে আমার, আমার মত অপরাধীর। সমাজের নামী দামী মানুষের ফোন কেন ট্যাপড হবে! এ কি একধরনের বাঁচা যে তুমি মরছ মরো, এখন ভাই তোমাকে জন্য আমাদের কিছু করা সম্ভব নয়। তোমার জন্য আমরা মরব কেন! অতএব আমার ফোন ট্যাপড হচ্ছে। তুমি আর যোগাযোগ করো না।
মনে মনে কি আমি ভাবিনি শামসুর রাহমান বলবেন, কোথায় আছ তুমি? খবরটি শোনার পর অস্থির হয়ে আছি। আমি অনেকের সঙ্গে তোমার বিষয়ে কথা বলেছি। আমরা তোমাকে নিরাপদে কোথাও রাখার জন্য চেষ্টা করছি। আমার বাড়িতে এক্ষুনি চলে এসো। অথবা তুমি কোথায় আছো বলো, আমরা তোমাকে গিয়ে নিয়ে আসবো। আমরা লড়ে যাবো এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। কোনও রকম দুশ্চিন্তা কোরো না।
ভাববো না কেন! শামসুর রাহমান তো ছিলেনই আমার পাশে সবসময়। ব্যক্তিগত, আদর্শগত ঘনিষ্ঠতা আমার সবচেয়ে বেশি ছিল তাঁর সঙ্গেই। তাঁরও তো সেই একই। আমি কি তাঁর খুব কাছের মানুষ ছিলাম না! এই আচমকা বিপদ এলে আমি যদি তাঁর কাছে না যেতে পারি, কার কাছে যাবো!
ক আসেন সকালেই। ককে জানাই যে দূতাবাসে আমার আশ্রয় হবে না। কর মুখটি মুহূর্তে করুণ হয়ে ওঠে।
–তাহলে কি করবেন এখন? কোথায় যাবেন, ঠিক করেছেন কিছু?
–আমার কোথাও যাবার নেই। আত্মসমর্পণ কঞ্চরা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
ক আমার পাশে বসে মৃদুকণ্ঠে বললেন যে তিনি আমার উকিলের সঙ্গে কথা বলেছেন। উকিল আজই জামিন নেবার জন্য আদালতে যাচ্ছেন।
–তাহলে কি জামিন হবে? আমি উদগ্রীব।
–হলে তো আপনি জানতেই পারবেন। কিন্তু আজ রাতে তো কোথাও থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে তো গ রাজি হচ্ছেন না। গ কে বলেছিলাম যেন আজকের রাতটা এখানে থাকতে দেন।
ক কিছু খবর দ্রুত দিয়ে গেলেন। মিলন তাঁর কাছে সকালেই এসেছিল। কাল রাতে পুলিশ আমার বাড়িতে কয়েকবার গিয়েছে। বাড়ি তছনছ করেছে। রীতিমত সন্ত্রাস যাকে বলে। সবাইকে জেরা করেছে। জেরার নামে চিৎকার চেঁচামেচি অনেক করেছে। মিলনকে জিজ্ঞেস করেছে কোথায় গিয়েছিল সে আমাকে নিয়ে। হাজতে নিয়েও মিলনকে ঘণ্টাখানিক জেরা করেছে, তারা জানে যে সে আমার সঙ্গে বেরিয়েছিল, কোন বাড়িতে আমাকে সে পৌঁছে দিয়েছে সেটি জানার জন্য তাকে ঘামিয়ে কাঁপিয়ে কাঁদিয়ে ছেড়েছে। মিলন তবু বলেনি। সাহাবুদ্দিনকেও গুঁতিয়েছে, কোন বাড়িতে তিনি আমাকে নিয়ে বিকেলে বেরিয়েছিলেন তা জানতে। সাহাবুদ্দিনের পেট থেকে পুলিশ একটি শব্দও বের করতে পারেনি। ক মিলনকে পরামর্শ দিয়েছেন আপাতত বাড়িতে না গিয়ে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থাকতে।
ক চলে গেলেন আজ রাতের জন্য কোথাও কোনও বাড়ি পাওয়া যায় কি না দেখতে। ক র উদভ্রান্ত মুখ দেখে বড় মায়া হয়। ক আমার এমন কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধু নয় যে এত বড় দায়িত্ব তাঁকে আমি দিতে পারি। আমাকে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েই এখন দেখছেন তাঁর ঘাড়ের ওপর বসে আছি আমি। ক বলেছেন এ সময় কোনও বাড়িতে আশ্রয় পাওয়া আর আকাশের চাঁদ হাতের মুঠোয় পাওয়া এক কথা। কেউ আশ্রয় দিতে চাইবে না। ক ভুল বলেননি। পুরো দেশের সবচেয়ে বড় খবর এটিই এখন। মৌলবাদীরা উল্লাসে ফেটে পড়ছে। দেশ এখন আক্ষরিক অর্থেই তাদের দখলে। মৌলবাদীদের ভয়, পুলিশের ভয়। কার এত বড় বুকের পাটা যে বলে যে হ্যাঁ আশ্রয় দেব! ঝুঁকি নেব। যে আমাকে আশ্রয় দেবে সে-ই অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে আইনের চোখে। তার ওপর মৌলবাদীরা পেলে আমাকেই কেবল ছিঁড়ে খাবে না, আশ্রয়দাতা বা দাত্রীকেও কাঁচা খেয়ে ফেলবে।
সারাদিনই গ উৎকণ্ঠায় ছিলেন। ঘরের জানালাগুলো একটিও খোলা হয়নি। দরজাগুলো তালাবন্ধ। বারবারই তিনি ঝিম ধরে বসেছিলেন আর অপেক্ষা করছিলেন রাত হওয়ার। রাত হচ্ছে কিন্তু ক আসছেন না আমাকে নিতে। ক র বাড়িতে ফোন করে ককে আসতে বলবেন সেটিও করছেন না, কারণ কর বাড়ির ফোনে আড়ি পাতা হতে পারে। কঞ্চর বাড়িতে আমি গিয়েছিলাম এই খবরটি জেনে গেলে পুলিশ ককে সন্দেহতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করবে। ক নিজেও বলেছেন তাঁর বাড়িতে যেন ফোন না করা হয়। গ তাঁর স্বামীকে পাঠিয়ে দিলেন ক র বাড়িতে, যেন ক অথবা খ এসে আমাকে এ বাড়ি থেকে নিয়ে যান। আমার বিশ্বাস, ক কোনও বাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না আমাকে রাখার। কিন্তু বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাক বা না যাক আমাকে এ বাড়ি থেকে আজ রাতে বিদায় নিতেই হবে। গ র স্বামী খবর দিয়ে চলে এসেছেন। কিন্তু তারপরও ক র দেখা নেই। গ একবার উঠে দরজার কাছে যান, একবার জানালার কাছে, একবার ফোনের কাছে। কোনওটিই তিনি স্পর্শ করছেন না, কিন্তু করতে চাইছেন স্পর্শ।
যদি ক কোথাও না পেয়ে থাকেন লুকিয়ে থাকার জায়গা! এক চিলতে, এক ফালি জায়গা।
তাহলে কর বাড়িতে থাকবেন বা কিছু।
কিন্তু..
শুনুন, গ বলেন, আপনি কিন্তু ভাববেন না আপনাকে আমি চলে যেতে বলছি আমার নিরাপত্তার জন্য। এটা আপনার নিরাপত্তার জন্য। এখানে থাকলে আপনাকে পুলিশে ধরার আশংকা খুব বেশি।
এক দমে গ কথাগুলো বলেন। মানবাধিকার বিষয়ের আইনজ্ঞ তিনি, তিনি ফালতু কথা বলেন না।
ক রাতে আসেন। মলিন মুখ। কর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বারবারই তিনি হাতের পিঠে ঘাম মুছে নিচ্ছেন। ঘাম আবার জমছে। তাঁর ইশারায় আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। অন্ধকারে রাখা গাড়িটিতে উঠি। ক আমাকে শুয়ে পড়তে বললেন পেছনের আসনে। একটি চাদর বিছিয়ে দিলেন আমার ওপর। চাদরের ওপর কিছু কাপড় চোপড় ব্যাগ ইত্যাদি ডাঁই করে রাখলেন। বাইরে থেকে কারও যদি চোখ যায় ভেতরে, ভেবে নেবে গাট্টি বোঁচকা নিয়ে নিশ্চয়ই যাচ্ছে এরা ঢাকার বাইরে কোথাও। পথের বিপদ আপদ পেরোতে পেরোতে গাড়ি যাচ্ছে। আজ বিশাল মিছিল হয়েছে মৌলবাদীদের। আনন্দে তারা শহরময় নৃত্য করছে। খুব সাবধানে গাড়ি চলছে, সন্দেহের কিছু মাত্র যেন কারও মনে না জাগে। ভেতরে কতগুলো প্রাণ কি অবস্থায় আছে, তা ভেতরের মানুষগুলোই জানে।
গাড়ি থামলে আমাকে নিয়ে দ্রুত একটি অ্যাপার্টমেণ্টে ঢোকানো হল। এই অ্যাপার্টমেণ্টে আমি এসেছি আগে। ধরা যাক এটি যার বাড়ি, তার নাম ঘ। ঘ ঘরের আলো প্রায় নিবিয়ে অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। ক অনেক চেষ্টা চরিত্র করে এ বাড়িটিই পেয়েছেন যে বাড়িতে আমাকে থাকতে দেওয়ায় কোনও আপত্তি নেই। ঘ আমার লেখালেখি পছন্দ করেন। শান্তিবাগের বাড়িতে তিনি দুবার গিয়েছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। দুবার আমাকে এ বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। চমৎকার মহিলা এই ঘ। নিজেও লেখালেখি করেন। ঘ র স্বামীও বেশ নামী লোক। আমাকে ছোট একটি ঘর দেখিয়ে বললেন, ওটিই আমার ঘর। এ বাড়িতে একটিই অসুবিধে সে হল কাজের লোক। আমি যদি সারাদিন ঘরের বাইরে না বেরোই, তবে কাজের লোক আমার মুখ দেখবে না। ক জিজ্ঞেস করলেন, কয়েকদিনের মামলা কিন্তু। জামিন না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকতে পারবে তো! ঘ বললেন, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। ওর এই বিপদের সময় আমাদের তো কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই ওকে সাহায্য করতে হবে। ঘ বলে চললেন, এই এলাকাটা খুব নিরাপদ। এলাকায় আজে বাজে লোক নেই বললেই চলে। ছোট ঘরটি বাইরে থেকে বন্ধ থাকে। এটি বন্ধ থাকলে কেউ বুঝবেও না যে ঘরে কেউ আছে। আমার মেয়ে যখন বেড়াতে আসে, তখন এ ঘরটিতে থাকে। ওর ইদানীং এখানে আসার কোনও পরিকল্পনা নেই।
ঘ র স্বামী বললেন, কোনও ভয় নেই। ওর যতদিন ইচ্ছা, ততদিন ও এখানে থাকবে।
ক র মুখে হাসি ফোটে। আমার মুখেও। অপ্রত্যাশিত একটি প্রস্তাব। এর চেয়ে স্বস্তিকর আর কী আছে এ সময়!
ঘ আমাকে একটি লম্বা জামা দিলেন শাড়ি পাল্টে ঘরে পরে থাকার জন্য। কিছু বইও দিয়ে গেলেন পড়তে। কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেল। দশ ফুট বাই দশ ফুটের ঘরটিতে কেবল একটি চৌকি, চৌকিতে শক্ত তোশকের বিছানা। একটি জানালা আছে, সাঁটা। এমন একটি ঘরকেই আমার রাজপ্রাসাদের মত মনে হয়।
৩. অতলে অন্তরীণ – ০৩
ছয় জুন, সোমবার
সকালবেলা ঘ নিজে আমার জন্য ট্রেতে করে নাস্তা নিয়ে আসেন। হাতে বানানো পাতলা রুটি, ডিম, আলুপটলভাজা, চা। কাজের মহিলা দিনে দুবেলা আসে, সকালে নাস্তা আর দুপুরের রান্না করে চলে যায়, আবার সন্ধেয় এসে রাতের জন্য রান্না বান্না করে। মহিলা যখন রান্নাঘরে ব্যস্ত, ঘ এলেন এ ঘরে, চোখে তাঁর করুণা। যখন আমাকে এ বাড়িতে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল আগে, তখন ওই চোখে দেখেছি আমাকে নিয়ে তাঁর গর্ব। অনেককে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আমার সঙ্গে পরিচিত হতে। আমাকে নিয়ে সেই উচ্ছাস আর নেই, গর্বের জায়গায় দুফোঁটা করুণা চিকচিক করছে। কাজের মহিলার চোখ ফাঁকি দিয়ে বেড়ালের মত দৌড়ে গিয়ে আমাকে টুপ করে ঢুকতে হয়েছে পেচ্ছ!বখানায়। তিনি সতর্ক। কোনও জানালা দরজার ফাঁক দিয়ে কেউ যেন আবার দেখে না ফেলে আমাকে। নাস্তা খেয়ে বন্ধ ঘরটিতে বসে বসে আজকের পত্রিকাগুলো পড়ি। একটি পত্রিকাতেও কোনও বিবৃতি নেই। কেউ প্রতিবাদ করেনি আমার বিরুদ্ধে সরকারের এই মামলার, এই হুলিয়া জারির। আমি কী আশা করেছিলাম? আজকের পত্রিকা ছেয়ে যাবে প্রতিবাদে? বিবৃতিতে? হ্যাঁ আশা করেছিলাম। আমার ফাঁসি চেয়ে গত শুক্রবারে যে মিছিলটি বায়তুল মোকাররম থেকে বেরিয়েছিল, সে মিছিল থেকে কিছু লোক জনকণ্ঠ পত্রিকা আপিসে ঢিল ছুঁড়েছিল। জনকণ্ঠে ইসলামের ন্যায় নীতি আদর্শ মহিমা ইত্যাদি বর্ণনা করার জন্য একটি নিয়মিত বিভাগ থাকে, ইসলামের প্রশংসা করাই এর মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু সেদিন এই বিভাগটিতে কোন একটি সুরার ব্যাখ্যা মৌলবাদীদের পছন্দ হয়নি। পছন্দ হয়নি বলে ঢিল ছোঁড়া। সেদিনই ঢিল ছোঁড়ার প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলেন বুদ্ধিজীবীরা। কিন্তু মিছিলগুলো যে আমার ফাঁসির জন্য ছিল এবং সেই কথার জন্য, যে কথা আমি বলিনি এবং তা পত্রিকায় প্রকাশিত, তারপরও কেউ সেই বিবৃতিতে বলেননি যে, যে কথা তসলিমা বলেনি সে কথার ভিত্তিতে তার ফাঁসি চাওয়া অন্যায়। আজকের পত্রিকাগুলোর খবর ঃ তসলিমা নাসরিনকে পুলিশ খুঁজছে। পুলিশ তাকে গ্রেফতারের জন্য হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। গতকাল সারা রাত এবং গতকাল রোববার সারাদিন গোয়েন্দাশাখার কয়েকটি দল ঢাকা মহানগরী এবং পাশ্ববর্তী এলাকায় ব্যাপক তল্লাশি অভিযান চালায়। তার আত্মীয় স্বজনের বাসায় পুলিশ তার খোঁজ করেছে। আত্মীয় স্বজনকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। পুলিশের ধারণা তসলিমা গ্রেফতার এড়ানোর জন্য ঢাকা মহানগরী অথবা দেশের অন্য কোথাও নিরাপদ জায়গায় আত্মগোপন করে আছেন। দেশের বাইরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বা সীমান্ত এলাকায় তাকে পেলে গ্রেফতারের আদেশ দেওয়া হয়েছে। তসলিমাকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশের কয়েকটি বিশেষ দলকে ময়মনসিংহ সহ ঢাকার বাইরে পাঠানো হয়েছে। এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, আমরা নাজুক অবস্থার মধ্যে আছি। তসলিমা নাসরিনকে গ্রেফতারের দায়িত্বে নিয়োজিত অফিসার-কনস্টেবলদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সব কটি দল তাকে গ্রেফতার অভিযানে ব্যস্ত রয়েছে।
আমার বিরুদ্ধে সরকারের মামলা আর আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতেই মৌলবাদীরা খুশিতে আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটায়নি। বরং আন্দোলনে এখন জোর বেড়েছে। আজ তাদের প্রশ্ন, এখনও কেন তসলিমাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না? তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, এ কোনও কথা হল? তাকে পেতে হবে এবং ফাঁসি দিতে হবে। এক্ষুনি। তাদের তর সইছে না। কেবল আমাকেই নয়। আরও দাবি এখন তাদের। অন্যান্য মুরতাদদেরও ফাঁসি দিতে হবে। তাদেরও গ্রেফতার কর। এনজিও বন্ধ কর। কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা কর। জনকণ্ঠ বন্ধ কর। মৌলবাদীদের পত্রিকায় প্রধান খবর, তসলিমার ফাঁসির দাবি অব্যাহত। জামাতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সভা সংগঠনের আমীর গোলাম আযমের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মুরতাদ ও ধর্মদ্রোহীদের কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানানো হয়। জামাতে ইসলামী আগামী ৮ জুন দাবি দিবস পালন করবে। ওলামা পরিষদ, খেলাফত মজলিশ, ইসলামী সংগ্রাম পরিষদ, মসজিদ রক্ষা আন্দোলন, বাংলাদেশ মসুল্লি কমিটি, আঞ্জুমানে তালামীযে ইসলামিয়া, খাদেমুল ইসলাম ছাত্র পরিষদ, নাস্তিক নির্মূল কমিটি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন থেকে কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী ভারতের পদলেহী জাতির কলংক কুখ্যাত মুরতাদ তসলিমা নাসরিনকে সরকার এখনও গ্রেফতার করে ফাঁসি দিচ্ছে না বলে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। নাস্তিক মুরতাদ প্রতিরোধ আন্দোলনের সংবাদ সম্মেলনে শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক বলেছেন, কতিপয় নাস্তিক ও ধর্মদ্রোহী ব্যক্তির ঔদ্ধত্য চরমসীমা লঙ্ঘনের পর্যায়ে। এরা কোরান ও হাদিসের সংশোধন ও পরিবর্তনের মত মারাত্মক দুঃসাহস দেখাচ্ছে। এই মহল দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস ও ঈমান আকিদার ওপর নগ্ন হামলা করছে, এর আগে যা কখনও হয়নি। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, বর্তমানে দেশে যে সরকার ক্ষমতাসীন তারা বিসমিল্লাহর দোহাই দিয়ে ভোট বাগিয়ে মসনদে বসেছে। বলা হয়ে থাকে যে সাংবিধানিকভাবে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্মের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। অথচ ইসলামের ওপর ফ্রি স্টাইলে আক্রমণের মোকাবেলায় সরকার নিস্ক্রিয় সাক্ষী গোপালের ভূমিকা অনুসরণ করে চলেছে। এমন কী নাস্তিক মুরতাদদের সুকৌশলে পৃষ্ঠপোষকতা দান করে চলেছে। তিনি সরকারের তীব্র নিন্দা করেন। অবিলম্বে নাস্তিক মুরতাদদের ধর্ম বিরোধী তৎপরতার জন্য কঠোর শাস্তির দাবি জানান। এবং সেই সঙ্গে ধর্মদ্রোহীতা আইন প্রণয়ণের দাবি জানান। দেশ ও ধর্মের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র ও গণতৎপরতা বন্ধ করতে প্রতিরোধ গড়ার লক্ষ্যে আগামী ১০ জুন শুক্রবার বাদ জুম্মা ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল হবে, আগামী ১৬ জুন বৃহস্পতিবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং স্মারকলিপি পেশ। ১৭ জুন শুক্রবার সকাল নটায় ওলামা মাশায়েখ দ্বীনদার বুদ্ধিজীবী সম্মেলন এবং বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
কেবল ঢাকায় নয়, সারা দেশেই মৌলবাদীদের সভা সম্মেলন চলছে। প্রতিটি সভায় বলা হচ্ছে, তসলিমার ফাঁসি চাই। মৌলবাদী সংগঠনের বিবৃতি তো আছেই। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬২ জন শিক্ষকও বিবৃতি দিয়েছেন, তাঁরাও আমার ফাঁসির দাবি করেছেন। ১৬২ জন শিক্ষকের মধ্যে আছেন, সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর এবং মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডঃ জহুরুল হক ভুঁইয়া, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সহ সভাপতি ডঃ মোঃ আবদুল হক, ডঃ মোঃ তাজুল ইসলাম, ডঃ মোঃ ইকবাল হোসেন, ডঃ মোঃ মইনুদ্দিন, অধ্যাপক এম এ ফারুক, ডঃ আবদুল হামিদ .।
না, কোথাও আমার বিরুদ্ধে সরকারের করা মামলাটির প্রতিবাদ করে একটি বিবৃতি নেই, একটি প্রতিবাদ নেই। খুঁজতে খুঁজতে একটি অখ্যাত পত্রিকার এক কোণে দেখি বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) পক্ষ থেকে আবদুল্লাহ সরকার বিবৃতি দিয়েছেন — দেশে যে মুহূর্তে ফতোয়াবাজ ধর্মান্ধ শক্তি প্রকাশ্য দিবালোকে হামলা চালাচ্ছে, তখন সরকার ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাদের ওই জাতীয় অপকীর্তিতে ইন্ধন জোগানোর জন্য লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা করেছে। ভারতীয় দি স্টেটসম্যান পত্রিকায় কথিত বক্তব্য প্রকাশিত হবার পর তসলিমা নাসরিন তার প্রতিবাদ করেছেন। তসলিমার সেই প্রতিবাদ স্টেটসম্যান এবং বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকসমূহে প্রকাশিত হবার পরও মামলা দায়েরের ঘটনা লেখকের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপের সামিল এবং ফতোয়াবাজ মৌলবাদী শক্তির কাছে আত্মসমপর্ণের নামান্তর। সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বেলাল চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতনও বিবৃতি দিয়েছেন। গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী সদস্যরা বাক, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ও মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে সরকার ও সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট চক্রের আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির প্রতি আহবান জানিয়েছেন। আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছেন।
বাসদ একটি ছোট রাজনৈতিক দল। জাসদ ভেঙে বাসদ হয়েছে। সেই বাসদও টুকরো হয়ে গেছে। বাসদের একটি টুকরো এই বিবৃতিটি দিয়েছে। গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটও ছোটখাটো একটি জোট। কিন্তু বড় দলগুলো কোথায়? যে আওয়ামী লীগ বিএনপির পান থেকে চুন খসলেই যে রাস্তায় নেমে পড়ে, সেই আওয়ামী লীগ কোথায়? কোথায় বড় বড় বামদল? মানবাধিকারের এই লঙঘন কেন তাদের চুপ করিয়ে রাখছে! আমার বন্ধুরা কোথায়? আমার কবি বন্ধুরা? লেখক বন্ধুরা? কোথায় বুদ্ধিজীবীরা? যাঁরা মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন! সবাই কেন চুপ হয়ে আছেন? আমার পক্ষে কথা বলতে ইচ্ছে যদি না হয়, বলবেন না। এখন পক্ষ বিপক্ষ বড় কথা নয়। বড় কথা অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। প্রতিবাদ করছেন না কেন তাঁরা? তাঁরা কি ভাবছেন এটি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার! এটি কি সত্যিই আামার ব্যক্তিগত ব্যাপার! আমি কি কাউকে খুন করেছি যে আমার বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদ করতে সংকোচ হচ্ছে! জার্মানীর এক প্রোটেস্টান্ট নেতা মার্টিন নিয়েমোলেরএর কথা মনে পড়ছে, নাৎসীরা যেভাবে ধরে ধরে মানুষ মারছিল, সে প্রসঙ্গে বলেছিলেন, প্রথম ওরা কম্যুনিস্টদের জন্য এল, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি কম্যুনিস্ট নই, এরপর ওরা ইহৃুদির জন্য এল, আমি প্রতিবাদ করিনি কারণ আমি ইহুদি নই, এরপর ওরা ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের জন্য এল, আমি প্রতিবাদ করিনি কারণ আমি ট্রেড ইউনিয়নিস্ট নই, এরপর ওরা ক্যাথলিকদের জন্য এল, আমি প্রতিবাদ করিনি কারণ আমি ক্যাথলিক নই। এরপর ওরা আমার জন্য এল, তখন আমার পক্ষে কথা বলার দেখলাম কেউ নেই।
সমাজতান্ত্রিক দলের যাঁরা আমার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে আমার কোনওদিন আলাপ হয়নি। তাঁদের সঙ্গে কখনও আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করিনি দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থা নিয়ে কথা বলে, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা নিয়ে। কিন্তু করেছিলাম তো অনেকের সঙ্গে। আমরা তো অনেকেই একই আদর্শের জন্য লড়াই করছিলাম, তাঁরা আজ হঠাৎ হারিয়ে গেলেন কেন? তাঁরা আজ কেউ আমার সঙ্গে নেই কেন!
বুকের ভেতর হু হু করে। আচমকা একটি আশঙ্কা আমাকে আঁচড় কাঁটতে থাকে। বন্ধ জানালাটির দিকে চোখ রেখে শুয়ে থাকি। জানালার ছিদ্র দিয়ে যে সরু একটি আলো ঘরে ঢুকছিল, ধীরে ধীরে সেটি দেখি কমে যাচ্ছে। বাইরে অন্ধকার। ভেতরেও অন্ধকার। দুই অন্ধকারের মাঝখানে আমি, আমি আর আশঙ্কা।
৩. অতলে অন্তরীণ – ০৪
সাত জুন, মঙ্গলবার গতকাল জামাতে ইসলামী আমার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বের করেছে। হাজার হাজার মানুষ ছিল সে মিছিলে। মিছিলের সামনে যে ব্যানারটি নিয়ে তারা হেঁটেছে, ওতে তসলিমা নাসরিনের ফাঁসি চাই লেখা নয়, লেখা ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক আইন চাই। বিপদের ঘন্টাধ্বনি বাজছে। শুনতে পাচ্ছে! কেউ, শুনতে পাচ্ছে!! জামাতে ইসলামি কেবল তসলিমার ফাঁসি দিয়ে তুষ্ট হতে চাইছে না। সংসদে ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে শাস্তির আইনের জন্য বিল পাস করার দাবি করছে। জামাতের সভায় বলা হচ্ছে, খোমিনীর ফতোয়ার ভয়ে রুশদি পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তসলিমারও তাই অবস্থা। তসলিমাদের খুঁটির জোর আধিপত্যবাদী ভারত, সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা এবং খ্রিস্টীয় সাম্রাজ্যবাদীদের ঐক্যবদ্ধ জেহাদের মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হবে। গোলাম আযমের প্রতিটি দিনই এখন স্বর্ণালী দিন। তিনি এখন দিন রাত ব্যস্ত। সরকারকে চাপ দিয়ে অনেক কিছু তো করানো হল, এটি হয়ে গেলে রাজ্যজয় হবে গোলাম আযমের জামাতের। মুসলিম লীগও নেমেছে আন্দোলনে, ইসলাম বিষয়ে তসলিমার অমার্জনীয় ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তির বিরুদ্ধে বিবৃতির ঝড় বইছে পত্রিকায়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ১০১ জন ছাত্রও বিবৃতি দিয়েছে, তারাও তসলিমার ফাঁসি চায়। ফাঁসি চায় জাতীয় ইসলামিক দল। তাহাফফুজে হারমাইন কমিটি। ইসলামি ছাত্র মজলিশ। একশ রকম দল। কেবল ঢাকায় নয়। সারা দেশে। এত যে ইসলামি দল আছে দেশে, আমার জানা ছিল না। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীর অনেকে বলতেন, মৌলবাদীরা খুবই ক্ষুদ্র একটি শক্তি, এদের নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করার কোনও মানে নেই। এরা লাফায় বেশি কিন্তু ভোট তো পায় না। ঠিক, এরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসতে পারেনি। কিন্তু আগে পেত তিনটে আসন, এখন পায় বারোটি আসন। কিন্তু যত কম আসনই পাক, এরা যা দাবি করছে, সরকার তো তার সবই মেনে নিচ্ছে। এরা আজ যে ধর্মদ্রোহিতার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আইনএর জন্য দাবি তুলছে, সরকার যদি এক সময় এটিও মেনে নেয়! এরা ক্ষুদ্র দল, তা জানি। কিন্তু ক্ষুদ্র দল সবসময় ক্ষুদ্রই থাকে না। ক্ষুদ্র দল অলক্ষ্যে দানবের মত বড় হতে থাকে। বিশেষ করে এদের যদি শুরু থেকেই প্রতিহত না করা যায়। ক্ষুদ্র বলে তুচ্ছ করে অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকে অনেকে, অনেক মৌলবাদ বিরোধী প্রগতিশীল মানুষ। মৌলবাদীদের ভিন্ন ভিন্ন দল থাকতে পারে কিন্তু এরা সঙ্ঘবদ্ধ। প্রগতিশীলদের দলে বিরোধ লাগে, কোন্দল হয়, দল শত টুকরো হয়, মতের অমিল হলে জন্মের শষনু বনে যায়। মৌলবাদীদের মধ্যে তা হয় না। তারা বৃহৎ স্বার্থে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে। বৃহৎ স্বার্থটি, দেশে ইসলামি শাসনতন্ত্র কায়েম করা — দেশটির আগপাশতলা ইসলামে মোড়ানো — দেশটির বুকে ইসলামের পেরেক গাঁথা। ইসলাম এখন আর কোনও ধর্ম নয়, ইসলাম এখন রাজনীতি। এই রাজনীতি জনপ্রিয় হওয়ার দিন আসছে। ঢেউ উঠছে ইসলামি জিগিরের। আশংকাটি এখন আর আঁচড় কাটে না, এখন ধারালো দাঁতে কামড়াতে থাকে। আর কতদিন ভেবে সুখ পাবে মানুষ যে মৌলবাদী দলটি একটি ক্ষুদ্র দল! ক্ষুদ্র দল ভেবে যে এদের মাঠে ছেড়ে দিয়েছো, ভেবেছো তোমার আঙিনায় এরা দখল বসাবে না, আহা তোমার দেখা হয়নি গায়ে গতরে কেমন বেড়েছে এ, কেমন ধারালো হয়েছে এর দাঁত নখ! কেবল তোমার আঙিনায় নয়, দরজা ভেঙে তোমার ঘরে ঢুকে পড়েছে! ধর্মের দৈত্যটি দেখ কেমন তোমার ঘাড়ের ওপর চড়ে বসেছে, এখন দেখ কেমন তোমার গলা টিপে ধরেছে। শ্বাস নিতে এখন কেমন লাগছে, বল তো!
পুলিশ আমাকে খুঁজে পাচ্ছে না। সারা দেশে খোঁজা হচ্ছে আমাকে। ময়মনসিংহের বাড়িতে, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব চেনা পরিচিতদের যত বাড়ি আছে, খোঁজা হচ্ছে। শান্তিনগরের বাড়িতে নাস্তানাবুদ হচ্ছে একেকজন। মোতালেবকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। আমি কোথায় আছি, বাড়ির কেউ জানে না, কিন্তু পুলিশের ধারণা, জানে। তাদের পেট থেকে আমার খোঁজ খবর বের করার সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। আমার আত্মীয়রা আমার উকিলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছেন। আমি আজ যাবো কাল যাবো উμচ আদালতে বা নিম্ন আদালতে, এরকম খবর প্রতিদিনই ছড়িয়ে পড়ছে, ছড়িয়ে পড়ছে আর ভিড় বেড়ে যাচ্ছে আদালত প্রাঙ্গনে। কিন্তু বৃথাই ভিড়, আমার টিকিটি কোথাও দেখা যায়নি। আরেকটি খবর পিলে চমকে দেয়, আমি যেহেতু ধরা দিচ্ছি না, আমার সম্পত্তি ক্রোক করার কথা ভাবছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়।
খবরঃ ধর্মদ্রোহীদের শাস্তি দিতে সংসদে আইন পাস করার দাবি নিয়ে জামাতে ইসলামি বায়তুল মোকাররম মসজিদের প্রাঙ্গণে এক বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। জামাতে ইসলামি বাংলাদেশের নায়েবে আমীর মাওলানা আবুল কালাম মুহম্মদ ইউসুফ বলেছেন, তসলিমা নাসরিনসহ ধর্মদ্রোহীদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেষনীকে স্পষ্ট বক্তব্য দিতে হবে। দেশবাসীকে জানাতে হবে খালেদা হাসিনা কি ধর্মদ্রোহী তসলিমার পক্ষে, না সাধারণ জনগণের পক্ষে। তসলিমা পবিত্র কোরান উল্টে দিতে চায় অথচ খালেদা হাসিনা একটা কথাও বলেন না। তসলিমার লাগামহীন বক্তব্য ও ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক ইসলাম বিরোধী চক্রের সাথে তার কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সে বলছে। কলকাতার সল্ট লেকে তাকে বাড়ি বানিয়ে দিচ্ছে বিজেপি। তসলিমা নিজেকে বেশ্যা বানিয়েছে, এখন আরও মহিলাকে সে বেশ্যা বানাতে চাচ্ছে। আগামী শুক্রবার জুম্মাহর নামাজের পর খুৎবায় তসলিমা সম্পর্কে বক্তব্য রাখার জন্য তিনি মসজিদের ইমামদের আহবান করেছেন। বক্তাদের মধ্যে জামাতে ইসলামির বড় নেতারা ছিলেন, সংসদ সদস্যও ছিলেন। তাঁরা বলেছেন, এবারের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে শুধু রাজপথের আন্দোলনে সীমাবদ্ধ না রেখে একটা পরিণতিতে নিয়ে যাওয়া হবে যাতে বাংলাদেশে আর কেউ ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারে। ভণ্ডামির একটা সীমা আছে, তসলিমাকে পুলিশ পাহারা দেবে আর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, এটা কেমন কথা!
খবরঃ সারাদেশে তসলিমার ফাঁসির দাবি তুঙ্গে উঠেছে। পবিত্র কোরান সম্পর্কে ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তির জন্য কুখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের ফাঁসি এবং দৈনিক জনকণ্ঠ নিষিদ্ধ করার দাবিতে সারাদেশে প্রতিবাদ সভা, মিছিল ও বিবৃতি অব্যাহত রয়েছে এবং তসলিমার প্রতি ঘৃণা ও ধিককারের জোয়ার প্রবলতর হচ্ছে। ঢাকা তো আছেই, এ ছাড়াও খুলনা, চট্টগ্রাম রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন সভা সমিতি সংগঠন থেকে দাবি উঠেছে, নাস্তিকতাবাদের নেষনী লজ্জার কুখ্যাত লেখিকা নির্লজ্জ তসলিমার বিরুদ্ধে কেবল গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে চলবে না, ফাঁসি দিতে হবে। জনকণ্ঠ পত্রিকায় সুরা ত্বীন এর অপব্যাখ্যা করা হয়েছে, জনকণ্ঠ নিষিদ্ধ করতে হবে। হাদিস ফাউণ্ডেশনের পরিচালক ডঃ মুহম্মদ আসাদুল্লাহ আল গালিব বিবৃতিতে বলেন, আট হাজার পাশ্চাত্য লেখক ও ছয় হাজার তিনশ পাশ্চাত্য সংগঠন যে তসলিমার পক্ষে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছে, নিশ্চয়ই সে ইহুদি নাছারাদের এ দেশীয় এজেন্ট, এতে কোনও সন্দেহ নেই। আর সে কারণেই সরকার এই কুখ্যাত মেয়েটি ও তার লেখনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পায়। সম্প্রতি তাকে গ্রেফতারের এক চমৎকার নাটক দেখিয়ে বর্তমান সরকার তার ভোটারদের আশ্বস্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু সে চালাকি বুঝতে কারো কষ্ট হয়নি।
গ্রেফতারি পরোয়ানার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ( কোনওদিন নাম শুনিনি), লেখক শিল্পী সংসদের ২৫ জন তরুণ লেখক লেখিকা ( মৃগাঙ্ক সিংহ ছাড়া কোনও নাম আগে শুনিনি)। ব্যক্তিগত বিবৃতি দিয়েছেন বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম (নাম শুনেছি)। বলেছেন যে তিনি অবাক হচ্ছেন আমার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির বিরুদ্ধে কেউ কোনও প্রতিবাদ করছেন না দেখে।
ঘ আজ সকালে আমার জন্য নাস্তা নিয়ে এসে চোখ টিপে বলেছেন আজ তিনি কাজের মহিলাকে সকাল সকাল বিদেয় করে দেবেন। তখন আমি এ ঘর ছেড়ে বেরোতে পারব, আমি এমনকী চাইলে সোফায় গিয়ে বসতে পারব। এই প্রস্তাব নিঃসন্দেহে চমৎকার। এই ঘরটি যদি প্রাসাদ হয়, তবে পাশের ঘরের সোফা তো রাজদরবারের মত। রীতিমত মসনদে গিয়ে বসা। পত্রিকার ওপর আমার এমন ঝুঁকে থাকা দেখে ঘ বলেন, এত কী পড়? বাদ দাও পড়া। আজ না হয় কাল তুমি জামিন পেয়ে যাবে। হৈ চৈ আর থাকবে না। দেখো তুমি!
জামিন যদি না হয়! আমার মলিন স্বর।
এও একটা কথা। জামিন যদি না হয়। এই সরকার যদি তোমাকে জেলে পাঠাতে চায়, যে করেই হোক পাঠাবে। এ দেশের জুডিশিয়াল সিসটেম তো ইনডিপেনডেন্ট না, সরকারি ইনফ্লুয়েন্সেই সব চলে। লোয়ার কোর্ট সরকারের ডাইরেক্ট আণ্ডারে। হাইকোর্ট অফিসিয়ালি ডাইরেক্ট না হলেও ইনডাইরেক্টলি আন্ডারে। তা না হলে হাইকোর্ট কিভাবে গোলাম আযমকে নির্দোষ প্রমাণ করে, বল! এই সরকার গোলাম আযমকে মুক্তি দিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন হাইকোর্টকে সরকারের আদেশ শুনতে হবে। তাছাড়া জাজরা তো আবার এক একটা পার্টির লোক।
হয়ত জেলই আছে কপালে। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলি।
ঘ বললেন, ‘জেলে তো আর পলিটিক্যাল প্রিজনারদের সঙ্গে তোমাকে রাখবে না। রাখবে ক্রিমিনালদের সঙ্গে। খুনী বদমাশদের সঙ্গে। তোমার বিরুদ্ধে যে কেইস, সেটা তো ক্রিমিনাল কেইস। তোমাকে ক্রিমিনাল হিসেবে ট্রিট করা হবে। জেলে তুমি থাকবে কি করে! অসম্ভব। আমি দেখেছি জেলের ভেতরটা। ক্রিমিনালদের যেখানে রাখা হয়, সেখানে খুবই জঘন্য অবস্থা। ফ্লোরে শুতে হয়, কোনও বেড দেওয়া হয় না। গাদাগাদি করে শোয় সব। ঘরে কোনও ফ্যান নেই। দুর্গন্ধ। আন-হাইজিনিক আন- হেলদি পরিবেশ। পেচ্ছ!ব পায়খানার অবস্থা কল্পনা করা যায় না। যেখানে ঘুমোয়, সেখানেই পেচ্ছ!বপায়খানা করে। জঘন্য খাবার দেওয়া হয়। দুর্গন্ধ, বাসি পচা। মোটা মোটা লোহার মত শক্ত রুটি। উফ!’ ক্ষণে ক্ষণে শিউরে ওঠার কাঁপুনি ঘএর গায়ে, জ্ঞএসব তো আছেই, গার্ডরা মহিলা প্রিজনারদের রেপ করছে যখন তখন। না না, জেলের নাম নিও না। আমি ভাবতেই পারি না. ..’
দুপুরবেলা। চনমনে ঘ হঠাৎ তিতিবিরক্ত। বললেন, মালেকা বেগম ফোন করেছিলেন। দেশের অবস্থার কথা উঠল। এখন তো দেশের অবস্থার কথা ওঠা মানে তোমার কথা ওঠা। তা উনি কি বললেন জানো?
–নাহ। তা তো জানি না কি বললেন!
–আচ্ছ!, তোমার সাথে কি মালেকা বেগমের কোনও গণ্ডগোল হয়েছে নাকি?
–না তো!
–আমি জিজ্ঞেস করলাম মহিলা পরিষদ থেকে কোনও প্রতিবাদ করা হচ্ছে কি না। বললেন, প্রশ্নই ওঠে না। এ কেমন নারীবাদী গো! ছি ছি ছি।
আমি চুপ হয়ে বসে থাকি। তিনিও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, তোমার খুব নিন্দা করছিলেন মালেকা বেগম। আমার ভাল লাগেনি, যেভাবে তিনি কথা বলছিলেন।
–কিরকম নিন্দা? জিজ্ঞেস করি।
–বললেন, যা হয়েছে ভাল হয়েছে। শিক্ষা হয়েছে। বিজেপির টাকা নিয়ে লজ্জা লিখেছে বেশ হয়েছে। ধর্ম নিয়ে বাজে কথা বলেছে, শাস্তি হবে না কেন? ফ্রান্সে গিয়েছিল টাকা আনতে, ওর ফাঁসি হওয়াই উচিত।
–মালেকা বেগম এসব কথা বলেছেন? আমি অবিশ্বাস্য চোখে তাকাই ঘ র মুখে।
–হ্যাঁ, বলেছেন। কেন, তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?
না বোধক মাথা নাড়তে গিয়ে নাড়ি না। কী জানি, হবে হয়ত। আজকাল কত কিছুই তো উদ্ভট ঘটছে। যাদের বন্ধু বলে ভাবি, দেখা যায় তারা আসলে সত্যিকার বন্ধু নয়। ঘ যদিও বলছেন, তিনি মালেকা বেগমের মন্তব্য পছন্দ করেননি। কিন্তু একটি জিনিস টের পাই, ওই মন্তব্য তাঁর সঙ্গে আঠার মত সেঁটে আছে।
এর পর মালেকা বেগম নয়, অন্য কিছু নিয়ে কথা হয়। বিকেলের চা নিয়ে, গরম পড়া নিয়ে, বিছানার চাদর-বালিশ নিয়ে।
একসময় ঘ বলেন, কপালে অনেকগুলো এলোমেলো ভাঁজ, আচ্ছ!, তুমি এত চমৎকার নির্বাচিত কলাম লিখলে! এত সুন্দর কবিতা লেখো তুমি। আমি তোমার সবগুলো কবিতার বই পড়েছি। কিছু কিছু কবিতা মুখস্তও হয়ে গেছে পড়তে পড়তে। মেয়েদের কথা তুমি যেভাবে লিখতে পারো, আর কেউ পারে না সেভাবে লিখতে! তুমি মেয়েদের মনের কথাগুলো প্রকাশ করছিলে, যে কথা মেয়েরা প্রকাশ করতে জানে না। তুমি তো কেবল মেয়েদের মনের কথাই কেবল বলোনি, তাদের তুমি অনেক প্রেরণা দিচ্ছ, সাহস দিচ্ছ। অনেক মেয়েই আমাকে বলেছে, তোমার লেখা পড়ে তাদের জীবন এখন পাল্টে গেছে, তারা এখন নতুন করে নিজেদের চিনতে পারছে, তারা এখন নিজেদের মূল্য দিতে শিখছে। তারা মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাইছে। এ কত বড় কাজ, তুমি বোঝো! যেভাবে লিখছিলে, সুন্দর লিখছিলে। সব কিছু তো ভালই ছিল। কিন্তু, তুমি হঠাৎ কেন লজ্জা লিখতে গেলে?
বড় একটি চমক আমার জন্য। ঘ এবং তাঁর স্বামী মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আর এই ঘ কি না বলছেন আমি কেন লজ্জা লিখতে গেলাম!
তোমার মাথা টাথা কি খারাপ হয়েছিল?
এর উত্তর কি দেব আমি তা না বুঝতে পেরে অপরাধীর মত নখ খুঁটি। নখ থেকে চোখ তুললেই দেখি ঘ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন আমার উত্তরের জন্য।
মৃদু কণ্ঠে বলি, এখানে হিন্দুদের ওপর অন্যায় অত্যাচার হয়েছে। এগুলোর প্রতিবাদ করেছি। করাটা কর্তব্য মনে হয়েছে।
–শোন, তুমি নারীবাদী লেখক, তুমি নারীবাদী লেখা লিখবে। হিন্দু মুসলমান সমস্যা নিয়ে লেখার জন্য তো অনেকেই আছেন। এসব পলিটিক্যাল লেখা। তুমি তো আর পলিটিক্স কর না। তোমার একটা ফিল্ড আছে, সেই ফিল্ডে তুমি নাম করেছিলে। তুমি নারীবাদ নিয়েই ফিক্সড থাকতে পারতে! খামোকা কেন তুমি ডিরেইল্ড হলে? তোমার লজ্জা লেখাটা উচিত হয়নি।
–লজ্জা লিখেছি বলে আমি যে মেয়েদের সম্পর্কে লেখা বন্ধ করে দিয়েছি, তা তো নয়। আমি তো লিখছিই।
–লিখছ কিন্তু লজ্জা লেখার জন্য অনেকে এখন তোমার নারীবাদী লেখাগুলোও আর ভাল ভাবে নিচ্ছে না। মালেকা বেগম বললেন তুমি বিজেপির কাছ থেকে টাকা নিয়ে লিখেছো লজ্জা, এ কথা তো শুধু তো মালেকা বেগমই বলেন না, এ কথা অনেকেই বলে। এই লজ্জা লিখে নিজের অনেক ক্ষতি করেছো তুমি তসলিমা।
এ সময় কানদুটো যদি বধির হয়ে যেতো! যদি সত্যিই বধির হত কান, আমার স্বস্তি হত।
–তুমি কি জানো না ভারতে মুসলমানদের কি করে মারছে? জ্বলন্ত উনুনে ওদের ফোটাচ্ছে, জানো না?
উনুনে ফোটানোর কথা বলতে গিয়ে ঘ র শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠল। জ্যান্ত মানুষগুলো যেন তাঁর চোখের সামনে উনুনে ফুটছে।
–এরকম শুনিনি তো! জ্বলন্ত উনুনে ..
ঘ উত্তেজিত।
–তাহলে তুমি জানো না! একটা বিষয় যদি না জানো, তবে বিষয়টি নিয়ে লিখতে যাও কেন! তোমার তো জানতে হবে ওখানে কী হচ্ছে।
আমি অসহায় বসে থাকি। মাথা নত।
ঘ র গলার স্বর উঁচু থেকে খাদে নেমে আসে। তিনি ধীরে, প্রায় গলা চেপে, প্রায় কানে কানে বলেন, এখানেও হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে তা ঠিক। কিন্তু তা বলতে যাবে কেন? ওরা কি মুসলমানদের ওপর ওখানে যে অত্যাচার হচ্ছে সেগুলো বলে? এসব বলতে হয় না। তুমি খুব ভুল করেছো লজ্জা লিখে।
ইচ্ছে হয় প্রতিবাদ করি। বলি যে না, আমি ভুল করিনি। ওখানে কি হচ্ছে, তা আমি দেখিনি, তা আমি জানি না। এখানে যা হচ্ছে, এখানে যা আমি দেখেছি, তা লিখেছি। ঘ আমার নীরবতার কিছু একটা অনুবাদ করে নিয়ে বললেন, এটা একটা সেনসিটিভ ইস্যু। এটা দুদেশের পলিটিক্যাল ব্যাপার। এটা নিয়ে তুমি ডীল করতে পারো না। কারণ তোমার কাছে ইনফরমেশন নেই দুদিকের। তাছাড়া তুমি তো আর পলিটিক্স বুঝবে না। পলিটিক্স করলে পলিটিক্স বুঝতে।
এর উত্তরে আমি কিছু বলি না, শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমি জানি ঘ এখন যা বলছেন, তা এদেশের অধিকাংশ লোক বলছেন। নাহ, প্রতিবাদ এখন আর আমি করছি না। আমার মানসিক শারীরিক সব শক্তি আমি হারিয়ে বসে আছি।
ঘ বিশ্রাম নিতে তাঁর নিজের ঘরে চলে যান। বাইরে থেকে আমার ঘরের দরজাটি বন্ধ। অন্ধকার জানালায় মুখ করে শুয়ে ছিলাম। যদিও রাজদরবারে গিয়ে মসনদে বসার কথা ছিল আমার, বসা হয়নি। মসনদের জন্য আমার কোনও আগ্রহ জন্মে না, এই ঘরে শুয়ে বসে অপেক্ষার এক একটি মুহূর্ত তো নয়, যুগ পার করছি জামিনের খবর শোনার জন্য। কেবল ক র আসার অপেক্ষা। ক আমার জন্য জামিন হওয়ার একটি সুসংবাদ নিয়ে দেবদূতের মত উদয় হবেন। তাঁর উদয়ের পথে আমি উদগ্রীব প্রাণ নিয়ে তাকিয়ে আছি। এসময় হঠাৎ ঘরে ঢোকেন ঘ। ক র কথা জিজ্ঞেস করেন। ক কোথায় আছে তা আমি জানি কি না জানতে এসেছেন।
না আমি জানি না।
ঘ বললেন ককে তাঁর খুব দরকার। ককে কেন দরকার তাঁর, তা আমি জিজ্ঞেস করি না। কিন্তু তিনি নিজেই বলেন, কর আজ আসা দরকার আমাকে নিয়ে যাবার জন্য।
কান তুমি বধির হও।
কান বধির হয় না।
–আপনি তো বলেছিলেন, আমি এখানে যতদিন দরকার হয়. ততদিন থাকতে পারব! নিজের স্বরে নিজেই চমকে উঠি, স্বরটি কান্নার মত শোনাচ্ছে।
–বলেছিলাম। তখন বুঝতে পারিনি এ যে কত বড় ঝুুঁকির ব্যাপার। ক কোথায় আছে এখন, তুমি জানো না?
মাথা নাড়ি। গলায় আর স্বর ফুটছে না।
আবারও অস্ফুট কণ্ঠ আমার, কাল আমার জামিন হয়ে যাবে হয়ত। আজকের রাতটা অন্তত থাকি..
ঘ বললেন, দেখ, একটা রাত কেন, অনেকগুলো রাতই তুমি থাকতে পারতে। কিন্তু আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে। পাশের ফ্ল্যাটের মহিলা আমার বাসায় দুবার কড়া নেড়েছে। দুবারই আমি তাকে দেখেছি দরজায় বাইরে থেকে ভেতরে উঁকি দিচ্ছে। কখনও সে এমন করে না। নিশ্চয়ই সে সন্দেহ করছে..
–ক এখন আমাকে নিয়ে কোথায় যাবেন? ক র তো কোনও জায়গা নেই আমাকে রাখার!
–সে ক জানবে।
স্বরটি থেকে লু ছুটে আমার চোখ মুখ পুড়িয়ে দিতে চায়।
অবিরল অশ্রুধারা পোড়া থেকে বাঁচায় আমাকে।
ঘ অন্য ঘরে চলে যান। ঘ র কণ্ঠস্বর ভেসে আসে অন্য ঘর থেকে। জ্ঞআমার বাসায় তুমি একটা কলম রেখে গেছিলে, কলমটা নিয়ে যেও আজ। আজই কিন্তু নিতে হবে, কারণ আমি কাল সকালেই ঢাকার বাইরে চলে যাচ্ছি। তুমি না আসতে পারলে অন্য কাউকে পাঠিয়ে দিও নিয়ে যেতে। উহ, যে গরম পড়েছে এ সময় জার্নি করাও মুশকিল…’
মধ্যরাতে ক আর খ আসেন। দুজনের মুখেই দুশ্চিন্তার কালো দাগ। আমি যে কত বড় বোঝা এখন, আমি যে কত বড় ঝুঁকি এখন তাঁদের কাছে, দাগটি দেখেই বুঝি। হাড়ে মজ্জায় টের পাই। ক কে আকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি, কিছু হল জামিনের? ক মাথা নাড়েন। না বোধক। ঘ একবার ক কে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় এখন নিয়ে যাচ্ছ? ক উত্তর দেন নি। ঘ আমার মাথার ওপর তাঁর নিজের একটি চাদর ফেলে বললেন যেন এটি দিয়ে মুখ মাথা সব ঢেকে ফেলি। ঢেকে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নামতে হয়। যেন কেউ কোনও বাড়ির দরজা খুলে এ সময় বেরিয়ে আমাকে দেখে ফেলার সুযোগ না পায়। মুখ মাথা ঢেকে বসে থাকতে হয় পাথরের মূর্তির মত গাড়িতে। কেউ কোনও কথা বলছে না। গাড়ি কোথায় কোনদিকে যাচ্ছে, কিছুই আমার বোধে আসে না। গাড়ি হঠাৎ একসময় থেমে যায়, হঠাৎই অন্ধকার থেকে লাফিয়ে কেউ একজন গাড়িতে ওঠেন। গাড়িতে যিনি ওঠেন, তাঁর নাম ধরছি ঙ। ক, খ এবং ঙর মধ্যে কোনও কথা হচ্ছে না। ঙ কেবল গাড়ির চালককে বামে, ডানে, সামনে শব্দগুলো বলছেন। গাড়ি যখন এক গলিতে ঢুকলো, গলির ভেতরে একটি ট্রাক আমাদের উল্টো দিক থেকে এসে পথরোধ করে দাঁড়ালো, কারও পাশ কেটে যাওয়ার কোনও অবস্থা নেই। ট্রাকের পেছনে দুটো গাড়ি এসে থামল, আমাদের গাড়ির পেছনে একটি গাড়ি, পাশে চারটে রিক্সাও থামল। ট্রাক চালক নেমে এল যানভিড় হালকা করার জন্য। আমাদের গাড়ির চালককে পেছনে যাবার নির্দেশ দিচ্ছে। গাড়িগুলো ভেঁপু বাজাচ্ছে, কিছু পথচারী থেমে আছে জটলার মধ্যে। গাড়ির আলো এসে পড়ছে মুখে। উপুড় হয়ে বস্তার মত পড়ে থাকব ভেতরে, সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। পথচারির চোখে পড়তে পারে বস্তা হওয়ার দৃশ্য। মুখ বেশি ঢাকা যাচ্ছে না, বেশি করে মুখ ঢাকলে সন্দেহ হবে, এমনিতে গরমকালে শীতের চাদরে মাথা ঢাকাটাই উদ্ভট। আমি শাড়ির আঁচল দিয়ে নাক ঢেকে রাখি, যেন নাক ঢাকছি ধুলো বালি এড়াতে। নাক ঢাকতে গিয়ে চিবুক ঢাকা হয়ে যাচ্ছে, ঠোঁট ঢাকা হচ্ছে, গাল হচ্ছে। চাদর মাথার ওপরে বেশি টেনে দেওয়ার ফলে কপালের খানিকটা ঢাকা হয়েছে। বাকি আছে চোখদুটো। চোখদুটোতে আশংকা, এ্ই আশংকাই কারও নজরে পড়লে সংশয় জাগাবে। কিন্তু আশংকাকে কোথায় লুকোই আমি! আশংকা নিয়ে চোখদুটো নত হয়ে থাকে। কিন্তু রাস্তায় যান বাহন জট পাকাচ্ছে, আমি তো আর আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা নই, আমি কেন চোখ তুলে দেখছি না কি হচ্ছে না হচ্ছে! গাড়ির ভেতর এক চালক ছাড়া আমরা সব শ্বাস বন্ধ করে রাখছি। আমার মাথাটি আলতো করে ধরে খ তাঁর নিজের কাঁধে রাখেন। এবার আমি মনে মনে বুঝি, আমাকে কি করতে হবে, আমাকে চোখ বুজে থাকতে হবে, আমি যে অসুস্থ এক মহিলা, গাড়ি করে কোনও হাসপাতালের দিকে যাচ্ছি, অথবা হাসপাতাল থেকে এসেছি, তা যেন অনুমান করে নেয় যে কেউ, যারই চোখ আমার মুখে পড়ে। গাড়ির জট খুলে রাস্তা পরিষ্কার হতে বারো মিনিট সময় নেয়, এই বারো মিনিট আমার কাছে বারো বছরের মত দীর্ঘ। যেন বারো বছর ধরে আমার সশস্ত্র আততায়ীটির চোখের সামনে নিরস্ত্র বসে আছি। গাড়ি থামলে আমাকে আর সবার সঙ্গে নেমে পড়তে হয়। মুখ মাথা ঢাকা আমি, কেবল চোখদুটো খোলা। দোতলা একটি বাড়ির দোতলায় উঠি মুখ মাথা খোলাদের সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে। ঘর অন্ধকার করে ভেতরে যে মেয়েটি বসেছিলেন, তার নাম চ। ঘরের আধো আধো আলোয় আমি ঙ কে চিনতে পারি, ঙ দেশের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। বড় মাপের একজন বুদ্ধিজীবী। ঙ র বাড়িতে আমি আগে দুবার গিয়েছি, একবার কজন সাহিত্যিককে ডেকেছিলেন একটি ঘরোয়া আলোচনায়, আর একবার ঙ এবং ঙর স্ত্রী আমাকে এবং আরও কজনকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন, সে নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম। ঙর মত এত বড় একজন মানুষ আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন, এটি আমাকে নিরাশার গাঢ় অন্ধকার থেকে টেনে আলোতে ওঠায়। কি করে ক র সঙ্গে ঙ র যোগাযোগ হল, কিছু আমি জানি না। যে বাড়িতে ঙ আমাদের নিয়ে এলেন, এটি তাঁর কন্যার বাড়ি। চ নামের মেয়েটি তাঁর কন্যা।
আধাঁর আঁধার ঘরটিতে ক, খ, ঙ, চ এবং আমি। আমাদের মধ্যে খুব নিচু গলায় কথা হয়। ক বলেন যে তিনি আমার উকিলের কাছে গিয়েছিলেন, উকিল এখনও আদালতে যাননি আমার জামিনের জন্য। ডঃ কামাল হোসেন দেশে ছিলেন না, তিনি ফিরে এসে অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করছেন। ক আরও বললেন যে যেহেতু এই মামলায় জামিন হয় না, সুতরাং জামিনের জন্য যদি উকিল লড়তে চান, তবে দেশের জনগণ যে আমার বিরুদ্ধে জারি হওয়া মামলা আর গ্রেফতারি পরোয়ানার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, তা বলতে হবে, তার প্রমাণ দেখাতে হবে। তাই আমার পক্ষে এখন জনমত দরকার, পত্রিকায় আমার পক্ষে বিবৃতি দরকার। এটিই এখন সরচেয়ে জরুরি। ক নিজে বিবৃতি যোগাড় করার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, কিন্তু কেউ, কোনও বুদ্ধিজীবী, লেখক, রাজনীতিক বিবৃতি দিতে চাইছেন না। কে দিতে চাইছেন না, তা আমার জিজ্ঞেস করার সাহস হয় না। আমি বলি, কিছু বিবৃতি তো গেছে। কর মুখে দুশ্চিন্তার দাগটি আরও ঘন কালো দেখায় যখন বলেন, ও কটা বিবৃতিতে কিμছু কাজ হবে না।
খ বললেন, তোমার জন্য এ দেশের লোকের সাপোর্ট আছে, তোমার পক্ষে দাঁড়াবার জন্য এটিই একমাত্র বেইস।
ঙ বললেন, বিদেশি কিছু ইম্পর্টেন্ট অরগানাইজেশন তো প্রতিবাদ করেছে।
ক বললেন, হ্যাঁ বিদেশি অরগানাইজেশনের সাপোর্ট আছে। কিন্তু দেশি সাপোর্ট লাগবে। দেশি সাপোর্টএর মূল্য এখন বেশি।
সারা হোসেনের সঙ্গে কথা হয়েছে আপনার? ক কে জিজ্ঞেস করি।
ক বললেন, আপনার ভাগ্য খুব ভাল যে আপনি ডক্টর কামাল হোসেনের মত উকিল পেয়েছেন। তাঁর মেয়ে সারা হোসেন আপনার জামিনের ব্যাপার নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। কোর্টে আপনার অনুপস্থিতিতে জামিন নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ কোর্টে যাওয়া তো আপনার জন্য রিস্কি। যতদূর মনে হচ্ছে জামিন পাওয়া মোটেও সহজ নয়। এ দেশে কজন উকিল এধরনের কেইস করার ঝুঁকি নিতে পারে? চারদিকে খবর হয়ে গেছে যে কামাল হোসেন আপনার উকিল। পাবলিক সেন্টিমেণ্টের ব্যাপার। কখন বোমা মেরে উড়িয়ে দেয় উকিলের অফিস কে জানে! কামাল হোসেন একটা পলিটিক্যাল পার্টির লিডার। আপনার পক্ষ নিলে তাঁরও ক্ষতি হবে।
দীর্ঘ একটি শ্বাস গোপন করি।
খ বললেন, ঙ যে কত উপকার করলেন আজ। ঙর সঙ্গে যদি আজ দেখা না হত তবে তোমাকে কোনও বাড়িতে আশ্রয় দেয়ার ক্ষমতা ছিল না। ঘ যখন জানিয়ে দিলেন যে তোমাকে তিনি আর রাখতে চাইছেন না, মোট সাতজনের সঙ্গে আমি গোপনে কথা বলেছি, কেউ তোমাকে রাখার ঝুঁকি নিতে চান না। একমাত্র ঙ রাজি হয়েছেন।
ক হঠাৎ অপ্রাসিঙ্গকভাবে লজ্জার কথা তুললেন। বললেন, আপনার উচিত ছিল লজ্জা বইটাতে একটা ব্যালেন্স রাখা। ভারতের মুসলমানের ওপর কি হয়েছে, সেটা আপনি পুরো এড়িয়ে গেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, এ দেশের মানুষ আগে যেমন আপনাকে পছন্দ করত, এখন আর তেমন করে না।
দীর্ঘশ্বাস জানে কতটা দীর্ঘ তার পথ।
ক হঠাৎই উঠে পড়েন, উঠে বিরক্ত গলায় বলেন, আপনি এত দীর্ঘদিন থেকে নারীবাদী লেখা লিখছেন। আপনার কেন কোনও মহিলা সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না! কেন করেননি যোগাযোগ? দেশে এত সংগঠন, আপনি কোনও সংগঠনের সদস্য নন। আজ যদি আপনি কোনও একটা মহিলা সংগঠনের সদস্য হতেন, আপনার এই অসুবিধা হত না।
যাবার আগে ক চকে বললেন দরজা তো বটেই, জানালাগুলোও সব সময় বন্ধ রাখার জন্য, যেন বাইরে থেকে কেউ আমাকে দেখার সুযোগ না পায়। টেলিফোন তালাবন্ধ রাখার জন্য যেন কোনওভাবেই আমার হাতের নাগালে টেলিফোন না আসে কারণ ভুল করে আমি এমন কাউকে ফোন করে ফেলতে পারি যার বাড়ির ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে, পুলিশ তখন জেনে যাবে কোন বাড়িতে আমি আছি, তখন কেবল আমার সর্বনাশ হবে না, চ র ও হবে।
৩. অতলে অন্তরীণ – ০৫
আট জুন, বুধবার
যে ঘরটিতে আমাকে থাকতে দেওয়া হয়েছে, সে ঘরটিতে একটি জানালা আছে, জানালাটি বন্ধ। ঘরে কোনও পাখা নেই। জুন মাসের গা সেদ্ধ করা গরম। সারারাত গরমে ঘামি, ছটফট করি, উঠে বসি, আবার শুই। মশা ভনভন করছে, কামড়াচ্ছে। অন্ধকারে এপাশ ওপাশ করছি, জলতেষ্টায় কাতরাচ্ছি, কোথায় আলো পাবো, জল পাবো, একটি হাতপাখা পাবো, জানি না। এক রাতেই ঘামাচিতে ভরে গেছে পুরো মুখ। মশার কামড়ের লাল লাল দাগ হাতে পায়ে গালে গলায়। সকালে এককাপ চা খাবার তৃষ্ণায় অস্থির হই। কিন্তু কোথায় পাবো চা! এ বাড়িতে চায়ের চল নেই। চ সকালেই তাঁর চার বছর বয়সী কন্যাটিকে নিয়ে বেরিয়ে গেছেন, ওকে ইশকুলে ছেড়ে দিয়ে তিনি আপিসে যাবেন। বিকেলে বা সন্ধ্যায় ফিরবেন। চর স্বামী ঢাকার বাইরে থাকেন। এ বাড়িতে চ তাঁর কন্যা নিয়ে থাকেন, বাড়ির কাজ কর্ম করার জন্য দশ এগারো বছর বয়সী বল্টু নামের একটি ছেলে আছে। বল্টু রান্না বান্না করে খেয়ে দেয়ে খাবার ঘরে বসে থাকবে। আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে পাখাহীন ঘরটিতে বসে থাকব। পেচ্ছ!ব পায়খানায় যেতে হলে আশপাশ দেখে নিয়ে মাথায় কাপড় চোপড় দিয়ে নিজেকে যতটা সম্ভব অচেনা করে ঢুকে যাবো। যদি ক্ষিধেয় মরে যেতে থাকি, কিছু খাবার পেটে না দিলেই নয়, তবে, টেবিলে, আশেপাশের বাড়ির বারান্দা বা জানালা থেকে কেউ কোনও রকম ছিদ্র দিয়েও যেন আমাকে দেখতে না পায় এমন ভাবে বসতে হবে, খেতে হবে। হাঁটাচলা করতে হবে নিঃশব্দে, যেন নিচের তলার লোকেরা টের না পায় যে এ বাড়িতে একটি মানুষ হাঁটছে। মাথার কাপড় যেন কখনও না খসে আমার, বল্টুর যেন কোনও সন্দেহ না হয় যে আমি চর কোনও দূর সম্পর্কের আত্মীয় নই, আমার স্বামী মারা যায়নি, আমি শহরের আত্মীয়দের কাছে অর্থ সাহায্যের জন্য আসিনি। বল্টুর সঙ্গে চোখাচোখি মুখোমুখি পারতপক্ষে না হলে ভাল। সদর দরজায় হঠাৎ বাইরে থেকে তালা পড়লে এখন সন্দেহ জাগবে। বল্টুর তো জাগবেই, প্রতিবেশিদেরও জাগবে। সুতরাং যা চ আগে করছিলেন, তাই করেছেন, শোবার ঘরে তালা দিয়ে গেছেন। খোলা শুধু রান্নাঘর আর গরম ঘরটি, আর এক চিলতে খাবার ঘর নামক জায়গাটি। সকাল পার হতে থাকে, চা পাওয়া হয় না, কিন্তু মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে, যেন গহীন গ্রামের লজ্জাশীলা ফুলবিবি, দুটি রুটি আধা চিবিয়ে আধা গিলে গরমে সেদ্ধ হতে চলে আসি জানালা বন্ধ ঘরটিতে। টেলিফোনের লেজটি বেরিয়ে এসেছে চর শোবার ঘরের দরজার তল দিয়ে। খাবার ঘর থেকে সরিয়ে ফোনটি শোবার ঘরে বন্দি করা হয়েছে। যেন আমি শিশু, আমার নাগাল থেকে কাচের বাসন কোসন সরিয়ে রাখা হচ্ছে। তা হোক, আমি তো অনেকটা শিশুই এখন, অন্যের ওপর নির্ভর করে আছি সব কিছুর জন্য। কোথায় সেই স্বাধীনচেতা মানুষটি! মানুষটির দিকে এখন তাকাতে পারি না। কী হচ্ছে দেশে, জামিন কবে পাবো, কবে মুক্তি পাবো এই লুকিয়ে থাকা থেকে! কিছুই জানি না। সম্ভবত কোনও জামিন আমার হবে না, সম্ভবত আমাকে ছুঁড়ে ফেলা হবে কারাগারে। এই কারাগারের মত বাড়িটিতে সম্ভবত আমার একরকম মহড়া চলছে সত্যিকার কারাগারে থাকার।
সকালেই ঙ আসেন। এসেই খাবার ঘরের জানালর কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের চারদিক দেখে আবিষ্কার করেন যে পাশের তিনতলা বাড়িটির বারান্দা থেকে এ বাড়ির খাবার ঘরটি চাইলেই কেউ দেখতে পারে। একটি পর্দা টাঙিয়ে দেবেন কী না জানালায় তা নিয়ে ভাবেন। কিন্তু আবারও ভাবেন যে হঠাৎ করে পর্দা টাঙিয়ে দিলে কারও যদি আবার সন্দেহ হয়! বাড়িতে একটি ঘোমটা পরা মহিলাকে দেখা গেছে একদিন, তার পরই জানালায় পর্দা ঝুলছে! সন্দেহের কারণ বটে। ঙ সরে আসেন জানালা থেকে, গলা চেপে বলেন, ওদিকটায় যেও না। যাবো না। ঙ কি আজ জানালা দরজা পরীক্ষা করতে এসেছেন! কোথায় আমি যাবো, কোথায় আমি যাবো না তা দাগিয়ে দিতে এসেছেন! না, এসব কারণে আসেননি ঙ। ঙ এসেছেন খুব জরুরি একটি কাজে। আমাকে দিয়ে এক্ষুনি তিনি একটি চিঠি লিখিয়ে নিতে এসেছেন, চিঠিটি আমাকে লিখতে হবে জাতীয় সংসদের স্পীকারের কাছে। ঙর কপালে, গালে, গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম, ঘাম গরমের নাকি ভয়ের তা নিয়ে যখন ভাবছি, বললেন, দেশের অবস্থা খুব খারাপ তসলিমা। আমরা কেউ বুঝে পাচ্ছি না কি হতে যাচ্ছে .। সংসদ ভবনে বাংলাদেশের পতাকার বদলে চাঁদ তারার পতাকা উড়েছে সেদিন।
এসব বলছেন কি! এত বড় স্পর্ধা ওদের!
আতঙ্ক আমাকে আঁকড়ে ধরে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঙ বলেন, দেশের মানুষকে কি জানাতে চাও, বল। তোমার কথা তাদের শোনা দরকার। কোরান সংশোধনের কথা যে বলনি তা লেখ।
বিরক্ত কণ্ঠে বলি, আমি তো বলেইছি যে আমি বলিনি। কতবার বলব!
আবার বল। আবার লেখ। এই চিঠি স্পীকারের কাছে যাবে, সব পত্রিকায় যাবে। আমি ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছি। তাঁরাও আমাকে বললেন যে স্পীকারের কাছে চিঠি লিখে দেখা যাক কি হয়।
–কী লিখব, আমি কোরান বিশ্বাস করি না সুতরাং কোরান সংশোধন করার কথা বলার আমার কোনও কারণ নেই!
–কোরান বিশ্বাস কর না, এ কথা বলার তোমার দরকার নেই এখন। এসব কথা আগে অনেক বলেছো। খুব বিনীত হয়ে এই চিঠিটি লেখ।
ঙ আমার দিকে কাগজ কলম এগিয়ে দেন। আমি দ্রুত লিখতে থাকি,
মাননীয় স্পীকার,
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।
সম্প্রতি সরকার আমার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছেন। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমি নাকি কোরান শরিফ সংশোধনের কথা দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে বলেছি। অথচ কোরান শরিফ সংশোধনের কথা আমি কখনও কোথাও কোনওদিনই উচ্চারণ করিনি। আমার বিশ্বাস এবং মতবাদ নিয়ে আমার রচিত ২১টি বইয়ের কোনও বাক্যেও কোরান সংশোধনের প্রসঙ্গ নেই।
কলকাতার দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার জন্যে যে অমুসলমান মেয়েটি আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিল, সে কোরান ও শরিয়া আইনের মধ্যে কী পার্থক্য তা স্পষ্ট জানে না। তাই শরিয়া বিষয়ে আমার উত্তরকে কোরানের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলে। তার প্রশ্ন ছিল, তিরিশের দশকে আল্লামা ইকবাল শরিয়া আইনের পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন, এ সম্পর্কে আপনার মত কি? আমি তখন উত্তরে বলি, শরিয়া আইনের অল্প পরিবর্তন আমি চাই না, ১৯৬১ সনে আমাদের দেশে শরিয়া আইনের কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু আমি চাই সংশোধিত শরিয়া আইন অর্থাৎ মুসলিম পারিবারিক আইনের পরিবর্তে একটি আধুনিক আইন (য়শভপষক্ষল দভৎভর দষধন)যাতে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত হয়। এই দাবি আমার একার নয়, দেশের প্রতিটি নারী আন্দোলন সংস্থা এই দাবি দীর্ঘদিন থেকে করে আসছে। স্টেটসম্যানের অনভিজ্ঞ সাংবাদিকটি আমার এই বক্তব্যকে সংক্ষেপ করে শরিয়ার স্থলে কোরান বসিয়ে দিয়েছে। কোরান যে সংশোধন করা যায় না তা আমি এর আগের একটি প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্ট করে বলেছি কোরানের একটি শব্দও কেউ কখনও পরিবর্তন করতে পারবে না। এই বক্তব্য দ্য স্টেটসম্যানের সাক্ষাৎকারে ছাপাও হয়েছে। ৯ই মে তারিখে বড় বড় ভুলসহ আমার সাক্ষাৎকারটি স্টেটসম্যানে ছাপা হবার পরদিনই আমি প্রতিবাদ করি, যা ওই পত্রিকার ১১মে তারিখে ছাপা হয়েছে। প্রতিবাদের মূল কথা ছিল, আমি কখনও কোথাও কোরান সংশোধনের কথা বলিনি। যারা এখন উদ্দেশ্যমূলক ভাবে যে কথা আমি বলিনি সে কথা প্রচার করে আমার ফাঁসি চাইছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ না নিয়ে, কোনও তথ্য যাচাই না করে আমাকেই আসামী করে সরকার মামলা রুজু করেছেন। এটি যে কোনও মানুষেরই মৌলিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি হতাশাজনক দৃষ্টান্ত। আমি এই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করছি।
এটুকু লেখার পর ঙ বললেন, কোরানের আগে পবিত্র শব্দটি বসিয়ে দাও।
না, এটা লিখব না। আমি বলি।
পবিত্র শব্দটি জুড়ে দিলে কী ক্ষতি?
কোনও ক্ষতি নেই। কিন্তু কোরানকে আমি পবিত্র বলে মনে করি না। আমার বইগুলোতে কোরান সম্পর্কে বিস্তর সমালোচনা আছে। তাছাড়া বেদ বাইবেল ও কোরানের নারী নামের লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। সবাই জানে যে আমি কোরানকে মোটেও পবিত্র ভাবিনা। তাছাড়া পবিত্র লিখলেই কি না লিখলেই কি, কোরান তো কোরানই। যারা এটিকে পবিত্র মনে করে তারা করবেই।
ঙ ঠোঁট সজোরে যুক্ত করে ভেবে বলেন, নিরাপত্তার কথা লেখ। তোমার, তোমার ফ্যামিলির। ফ্যামিলির কাকে কাকে নাকি পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তোমার বাবার ওপর হামলা হচ্ছে। মৌলবাদীরা ফাঁক খুঁজে বেড়াচ্ছে আক্রমণ করার জন্য।
লিখে যাই, আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচারকারীরা এবং আমার প্রাণনাশের হুমকি প্রদানকারীরা কেবল আমার জীবন বিপণ্ন করছে না, আমার পরিবারের সদস্যদের জীবনও বিপন্ন করে তুলেছে। যে কথা আমি কখনও উচ্চারণ করিনি তার জন্যে আমাকে দায়ী করে আমার বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছে, সেই মামলা প্রত্যাহার করার জন্যে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে আমি সরকারের কাছে আমার এবং আমার পরিবারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার আবেদন জানাচ্ছি।
এটুকুর পর ঙ বললেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে চাওনি এ কথা বল।
বলি, আমি যা সত্য মনে করি লিখি। কারও ধর্মীয় অনুভতিতে আঘাত লাগবে কি লাগবে না তা ভাবি না।
কিন্তু তুমি তো ইচ্ছে করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবার জন্য লেখ না। তোমার কি উদ্দেশ্য অন্যের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করা?
না এত স্থূল উদ্দেশ্য আমার নেই।
তবে লিখে দাও।
আশা করি আমার এই বিবৃতির পরে সকল ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে। কেননা আমার মতামত দ্বারা কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না, এবং নেই।
সই করি। তারিখ লেখার সময় ঙ আমাকে থামিয়ে একটু ভাবলেন, ভেবে বললেন, গতকালের তারিখ দাও।
কেন?
সবই তোমার নিরাপত্তার কারণে। আজকে যে লোক চিঠিগুলো চিঠির বাক্সে গোপনে রেখে আসবে, তার চিহ্নিত হলে চলবে না।
ঙ চলে যান, রেখে যান আজকের পত্রিকাগুলো।
এবার বন্ধ ঘরে বসে আগুনে পোড়ো। আগুন পাখাহীন হাওয়াহীন ঘরের নয়, আগুন পত্রিকার খবরের।
তসলিমার কর্মকাণ্ডে নাটের গুরুর ভূমিকায় ভারতের একটি মহল
দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা ইনকিলাবের প্রথম পাতায় প্রধান খবর হিসেবে ছাপা হয়েছে একটি চিঠি এবং চিঠির ওপর ভিত্তি করে মন্তব্য। _______________________________
25th May,1994
‘Dearest Taslima,
Further to our telephone conversation this afternoon, here is my latest information.
It seems that, due to an oversight by somebody in our financial depertment, a cheque of $ 5,144.21 ( the advance payment of Lajja), dated 15th of April and in your favour was sent directly to your address( instead of a bank order, to your bank account, as per my instructions).
This cheque was cashed and our account debited by the clearing bank in New York on the 19th of May. I have asked the BNP ( our bank) to fax me the copy of this cheque. I can’t understand what happened unless it was stolen and your signature forged.This is what we want to find out.
The two other payments were made according to my instructions on the 15th and 16th of May, and have gone to your bank who should have the money very shortly if not already.
Needless to say that I am pursuing my enquiries. I shall talk to our financial controller tomorrow to see how to solve the problem.
I am awfully worried about you, and the more furious that such a stupid thing should happen at such an inconvenient time.
With lots of love
Christaine Besse
বাংলাদেশের বিতর্কিত লেখিকা দীর্ঘদিন থেকে ইসলাম ধর্ম, আইন, ভারত বিভাগ, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, দেশের শ্রদ্ধাভাজন পীর মাশায়েখ, আলেম উলামাদের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক, অপ্রাসঙ্গিক ও আপত্তিকর মন্তব্য এবং লেখালেখি করে আসছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, কথাবার্তা ও লেখালেখির মধ্যে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ খোলাখুলি প্রকাশিত হয়েছে। তসলিমার এসব কর্মকাণ্ডের পিছনে ইন্ধনদাতা তথা নাটের গুরু হিসেবে যে ভারতের একটি বিশেষ মহল কাজ করছে, তা আজ সুবিদিত। মূলত তসলিমা নাসরিনকে ভারত তার দীর্ঘলালিত মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব প্রসূত কর্মকাণ্ড বা সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য হাসিলের লক্ষ্যে প্রণীত নীল নকশা বাস্তবায়নের খুঁটি হিসেবেই ব্যবহার করছে। তাই দেখা যায়, ইসলাম ও মুসলমান বিরোধী, রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী ভূমিকার জন্য তসলিমা নাসরিন যখন দেশপ্রেমী জনগণ কর্তৃক ধিকৃত ও ঘৃণিত, তখন ভারত ও সে দেশের একটি বিশেষ মহল তাকে পরম সমাদরে লুফে নিচ্ছে এবং নগদ অর্থ ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদানসহ প্রচার মাধ্যমে ব্যাপক গুরুত্ব প্রদান করে তাকে প্রায় দেবীর মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাই যে উপন্যাস পড়ে মানুষ লেখিকার প্রতি ঘৃণা ও ধিককারে সোচ্চার হয়ে ওঠে, সেই লজ্জা উপন্যাস ভারতের উμচ মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য পাঠ্যসূচিভুক্ত করা হয়েছে। মিথ্যা ও বানোয়াট কথাবার্তায় ঠাসা উপন্যাস নামের এ অপ উপন্যাসটি পড়ে ইতোমধ্যেই ছাত্র ছাত্রীরা বিভ্রান্ত হতে শুরু করেছে। সেখানকার অভিভাবক মহলে এই বইটি পাঠ্য করায় তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে অতি সম্প্রতি লজ্জা উপন্যাস লেখার জন্য বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের ভারতীয় অর্থ পাওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। ভারতীয় বিশেষ মহলের সুকৌশলী ব্যবস্থাপনায় রুপি নয়, এখন তার নামে দফায় দফায় বিদেশি ডলার আসার চাঞ্চল্যকর প্রমাণ পাওয়া গেছে। তসলিমা নাসরিনের লজ্জা উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর এতে ভিত্তিহীন, মিথ্যা তথ্যের ব্যাপক উপস্থাপন দেশপ্রেমিক জনগণকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বক্তব্য ও তথ্যে ভরা এ উপন্যাসটি সার্বিকভাবে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী হওয়ার কারণে সরকার তা নিষিদ্ধ করে। কিন্তু বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হলেও প্রতিবেশী দেশ ভারতের একটি বিশেষ গোষ্ঠী ও মৌলবাদী দল বিজেপি লজ্জাকে লুফে নেয় এবং সেখানে উপন্যাসটির ব্যাপকভাবে মুদ্রণ ও প্রচার শুরু হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সূষেন জানা যায় যে, বিজেপি এ উপন্যাসটি লেখার জন্য তসলিমাকে ৪৫ লাখ টাকা দিয়েছে। বাংলাদেশে তসলিমার অনুরাগী ও ভক্ত মহলটি সাথে সাথে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং তসলিমাকে ভারতীয় অর্থ মদতানের বিষয়টি মৌলবাদীদের প্রচারণা বলে আখ্যায়িত করে একে ভিত্তিহীন প্রমাণের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু বিধি বাম। অতিসম্প্রতি অপ্রত্যাশিত ভাবে হস্তগত হওয়া তসলিমার নামে নিউইয়র্ক থেকে প্রেরিত একটি ফ্যাক্স থেকে তার ভারতীয় অর্থলাভের চাঞ্চল্যকর প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ফ্যাক্স থেকে দেখা যায় লজ্জা উপন্যাসের জন্য ভারত থেকে তসলিমাকে অর্থ প্রেরণের ঝুঁকি এড়াতে ভিন্ন কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। তাই ভারত থেকে সরাসরি নয়, অর্থ প্রেরণ করা হয়েছে আমেরিকার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে। এভাবে ধর্ম রাষ্ট্র ও জাতীয় স্বার্থের বিরোধী তসলিমা নাসরিনকে অর্থের মদদ জোগানো হচ্ছে — যা তসলিমাকে ধর্মপ্রাণ ও দেশপ্রেমিক মানুষের ধিককার ও প্রতিবাদের প্রতি অবহেলা ও উপেক্ষা প্রকাশের সাহস যোগাচ্ছে।
অন্যদিকে গত ৩ জুন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা প্রথম পৃষ্ঠায় এক খবর প্রকাশ করেছে। এ খবরে বলা হয় বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে বাগে আনতে মুসলিম মৌলবাদীরা এবার তাঁর বাবার ওপর চাপ দিতে শুরু করেছে। পত্রিকা জানায়, তসলিমার বাবা হওয়ার জন্য ডাঃ রজব আলীকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। অবশ্য আনন্দবাজার পত্রিকা তসলিমা সম্পর্কে তার আব্বার মন্তব্যও তুলে ধরেছে। জনাব রজব আলী বলেছেন যে আমি ধর্ম বিশ্বাসী মুসলমান হিসেবে ওর(তসলিমা) ধর্মবিরোধী লেখা সমর্থন করি না। ধর্ম সম্বন্ধে ওর বক্তব্যের বিরোধী আমি। লক্ষণীয় যে, তসলিমার আব্বার এ সুস্পষ্ট বক্তব্য এবং অবস্থান সত্ত্বেও ধর্মবিরোধী লেখা থামাতে তসলিমার বাবাকে চাপ শিরোনামে খবরটি চিহ্নিত করার মধ্যে ভারতের ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী বিশেষ মহলটির সাথে আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর বিশেষ উদ্দেশ্যটিরই নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে।’
________________________________
লেখাটি প্রায় এক নিঃশ্বাসে পড়ে আমি ভাবতে বসি, ক্রিশ্চান বেস এর পাঠানো ফ্যাক্স ইনকিলাবের লোকদের হাতে পড়ল কি করে! এই ফ্যাক্স আমি পাইনি। আমার যেহেতু ফ্যাক্স মেশিন নেই, ইয়াসমিনের আপিসের ফ্যাক্স নম্বরটিই ক্রিশ্চান বেসকে দিয়েছিলাম। ফ্যাক্সটি ইয়াসমিনের হাতে না পড়ে নিশ্চয়ই অন্য কারও হাতে পড়েছে। যার হাতেই পড়েছে, দিয়েছে ইনকিলাবের লোকদের। নাকি ক্রিশ্চান ফ্যাক্স নম্বর লিখতে ভুল করেছেন, আর গিয়ে পড়েছে কোনও ইনকিলাবের লোকের হাতে, অথবা অন্য কারও হাতে যে কি না ইনকিলাবের লোককে দিয়েছে! কিছু একটা হবে। তবে নিউইয়র্ক থেকে অবশ্যই এই ফ্যাক্স পাঠানো হয়নি। ফরাসি দেশের ফ্রাঁ নিউইয়র্কের ব্যাংকে ডলার হয়ে পরে বাংলাদেশের ব্যাংকে এসে টাকা হয়। এরকই নিয়ম। কিন্তু ইনকিলাব নিউইয়র্কের ব্যাংকের নাম দেখেই ভেবে নিয়েছে ফ্যাক্স নিউইয়র্ক থেকে এসেছে। ভেবে নিয়েছে অথবা ইচ্ছে করেই বানিয়ে লিখেছে। পত্রিকা ঘাঁটতে গিয়ে দেখি বিএনপি দলের পত্রিকা দৈনিক দিনকালে এই চিঠি ছেপে বিশাল করে লিখেছে তসলিমার কাছে ভারত থেকে সরাসরি নয়, ভায়া আমেরিকা হয়ে মোটা অংকের ডলার আসছে। ইয়াসমিন একবার বলেছিল, তার আপিসের মালিকের বড় ভাই মাইদুল ইসলাম বিএনপির সঙ্গে যুক্ত, জিয়ার আমলে মন্ত্রী ছিলেন। তিনিই কি তবে তাঁর দলের পত্রিকায় ছাপার জন্য চিঠিটি পাঠিয়ে দিয়েছেন! হতে পারে! আরেকটি পত্রিকায় আজকের খবর—
ধর্মদ্রোহী নাস্তিক তসলিমার আন্তর্জাতিক মদদদাতাদের আংশিক সন্ধান পাওয়া গেছে। গত মাসের শেষ সপ্তাহে ফ্রান্স থেকে পাঠানো এক ফ্যাক্স অনুযায়ী দেখা যায় ফ্রান্সের খ্রিস্টান বিশি তসলিমাকে তার লজ্জার জন্য অগ্রিম বাবদ পাঁচ হাজার ১৪৪ দশমিক ২১ ডলার পরিশোধ করেছে। এছাড়াও গত ১৫ ও ১৬ মে আরো দু দফায় অর্থ প্রদান করা হয়েছে। প্রাপ্ত ফ্যাক্স অনুযায়ী ১৫ এপ্রিলে পাঠানো প্রথম কিস্তির টাকা গায়েব হয়ে গেছে। এ নিয়ে দু পক্ষে ২৫ মে বিকেলে ফোনে আলোচনা হয়েছে। অর্থ গায়েব হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি নিয়ে ফ্রান্সের বিশি খুব দুশ্চিন্তায় আছেন। তাই তিনি লিখেছেন, আমাদের ব্যাংকের নিউইয়র্ক শাখা থেকে উল্লিখিত অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে বলে প্রমাণ রয়েছে। এ কারণে মিঃ বিশি তাঁদের ব্যাংক বিএনপিকে চেকের কপি পাঠাবার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর ধারণা স্বাক্ষর জাল অথবা চেকটি চুরি না হলে এ ঘটনা ঘটতে পারে না। কারণ চেকটি সরাসরি তসলিমার ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে। চেকটি ভুলবশত তসলিমার ব্যাংকের অ্যাকাউণ্টে না গিয়ে বাসায় গিয়েছে বলে ফ্যাক্সে বলা হয়েছে। ফ্যাক্সে উল্লেখ করা হয়েছে মিঃ বিশি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন রয়েছেন। উল্লেখ্য, তসলিমা নাসরিন তার বৈধ পাসপোর্ট ফেরত পাবার পর প্রথমে ফ্রান্স পরে নিউইয়র্ক ও কলকাতা হয়ে বাংলাদেশে আসেন। তসলিমার লজ্জা উপন্যাস ভারতে বিজেপির মুখপত্র হিসেবে কাজ করছে।
এই পত্রিকার লোকের হাতেও ফ্যাক্স টি গেছে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। অন্তত এই লোকেরা জানে যে ফ্যাক্সটি পাঠানো হয়েছে ফ্রান্স থেকে। তবে কোন কোন দেশ হয়ে আমি বাংলাদেশে এসে পৌঁচেছি তা বলতে গিয়ে নিউইয়র্ক উল্লেখ করার সম্ভবত একটি কারণ, ফ্যাক্সে নিউইয়র্কের ব্যাংক প্রসঙ্গটি আছে, আমি ও শহরটা হয়ে এলে অর্থযোগের ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়। সুতরাং আমি ও শহরে না গেলেও পত্রিকাটি আমাকে ও শহরে ঘুরিয়ে আনবে, কার কি বলার আছে! বিজেপি আমাকে ৪৫ লক্ষ টাকা দিয়েছে লজ্জা লেখার জন্য, এটি যারা এতকাল বিশ্বাস করেনি, তাদের বিশ্বাস করাবার জন্য চমৎকার একটি প্রমাণ দেওয়া হল। অনেকে বলে, যা রটে, তা কিছুটা বটে। সুতরাং ৪৫ লক্ষের রটনা যে কিছুটা বটেও, সে ব্যাপারে আজ দেশের কত লক্ষ লোক নিশ্চিত হবে, অনুমান করতে চেষ্টা করি। মাথা বন বন করে ঘুরে ওঠে। আজ যদি ঙ আসেন, চ এসে সামনে দাঁড়ান, অথবা ক, অথবা খ, তাঁরা কী চোখে তাকাবেন আমার দিকে? নিশ্চয়ই বলবেন, যে, না, তোমাকে আমরা আর সাহায্য করতে পারছি না। তুমি এবার নিজের পথ দেখ। তবে কী করব আমি? বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা রিক্সা নেব? রিক্সায় আমি কতদূর যেতে পারব আমাকে রিক্সা থেকে টেনে নামিয়ে রাস্তায় যখন পিষে মারবে? আমার লাশ নিয়ে বড় একটি জয়ের মিছিল হবে সারা শহরে! ঠিক কতক্ষণ পর তা হবে, আমি বেরোনোর কত মিনিট পর! অনুমান করতে চেষ্টা করতে গিয়ে দেখি বমির উদ্রেক হচ্ছে। পেচ্ছ!বখানায় গিয়ে বল্টুর গু মুতের তীব্র গন্ধের মধ্যে দরজা বন্ধ করে মেঝেয় বসে থাকি। বমি আসছে কিন্তু আসছে না। গা জ্বলছে, গলা জ্বলছে। গোঙানোর শব্দ শুনতে থাকি নিজের। একসময় নিজেকে টেনে তুলে বিছানায় নিয়ে যাই। বিছানায় ছড়িয়ে আছে পত্রিকার স্তূপ। এক একটি হাতে নিই, চোখ বুলোই।
তসলিমাকে ধরতে পুলিশ কোর্ট এলাকায় ওৎ পেতে ছিল।
পুলিশ লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে গতকাল মঙ্গলবার রাত ১০টা পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি। পুলিশ জানিয়েছে যে তাকে গ্রেফতারের জন্য মতিঝিল থানা ও গোয়েন্দা শাখার একাধিক বিশেষ দল ঢাকা মহানগরী ও দেশের কয়েক জায়গায় তৎপরতা চালাচ্ছে। কোথাও তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। তসলিমা আদালতে আত্মসমর্পণ করতে আসতে পারেন, এ ধরনের গুজবের প্রেক্ষিতে পুলিশ গত ২ দিন হাইকোর্ট ও জজ কোর্ট এলাকায় ওৎ পেতে ছিল। ( দৈনিক সংবাদ)
তসলিমাকে ব্যাপক খোঁজাখুঁজি
গত তিনদিনে তসলিমাকে ধরার জন্য দুই শতাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ ও ঢাকাসহ দেশের পাঁচ শতাধিক সম্ভাব্য স্থানে অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু তসলিমাকে পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশের ধারণা, তিনি দেশের ভেতরেই আত্মগোপন করে আছেন। ঢাকা ময়মনসিংহসহ দেশের সকল সম্ভাব্য স্থানে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। কড়া নজর রাখা হচ্ছে তসলিমার আত্মীয়স্বজনসহ ঘনিষ্ঠজনদের গতিবিধির ওপর। জয়দেবপুরের প্রভাবশালী যুবক কায়সারের আশ্রয়ে তসলিমা রয়েছেন, এ খবর পেয়ে পুলিশ সেখানেও অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। তসলিমার বাসাসহ তার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে এমন বেশ কয়েকটি টেলিফোনের কথাবার্তা পুলিশ রেকর্ড করছে বলে সূত্র জানিয়েছে। পুলিশের অপর একটি সূত্র জানায়, সিএমএম আদালত ও হাইকোর্ট এলাকাতেও তল্লাশি চালানো হয়েছে। গত রোববার এক গোপন সূষেন খবর পেয়ে পুলিশ হোটেল শেরাটনের বেশ কয়েকটি কক্ষে অভিযান চালায়। (ভোরের কাগজ)
তসলিমাকে গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে বিবৃতি বিক্ষোভ সমাবেশ
ধর্মদ্রোহী তসলিমা নাসরিনকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের দাবিতে সারাদেশে সভা সমাবেশ বিবৃতি ও বিক্ষোভ মিছিল অব্যাহত রয়েছে। নেতৃবৃন্দ ধর্মদ্রোহীদের ইসলামি বিধানমতে শাস্তি প্রদানের জোর দাবি জানান। জনকণ্ঠসহ ধর্মদ্রোহী সকল পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল, ধর্মবিরোধী বইপুস্তক নিষিদ্ধ এবং লেখক, প্রকাশক, সম্পাদকের কঠোর শাস্তি ও এনজিওদের অপতৎপরতা বন্ধের দাবিতে ৩০ জুন বৃহস্পতিবার ইয়ং মুসলিম সোসাইটি বাংলাদেশ আহুত দেশব্যাপী অর্ধদিবস হরতাল কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।
আজ সকাল ১১টায় হোটেল ওসমানী ইন্টারন্যাশনালএ সবুজবাগ, মতিঝিল, ডেমরা, সূত্রাপুর থানা ও ইউনিট প্রধানদের বৈঠক। একই দিন বিকাল ৫টায় সবুজবাগ থানা শাখার উদ্যোগে বাসাবো ওহাব কলোনির মোড়ে গণসমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় হোটেল ওসমানী ইন্টারন্যাশনাল এ লালবাগ, কোতায়ালি, রমনা, ধানমণ্ডি থানা ও ইউনিট প্রধানদের বৈঠক। একই দিন বিকাল ৩টায় বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ চত্বর ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রাহী তৎপরতা প্রতিরাধ মোর্চা ঘোষিত যুব সমাবেশে যোগদান। শুক্রবার সকাল ৯টায় হোটেল ওসমানী ইন্টারন্যাশনাল মোহাম্মদপুর, মীরপুর, পল্লবী, তেজগাঁও, ক্যান্টনমেন্ট, গুলশান, উত্তরা থানা ও ইউনিট প্রধানদের বৈঠক। একই দিন বাদ জুম্মা ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা প্রতিরোধ মোর্চা আহুত মিছিলে যোগদান। গতকাল ৩৩ মিন্টো রোডে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ওলামা দল আয়োজিত এক সভায় ধর্মদ্রোহী তসলিমা নাসরিনকে অবিলম্বে গ্রেফতার পূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়। বড় কাটরা মাদ্রাসা ছাত্র সংসদের প্রতিবাদ সভায় তসলিমার ফাঁসির দাবি জানানো হয়। তমদ্দুন মজলিশ আয়োজিত আলোচনা সভায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তুল্য বিদেশি অর্থপুষ্ট এনজিওসমূহের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, কুখ্যাত তসলিমা নাসরিনসহ একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও কিছু পত্রিকার ইসলাম বৈরি তৎপরতা দমন এবং আমাদের স্বাধীনতা, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে বিদেশি মদদ পরিচালিত অপপ্রচার মোকাবেলা করার আহবান জানানা হয়। ফ্রীডম পার্টির আলাচনা সভায় বলা হয়, শত প্রলোভনের পশরা সাজিয় এদেশের মানুষকে ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য প্রলুব্ধ করা হলেও জনগণ তাদের ঈমান বিক্রি করবে না। চট্টগ্রাম মাদ্রাসা শিক্ষক মিলনায়তনে প্রতিবাদ সভায় বক্তারা কুখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের ইসলাম ও কুরআন সম্পর্ক ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের নিন্দা করেন এবং তার সকল বই বাজেয়াপ্ত করা এবং তার ফাঁসির দাবি করেন। ২৬৮ এলিফেন্ট রোডে বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টির (ন্যাপ ভাসানী) সভায় তসলিমা নাসরিন সহ সকল মুরতাদ ও ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে শাস্তির জোর দাবি জানানো হয়। এছাড়াও বাংলাদেশ মুসলীম লীগ, বাংলাদেশ জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া, ঈমান বাঁচাও দেশ বাঁচাও আন্দোলন, বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রসমাজ অবিলম্বে তসলিমাকে গ্রেফতার করে ফাঁসি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। বাংলাদেশ সীরাত মিশনের সভাপতি মাওলানা শাহ আবদুস সাত্তার অবিলম্বে তসলিমা নাসরিনকে খুঁজে বের করতে লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। ধর্মদ্রোহীদর শাস্তি প্রদান, সংসদে ধর্মদ্রোহীদের শাস্তি আইন পাসএর দাবিতে আজ বিকাল সাড় ৪টায় জামাতে ইসলামির উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে এক গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখবেন জামাতে ইসলামির সেক্রেটারি ও জামাত সংসদীয় দলের নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামি, প্রখ্যাত মোফাসসির কুরআন মাওলানা দেলোয়ার হোসন সাইদী ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। গণসমাবেশে দলে দলে যোগদান করার জন্য প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের প্রতি উদাত্ত আহবান জানানা হয়েছে। সিলেট মৌলভীবাজারের ৮৫ জন আলেম, শিক্ষক ও বিশিষ্ট ব্যক্তি পৃথক দুটি বিবৃতিতে বলেছেন, আমরা মনে করি দেশে ইসলামের বিরুদ্ধে পরিচালিত মুরতাদী অপতৎপরতা একটি গভীর আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতার পরিকল্পিত অংশ। বিবৃতিতে জাতিকে একতাবদ্ধ দ্বীনি অনুপ্রেরণায় ইসলামদ্রোহী আধিপত্যবাদী এ সকল খ্রিস্টান মিশনারি ও ইহুদিবাদী চক্রান্তকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান করছি।
বরিশালে বিবির পুকুরপাড়ে বিকাল ৩টায় ইসলামি শাসনতন্ত্রের জনসভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। (দৈনিক ইনকিলাব)
নাস্তিক মুরতাদদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়িতে হইবে
ইসলাম ও রাষ্ট্রাদ্রোহী তৎপরতা প্রতিরোধ মোর্চা গঠনের লক্ষ্যে গঠিত সমন্বয় কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ও উলামা কমিটি বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মুফতী ফজলুল হক আমিনী নাস্তিক মুরতাদদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পাশাপাশি আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানান। মোর্চা ঘোষিত ৯ ই জুনের যুব সমাবেশ ও ১০ই জুনের বিক্ষোভ দিবস সফল করার লক্ষ্যে গতকাল মঙ্গলবার লালবাগের জামেরা কোরানিয়া আরাবিয়ায় আয়োজিত এক দোয়া সমাবেশে বক্তৃতাকালে মাওলানা আমিনী বলেন, আল্লাহর নিদর্শন যে জাতি অবমাননা করে, আল্লাহর বিধান হইল সে জাতিকে ধ্বংস করিয়া দেওয়া। পবিত্র কোরানের সহিত যে চরম বেয়াদবি ও উপহাস করা হইতেছে তাহাতে যে কোনও সময় ্এই জাতি ধ্বংস হইয়া যাইতে পারে। তাই এ দেশের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে প্রতিটি মুসলমানকে প্রতিবাদমুখর হইতে হইবে। (দৈনিক ইত্তেফাক)
জামাতে ইসলামির পত্রিকা দৈনিক সংগ্রামে আজকের সম্পাদকীয়
তসলিমাকে রক্ষার অভিনব উদ্যোগ
ধর্মদ্রোহী তসলিমার বিরুদ্ধে বিলম্বে হলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় যখন একটি জামিনের অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে, তখন তসলিমাকে রক্ষাকারী ও তার অপসৃষ্ট মুদ্রণ-প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণকারী এনজিও সেক্যুলারবাদীরা পরিস্থিতি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য সম্ভবত পতাকা নাটকের অভ্যুদয় ঘটিয়েছে। তসলিমা, আহমদ শরীফসহ মুরতাদ ইসলামবিরোধী মহলের ঢালাও অপপ্রচার ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে সারাদেশে যখন ধর্মপ্রাণ জনগণের মাঝে স্বতস্ফূর্ত ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, তখন নাস্তিকতাবাদী মুরতাদপন্থীরা ষড়যন্ত্রের চোরাপথে তসলিমাকে রক্ষার জন্য নতুন নাটক শুরু করেছে। জাতীয় সংসদের কার্যক্রম যখন স্থগিত ছিল, তখন সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জাতীয় পতাকার বদলে কে বা কারা এক টুকরো বিতর্কিত রঙিন কাপড় টানিয়ে দিয়েছে এবং এই নিয়েই তসলিমা পন্থীরা সারাদেশে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছে। এ ক্ষেষেন বিরোধীদলীয় নেষনী শেখ হাসিনার ভূমিকাও তসলিমা ও মুরতাদপন্থীদের আস্কারা দেবে। তসলিমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারিকে শেখ হাসিনা বাড়াবাড়ি বলে অভিহিত করে তার ও তার দলের অবস্থান নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যে নারী জরায়ুর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যে নারী পুরুষ ধর্ষণের মত অশালীন কুৎসিত কথা বলে, যে নারী পবিত্র কোরান সংশোধনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করে, শেষ হাসিনা সেই নারীর রক্ষক হতে চাইছেন। শেখ হাসিনাদের হজ্ব, মাজার জিয়ারত যে কত ভণ্ডামি এতেই তার প্রমাণ মিলছে। ইতিমধ্যেই কথা উঠেছে, ইসলামের মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত হতে দেবার ক্ষেষেন শাসকদল ও আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। সরকারের যে পুলিশরা এতদিন তসলিমাকে নিরাপত্তা দিয়েছে, তাদের চোখকে এখন ফাঁকি দিয়ে তসলিমা কিভাবে আত্মগোপন করল? তসলিমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির সময়ই কি তাহলে তাকে খবর দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে? পুলিশ নাকি দশ মিনিটের ব্যবধানে তাকে ধরতে পারেনি। তসলিমার ব্যাপারে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দীর্ঘসূত্রিতা নানাধরনের প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। সরকারের পুরো কার্যক্রমই মনে হচ্ছে আই ওয়াশ। অবশ্য স্পীকারও বলেছেন, তসলিমার ধর্মদ্রোহীতামূলক আচরণের প্রসঙ্গ জাতীয় সংসদে আলোচনা করা হবে। তবে তসলিমার মত একটি ধিকৃত নষ্ট মেয়েকে রক্ষা করার জন্য তার ভক্ত অনুরক্ত মৌলবাদবিরোধী চক্রটি শেষ পর্যন্ত জাতীয় পতাকার মত স্পর্শকাতর ইস্যুকেও ব্যবহার করে ছেড়েছে। পতাকা নামানো এবং সেখানে একখন্ড কাপড় ঝোলানোর এই ঘটনার জন্য সংসদ সচিবালয়ে প্রেসনোট ইস্যু করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছে। এছাড়া এ ব্যাপারে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেবার লক্ষ্যে ব্যাপক পুলিশী তদন্ত চলছে। কিন্তু তারপরও এনজিওবিরোধী ফতোয়াবাজ মৌলবাদীদের এ ব্যাপারে অভিযুক্ত করার অপপ্রয়াস চলছে। বামপন্থী গুটিকতক লোক এ নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করেছে, মিছিল পর্যন্ত বের করেছে। এমনকি কেউ কেউ পতাকার মর্যাদা রক্ষায় সরকারী ব্যর্থতার প্রসঙ্গ টেনে সরকারের পদত্যাগ পর্যন্ত দাবি করেছে। একদল তো তসলিমার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির নিন্দা করেছে। সরকারের বিরুদ্ধে তারা নানা ধরনের বাক্যবান নিক্ষেপ করেছে। সরকার নাকি মৌলবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তসলিমার বিরুদ্ধে যখন আদালতে মামলা বিচারাধীন, সেই অবস্থায় ইস্যুটি রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিভাবে? একশ্রেণীর পত্রপত্রিকা একই ইস্যুতে সংবাদপষেনর নীতিমালা লঙ্ঘন করে বিকৃত উস্কানিমূলক খবর প্রচার করে যাচ্ছে। এই বাড়াবাড়ির অবসান হওয়া দরকার। সরকার যদি এসব সমাজবিরোধী শান্তিবিনাশী কর্মকাণ্ড কঠোর হাতে দমন না করে, তাহলে তসলিমাকে গুম করার নাটকও হয়ত আমাদের দেখতে হবে। কেননা, তসলিমা এখন মহলবিশেষের হাতে তুরুপের তাস। তসলিমা গ্রেফতারের নাটক যত চলতে থাকবে, পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে।
তসলিমা নাসরিনের ব্যাপারে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের উদ্বেগ
তসলিমা নাসরিনের নিরাপত্তা বিধান এবং তার ওপর হয়রানি বন্ধের জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আহবান জানিয়েছে। ঢাকাস্থ বিভিন্ন দূতাবাসের কুটনীতিকরা তসলিমার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চেয়েছেন তাঁর ব্যাপারে। মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তসলিমার বিরুদ্ধে যে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেই করা হয়েছে। কেউই আইনের উর্ধ্বে নয়। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। তসলিমার উচিত আইন অমান্য না করে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করা। (আজকের কাগজ)
তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রতিবাদ
উইমেন ডেভেলপমেন্ট ফোরামের উদ্যোগে মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর নারীর সমঅধিকার ও উন্নয়ন বিরোধী অপতৎপরতার প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত সভায় তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেফতারি পরোয়ানার নিন্দা করা হয়। বলা হয়, তসলিমা পবিত্র কোরান সম্পর্কে কোনও কটূক্তি করেনি, সরকার এই মামলা করে মৌলবাদীদের উৎসাহিত করেছে। সভায় মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, মৌলবাদীরা ফতোয়া দিয়ে নারীপুরুষকে দোররা মারা, পুড়িয়ে মারা, বিষপানে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা, উন্নয়ন কার্যক্রমে নিয়োজিত বেসরকারি সংস্থার স্কুল অফিস পুড়িয়ে দেওয়া, জাতীয় পতাকার অবমাননা ইত্যাদি অপরাধ সংঘটিত হলেও এ নিয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্টমহল কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। অথচ হঠাৎ করেই সরকার তসলিমার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেছে। ২২ জন মহিলা সই করেন, রোকেয়া কবীর, সাহিদা বেগম, আফরোজা পারভিন, শিরিন বানু, সালেহা খাতুন..। নারীপক্ষ থেকেও বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। নারীপক্ষের আহবায়ক ফিরদৌস আজিম বলেছেন, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সমনাগরিকত্বের সঙ্গে সঙ্গে বাক স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা, এবং এমন একটি পরিবেশ যেখানে বিভিন্ন ধরনের মতামত প্রকাশ করার সুযোগ প্রত্যেকটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে সুরক্ষিত — একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু রাখার জন্য এগুলোই হচ্ছে ন্যূনতম শর্ত। বিবৃতিতে তিনি বলেন, সরকার এ পরোয়ানা জারি করে আমাদের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারকে আঘাত করেছেন। তিনি অবিলম্বে এ গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার এবং তসলিমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানান। গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রণ্টের আফরোজা বেগম তসলিমার গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহারের দাবি করেন। নারী নির্যাতন গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারি ফেডারেশনের পক্ষ থেকেও করা হয়।
সুপ্রিম কোর্টের ৫২ জন আইনজীবী একই দাবি জানান।
চট্টগ্রামের ফতেয়াবাদে তসলিমা পক্ষ, শিবচর থানার বরহামগঞ্জ তসলিমা পক্ষ তসলিমার বিরুদ্ধে জারিকৃত গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহারের দাবিতে সভার আয়োজন করে। (ইত্তেফাক)
জ্ঞানকে জ্ঞান দিয়ে মোকাবেলা করার মধ্যেই প্রক্রক্রক্রকৃত মনীষা নিহিত
মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট লেখক মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধু গবেষণা সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল আবীর আহাদ এক বিবৃতিতে তসলিমা নাসরিনকে সংগ্রামী এবং মানবতাবাদী লেখিকা হিসেবে আখ্যায়িত করে তথাকথিত ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে সরকারের মামলা দায়েরকে দুর্ভাগ্য বলে অভিহিত করে বলেন, ধর্মের সমালোচনা করলে যদি ধর্মের ক্ষতি হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে ধর্মটি অতি ঠুনকো। কোরানে যেখানে পরিষ্কার বলা হয়েছে, ইসলামকে আল্লাহ নিজেই রক্ষা করবেন, সেখানে ইসলামের বিরুদ্ধে কে কি বলল না বলল তাতে কার কি আসে যায়? ধর্মের সমালোচনাকে গোনাহ বলে কোরানে উল্লেখ রয়েছে এবং গোনাহর বিচার করবেন একমাত্র আল্লাহ। সে ক্ষেষেন ইসলামের সমালোচনাকারীদের বিচারের ভার আল্লাহ কোনও মানুষকে দেননি। অথচ ইসলামের নামাবলী জড়িয়ে একশ্রেণীর অশিক্ষিত ধুরন্ধর মোল্লারা আল্লাহর দায়িত্বটা নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে প্রকারান্তরে তারাই আল্লাহ-দ্রোহিতার পরিচয় দিচ্ছে। অবিলম্বে তিনি এই দুর্বৃত্তদের চক্রকে শায়েস্তা করার জন্যে প্রশাসনের প্রতি আহবান জানান। (আজকের কাগজ)
আমি অবাক হচ্ছি, আমার বিরুদ্ধে সরকারের এই অন্যায় মামলার প্রতিবাদ করছেন না কোনও গণ্যমান্য লেখক, নামী দামী বুদ্ধিজীবী, বড় রাজনৈতিক দল, সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক সংগঠন! তাঁরা তো সবসময়ই যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন, বিবৃতি দেন। আমার বোঝার সাধ্য নেই কি কারণ সকলের এমন নীরবতার। আইনজীবীদের যে বিবৃতি বেরিয়েছে, আমার বিশ্বাস তা ক যোগাড় করেছেন। ৫২ জন আইনজীবী সই করে দিয়েছেন, ব্যাপারটি কেমন যেন বিশ্বাস হতে চায় না, সম্ভবত ক একটু বেশি করেই নামধাম লিখে দিয়েছেন। গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টএর বিবৃতির পেছনে আমার বিশ্বাস সাজু আর জাহেদার হাত আছে। তারাই এই বিবৃতি দিয়েছে। উওম্যান ডেভেলপম্যান্ট ফোরামের যে বিবৃতি, হয়ত খ করেছেন যোগাড়। দিব্য-চোখে দেখি আমার জন্য হাতে গোণা কজন মানুষ লোকের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বিবৃতি ভিক্ষে চাইছেন। আজ আমার এমনই পরিণতি। রাতে ঙ এসে বললেন যে তিনি বুদ্ধিজীবীদের একটি বিবৃতি যোগাড় করতে চাইছেন, কিন্তু সই করার লোক বেশি নেই বলে বিবৃতি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ঙর সঙ্গে ক ও এসেছেন। বলেছেন যে দেশের অবস্থা দিন দিন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে। লুকিয়ে থাকলে বেঁচে যাবো–এর কোনও নিশ্চয়তা নেই, যে কোনও সময় বিপদ হতে পারে, বিশেষ করে মৌলবাদীদের কেউ যদি আমার খোঁজ পেয়ে যায়। জামিনের অনিশ্চয়তা দিন দিন বাড়ছে। আমাকে জামিন দেওয়া হবে না, আদালতের এই সিদ্ধান্তের কথা কোনও না কোনওভাবে আমার উকিলদের কানে গিয়েছে। জামিন না দেওয়ার সিদ্ধান্তই যদি হয়ে থাকে তবে আমাকে উন্মত্ত মানুষের ভিড়ের মধ্যে আদালতে উপস্থিত করার কোনও অর্থ হয় না। জামিন তো পাওয়াই হবে না, মাঝখান থেকে আমার জীবনটি যাবে। জামিনের এই অনিশ্চয়তা, সর্বোপরি জীবনের এই অনিশ্চয়তা নিয়ে আমি একটি কাজ করতে পারি, এ মুহূর্তে এর চেয়ে ভাল সমাধান অন্য কিছু আর নেই, সে হল পালিয়ে যাওয়া।
স্মাগলড আউট।
প্রথম ভেবেছিলাম বুঝি মজা করছেন ওঁরা। কিন্তু লক্ষ্য করি, মোটেও মজা করার জন্য নয়, ক এবং ঙ দুজনেই এ বিষয়ে রীতিমত গুরুগম্ভীর আলাপ করলেন, এবং একমত হলেন। দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া– হাজার রকম অসম্ভব জিনিস আমি কল্পনা করতে পারি, কিন্তু এটি পারি না। আমার দিকে চারটে চোখ যখন প্রশ্ন নিয়ে তাকালো, আমি বললাম, আমি অবৈধভাবে দেশ ছাড়ব না। আমি পালাবো না। দেশের পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হবে, তখন হয়ত পালানোর আর কোনও সুযোগও থাকবে না। এখনও হয়ত ঝুঁকি নিয়ে হলেও এ কাজটি করা যায়। কোনও একটা গাড়ির ব্যবস্থা হবে, গাড়িতে আমাকে তুলে নিয়ে কোথাও কোনও সীমান্তের দিকে অন্ধকারে ছেড়ে দেওয়া হবে। আমার চেহারা বেশভুষা সম্পূর্ণ অন্যরকম থাকবে, ওখানে ধরা পড়লেও যেন কেউ চিনতে না পারে। হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে যাবো। বাঁচার জন্য মানুষ তো অনেক কিছু করে। আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে খুব দ্রুত। কারণ দিন দিন দিন জটিল হচ্ছে। সরকার মৌলবাদীদের হাতের পুতুল হয়ে উঠছে। কথায় কথায় জনকণ্ঠের কথা ওঠে। জনকণ্ঠে গতমাসে ক্লান্ত পথিক ছদ্মনামে এটিএম শামসুদ্দিনের একটি কলাম ছাপা হয়েছিল, শামসুদ্দিন মূলত সেই মোল্লাদের সমালোচনা করেছিলেন, যারা গ্রামে গ্রামে এনজিওতে কাজ করা মেয়েদের ফতোয়া দিচ্ছে। উত্তরবঙ্গের গরিব মেয়েদের তুত গাছ লাগানোর কাজ দিয়েছিল ব্র্যাক। কিন্তু গ্রামের মোল্লারা মেয়েদের লাগানো তুত গাছ কেটে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। মেয়েদের বলে দেয় তারা যদি এনজিওতে কাজ করা বন্ধ না করে তবে তাদের সমাজচ্যুত করা হবে, স্বামীদের বাধ্য করা হবে তাদের তালাক দিতে। কলাম লেখক কাঠমোল্লারা যে কোরানের ভুল ব্যাখ্যা করে ফতোয়া দিচ্ছে তাই বলতে গিয়ে তাঁর ছোটবেলার একটি শোনা ঘটনা বর্ণনা করেন, ঘটনাটি এরকম, আমিন নামের এক লোকের কাছে সুন্দরী বিধবা জৈয়তুনের একটি বলদ বর্গা ছিল। আমিন জৈয়তুনের কাছে প্রেম নিবেদন করে ব্যর্থ হলে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সে গরুটি বিক্রি করে দেয়। তো জৈয়তুন টাকা চেয়ে পাঠায় বলদের। কিন্তু আমিন বলদটি তার নিজের ছিল বলে দাবি করে। গ্রামের মোল্লাদের কাছে জৈয়তুন বিচার চায়। বিচার বসে। এদিকে কিন্তু কাঠমোল্লাদের কিছু টাকা পয়সা দিয়ে আমিন ব্যবস্থা করে রেখেছে। সালিশ বসে গ্রামে, কাঠমোল্লারা সুরা ত্বিন থেকে পড়ে ওয়া হাজাল বালাদিন আমিন, এর অর্থ ওরা বলে, পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে বলদটি আমিনের। নিরক্ষর জৈয়তুন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে যায়। এই হল জনকণ্ঠের দোষ, মোল্লাদের নিয়ে ঠাট্টা করে লেখা একটি কলাম ছেপেছে জনকণ্ঠ। ক্লান্ত পথিক তো তবু মোল্লাদের সম্মান করেছেন। কেবল কাঠমোল্লাদের গাল দিয়েছেন, কাঠমোল্লাদের তো মোল্লারাই গাল দেয়। মূর্খ লোকেরা যারা নিজেদের মোল্লা বলে দাবি করে লোক ঠকানোর ব্যবসা করে, তাদের বলা হয় কাঠমোল্লা। কোরানে ভাল কথা লেখা আছে, কিন্তু কোরান হাদিস সম্পর্কে কোনও জ্ঞান নেই বলে কাঠমোল্লারা কোনও আয়াতের বা কোনও সুরার সঠিক ব্যাখ্যা না করে অপব্যাখ্যা করে নিজেদের স্বার্থে, এ কথাই ক্লান্ত পথিক বলেছেন। লেখাটিতে কাঠমোল্লাদের দোষ দেওয়া হয়েছিল, কোরানের সুরাকে দোষ দেওয়া হয়নি। কিন্তু মৌলবাদীদের কিছু একটা ধরতে হয়, ধরতে হয় বলেই জনকণ্ঠকে ধরা। আমাকে যখন ধরে, তখন কিন্তু ঠিক ঠিকই ধরে। আমি তো কোরানের সুরা আয়াতকেই নিন্দা করেছি। আমার ফাঁসির দাবিতে যখন মৌলবাদীদের আন্দোলন সারাদেশে বিশাল আকার ধারণ করল, তখন তারা সুযোগ পেয়ে গেল একটি একটি করে মৌলবাদবিরোধী শক্তিকে ঘায়েল করার। সরকার মৌলবাদীদের প্রতিটি দাবি মেনে নিচ্ছে। আজ জনকণ্ঠের চারজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ২৯৫ (ক) ধারায় সরকার মামলা করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে, দুজন সাংবাদিককে ধরেছে পুলিশ, দুজন পলাতক। মৌলবাদীদের দাবি মেটানো ছাড়া সরকারের এখন আর বড় কোনও কাজ নেই। আমার পরিস্থিতির সঙ্গে জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের পরিস্থিতির তুলনা করা যায় না। কারণ জনকণ্ঠের কোনও সাংবাদিকের ফাঁসির দাবি মৌলবাদীরা করেনি, দাবি করেছে জনকণ্ঠ পত্রিকা নিষিদ্ধ করার। জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের নামও মৌলবাদীরা জানে না, চেহারাও চেনে না। সুতরাং সরকার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একই মামলা করলেও আমি হচ্ছি মৌলবাদীদের মূল টার্গেট।
ক এবং ঙ আমার পালাবার ব্যবস্থা কিভাবে করা যায় তার একটি ছক আঁকলেন। ঘরে অতি সামান্য আলো। কথাবার্তা নিচু স্বরে। কেমন ভূতুড়ে লাগছে সবকিছু। কানে একসময় কারও কোনও কথা পৌঁছয় না। কাঠ কাঠ লাগে শরীরটি। নিজের স্বরে নিজেই আমি চমকে উঠি, যখন শুনি যে বলছি, আমি পালাবো না। তার চেয়ে ভাল আত্মসমর্পণ করব।
এ সময় আত্মসমর্পণ করা আর মৃত্যুদণ্ড গ্রহণ করা যে সমান কথা, এ বিষয়ে ক এবং ঙ অনেকটা একমত। এই সরকারের ওপর কারও আস্থা নেই। মৌলবাদীদের দাবি মেনে আমার ফাঁসির ব্যবস্থা যে এই সরকার করবে না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
আত্মসমর্পণ!
হ্যাঁ, আত্মসমর্পণ। আমার বিচার করতে চায় বিচার করুক। যত হোক দেশের আইন। আইন সবাই মানছে, আমি মানবো না কেন!
ভেবে বলছ কথাটা? ঙ জিজ্ঞেস করেন।
এই আইনে দুবছরের জেল হয়। দুবছর জেল খাটব। কত মানুষই তো জেল খাটে। বলে একটি দীর্ঘশ্বাস সামলে নিই।
ঙ বললেন, জেল জেল যে করছ, জেলে তোমার নিরাপত্তা কি?
আমি বলি, নিরাপত্তা তো দেওয়া হয় জেলে। হয় না কি?
তুমি কি জানো যে জেলে অনেক পলিটিক্যাল মার্ডার হয়! আর তোমার কেইস তো পলিটিক্সের চেয়েও বেশি সেনসিটিভ। রিলিজিয়াস সেন্টিমেন্ট সম্পর্কে তোমার কোনও ধারণা নেই। এর চেয়ে ভয়াবহ জিনিস জগতে আর নেই।
ক শুকনো মুখে বসে থাকেন ঙর পাশে। চোখদুটো ধু ধু করছে। আমি জানি সে কথা। জানি যে জেলে আমাকে মেরে ফেলতে পারে। কিন্তু দুটো খারাপ এর মধ্যে একটি খারাপকে বেছে নিলাম। চোরের মত পালাতে গিয়ে মরার চেয়ে জেলে খুন হওয়া ভাল। পালাবো কেন, আমি তো কোনও অন্যায় করিনি! আসলে এখন আমার অন্য কোনও উপায় নেই দুধরনের মৃত্যুর মধ্যে একটি মৃত্যুকে বেছে নেওয়া ছাড়া। আমি জেলের মৃত্যুকে বেছে নিলাম।
ক আর ঙ চুপ হয়ে থাকেন। চ শব্দহীন পায়ে ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকেন। ক আর ঙর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকেন দেয়ালে হেলান দিয়ে। সবকটি প্রাণী চুপ। নৈঃশব্দ্য ভেঙে চ বলেন, কিছু খাবেন আপনি?
মাথা নেড়ে না বলি।
দুপুরে খাইনি, রাতেও না। ক্ষিধে বলতে কোনও কিছু আমি বোধ করছি না।
ক এবং ঙ দুজনে আমাকে দুটো চিরকুট দেন। ঙ দেন শামসুর রাহমানের লেখা একটি চিরকুট। তসলিমা, মানসিক ভাবে আমি তোমার সঙ্গে আছি। ক দেন ছোটদার লেখা একটি চিরকুট। নাসরিন, আমরা সবাই তোর কথা ভাবছি। তুই ভেঙে পড়িস না। সত্যের জয় একদিন হবেই। চিরকুটটি আমার হাতে দিয়ে ক বলেছেন, আপনার ভাই কামাল আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, আপনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন তার কোনও খবর আমি জানি কি না জানার জন্য। আমি কিছু বলিনি তাকে। আমাকে এই চিঠিটা দিয়ে গেছে, যদি কখনও আপনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়, যেন দিয়ে দিই। বলেছে, ময়মনসিংহ থেকে আপনার বাবা নাকি জানিয়েছেন, আপনার কোনও খোঁজ পেলে বলতে যে আপনি যেন মনের জোর রাখেন, যেন ভেঙে না পড়েন। কামাল তার বউ বাচ্চা নিয়ে এখন আপনার বাড়িতে থাকছে। আপনার উকিলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছে সে।
ক আর ঙ কতক্ষণ ছিলেন বসে আমার মনে নেই। কারও সঙ্গে আমার আর কোনও বাক্য বিনিময় হয়েছে কি না মনে নেই। মনে নেই সে রাতে আমার ঘুম পেয়েছিল কি না, আমি ঘুমিয়েছিলাম কি না।
৩. অতলে অন্তরীণ – ০৬
নয় জুন, বৃহস্পতিবার
ঢাকা শহরের এমন কোনও রাস্তা নেই যেখানে মৌলবাদীদের জমায়েত হচ্ছে না বা মিছিল হচ্ছে না। গতকাল দেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে জামাতে ইসলামির জনসভায় হাজার হাজার লোক জমেছিল। জামাতে ইসলামির মহাসচিব, জাতীয় সংসদ সদস্য মতিউর রহমান নিজামী জনসভায় বলেন, তসলিমা বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্ম, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। স্বাধীনতার চেতনার দাবিদার যে সমস্ত নেতা ও দল ওই লেখিকাকে সমর্থন করছেন তাঁরাও মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিপক্ষে থেকে যাচ্ছেন। বাইবেল বা যীশু-খ্রীস্টের বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য বা কটূক্তি করলে বৃটেনসহ পশ্চিমাদেশগুলোতে যে শাস্তির বিধান রয়েছে, কোরান শরিফ সম্পর্কে দুঃসাহসিক বক্তব্যের কারণে তসলিমারও একই শাস্তি প্রাপ্য। বিজেপি, আনন্দবাজার পত্রিকা, পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা যারা তসলিমাকে ইন্ধন যোগাচ্ছে, তারা ইসলাম ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আইনের দাবি।
জামাতে ইসলামির মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাইদী বক্তা হিসেবে জনপ্রিয় বেশ। তাঁর বক্তৃতার ক্যাসেট হাটে ঘাটে মাঠে ঝালমুড়ির মত বিক্রি হয়। তিনি অগুনতি জনতার সামনে বলেছেন, সমাজতন্ত্রের ধ্বস নামার পর নাস্তিক মুশরিক ও ইহুদিবাদীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এখন ইসলামকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। দেশ আজ তৌহিদী জনতা ও মুরতাদ এই দুই ভাগে বিভক্ত। মুরতাদ দলের নেষনী হচ্ছে তসলিমা। সুতরাং তসলিমাকে ফাঁসি দেওয়া হলে দেশ মুরতাদ মুক্ত হবে।
শায়খুল হাদিসও তাঁর বাহিনী নিয়ে পথে নেমেছেন। আর অনেকের মত তিনিও এখন সরকারকে দোষ দিচ্ছেন, আমাকে এখনও গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না বলে। বলেছেন, জনতার রুদ্ররোষ থেকে বাঁচাবার জন্য সরকার তসলিমাকে অন্যত্র সরিয়ে রেখেছে। ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা মাওলানা ওবায়দুল হক তাঁর সভায় বলেছেন, জনমতের চাপে সরকার তসলিমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেও এখন পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার করতে না পারায় সরকারের প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত হয়ে পড়েছে।
আজ সব পত্রিকায় স্পীকারের কাছে লেখা আমার চিঠিটি ছাপা হয়েছে। ভাল কথা। খুব ভাল কথা। যে কথা আগেই জানিয়েছিলাম, সে কথা আবার জানালাম যে আমি কোরান সংশোধনের কথা বলিনি। এতে কী উপকার হবে আমার? এখন কি মৌলবাদীরা বলবে, যে, দুঃখিত আমাদের ভুল হয়ে গিয়েছিল, তসলিমার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, কারণ ও তো বলেনি কোরান সংশোধনের কথা–সুতরাং আমরা সরে দাঁড়াচ্ছি ওর ফাঁসি চাওয়া থেকে! সরকার কি বলবে, ইসরে কি মিথ্যে মামলা ঠুকে দিয়েছি। এখন ক্ষমা চেয়ে মামলা তুলে নিই! কেউ বলবে না। বলবে না কারণ সংশোধনের কথাটির জন্য মৌলবাদীরা আমার ওপর ক্ষিপ্ত নয়, কোরান সংশোধনের কথা শুনে সরকারের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতও লাগেনি। মৌলবাদীদের ইচ্ছে কোনও একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মাঠে নামা, নিজেদের তেজ দেখানো, রাগ দেখানো আর লোকদের ভয় দেখানো। ইচ্ছে, শক্তিমান হওয়া। এ তো মৌলবাদীদের ইচ্ছে। সরকারের ইচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। মাঝখান থেকে কে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে? আমি। ক্ষমতাসীন জাতীয়তাবাদী দল বা বিরোধী দল আওয়ামী লীগ (এই দুটো দলই আকারে আকৃতিতে প্রতিশ্রুতিতে সন্ত্রাসে সবার ওপরে) কারও বুকের পাটা নেই মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে শক্ত শক্ত কথা বলে, কারণ দুই বড় দলেরই সময় সময় এই মৌলবাদী দলের সঙ্গে আঁতাত করতে হয়। সম্ভবত সরকারি দলের ধারণা ছিল না, উসকে দিলে মৌলবাদীরা এত বিকট শক্তি ধারণ করতে পারে। অথবা ধারণা ছিল, সরকারের অন্তঃস্থলে যথেষ্টই ধর্মান্ধ বিরাজ করে।
আজ সব পত্রিকায় বিবৃতি বেরিয়েছে। বিবৃতি দিয়েছেন দেশের সমস্ত বুদ্ধিজীবীগণ। দেশের যত রাজনৈতিক দল আছে ( বিএনপি এবং মৌলবাদী দল ছাড়া), দেশের যত প্রগতিশীল সংগঠন, সংস্থা, সমিতি, পরিষদ আছে, খুব বড়, বড়, মাঝারি, ছোট, সবার, দেশের যত নারী সংগঠন আছে, যত সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী আছে, লেখকদের, কবিদের, নাট্যকারদের, শিল্পীদের, সাংবাদিকদের যত রকম সংস্থা আছে সবার, আবৃত্তির দলের, গানের দলের, নাচের দলের, খেলার দলের, হ্যাঁ সবারই বিবৃতি আজকের পত্রিকায়, প্রতিবাদে মুখর আজ দেশ, প্রতিবাদ–জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদ। দাবিতে মুখর আজ দেশ, জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের দাবি। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সবার ওপরে আছেন শামসুর রাহমান। বিবৃতিটি কে লিখেছেন? নিশ্চয়ই শামসুর রাহমান। শওকত ওসমান, কে এম সোবহান, বেলাল চৌধুরী, বশীর আল হেলাল, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, মুস্তফা নুরউল ইসলাম. . .। বিবৃতির পর বিবৃতি। বাক স্বাধীনতার পক্ষে বিবৃতি, কিন্তু আমার বাক স্বাধীনতার পক্ষে নয়। সুফিয়া কামাল, মালেকা বেগম আছেন, ওদিকে হুমায়ূন আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, ইমদাদুল হক মিলন, আসাদ চৌধুরী…. শত শত নাম। নামী দামী মানুষ। বিশেষজ্ঞ। পণ্ডিত। সমাজের মাথা। তাত্ত্বিক থেকে সাংবাদিক, শিক্ষক থেকে চিকিৎসক, বামপন্থী ডানপন্থী মধ্যপন্থী, পন্থীহীন, নাস্তিক আস্তিক, সকলেই বিবৃতি দিয়েছেন। দেশের প্রগতিশীল মুক্তবুদ্ধি যুক্তিবাদী একটি প্রাণীও নিশ্চুপ নন। তন্ন তন্ন করে একটি, অন্তত একটি বিবৃতির মধ্যে আমার নামটি খুঁজি, জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের সঙ্গে এই সামান্য নামটি, মাত্র চার অক্ষরের নামটি খুঁজি, কোথাও কোনও শব্দের আড়ালে আছে কি না নামটি, যেহেতু একই ২৯৫ (ক) ধারায় মামলা জারি হয়েছে আমার বিরুদ্ধেও, যেহেতু অন্যায় ভাবে আমার বিরুদ্ধেও, যেহেতু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার অভিযোগ আমার বিরুদ্ধেও, নামটি খুঁজি, ভুলেও যদি কেউ উল্লেখ করে থাকেন নামটি, খুঁজি। নেই। কোথাও নেই। কোনও বিবৃতিতে নেই। কোনও প্রতিবাদে নেই। তবে কি এই সত্য যে আমার বিরুদ্ধে মামলা করা সরকারের উচিত হয়েছে, এবং জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা উচিত হয়নি? বিবৃতির কোথাও আমি নেই, তবে আমার নামটি আছে, আছে পত্রিকার বাকি অংশ জুড়ে–মৌলবাদীদের সভায়, সম্মেলনে, মিছিলে, ব্যানারে, কেবল আমার নামটিই আছে, আর কারও নাম নেই।
জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের মামলা প্রত্যাহার করার জন্য সরকারের কাছে দাবি করছে, তাদের গ্রেফতারি পরোয়ানার প্রত্যাহারের দাবি করছে, তাদের বিরুদ্ধে জারি করা মামলা প্রত্যাহার করার দাবি করছে তোমার সব প্রগতিশীল বন্ধুরা। তারা কেউ তোমার বিরুদ্ধে জারি করা মামলার কথা কিছু বলছে না। তোমার প্রগতিশীল বন্ধুরা কেউই তোমার গ্রেফতারি পরোয়ানার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করছে না।
আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি না। বারবার পড়ি। আমি কি ঠিক দেখছি, ঠিক পড়ছি? হ্যাঁ তুমি ঠিক দেখছ, ঠিক পড়ছ। এটা ঘটেছে। বিস্মিত হচ্ছে!? হ্যাঁ বিস্মিত হচ্ছি। বিস্ময় আমার হৃদয়ে, বিস্ময় আমার সর্বাঙ্গে। আমি বিস্ময়ের ঘোর থেকে একতিল নড়তে পাচ্ছি না। না ডানে, না বামে। বিস্ময় আমাকে একটি মূর্তির মত বসিয়ে রেখেছে সেই সকাল থেকে, সকাল পেরিয়ে গেছে, দুপুর গেছে, বিকেল গেছে। বিস্ময় কি কেটেছে তোমার? না কাটেনি।
আমার হৃদপিণ্ড কি চলছে? জানি না। আমার রক্ত চলাচল কি বন্ধ হয়ে গেছে, জানি না। বিস্ময় আমাকে মুক্তি দিচ্ছে না। মূর্তির চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। জল গড়াক। মূর্তির হাত জল মুছে ফেলতে সেই জলের দিকে এগোচ্ছে না। গড়াক। জল গড়াতে গড়াতে মূর্তিটি স্নান করে ফেলুক। তার আজ পাঁচদিন স্নান হয়নি। স্নানের প্রয়োজন ছিল তার।
৩. অতলে অন্তরীণ – ০৭
দশ জুন, শুক্রবার
–তসলিমা, ঘুমিয়েছো রাতে?
–না।
–ঘুম আসছে না?
–নাহ!
–তুমি জানো আজ তোমার বিরুদ্ধে বায়তুল মোকাররমে গণবিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে!
–জানি।
–জানো আজ মিছিল তোমার বাড়ির দিকে যাবে! তোমার বাড়ি ঘেরাওএর কর্মসূচি আছে, জানো?
–জানি।
–তুমি জানো যে ৩০ তারিখ তোমার ফাঁসির দাবিতে সারাদেশে হরতাল ডাকা হয়েছে?
–জানি।
–তুমি জানো যে তোমার ঠিকানায় বিদেশ থেকে আসা চিঠিপত্র পত্রপত্রিকার পার্সেল কাস্টমসএ আটক করা হয়েছে?
–না।
–আজ পত্রিকা পড়েছো?
–না।
–কেন পড়নি? ভয় হয় বুঝি! আবার যদি দেখ তোমার পক্ষে কোনও বিবৃতি কেউ দেয়নি! তোমার বাক স্বাধীনতার পক্ষে কেউ কথা বলেনি! ভয় কেন! মানুষের সত্যিকার চেহারাটা এবার একটু চিনে নাও। ওঠো। দেখ। পড়। বোঝো।
–কেউ কি লিখেছে কিছু আজ?
–তোমার মত বোকা আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। আজও সব পত্রিকায় বিবৃতি গেছে, গতকাল কুলিয়ে উঠতে পারেনি ছেপে। আজও বিবৃতিতে ভরে আছে পত্রিকা! কেউ বলেনি তোমার কথা। তোমার কথা বলবে কেন? তুমি কে? তুমি কিμছু না। তুমি একটা ঘোড়ার ডিম। তুমি বোকার মত একা বসে বসে কেবল লিখেছো, সমাজের সমস্ত অন্ধকার দূর করার জন্য লিখেছো। কি লাভ হয়েছে লিখে? আজ সবাই জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের মুক্তি চেয়েছে, তাদের মামলা হুলিয়া তুলে নেওয়ার দাবি করেছে। একটা কথা কি জানো? ধর্মের সমালোচনা তো অনেকেই করে, কিন্তু মৌলবাদীরা তোমাকে টার্গেট করেছে কারণ তারা জানে যে তুমি একা, তুমি অসহায়, এ দেশে তোমার পক্ষে দাঁড়াবার মত কোনও ব্যক্তি নেই, সংগঠন নেই, কোনও রাজনৈতিক দল নেই। মৌলবাদীদের এই উত্থানে মদত দিচ্ছে কারা, তা জানো? দিচ্ছে তাবৎ রাজনৈতিক দল, প্রগতিশীল ব্যক্তি, সংগঠন, আর বুদ্ধিজীবী – বিবৃতিঅলাদের নীরবতা। তোমাকে ফাঁসি দিচ্ছে আসলে মৌলবাদীরা নয়, ফাঁসি দিচ্ছে প্রগতিশীলরা। আজও মৌলবাদীদের পত্রিকা ছাড়া আর সব পত্রিকায়, বাংলা বল ইংরেজি বল সব পত্রিকায় জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সরকারের মামলা দায়েরের নিন্দা করে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে, উপসম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। কলাম ছাপা হয়েছে। কোথাও কেউ ভুলেও যোগ করছে না তোমার নাম। কেউ ভুলেও প্রতিবাদ করছে না তোমার মামলার।
–কেউই আমার কথা উল্লেখ করেনি? কেউই না?
–না। কেউ না। তবে একজন উল্লেখ করেছেন। গোটা কলামটাই তিনি তোমাকে নিয়ে লিখেছেন। তিনি বদরউদ্দির উমর। লিখেছেন তোমার কোনও অধিকার নেই প্রগতিশীল হওয়ার, কারণ তুমি কোনও দিন মিছিলে যাওনি, কোনওদিন স্লোগান দাওনি।
–মিছিলে না গেলে, স্লোগান না দিলে কি প্রগতিশীল হওয়া যায় না?
–উমর তো বলছেন হওয়া যায় না।
–তবে আমি কী? প্রতিক্রিয়াশীল?
–তুমি তারও চেয়ে অধম। তুমি একটা বাজে লেখক। লিখতে জানো না। রাজনীতির কিμছু জানো না। ধর্ম সম্পর্কে তোমার যা মত, তা পেটের ভেতর রাখতে পারো না, বিপদ জেনেও ফটফট করে বলে দাও। ধর্মের বিরুদ্ধে লিখে প্রগতিশীল আন্দোলনের ক্ষতি করেছো। তোমার লেখালেখির কারণে মৌলবাদীরা একটা ইস্যু পেয়েছে।
–বদরুদ্দিন উমর কি জনকণ্ঠের সাংবাদিকদেরও দোষ দিয়েছেন? কারণ জনকণ্ঠকেও তো মৌলবাদীরা ইস্যু করেছে!
–না তা দেননি, তিনি বিবৃতি দিয়েছেন জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের ওপর থেকে মামলা আর হুলিয়া তুলে নেওয়ার জন্য।
–আমার বিরুদ্ধে সরকারের মামলা আর হুলিয়া তুলে নিতে বলেননি?
–না। তুমি ধর্মের সমালোচনা করেছো, তোমার এসব শাস্তি প্রাপ্য ছিল, এমনই তাঁর মত। তিনি লিখেছেন তুমি অন্যের ক্রীড়নক হয়ে লিখছ।
–কার?
–অনুমান করে নাও। জানো তো কী দোষ তোমাকে দেওয়া হয়! বিজেপির, আনন্দবাজারের তুমি ক্রীড়নক!
–এগুলো তো মোল্লারা বলে। প্রগতিশীল বামপন্থীও বললেন? তিনি কি কোনও প্রমাণ দিতে পারবেন তাঁর এইসব মিথ্যের? পারবেন না। আমি কি বিজেপির একটি লোককে চিনি? চিনি না। আনন্দবাজারের কেউ কি আমাকে বলে দেয় আমি কী লিখব না লিখব? কখনই না। পশ্চিমবঙ্গে আমার লেখা পাঠক পড়তে চায় বলে আনন্দবাজার আমার লেখা ছাপে বা বই ছাপে।
–তুমি আনন্দ পুরস্কার পেয়েছো, এটাকে তোমার দোষ বলে ভাবা হচ্ছে।
–এ কী করে আমার দোষ হয়? আনিসুজ্জামান পেয়েছেন, শামসুর রাহমানও তো আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন, কই তাদের তো কেউ দোষ দিচ্ছে না?
–তাঁরা তো অনেক বড়। তাঁরা পেতেই পারেন আনন্দ পুরস্কার। তুমি এত ছোট হয়ে কেন পেলে, সেটাই তোমার দোষ। তুমি যদি কোনও পুরস্কার না পেতে, তুমি যদি পাঠক না পেতে, তাহলে আজ হয়ত তুমি করুণা পেতে কিছু!
–আচ্ছ!, আমি কি প্রগতিশীল আন্দোলনের ক্ষতি করেছি, নাকি মৌলবাদীরা করছে ক্ষতি? মৌলবাদীদের পক্ষ নিয়ে এই সরকার করছে ক্ষতি?
–বদরউদ্দিন উমর কোনও মৌলবাদীকে বা বিএনপি সরকারকে দোষ দিচ্ছেন না। দোষ দিচ্ছেন কেবল তোমাকে। বলছেন তুমি করেছো ক্ষতি। কেবল তিনিই নন তসলিমা, প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রায় সব নেতাই এটা বলছেন। তুমি যাদেরকে বন্ধু মনে করতে, তাঁরাই বলছেন।
–এ কি করে হয়? আমি তো দেশটির মঙ্গলের জন্য লিখছিলাম, আমি তো বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখছিলাম, আমি তো একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন করছিলাম।
–কাজী শাহেদ আহমেদ আজকের কাগজে তোমার লেখা চাইতেন। তোমার লেখা থাকলে পত্রিকার কাটতি বাড়ে, তাই বলতেন তিনি। তুমি তো নিয়মিত লিখেছো ওই পত্রিকায়। তাঁর খবরের কাগজ, সাপ্তাহিক পত্রিকাটিতেও নিয়মিত লিখতে। তোমাকে তিনি নিমন্ত্রণ করতেন, এবং তাঁর অনেক বন্ধু যাঁরা তোমার লেখার অনুরাগী, তিনি নিজে খুব গর্ব করে পরিচয় করিয়ে দিতেন তাঁদের সঙ্গে তাঁর লেখকের। কি করেছেন সেই কাজী শাহেদ আহমেদ তুমি জানো? তিনি কাল একটি সভা ডেকেছেন, ডেকে তোমার মামলার কথা সম্পূর্ণ এড়িয়ে জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে জারি করা মামলার প্রতিবাদ করলেন। তা বিস্তারিত আজ ছাপাও হয়েছে আজকের কাগজ পত্রিকায়। তুমি তো যায় যায় দিন পত্রিকাতেও লিখতে। ওই পত্রিকায় সবচেয়ে জনপ্রিয় কলামটি ছিল তোমার। যায় যায় দিন পত্রিকার শফিক রেহমান একই কাজ করেছেন। সভা ডেকেছেন। সভায় জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের ওপর থেকে মামলা তুলে নেওয়ার দাবি করলেন, তোমার ওপর থেকে মামলা তুলে নেওয়ার কথা কিন্তু বলেননি। যে সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো প্রতি সপ্তাহে তোমার ছবি আর খবর ছেপে ব্যবসা করেছে এতকাল, সেসব পত্রিকার সম্পাদকও সাংবাদিকদের মুক্তি চাইল, ওদের মামলা প্রত্যাহার করতে বলল। তোমাকে নিয়ে ব্যবসা করল, পয়সা করল, আর প্রতিবাদের বেলায় দায়িত্ব অনুভব করল অন্যের জন্য। তোমাকে বাদ দিয়ে। আসলে জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের পক্ষে ওরা ব্যক্তিগত পরিচয়ের কারণে প্রতিবাদ করছে না, করছে একটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার দায়িত্ব থেকে। এ যাবৎ লিখে, মৌলবাদীদের অত্যাচার নিরন্তর সয়ে তুমি কিছুই অর্জন করতে পারোনি তসলিমা, সব শূন্য। জীবন বিয়োগ দিয়ে যোগের ঘরে শূন্য জমেছে তোমার।
–তবে কি আমার বিরুদ্ধে মামলা কোনও অন্যায় মামলা নয়?
–তারা তা মনে করছে না। জনকণ্ঠ একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান আর তুমি হচ্ছ একা। তোমার মাথার ওপর মৌলবাদী শক্তি আর সরকার, উভয়ে খড়গহস্তে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু জনকণ্ঠের সঙ্গে মৌলবাদী আর সরকারের খুব বেশি বিরোধ কখনও হবে না। রাজনৈতিক কারণেই হবে না। তারা কোনও না কোনও ভাবে একে অপরের পরিপূরক। তাছাড়া জনকণ্ঠের পেছনে বড় একটি শক্তি আছে, আওয়ামী লীগ। বিবৃতিকারীরা তাই কোনও একটি শক্তির পক্ষে গেল, স্রোতের পক্ষে গেল। যে একা, যার পক্ষ নিলে বিপদ, মৌলবাদীরা সত্যিকার অর্থে যার বিপক্ষে, সরকার যার অনিষ্ট করতে চায়, তার পক্ষে কথা বলা যাবে না। তা না হলে কোরান অবমাননার অভিযোগের এই ইস্যুর মধ্যে প্রগতিশীলরা কেন একটি পক্ষ নিচ্ছেন! যদি তাঁরা বলেন যে তোমার লেখালেখি পছন্দ হয় না, তাতে কি? মতবাদ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু যে কারণে তোমার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, সেটি তো নিঃসন্দেহে অন্যায় একটি মামলা, তা কি তাঁরা জানেন না? ঠিকই জানেন। তোমার লেখালেখি পছন্দ হবে না বলে বিবেকবান মানুষ, নীতিবান মানুষ তোমার বিরুদ্ধে মামলাটি সমর্থন করবেন কেন!
–কিছু বুঝতে পারছি না । সব কিছু কেমন যেন খুব অদ্ভুত মনে হচ্ছে।
–অদ্ভুতই ছিল। তুমি কেবল বুঝতে ভুল করেছিলে আগে। কাল জামাতের গণসভা হল। এখন তারা জনকণ্ঠের বিরুদ্ধে তেমন কিছু বলছে না। তারাও বুঝে গেছে যে জনকণ্ঠের বিরুদ্ধে চেঁচিয়ে লাভ হবে না। লাভ হবে তসলিমার ফাঁসি চেয়ে। এতে কাজ হয়। সকলের সমর্থন পাওয়া যায়। তোমার ফাঁসি চাইছে, প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছে তারা তোমাকে মেরে ফেলবে, তারপরও সরকার চুপ, সবাই চুপ, এই সুযোগে জামাতিরা ব্লাসফেমি আইন করার দাবি জানাচ্ছে। নীরব-বাদীরা কি একবার ভেবেছে এই আইন এলে কি অবস্থা হবে দেশের? হয়ত ভেবেছে, তারা তো আর ধর্ম নিয়ে তসলিমার মত বাড়াবাড়ি লেখা লেখে না, তারা পার পাবে। সংসদে কে বিরোধিতা করবে এর? কেউ না। খুব সহজেই এই বিলটি সংসদে পাস হয়ে যাবে।
–এরকম ভয়ংকর আইনটি সহজে পাস হবে, কেন যেন আমার বিশ্বাস হয় না।
–ব্লাসফেমির শাস্তি তো মৃত্যুদণ্ড। যখন তখন যাকে তাকে বলা হবে সে ব্লাসফেমি করেছে। পাকিস্তানে হচ্ছে না? খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে এই আইন ব্যবহার হচ্ছে। এখানেও অমুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে। এখানেও ফতোয়ার বিরুদ্ধে যারাই বলবে, যারাই শরিয়া আইনের সমালোচনা করবে ব্লাসফেমি করেছে বলে বলা হবে। কে মুক্তি পাবে তখন মৌলবাদী ছাড়া!
–সংসদে বিরোধী দল নিশ্চয়ই এটিকে আইন করতে দেবে না।
–শোনো, শেখ হাসিনা আজ সরকারের এই মামলা, যে মামলায় জনকণ্ঠের দুজন সাংবাদিককে ধরা হয়েছে, তাদের মুক্তি দাবি করেছেন। তাদের ওপর থেকে হুলিয়া প্রত্যাহার করার দাবি করেছেন। তাদের ঝামেলা করাতে সরকারের নিন্দা করেছেন। শেখ হাসিনা চারজন সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করে মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। নাম উল্লেখ করেছেন স্পষ্ট করে এই জন্য যে ভুলেও যেন আবার কেউ মনে না করে যে তিনি তোমার মামলারও প্রত্যাহার চান। এই যদি হয় বিরোধী দলের নেষনী, তবে কি তুমি আশা কর যে সংসদে যখন তোমাকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য ব্লাসফেমি আইন আনা হবে, তখন তিনি প্রতিবাদ করবেন? না, তিনি প্রতিবাদ করবেন না, প্রতিবাদ তিনি করবেন না এই কারণে যে তিনি তবে ইসলাম বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাবেন। আরও একটি কারণ হল, বিএনপি যেমন জামাতকে খুশি করতে চাইছে, আওয়ামী লীগও চাইছে। জামাতের এখন পোয়াবারো। জামাত এখন দুদলকেই নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। আসলে দুদলেরই জামাতকে দরকার। যে দলই জামাতকে সঙ্গী হিসেবে নেবে, সে দলই বিপক্ষ দলের চেয়ে শক্তিতে বড় হবে। দেখ, বুদ্ধিজীবিরা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদ করলেন, তাঁরা কিন্তু ব্লাসফেমি আইন জারি করার জন্য এত যে চিৎকার করছে মৌলবাদীরা, এই ব্লাসফেমি আইনের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ করেননি। কোনও বুদ্ধিজীবীর মধ্য থেকেও প্রতিবাদ আসবে না, কারণ তাঁরা নিশ্চিত যে তাঁরা কখনও ব্লাসফেমির মত অপরাধ করছেন না, তাঁরা পেটে রেখে দিচ্ছেন তাঁদের ব্লাসফেমি, তসলিমাই কেবল পেটে রাখতে পারে না, উগলে দেয়। তাই এই ব্লাসফেমির বিরুদ্ধে আইনটি কেবল তসলিমার জন্যই দরকার।
–কিন্তু আইন যদি বহাল হয়ে যায়, তবে আইন কি তাদের কি ছেড়ে দেবে?
–দেবে না। কিন্তু তারা হয়ত ভাবছেন, দেবে। দেবে, কারণ তারা তো তসলিমার মত বোকা নন। তারা বুঝে সুঝে কথা বলেন। তুমি একা তসলিমা। তোমার পাশে কেউ নেই। তুমি ভেবেছিলে তুমি ধর্মীয় গোঁড়ামি, অন্ধত্ব, অশিক্ষা, মৌলবাদ–সব তারা যেমন সরাতে চায়, তুমিও তেমন চাও। ভেবেছিলে তুমি যা বলনি তার ভিত্তিতে সরকার তোমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে, হুলিয়া জারি করেছে, তোমার বিরুদ্ধে সরকারের এই অন্যায়ের প্রতিবাদ সবাই করবে, ভেবেছিলে মৌলবাদীরা তোমার ফাঁসির দাবিতে দেশজুড়ে তাণ্ডব করছে, এই দুঃসময়ে প্রগতিশীল শক্তিটি তোমাকে সমর্থন করবে, মত-পার্থক্য থাকলেও ভেবেছিলে তাঁরা অন্তত বাকস্বাধীনতার জন্য হলেও তোমাকে সমর্থন করবে। কিন্তু তুমি ভুল ভেবেছিলে। কেউ তোমার পাশে নেই। তুমি একা। তুমি একা বিশাল এক মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে লড়ছিলে। তুমি একা তসলিমা, কেউ নেই তোমার। এখন তোমাকে যদি ফাঁসি দেয়, যাদের তুমি বন্ধু ভাবতে, ভাবতে একই আন্দোলনে জড়িত তোমরা, তারা দূরে দাঁড়িয়ে দেখবে তোমার ফাঁসি। তুমি কি মনে করছ তোমাকে হত্যা করছে মৌলবাদীরা? না। ছুরি তোমার পিঠে কোনও মৌলবাদী বসাচ্ছে না। মৌলবাদীরা রাস্তায় নামছে, নেপথ্যে দাঁড়িয়ে আছে প্রগতিশীল বলে দাবি করে, সেই ভণ্ডগুলো। তুমি যাদের আপন ভাবতে তারা। কত বড় ভণ্ড হলে আজ প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী কেউই তোমার ওপর সরকারি আর মৌলবাদী জঘন্য ভয়াবহ হামলার প্রতিবাদ না করে জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের ওপর হামলার ওপর প্রতিবাদ করে! কারা ওই সাংবাদিক? কি করেছে ওরা এ পর্যন্ত? কজন মানুষ পড়েছে ওদের লেখা? মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে ওরা কি কোনও চ্যালেঞ্জ ছিল, সমাজ কতটুকু বদলাতে চেয়েছে ওরা? অন্ধত্ব কতটুকু ঘোচাতে চেয়েছে ওরা? তোমার প্রগতিশীল প্রতিবাদী বন্ধুদের সঙ্গে ওদের কতটা ঘনিষ্ঠতা ছিল? ওরা কি কোনও নাম মৌলবাদবিরোধী বা সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনে? যারা আজ তোমাকে বাদ দিয়ে ওদের জন্য কাঁদছে, তারা কি ওদের লেখা পড়েছে? চেনে ওদের? তারপরও এটা ঠিক, যে, সরকার ওদের বিরুদ্ধে মামলা করে অন্যায় করেছে। প্রতিবাদ অবশ্যই করতে হবে সরকারের আচরণের বিরুদ্ধে, কিন্তু গতকাল বা আজ যে বিবৃতিগুলো দেওয়া হল, কেন তোমাদের পাঁচজনের কথা উল্লেখ করা হল না একসঙ্গে, কেন ওদেরকে আলাদা করে কেবল ওদেরই মুক্তি চাওয়া হল! কেবল ওদের বাক স্বাধীনতার কথা বলা হল! তোমার বুঝি বাক স্বাধীনতা থাকতে নেই! যেদিন মামলা হল ওদের বিরুদ্ধে, তার পরদিনই এত শত শত বিবৃতির সই যোগাড় হয়ে যায় কেন? তোমার বেলায় হয় না কেন? কেউ তোমার পক্ষে দাঁড়াতে চায় না। তোমার পক্ষে না দাঁড়াক, তোমার ওপর অন্যায়ের বিপক্ষেও দাঁড়াতে চায় না। কেন চায় না জানো? চায় না কারণ তুমি একা। আবারও বলছি, বারবার বলছি, বলছি যে তুমি একা। এত বার তোমাকে এ কথা শোনাচ্ছি কারণ তুমি বিশ্বাস করতে চাও না যে তুমি একা। জনকণ্ঠ পত্রিকা একা নয়, জনপক্ষ পত্রিকা একটি বড় শক্তি। সবলের পক্ষ নিলে কোনও ঝুঁকি নেই। দুর্বলের পক্ষে ঝুঁকি আছে। তোমার সঙ্গে আজ অনেকে মানসিক ভাবে আছেন, গোপনে গোপনে আছেন, কিন্তু বিবৃতিতে নেই, প্রতিবাদে নেই, প্রকাশ্যে নেই। তুমি সুন্দরী যুবতী, তোমার সঙ্গে মানসিক ভাবেই থাকা নিরাপদ কি না।
–বাজে কথা বোলো না। মানসিকভাবে সঙ্গে থাকাই তো সবচেয়ে বড় থাকা। আমি জানি যে তিনি আমার পক্ষে আছেন। তিনি আমার জন্য উদ্বিগ্ন। তিনি আমাকে ভালবাসেন।
–মানসিকভাবে থাকলে তোমার কী লাভ এখন? এখন তোমার বিবৃতি দরকার, সমর্থন দরকার। তা না থাকলে তোমার উকিল তোমার জন্য কিছুই করতে পারবেন না। পত্রিকায় বিবৃতির মাধ্যমে, আন্দোলনের মাধ্যমে, একই ধারার মামলার আসামী জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের সঙ্গে আছেন, আর তোমার সঙ্গে আছেন নিভৃতে, গোপনে, মানসিকভাবে। শামসুর রাহমান বলেছেন সই করার লোক পাওয়া যায়নি বলে তিনি তোমার পক্ষে বিবৃতি দিতে পারেননি। তিনি কি একাই বিবৃতি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট বড় ব্যক্তিত্ব নন? তোমার মত হতভাগা কেউ নেই। তিনি একটি কবিতা লিখেছেন তোমাকে নিয়ে, তোমাকে সেই কবিতাটা দিয়েছিলেন শারদীয়া দেশ এর জন্য পাঠিয়ে দিতে? পাঠিয়েছিলে?
–পাঠাইনি। সময় পেলাম কোথায়? হুলিয়া জারি হয়েছে পরদিনই।
–মনে হয় তিনি আর চাইবেন না কবিতাটি কোথাও ছাপা হোক।
–কেন চাইবেন না? নিশ্চয়ই চাইবেন। নিজের কবিতা কেউ কি আড়াল করে?
–এখন অন্যরকম অবস্থা তসলিমা। তোমার পক্ষে কবিতা লিখতে, কলাম লিখতে এখন লেখক বুদ্ধিজীবীরা ভয় পান। যদি লোকে মন্দ বলে, তাই ভয়। যদি লোকে ছি ছি করে তাই ভয়। সংখ্যালঘুদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলে, সুরঞ্জনদের কষ্ট দেখে কেঁদেছো। কিন্তু তুমি কি জানো, তুমি সুরঞ্জনদের চেয়েও অসহায়! যে সুরঞ্জনরা আজ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাদের জীবন কি তোমার চেয়ে অনিশ্চিত, নিরাপত্তাহীন! যে কোনও সংখ্যালঘুর চেয়ে বড় সংখ্যালঘু তুমি। যারা বিপদে আছে তাদের চেয়ে তুমি সহস্রগুণ বিপদে আছো। তুমি আরও অবাক হবে যদি শোনো যে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান সমিতি আজ বিবৃতি দিয়েছে জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের পক্ষে, তোমার কথা তারা উল্লেখ করেনি। কেউ তোমাকে মর্যাদা দেয়না তসলিমা। তুমি খামোকাই লিখেছো মানুষের জন্য। মানুষ তোমাকে ভালবাসে না। দেশ দেশ করে মরো, দেশ তোমাকে কী দিল? দেশ তোমাকে ঘৃণা দিল, অবজ্ঞা দিল, এবং খুব শীঘ্র তোমাকে ফাঁসি দেবে। যদি ফাঁসির হাত থেকে বেঁচে যেতে পারো, তুমি এ দেশে থেকো না তসলিমা।
–কোথায় যাবো?
–চলে যাও অন্য কোনও দেশে। এ দেশ তোমার যোগ্য নয় অথবা তুমি যোগ্য নও এদেশের। কোনও সভ্য দেশে চলে যাও।
–কেন যাবো? আমাকে কি এ দেশের কেউ একটুও ভালবাসে না?
–ভালবাসে। তারা ভালবাসে যাদের দিকে তুমি কখনও ফিরে তাকাওনি। যাদের ভালবাসার সময় তোমার একটুও হয়নি। তুমি ব্যস্ত থেকেছো তোমার প্রগতিশীল কবি সাহিত্যিক বন্ধুদের নিয়ে, তোমার লেখালেখি নিয়ে, অন্যের ভালর জন্যই ভেবেছো কেবল। তোমাকে ভালবাসে তোমার বাবা, মা, ভাই, বোন। কোনওদিন কি সময় হয়েছে তোমার, তোমাকে যারা নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসে, তাদের কথা একটু ভাবার? তোমার বাবার চেম্বারে তোমার বিরুদ্ধে পোস্টার পড়েছে, তাঁর সামনে দিয়ে প্রতিদিন মিছিল যাচ্ছে। যে কোনও সময় তোমার বাবার ওপর হামলা হবে, যেহেতু তিনি তোমার বাবা। চেনা পরিচিত অনেক বন্ধুই এখন তোমার বাবার কাছে আর আসেন না। রোগীরাও তাঁর কাছ থেকে আর চিকিৎসা নিতে আসে না। তোমার বাবা বলে তিনি মানুষের ঘৃণা পাচ্ছেন। তারপরও তিনি তোমাকে সমর্থন করছেন। তোমার ভাইরাও বন্ধু হারাচ্ছে। তোমার ভাইয়ের ছেলেরা ইশকুলে গেলে তাদের ছি ছি করছে ইশকুলের ছাত্ররা, বলছে তোর ফুপুকে তো জেলে নেবে, তোর ফুপুর তো ফাঁসি হবে। কেউ লজ্জায় ভয়ে ঘর থেকে বেরোতে পারছে না। তোমার বোনের চাকরিটি যাবে, কারণ সে তোমার বোন। সবাই তোমার জন্য ভুগছে, কিন্তু তোমাকে অসম্ভব রকম ভালবাসছে। তোমার বাবার কথাই ভাবো, তিনি মধ্যরাতে যখন রোগী দেখে চেম্বার থেকে বাড়ি ফেরেন, তিনি তো একা ফেরেন, তখন কেউ যদি পেছন থেকে তাঁর পিঠে ছুরি বসায়! যে কোনও দিন, তোমার ওপর আক্রোশে ধর্মান্ধ লোকেরা তো এই কাণ্ডটি করে ফেলবে। একই রকম তোমার দাদাকেও করবে। তোমার দাদাও তো সেই কত রাতে ওষুধের দোকান বন্ধ করে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরেন। ময়মনসিংহে ধর্মান্ধদের সভা হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে, ওরা তো তোমার বাবাকে ভাইকে চেনে। তোমার ভাইয়ের ছেলে শুভকে একদিন ইশকুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে তুলে নেবে কেউ, নিয়ে কোনও ডোবায় পুঁতে রাখবে। আর ঢাকায়, তোমার শান্তিনগরের বাড়িতে! বোন তোমার রাস্তায় বেরোলে মেরে ফেলবে। অথবা বাড়িতে ঢুকেই ওরা ছুরি বসাবে বুকে। ছুরি বসানো তো ওদের কাছে ডালভাত। পড় না খবর কত জনকে ওরা যে এভাবে মারছে! যাকেই পছন্দ হচ্ছে না, যার ওপরই রাগ, তাকেই জবাই করে ফেলে রাখছে। শিবিরের সন্ত্রাসে আজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কাঁপছে পর্যন্ত। এগুলো গলা কাটা রগ কাটা ছুরি বসানো খুন করা ওদের কাছে ডাল ভাত। একদিন তুমি পত্রিকার পাতায় পড়বে, গত রাতে তসলিমার বাড়িতে ঢুকে একদল সশস্ত্র যুবক তার মা, ভাই, বোন, বোন বোনের মেয়েকে জবাই করেছে। তোমার আশংকা হয় না! চলে যাও এ দেশ ছেড়ে..
–আমার এই প্রিয় দেশ ছেড়ে, আমার ভালোবাসার মানুষদের ছেড়ে, প্রিয় নদী মাঠ বৃক্ষতল.ছেড়ে ..
–কত মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যায়..। তাতে কি? যে দেশের মানুষ তোমাকে ভালবাসে না, সে দেশে থাকতে তোমার ইচ্ছে করে কেন বুঝি না।
–কিন্তু আমি তো পালাতে চাই না।
–পালাবার তোমার কোনও পথও নেই। তোমার নিরাপত্তা কোথাও নেই। জেলে নেই, আদালতে নেই। পালাবার পথেও নেই। জামিনের কথা কল্পনাও কোরো না। জামিন নিতে গেলে আদালতে যেতে হয়। আদালতে তোমার নিরাপত্তা কি? ওখানে তুমি কি ভেবেছো পুলিশ তোমাকে নিরাপত্তা দেবে? যাকে পুলিশ খুঁজছে গ্রেফতার করার জন্য, তাকে কেন নিরাপত্তা দেবে! তোমাকে বরং পুলিশই ছেড়ে দেবে লক্ষ্য থাবার মধ্যে। উন্মত্ত মোল্লা-কুকুরগুলো তোমাকে ছিঁড়ে খাবে, আর তোমার বন্ধুরা দূর থেকে মজা দেখবে, যেমন দেখেছিল গতবছর বইমেলায় তোমার ওপর হামলা হচ্ছিল যখন। বইমেলার সেই হামলার সঙ্গে তুলনাও করো না এই হামলার। এই হামলা সেই হামলার চেয়ে লক্ষগুণ ভয়ংকর হবে। আদালতে গোপনে হঠাৎ করে কাকপক্ষী না জানে এমন ভাবে জামিন চাইতে যাবে! তোমার উকিল বলেছেন, তোমার জন্য হাইকোর্টে জামিন চাইতে যাবেন। যাও আদালতে, মরো গিয়ে। তুমি ভাবছো, মোল্লারা খবর পাবে না তুমি যে যাচ্ছে!! বোকা, বুঝতে পাচ্ছে! না! খবর তো মোল্লাদের আদালত থেকেই দেওয়া হবে। কত বিচারক আছেন জামাতে ইসলামি দলের, জানো না? কত উকিল আছেন মোল্লা, জানো না? শায়খুল হাদিসের দলকে, আমিনীর দলকে, ইয়ং মুসলিম সোসাইটিকে খবর আদালতের লোকেরাই দেবে। জেলে যাবে, জেলেই বা তুমি বাঁচবে কি করে, ওখানেও তো কামড় বসাবে তোমার গায়ে, চোর ছ্যাঁচোড় সবারই ধর্মের প্রতি অনুরাগ ভীষণ। যদি জেলে তোমার মৃত্যু না হয়, যদি বেঁচে থাকো, জেল থেকে বাইরে বেরোলেও তো তোমার নিরাপত্তা নেই। তোমার কোথাও নিরাপত্তা নেই। তারপরও যদি বেঁচে যাওয়া অলৌকিক ভাবে সম্ভবই হয় তোমার, এ দেশে থেকো না। মানুষ তো মরবেই, তুমিও মরবে, আর যাই কর, মোল্লাদের হাতে নিজেকে মরতে দিও না। তুমি দেশে থাকলে ওরা তোমাকে একদিন না একদিন খুন করবেই।
–সত্যের জন্য যদি মরে যেতে হয়, মরব।
–খুব গ্যালিলিও গ্যালিলেই হয়ে গেছো! নিজেকে তোমার খুব জিয়োর্দানো ব্রুনো মনে হচ্ছে, তাই না! মনে রেখো, এই পৃথিবীতে অনেক লেখকের ওপর নির্যাতন হয়েছে, তারা নির্বাসনে জীবন কাটিয়েছেন। তুমি একা নও।
–না, আমি নির্বাসনে যাবো না। ডক্টর কামাল হোসেন আমার জন্য লড়বেন। তিনি খুব বড় ব্যারিস্টার।
–দেখ, তোমার উকিল হতাশ হতে হতে, লোকের ধিককার পেতে পেতে হুমকি পেতে পেতে তোমার মামলা থেকে সরে দাঁড়ান কি না। । এরকম কিছু হওয়া এখন অসম্ভব নয় তসলিমা।
–আমার যে কত পাঠক ছিল! আমার পাঠকেরা আমাকে তো ভালবাসত। কত মেয়েরা! তারা কি হঠাৎ করে আমার বিরোধী হয়ে উঠেছে? নিশ্চয়ই নয়।
–সাধারণ মানুষের কথা বলছ তো! তুমি টের পাওনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও তোমার সমর্থন হ্রাস পেয়েছে। বই হয়ত বিক্রি হয়েছে অনেক। তোমার বই তো মোল্লারাও কেনে। কি লিখেছো, কত বাজে কথা লিখেছো, তা জেনে তোমাকে আক্রমণ করার জন্য কেনে। তাছাড়া হঠাৎ করেই পাঠকের সমর্থন তোমার কমে গেছে।
–কেন ?
–অপপ্রচার, তসলিমা, অপপ্রচার। গসিপ ম্যাগাজিনগুলোয়, মৌলবাদী আর সরকারি প্রচার মাধ্যমগুলোয় প্রতিদিন তোমাকে নিয়ে নানারকম গল্প বানিয়েছে, দেখনি? যা তুমি লেখোনি, তাই তোমার উদ্ধৃতি দিয়ে চালিয়েছে। তুমি বিজেপির কাছ থেকে ৪৫ লক্ষ, কেউ কেউ বলেছে ৪৮ বলছে, টাকা নিয়ে নাকি লজ্জা লিখেছো, আনন্দবাজার তোমাকে ইসলামবিরোধী লেখায় প্রেরণা দিয়ে ৩০ লক্ষ টাকা দিয়ে সল্টলেকে নাকি একটি বাড়ি তৈরি করে দিচ্ছে। তুমি দেশদ্রোহী, তুমি রএর এজেন্ট, ভারত থেকে টাকা পেয়ে তুমি দেশে বাড়ি গাড়ি কিনেছো, তুমি মেয়েদের সংসার ভেঙে দিতে চাও, মেয়েদের নষ্ট করছ, তুমি ফ্রি সেক্স বিশ্বাসী, তুমি পুরুষদের ধর্ষণ করতে চাও, একশ একটা পুরুষের সঙ্গে তোমার অবৈধ সম্পর্ক, তুমি জরায়ুর স্বাধীনতা চাও। সরকারি দৈনিকগুলোয় এসব খবর প্রথম পাতায় গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। এসব অপপ্রচার তোমার পাঠক নষ্ট করেছে।
–কিন্তু যারা এসব শুনেও আমার লেখা পছন্দ করেছে, তারা আজ কোথায়?
–তারা আছে। চুপচাপ ঘরে বসে আছে। তারা সংগঠিত নয়। বিবৃতি দেবার মত ব্যক্তিত্ব তারা নয়। প্রতিবাদ করার মত সাংগঠনিক জোর তাদের নেই। তার ওপর একটা ব্যাপার তো আছেই, ভয়। এগিয়ে আসতে ভয় পায় অনেকে। এবং এদের সংখ্যাই বেশি। মুখ খুলতে ভয় পায়। তোমার লেখা পছন্দ করলেও মুখ ফুটে বলবে না কিছু, তোমার ওপর অন্যায় হচ্ছে জেনেও বলবে না কাউকে যে অন্যায় হচ্ছে। যাদের এগিয়ে আসতে কোনও ভয় নেই, যাদের খুঁটির জোর ভাল, তারাই যখন চুপ হয়ে আছে, তখন অন্যদের আর দোষ দিয়ে লাভ কি! হতভাগা তসলিমা, চার সাংবাদিকের জন্য আজ ভালবাসায় মমতায় কাঁদছে সবাই, কেবল তোমার জন্য কেউ নেই দু কথা উচ্চারণ করার। তুমি লেখালেখি ছেড়ে দাও তসলিমা, আর লিখো না।
–অসম্ভব, আমি ছাড়ব না লেখা।
–তুমি কেন লিখবে? কার জন্য লিখবে? যারা তোমাকে জেলে পাঠাচ্ছে, ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে, তাদের জন্য? এত উদার হবে কেন তুমি? ঘাতকদের পায়ে ফুল নিবেদন করবে কেন, বল! যদি বেঁচে থাকো, লেখালেখি সম্পূর্ণ বাদ দিও। তবে এদেশে নয়, অন্য কোনও দেশে।
–না, এ আমি ভাবতেই পারি না।
–তোমাকে ভাবতে হবে তসলিমা। এই দেশে তোমার দাঁড়াবার কোনও জায়গা নেই আর। তোমাকে হতেই হবে দেশান্তরী। আর যদি গোঁয়াড়ের মত মরতে চাও, তবে থাকো এ দেশে। মরো। সপরিবার মরো। তবে আমার উপদেশ, বেঁচে থাকলে অলেখক, অবিপ্লবী হয়ে বেঁচে থেকো। কোনও ঝুট ঝামেলা নেই, হুমকি হুংকার নেই, জেল ফাঁসি নেই, পত্রিকা নেই, সাক্ষাৎকার নেই, এরকম একটি শান্ত স্নিগ্ধ নিশ্চিত শান্তির জীবন বেছে নিও।
–বিদেশের অনেক মানবাধিকার সংগঠন, লেখক সংগঠন আমাকে নিরাপত্তা দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে বলছে।
–−ছাঃ! বিদেশের সব আবেদনই ময়লা ফেলার ঝুঁড়িতে চলে যাচ্ছে, দেখ গিয়ে। দেশে কি হচ্ছে সেটা বড় কথা। আগে তো ঘর সামলাও, তারপর বাহির। আগে গদি সামলাও, তারপর অন্য কিছু। আচ্ছ! বল তো, হলিডের সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান কি মৌলবাদী?
–না।
–তাঁর পত্রিকায় আজ তিনি তোমার লজ্জা বইটির সমালোচনা ছেপেছেন। ভূমিকায় সম্পাদক লিখেছেন, তুমি বিজেপির লোক, তুমি সাম্প্রদায়িক, দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার মিশন নিয়েছো। এ সময় এসব কথা লেখার অর্থ কি জানো তো! লোক ক্ষেপানো। মোল্লা লেলিয়ে দেওয়া তোমার পেছনে। সরকারকে ইন্ধন যোগানো। তুমি জেলে গেলে, তোমার ফাঁসি হলে, এরাই খুশি হবে বেশি। এরাই হাততালি দেবে বেশি। কি, চুপ করে আছো যে! কি ভাবছো!
–না, কিছু ভাবছি না।
–ভাবছো, ভাবছো তোমার কমপিউটারের হার্ডডিস্কের লেখাগুলোর কি হবে! লেখা লেখা লেখা। লেখাগুলো পুলিশেরা নষ্ট করে ফেলবে কি না ভাবছো! লেখা সব তোমার নষ্ট হয়ে যাক। পুলিশ নিয়ে নিক। লেখার কথা ভাবা বাদ দাও। বেঁচে যদি থাকো, তবে আর যাই হও, লেখক হওয়ার চিন্তাও কোরো না, আবারও বলছি। লেখক হওয়ার সাধ তোমার আশাকরি পূরণ হয়েছে। লেখক হয়ে অন্ধকার দূর করতে চেয়েছিলে, অন্ধকারই তো সবলে গ্রাস করে নিল তোমাকে। সবাই তো বাইরের আলোয় হাঁটছে, আনন্দ করছে, তুমি একা পড়ে আছো অন্ধকারে, অন্ধকারই এখন তোমার ঠিকানা। লিখে তুমি এই পেয়েছো। এই তোমার পুরস্কার। এখানে এই গুমোট ঘরটিতে বসে বসে এখন জেলখানায় অথবা কবরে থাকার মহড়া দিচ্ছ।
–কিন্তু আমার তো অনেক স্বপ্ন ছিল..
–স্বপ্ন! তুমি হাসালে। তোমার মত বেচারা আবার নানারকম স্বপ্ন দেখতেও জানত। তোমার স্বপ্নগুলো এখন মৃত, বিস্মৃত। তোমার স্বপ্নগুলো কাকে খাওয়া, চিলে নেওয়া, তোমার স্বপ্নগুলো লোকের কফ কাশির সঙ্গে পড়ে আছে। তোমার স্বপ্নগুলো লোকের জুতোয় তলায়।
–থামো, এগুলো শুনতে ইচ্ছে করে না।
–ইচ্ছে না করলেও এগুলো সত্য, তুমিও তা জানো। তুমি যে হেরে গেছো, তুমি জানো। ভেবেছিলে, তুমি সমাজের মঙ্গল কিছুটা হলেও বুঝি করতে পেরেছো, ভেবেছিলে নারী পুরুষের বৈষম্যহীনতার কথা বলে তুমি কিছুটা হলেও মানুষকে বৈষম্যের ব্যাপারে সচেতন করতে পেরেছো। ভেবেছিলে সামান্য হলেও সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, অন্ধকার, কুসংস্কার দূর করতে পেরেছো। কিμছু পারোনি তসলিমা। তুমি প্রচণ্ডভাবে হেরে গেছো। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বই লিখে তুমি সাম্প্রদায়িক আখ্যা পেয়েছো। যাদের ভেবেছিলে সহযাষনী, তারাই আজ মৌলবাদের হিংস্র থাবার মধ্যে তোমাকে তুলে দিচ্ছে। এই তোমার এতকালের সংগ্রামের পুরস্কার। এই পুরস্কার মাথা পেতে নিতে কাল বা পরশু তুমি কারাগারে ঢুকবে অথবা তুমি ফাঁসিকাঠে ঝুলবে, তুমি অবধারিত মৃত্যুর দিকে রওনা হবে। তসলিমা, তোমার জন্য খুব মায়া হয় আমার। খুব মায়া হয়। তোমার মত এমন দুর্ভাগ্য নিয়ে আর যেন কারও জন্ম না হয় এই পৃথিবীতে।
–আমাকে একা থাকতে দাও। কথা বোলো না। বিরক্ত কোরো না।
–থাকো, একা থাকো। তুমি তো একাই। ….কাঁদছো? কাঁদো তসলিমা, কাঁদো। অনেকদিন তুমি কাঁদোনি। অনেকদিন প্রাণভরে এমন করে কাঁদোনি। কাঁদো।
বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদি আমি। আমার কান্নার শব্দ যেন কোথাও যেতে না পারে, তাই শব্দটিকে আটকে রেখে কাঁদি। যখন মাথা তুলি, চ আর চর বাচ্চাজ্ঞটর কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। এ ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। কিন্তু ছিল একজন, নিশ্চয়ই ছিল, দীর্ঘক্ষণ যার সঙ্গে কথা হয়েছে আমার, সে ছিল। মানুষটি তো ওখানেই বসেছিল, ওই চেয়ারে, তারপর বিছানায় এসে বসল। আমাকে স্পর্শ করেছিল, কপালে একটি শীতল হাত এসে একবার থেমেছিল। আমাকে কাঁদতে বলল। আশা করেছিলাম একবার অন্তত বলবে, অনেক কেঁদেছো, আর কেঁদো না। আমাকে একটিবার বুকে টেনে নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দেবে। আশা করেছিলাম, কাঁধে একটি হাত রাখবে সে।
দরজাটি ভেতর থেকে সিটকিনি আঁটা ছিল, এখন খোলা। আশ্চর্য, দরজা খুলে আমাকে না বলে নিঃশব্দে চলে গেছে সে! একবার বলে যাবে না!
৩. অতলে অন্তরীণ – ০৮
এগারো জুন, শনিবার
সেই চার তারিখে বাড়ি ছেড়েছি যে কাপড়ে, সে কাপড়েই এখনও আছি। ঘামের দুর্গন্ধ সারা শরীরে। গা আঠা আঠা হয়ে আছে ধুলোয়, ঘামে, চোখের জলে। অসহ্য গরম। এক পশলা হাওয়া ঢোকার কোনও সুযোগ নেই ঘরে। যেন জ্বলন্ত চুলোর ওপর বসে আছি। দুর্গন্ধ বা আঠা দূর করতে নয়, গোসলখানায় যাই গা থেকে আগুন দূর করতে। গোসলখানায় কোনও সাবান নেই, কোনও তোয়ালে নেই। কোনও বালতি নেই, কোনও লোটা বা মগ নেই। কলটি মেঝে থেকে দু ফুট উঁচুতে। কলের তলে বসে গায়ের ওপর জল ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও কায়দা নেই গা ভেজানোর। এই কলের তলে বল্টু গোসল করে উঠতে পারে, আমি পারি না। আমার পিঠ যায় তো মাথা যায় না। অগত্যা আলাদা আলাদা করে পা হাত মাথা ইত্যাদি কলের তলে নিয়ে ভেজাই, দুহাতে জল নিয়ে বুক পিঠ। জল তো জল নয়, যেন ফুটোনো জল, এমন গরম। এক চিলতে সাবান লেগে ছিল গোসলখানার মেঝেয়, সম্ভবত বল্টুর কাপড় ধোয়ার সাবান। সেটিকেই চিমটি দিয়ে তুলে তুলে গায়ে মাখি। মাখা ফুরোনোর আগেই সাবানের অস্তিত্ব ফুরিয়ে যায়। এর পর কি? গা মুছব কি করে! পরনের শাড়িটি দিয়ে গা মুছে ঘ র দেওয়া লম্বা জামাটি পরি। ঘ র জামাটি ও বাড়ি ছাড়ার সময় আমি খুলে রেখেছিলাম, ঘ আমার হাতে দিয়ে জামাটি, বলেছিলেন নিয়ে যেতে। গোসল হল কিন্তু এর নাম গোসল নয়। এর নাম যে ঠিক কী, জানি না। গোসলখানার গরম জল থেকে ফিরে আসি জ্বলন্ত উনুনের ওপর আবার। সারা শরীরে কুটকুট করে কামড়াতে থাকা ঘামাচি নিয়ে বসে থাকি, বসে থাকি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি। এ ছাড়া করার কিছু নেই আমার। বসে থাকি আর অপেক্ষা করি কারওর। অপেক্ষা আমাকে একটি ঘরের মধ্যে স্থির বসে থেকে করতে হয়। কারওর অপেক্ষা করলে যে দরজা খুলে দাঁড়াবো, জানালা খুলে তাকাবো, যে অভ্যেসটা ছিল এতকাল, অভ্যেসটা শক্ত করে খামচে ধরে তোশকের তলায় রেখে দিই। বরং কান পেতে রাখি। কান পেতে রাখি পায়ের শব্দ পাওয়ার। কান দুটো বেড়ালের পায়ের শব্দও শোনে।
ঙ এলেন দুপুরে খুশির খবর নিয়ে। আজ বুদ্ধিজীবীদের বিবৃতি ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। সই যোগাড় করেছেন ঙ। তসলিমার বিরুদ্ধে মামলা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। গতকাল শুক্রবার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীগণ এক বিবৃতিতে বলেন, সরকার ইচ্ছাকৃত ভাবে আইনের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে মৌলবাদী চক্রের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে। সরকারের এ আচরণকে সততা ও নাগরিকের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী অভিহিত করে বিবৃতিতে এর নিন্দা এবং তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, সরকার তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে, লেখিকা তার সত্যতা অস্বীকার করে নিজের অবস্থান পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেছেন। লেখিকা স্পষ্ট করে বলেছেন, তিনি পবিত্র কোরান সংশোধনের কথা বলেননি, সুতরাং তিনি যে কথা বলেননি সে কথা দ্বারা কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার অভিযোগ অবাস্তব এবং অলীক। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, শরিয়া আইন সংশোধনের দাবি করার অধিকার সকল নাগরিকের আছে এবং এ দাবি ইতিমধ্যে একাধিক মহল থেকে উত্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এ ব্যাপারে সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে ইতিমধ্যে বিল দাখিল করেছে।
মৌলবাদী শক্তির চাপে পড়ে সরকারের এই আচরণের আমরা নিন্দা করি এবং তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছে তা অবিলম্বে প্রত্যাহার করার দাবি জানাই। আমরা লেখিকার ও তার পরিবারের নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। উগ্র মৌলবাদীরা বারবার তসলিমা নাসরিনসহ দেশের কয়েকজন বরেণ্য বুদ্ধিজীবীর প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে, অথচ সরকার এদের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে লেখক ও সাংবাদিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। আমরা এই দুঃসহ পরিস্থিতির অবসান চাই। অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত এই সরকার একটির পর একটি গণতন্ত্রবিরোধী কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে গণতন্ত্রকে ক্রমশ বিপন্ন করে তুলছে।
বাইশ জন বুদ্ধিজীবী সই করেছেন, কে এম সোবহান, খান সারওয়ার মুরশিদ, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কলিম শরাফী, মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, ফয়েজ আহমেদ, রফিকুননবী, কাইউম চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম, হাশেম খান, মোহাম্মদ রফিক, শফি আহমেদ, হায়াৎ মামুদ, পান্না কায়সার, আসাদুজ্জামান নূর, আলী যাকের, হারুন হাবীব, নাসিরুদ্দিন ইউসুফ, আখতারুজজ্জামান, আলী আনোয়ার..।
আজ আটদিন পর একটি বিবৃতি। মাঝখানে এঁরাই বিবৃতি দিয়েছেন আমার মামলার পরে জারি হওয়া মামলার বিরুদ্ধে। আমি এমন একটি নাম, যে নামটি উচ্চারণ করতে লজ্জা হয়, ভয় হয়। আমি জানি যাঁরা আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে, যাঁরা আমার লেখার সঙ্গে একশ ভাগ একমত তাঁদেরও লজ্জা ভয় যায় না। কি জানি কি বলে লোকে, এই আশংকা। কি জানি কি বিপদ ঘটে, আশংকা। আশংকার পরোয়া করে না গার্মেণ্টেসএর ওই দরিদ্র শ্রমিকেরা। সাজু, জাহেদা, লাভলী বিবৃতি দিচ্ছে, সভা করছে। গার্মেন্টসএর আরও শ্রমিক নিয়ে আমরা কজন তসলিমা পক্ষ নামে দল করে সভা করেছে আবার, লিফলেট ছেপেছে। ওরা অচেনা অজ্ঞাত মানুষ, ওদের সভা বা বিবৃতির মূল্য নেই, কিন্তু তারপরও মরিয়া হয়ে অসাধ্য সাধনে নেমেছে। ওরা যেদিন খবর শুনেছে, সেদিনই প্রতিবাদ করেছে। আর আজ যাঁরা প্রতিবাদ করলেন, ভেবে চিন্তে করেছেন, তবু তো করেছেন, করুণা করে হলেও তো করেছেন, নাও করতে পারতেন। যে বিষাদ আমাকে গ্রাস করেছিল গতকাল, তা দূর হয়। দূর হলেও দুর্ভাবনা থেকে মুক্তি জোটে না। এই বিবৃতির কারণে আমার ওপর থেকে মামলা তুলে নেওয়া হবে না, কিন্তু আমার কি অন্তত জামিন পাওয়া হবে? ঙ বললেন যে ক তাঁকে জানিয়েছেন যে আগামীকাল সকালে যে কোনও সময় সম্ভবত আমাকে আদালতে উপস্থিত হতে হবে। হঠাৎ করে আদালতে উদয় হয়ে জামিন চাইতে হবে, এমন একটি ব্যবস্থা করছেন আমার উকিল। ক প্রায়ই উকিলের কাছে খবর নিচ্ছেন কি হচ্ছে না হচ্ছে। জামিনের জন্য যখন আমার উপস্থিতির প্রয়োজন হবে, তখন যেন তাকে জানানো হয়, বলে রেখেছেন উকিলকে। ক ব্যবস্থা করবেন আমাকে আদালতে নেওয়ার। আগামীকাল কটার সময় যেতে হবে, কিভাবে যাবো তার আমি এখনও কিছুই জানি না। ঙর বক্তব্য, আগে থেকে কেউ আসলে কিছুই জানে না। উকিল ককে খবর দেওয়ার দশ মিনিটের মধ্যে আমাকে আদালতে যেতে হবে। বাতাসে খবরটি ওড়ার আগেই যেন আমি উপস্থিত হয়ে জামিন নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারি। যাকে বলা হয় ঝড়ের বেগে। কিন্তু বেগটি আদপেই ঝড়ের হবে কি না এ বিষয়ে ঙ ঠিক নিশ্চিত নন। জামিন না হওয়াতক অনিশ্চিত প্রতিটি মুহূর্ত। জামিন আদৌ হবে কি না, হলে কবে হবে। লুকিয়ে থাকা সম্ভব আর হবে কি না, না হলে কী হবে! কে উত্তর দেবে এসবের! পুলিশের চেয়ে শত গুণ আশংকা মোল্লাদের নিয়ে। আজকাল ঘরে ঘরে মোল্লা। এ বাড়ির আশে পাশে কজন মোল্লা বাস করছে কে জানে! যদি কেউ একবার গন্ধ পেয়ে যায় আমার, কী হবে তা আমি এবং ঙ দুজনই অনুমান করতে পারি। ঙ চলে যেতে চান, তাঁকে আরও কিছুক্ষণ বসার জন্য অনুরোধ করি। ঙ আধঘন্টা থাকলেও আধ মুহূর্ত বলে মনে হয়। ক বা ঙ এলে ঘড়ির কাঁটা আচমকা লাফাতে থাকে। এ সময় আমার আপন আর কে আছে ক আর ঙ ছাড়া! ক আর ঙ না থাকলে আমার কবেই তো মৃত্যু হত। একএকটা মুহূর্ত বেঁচে থাকি, এর মানে একএকটা মুহূর্ত ক আর ঙ আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন।
অবকাশে বাবার চেম্বারে তিন দফা হামলা। বাড়ি চেম্বার ভাঙচুর। জানিনা বাবা বা দাদার গায়ে কটা চাপাতি বা রামদার কোপ পড়েছে। জানিনা বাবার রক্তচাপ এই দুশ্চিন্তায় কতটা বেড়েছে। হৃদপিণ্ডে আরও একটি ধাককা লেগেছে কি? মস্তিষ্কে কি রক্তক্ষরণ হচ্ছে! কিছু একটা হচ্ছে নিশ্চয়ই। বাবাকে দেখেছি সামান্য কিছু ঘটলেই তাঁর রক্তচাপ এমন বেড়ে যায় যে হৃদপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয় হয় এমন অবস্থা হয়, রক্তচাপ দ্রুত কমানোর জন্য নিফিডিপিন ট্যাবলেট দুটো তিনটে গিলে তিনি মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখেন। বাবা কি এই ভয়ংকর সময়ে যখন তাঁর সামনে দিয়ে প্রতিদিন যাচ্ছে তাঁর কন্যাকে খুন করার জন্য বিশাল বিশাল মিছিল, তাঁর চোখের সামনে অবকাশের দেয়াল আর চেম্বারের দরজায় লাগানো হচ্ছে পোস্টার, কুখ্যাত মুরতাদ তসলিমার ফাঁসি চাই, তিনি কি পারছেন রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে! যে কোনও মুহূর্তে এসে যাওয়া মৃত্যুকে আর ঠেকাতে ঠেকাতে পারার তো কথা নয়! পত্রিকা কি সব খবর পায় আর! এমনও হতে পারে, বাবাকে ওরা কুপিয়েছে। পাঞ্জাবির তলে তো ওরা রামদা নিয়ে ঘোরে, কত কত মানুষকে তো কুপিয়ে মেরেছে, কোরবানির গরুর মত মানুষের গলা জবাই করেছে ওরা! বাবাকেও কি ওরা জবাই করবে, কুপিয়ে মারবে! জেল থেকে বেরিয়ে কি আমি আমার বাবাকে জীবিত দেখতে পাবো না! যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে, যন্ত্রণাটি বুক থেকে ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। কাল বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে হাজার হাজার লোকের মিছিল শান্তিনগরে গিয়ে উত্তেজিত হয়েছে! কেন উত্তেজিত হয়েছে! আমার অ্যাপার্টমেণ্টে গিয়ে আমার আত্মীয়দের গলা কাটার জন্যই তো! পুলিশ তো আর ওদের বাধা দেবে না এখন। কাল কি শুনতে হবে যে আমার পরিবারের চারজন অথবা পাঁচজন সদস্যকে খুন করা হয়েছে! চোখ বুজে বসে থাকি। হাতের পত্রিকা হাতে ঝুলতে থাকে। পত্রিকায় তপন দের ছবি। গতকাল দৈনিক খবরের সাংবাদিক তপন দে যখন মিছিলের ছবি তুলছিল, পুরানা পল্টনের মোড়ে মৌলবাদীরা তার ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলেছে, প্রচণ্ড মেরেছে তপন দেকে, শেষ পর্যন্ত কিছু সাংবাদিক তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তপন দে পুলিশের সাহায্য চেয়েছিল, পুলিশ সাহায়্য করেনি, সামনেই নিষিক্রয় দাঁড়িয়েছিল।
জামাতে ইসলামি এবং আর সব মৌলবাদী দলের সঙ্গে এখন আরও রাজনৈতিক দল যোগ হয়েছে, ফ্রীডম পার্টি –শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকারীরা যে রাজনৈতিক দলটি বানিয়েছে সেটি তো আছেই, একসময়ের বাম রাজনীতিবিদ আনোয়ার জাহিদ তাঁর দল নিয়ে ঢুকে গেছেন ইসলামি ঐক্যে, শফিউল আলম প্রধান একসময়ের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতা, তিনিও তাঁর জাগপা দল নিয়ে ঢুকেছেন। মৌলবাদীদের বিশাল বিরাট শক্তি দেখে এমনই মুগ্ধ তাঁরা যে ভেবে নিয়েছেন এই শক্তিটিই দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে ক্ষমতায় আসছে, সুতরাং এই দলের সঙ্গে ভিড়ে যাওয়া এখন সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। আনোয়ার জাহিদ আর প্রধানের মুখে মৌলবাদীদের ভাষা, তসলিমার ফাঁসির জন্য তাঁরাও মিছিলের অগ্রভাগে থাকছেন, তাঁরাও স্লোগান দিচ্ছেন। গতকাল জুম্মাহর নামাজের পর হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সভা হয় বায়তুল মোকাররমে। বক্তৃতা করেন বিখ্যাত সব ইসলামী নেতা। শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক বলেছেন, ধর্মদ্রোহিরা শুধু ইসলামের শষনু নয়, তারা দেশ ও জনগণেরও শষনু। ধর্মদ্রোহী নাস্তিক মুরতাদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তা শুধু আলেম ওলামা বা পীর মাশায়েখদের আন্দোলন নয়, দেশের সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মানুষ আজ এ ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই আন্দোলনের বিজয় হবে ইনশাআল্লাহ। ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলনের নেতা বরগুনার পীর মাওলানা আব্দুর রশিদ বলেছেন, তসলিমা ও জনকণ্ঠ আমাদের মূল লক্ষ নয়, মূল লক্ষ হল ইসলাম ও কোরানের বিরুদ্ধে চক্রান্ত নস্যাৎ করে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করা। তসলিমাকে গ্রেফতার করা না হলে বিএনপি সরকারের অবস্থা ভয়াবহ হবে। মাওলানা ওবায়দুল হক এম.পি বলেছেন, সংসদে চলতি অধিবেশনেই ধর্মদ্রোহিতা বিরোধী আইন পাস করুন। অন্যথায় জনগণ ধর্মদ্রোহীদের শাস্তির ব্যবস্থা নিজেরাই করতে বাধ্য হবে। ব্যারিস্টার কোরবান আলী বলেন, জনগণের দাবিকে উপেক্ষা করা হবে আগুন নিয়ে খেলা করার সামিল। ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতার প্রতিরোধ মোর্চার আহবায়ক মাওলানা মহিউদ্দিন আহমেদ নাস্তিকদের জানাজা না পড়ানোর জন্য সব মোল্লা মুসল্লির প্রতি অনুরোধ জানান। লালবাগ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা ফজলুল হক আমিনী বলেন, ঈমান ও ইসলামের কথা বলা হলে আমাদের বলা হয় মৌলবাদী, ফতোয়াবাজ ইত্যাদি। নামাজ রোজা হজ্ব পালন করলে যদি মৌলবাদী বলা হয় তবে হাসিনা খালেদাও মৌলবাদী। আমিনী ৩০ জুনের মধ্যে বিশেষ ট্রাইবুনালে তসলিমা নাসরিনের বিচারের দাবি করেন।
৩০শে জুনের আগেই তসলিমার ফাঁসি দিতে হবে। ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা প্রতিরোধ মোর্চার পক্ষ থেকে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে নেতৃবৃন্দ ৩০ শে জুন পর্যন্ত সরকারকে চূড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন, এর মধ্যে তসলিমার ফাঁসি না হলে দেশব্যাপী অর্ধদিবস হরতাল এবং পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে। ৩০শে জুন হরতালের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন।
পত্রিকায় মিছিলের ছবি দেখি। হাজার হাজার লোকের মিছিল। নগরীর রাজপথ সাদা হয়ে আছে সাদা টুপিতে সাদা পাঞ্জাবিতে। সামনে ব্যানার, ব্যানারে লেখা তসলিমা নাসরিনসহ সকল নাস্তিকদের ফাঁসি, এনজিওদের অপতৎপরতা ও জনকণ্ঠ বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদ, সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল। এটি ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা প্রতিরোধ মোর্চার মিছিল। ঈমান বাঁচাও দেশ বাঁচাও আন্দোলনের মিছিলের ব্যানারে লেখা তসলিমা নাসরিন সহ সকল ধর্মদ্রোহী ও নাস্তিক মুরতাদের ফাঁসি ও বিদেশি মদদপুষ্ট ইসলাম বিরোধী এনজিওদের অপতৎপরতা বন্ধের দাবি। জামাতে ইসলামির মিছিলের ব্যানারে লেখা, আল্লাহ, রাসুলুল(সাঃ) ও ইসলাম অবমাননাকারী ধর্মদ্রোহীদের শাস্তি চাই, সংসদে ধর্মদ্রোহীদের শাস্তিমূললক আইন পাশ কর। এনজিওদের অপতৎপরতা ও নাস্তিক মুরতাদ প্রতিরোধ আন্দোলনের মিছিলের ব্যানারে লেখা, তসলিমা নাসরিন সহ সকল নাস্তিক মুরুরতাদদের ফাঁসি চাই। ধর্মদ্রোহীতা বিরোধী আইন প্রণয়ন কর। এনজিওদের অপতৎপরতা বন্ধ কর। ঢাকার রাজপথ কেবল টুপিতে সাদা হয়নি, ঢাকায় যা ঘটছে, ঢাকার বাইরেও তা ঘটছে, টুপিতে সাদা। রাস্তায় যানবাহন চলছে না, মিছিল চলছে।
আমার জীবদ্দশায় আমি মৌলবাদীদের এত বড় আন্দোলন দেখিনি। আমার জীবদ্দশায় মৌলবাদীদের এত সংগঠিত আর শক্তিশালী হতে দেখিনি।
তসলিমা ও মুরতাদ নাস্তিকদের শাস্তি দাবি অব্যাহত। এখনও আমাকে সরকার গ্রেফতার করতে পারেনি বলে সরকারের নিন্দা করছে বিভিন্ন গোষ্ঠী। চট্টগ্রামের জনসভায় বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান বলেছেন, কুলাঙ্গার তসলিমা কিতাবুল্লাহর সংশোধনী দাবির ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। অতএব ঈমান নিয়ে বাঁচতে হলে এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তার আনুগত্য কোরানের প্রতি নেই, বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তার আনুগত্য এ দেশের প্রতি নেই। আছে ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতের প্রতি। সুতরাং ধর্মদ্রোহীতার পাশাপাশি রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে তাকে অবশ্যই ফাঁসি দিতে হবে। তসলিমাকে নিয়ে সরকার ভানুমতির খেল শুরু করেছে। এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে, এখনও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। অথচ দেশের ভেতরে থেকেই সে স্পীকারের কাছে চিঠি লিখে যাচ্ছে। নতুন নতুন সংগঠন যোগ দিচ্ছে আমার ফাঁসির দাবিতে। নারী অধিকার আন্দোলনের সভানেষনী অধ্যাপিকা চেমন আরা ও সেক্রেটরি হাবিবা চৌধুরী বিবৃতি দিয়েছেন, তসলিমা নাসরিন একজন নারী হয়েও নারী সমাজের অমর্যাদা করে চলেছেন, সুতরাং তাঁকে গ্রেফতার করা হোক, তাকে ফাঁসি দেওয়া হোক। সাংস্কৃতিক চেতনা বিকাশ কেন্দ্রও আমার গ্রেফতার এবং বিচার দাবি করেছে। আরেকটি সংগঠন গড়ে উঠেছে, নাম ইয়ং হিন্দু সোসাইটি। এরাও আমার শাস্তি দাবি করেছে। ইয়ং হিন্দু সোসাইটির নেতা স্বপন কুমার বিশ্বাস, শ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র দে, সুভাষ চন্দ্র দে ধর্মীয় উত্তেজেনা সৃষ্টির চেষ্টায় নিয়োজিত তসলিমা নাসরিন গংদের শাস্তির এবং ব্লাসফেমি আইনের আওতায় হিন্দু ধর্মকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান।
আজ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের একটি বিবৃতিও ছাপা হয়েছে। মৌলবাদীরা সামাজিক সংহতি এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্টে পাঁয়তারায় লিপ্ত। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে জোটের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রামেন্দু মজুমদার এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম কুদ্দুস গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছেন, আমরা অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করছি যে দেশে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী চক্রান্তমূলকভাবে সামাজিক সংহতি ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্ট করার কাজে লিপ্ত হয়েছে এবং ধর্মানুভূতির অপব্যবহার করে এই ষড়যন্ত্র জোরদার করে চলেছে। তাদের এইসব অপতৎপরতা বন্ধের ব্যবস্থা না করে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে সরকার বরং মৌলবাদী গোষ্ঠীর ক্রীড়নক হয়ে উঠছে। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারীদের বর্ধমান অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অপব্যাখ্যাকারীদের ফতোয়া, জাতীয়ভাবে সম্মানিত প্রতিষ্ঠিত লেখক বুদ্ধিজীবীদের মুরতাদ আখ্যাদান ও উস্কানিমূলক বক্তব্য, জাতীয় সংসদে স্বাধীনতার অবমাননাকর পাল্টা পতাকা উত্তোলন, সরকারি পত্রিকার স্থলে অশালীন অননুমোদিত পত্রিকা বিতরণ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিবিরের নতুন করে সশস্ত্র হামলা ইত্যাদির ১৩৯ বিরুদ্ধে সরকার নিষিক্রয় ভূমিকা পালন করে চলছে। পক্ষান্তরে কথিত অভিযোগের ভিত্তিতে জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক শ্রদ্ধাভাজন প্রবীণ সাংবাদিক তোয়াব খান ও নির্বাহী সম্পাদক বোরহান আহমেদকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেষেন আনীত অভিযোগের সুরাহার জন্য প্রেস কাউন্সিলের শরাণাপন্ন না হয়ে সরকার যেভাবে পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন তা গণতান্ত্রিক সমাজের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে সাংবাদিকদের মুক্তি দাবি করছি।
সেই সঙ্গে লেখিকা তসলিমা নাসরিন কর্তৃক প্রদত্ত অস্বীকৃতির পরও তার সাক্ষাৎকারের বিকৃত ভাষ্য নিয়ে ফায়দা হাসিলের খেলা বন্ধ এবং লেখিকার সুস্পষ্ট বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে আনীত মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। আমার প্রসঙ্গ লেজের দিকে বলা হলেও বলা হয়েছে। কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হই। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বড় ব্যাপার। ছোট দল তসলিমা পক্ষ একটি পোস্টার ছেপে ঢাকা শহরের বিভিন্ন দেয়ালে সেঁটেছে।
আমি পবিত্রত্রত্রত্র কোরান সংশোধনের কথা কখনও কোথাও বলিনি
–তসলিমা নাসরিন
০ তসলিমা নাসরিনএর উপর দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার কর
০ স্বাধীন সংবাদপত্র এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা চাই
০ ফতোয়াবাজদের রুখে দাঁড়াও
একটি লিফলেটও বের করেছে মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র থেকে। জানি না এই কেন্দ্রটিতে সাজু জাহেদাদের দল আছে কি না। আমার নামটি উচ্চারণ করতে ওদের কোনও আড়ষ্টতা নেই।
তসলিমা নাসরিনের হুলিয়া প্রত্রত্যাহার কর
ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও
প্রিয় দেশবাসী,
তসলিমা নাসরিনের কথিত কোরান সম্পর্কে উক্তির কারণে তার উপর সরকার মামলা দায়ের ও হুলিয়া জারি করেছেন। যে কথিত উক্তির জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা, সে উক্তি সম্পর্কে তসলিমা নাসরিন নিজেই বলেছেন, তিনি তা বলেননি। কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকা ভুল ছেপেছে। স্টেটসম্যান পত্রিকায় পাঠানো প্রতিবাদ লিপিতে তসলিমা নাসরিন বলেছেন, কোরান পরিবর্তনের কথা তিনি বলেননি। তিনি বলেছেন শরিয়া আইন পরিবর্তনের কথা।
স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত তসলিমা নাসরিনের কথিত এই উক্তি সম্পর্কে প্রথমে খবরটি প্রকাশিত হয় দৈনিক বাংলাবাজারে। তারপর খবরটি লুফে নেয় দৈনিক ইনকিলাব। এরপর প্রায় প্রতিদিনই ইনকিলাব পত্রিকায় তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে খবর ছাপা হচ্ছে। এই গ্রুপের সাপ্তাহিক পূর্ণিমা গত দুবছর ধরে তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে একের পর এক করেছে কভার স্টোরি। অর্ধেক পৃষ্ঠার লেখায় দেড় পৃষ্ঠাব্যাপী তসলিমার ছবি ছাপিয়ে পত্রিকাটি ব্যবসায়িক ফায়দা লুটেছে। কারণ তসলিমা নাসরিনের বিষয় নিয়ে কিছু লিখলে পত্রিকা চলে বেশি, পত্রিকার কাটতি বেশি। সম্প্রতি এই পত্রিকার নেপথ্য মালিক কুখ্যাত মাওলানা মান্নানের উস্কানিতে গঠিত সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলি এনজিওদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিষোদগার করছে। স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর থেকেই এনজিওরা এদেশে কাজ করে আসলেও এনজিওদের বিরুদ্ধে বিরোধিতা এত চরমে ছিল না। এখন এর বিরোধিতা করার কি কারণ? এনজিওরা এখন ব্যাপক প্রাথমিক ও বয়স্ক শিক্ষার কার্যক্রম শুরু করেছে। এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী চায় না যে, আমাদের দেশের মানুষ শিক্ষিত হোক। তারা তাদের মাতব্বরি খবরদারি টিকিয়ে রাখার জন্য এ দেশের মানুষকে অশিক্ষিত রাখতে চায়। এনজিওদের অর্থনৈতিক কর্মসূচী ও গ্রামীণ মানুষদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এদের আঁতে ঘা লেগেছে। কারণ তাদের মহাজনি ও দাদন ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। এইসব সাম্প্রদায়িক ও ফতোয়াবাজ গোষ্ঠীর ব্যাপারে সরকার একেবারে নীরব। বরং বলা যায় পঈচ্ছত সমর্থন দিয়ে চলেছে। তসলিমা নাসরিন ও জনকণ্ঠের বিরুদ্ধে মামলা তারই প্রমাণ করে। তাই আজকের প্রশ্ন, স্বার্থপর ধুরন্ধর এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর খপ্পরে পড়ে দেশ কি মধ্যযুগে ফিরে যাবে? নাকি আমরা গণতন্ত্রের পথে, ব্যক্তি স্বাধীনতার পথে, মানুষের মানবিক মূল্যবোধের পথে অগ্রসর হব! আমাদের দাবি অবিলম্বে তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে আরোপিত মামলা ও হুলিয়া প্রত্যাহার করা হোক। দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের উপর আরোপিত মামলা প্রত্যাহার করা হোক। ফতোয়াবাজদের বেআইনি কার্যক্রম বন্ধ করা হোক।
————– মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র ————-
আজকের আরেকটি খবরের কথা আমি এখনও বলিনি। খবরটি খুব বড় খবর। পত্রিকার প্রথম পাতার খবর। না বলার কারণটি সম্ভবত বেঁচে থাকার একটি আশা, যত ক্ষীণই হোক তা, আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি জানি আমার বাঁচার আর কোনও সম্ভাবনা আর নেই। এই ফতোয়া সিলেটের ছাহাবা সৈনিক পরিষদের দেওয়া ফতোয়ার মত নয়। এ ফতোয়া অন্যরকম। এই ফতোয়া মুফতীর দেওয়া ফতোয়া। ইসলামি আইনে একমাত্র মুফতীরই অধিকার আছে ফতোয়া দেওয়ার। সম্ভবত আমার মৃত্যু না হলে কেউ এইসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না। যে কোনও সময় যে কেউ আমার মাথাটি কেটে নেবে। আগের পঞ্চাশ হাজার, আর এখনকার এক লক্ষ, মোট দেড়লক্ষ টাকা মূল্য আমার এই মাথার। মূল্যবান মাথাটি বনবন করে ঘোরে, মূল্যবান মাথাটি বাঁচাবার কোনও বুদ্ধিই এই মাথায় নেই।
তসলিমাকে হত্যার জন্য লাখ টাকা পুরুরস্কার ঘোষণা
খুলুনা, ১০ই জুনুন। আজ বিকেলে স্থা্থানীয় শহীদ পার্কে আয়োজিত এক সীরাতুন্নুন্নবী সম্মেলনে লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে হত্যার জন্য এক লাখ টাকা পুরুরস্কার ঘোষণা করা হয়।
জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম এর খুলুলনা জেলা কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মাওলানা রফি আহমেদ মহল্লী। সীরাতুন্নুন্নবী সম্মেলনের অন্যতম বক্তা মুফুফতী সৈয়দ নজরুল ইসলাম তসলিমা নাসরিনকে হত্যার ঘোষণা দিয়ে বলেন, ইসলামের দুশমন, কোরানের অপব্যাখ্যাকারী তসলিমা নাসরিনকে যে ব্যক্তি হত্যা করতে পারবে, তাকে ১ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। এ সময় তিনি তাঁর ব্যাংকের হিসাব নম্বরও উল্লেখ করেন। তসলিমার হত্যাকারীকে তিনি তাঁর ঢাকার বাসার (৩১৪/২ লালবাগ) ঠিকানায় যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানান।
৩. অতলে অন্তরীণ – ০৯
বারো জুন, রবিবার
ইনকিলাবের প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত তসলিমাগংদের বিরুদ্ধে জেহাদি আন্দোলনের খবরই লেখা হয়। সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, মন্তব্য, কলাম প্রতিদিন যা চলছে, তা তসলিমার বিরুদ্ধে।
তসলিমাসহ মুরতাদদের ফাঁসি ও ধর্মদ্রোহী পত্রিকা নিষিদ্ধ করতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ।
ইসলামের ক্ষতি করার জন্য যুগে যুগে কুলাঙ্গারের আবির্ভাব ঘটেছে, বলেছেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। লেখিকা তসলিমা তাঁর যা ইচ্ছা তাই লিখুন, কিন্তু লেখার স্বাধীনতার নামে কারও ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানার অধিকার তাঁর নেই। দেশজুড়ে যে জেহাদী আন্দোলন চলছে, তা তিনি সমর্থন করছেন এবং ধর্মদ্রোহীতার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়নের ব্যাপারটিকেও তিনি সমর্থন করছেন।
মিজান চৌধুরী যে সে লোক নন, তিনি বড় রাজনৈতিক নেতা, একসময় আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন, তারপর এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। এখন তিনি জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। ভারপ্রাপ্ত এই জন্য যে আসল চেয়ারম্যান এখন জেলে। খালেদা তাঁকে জেলে ভরে রেখেছেন। নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনে জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা কমে গেছে, তাই জনপ্রিয়তা অর্জন করার জন্য মিজান চৌধুরী ইসলামী দলের সমর্থনে এগিয়ে এলেন।
দেশ ও ঈমানবিরোধী চক্রান্ত রুখতে আজকের সংগ্রামী মিছিলে শরিক হোন।
ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা প্রতিরোধ মোর্চা গঠনের লক্ষে গঠিত সমন্বয় কমিটির আহবায়ক মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, সমন্বয় কমিটির আহবায়ক মুফতী ফজলুল হক আমিনী আজ ১২ই জুন সকাল দশটায় বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে দেশবাসীকে সমবেত হয়ে দেশ ও ঈমানবিরোধী অপতৎপরতা রুখতে সংগ্রামী মিছিলে শরিক হওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
তাঁরা বলেন, আমরা জনতার মিছিল নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাবো এবং মুরতাদ তসলিমা নাসরিনগংদের ফাঁসি, জনকণ্ঠ নিষিদ্ধকরণ এবং ধর্মদ্রোহিতার জন্য মৃত্যুদন্ডের আইন প্রণয়নের দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদান করব। এই নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়েই আমরা সেই সব হায়েনাচক্রের দাফন প্রক্রিয়ার দিকে এগিয়ে যাবো, যারা একটি সরল, ধর্মপ্রাণ ও আত্মমর্যাদাবান জাতিকে বারবার বোকা মনে করে রক্তাক্ত করে চলেছে। এই চক্রের দুঃসাহস আজ সীমাহীন স্পর্ধার রূপ ধারণ করেছে। এরা মুক্তবুদ্ধি, প্রগতিশীলতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং মানবতার জিগির তুলে অব্যাহতভাবে ঈমান ও ইসলামের বিরুদ্ধে সব রকম অস্ত্র প্রয়োগ করে যাচ্ছে। এই হায়েনাচক্র এখন জাতির মুখোমুখি দাঁড়াতে চাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে শহর বন্দর, গ্রাম পর্যায়ের সকল মানুষ ঐক্যবদ্ধ । এদের মৃত্যু সুনিশ্চিত করার জন্য ১২ জুনের স্মারকলিপি প্রদানের শোভাযাত্রায় শরিক হওয়ার জন্য নেতৃবৃন্দ দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান।
তসলিমার ফাঁসির দাবিতে বরিশালে স্মরণকালের বৃহত্তম মিছিল।
ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তুলন।
তসলিমার ফাঁসি ও জনকণ্ঠ নিষিদ্ধের দাবিতে সভা সমাবেশ অব্যাহত।
নাস্তিক মুরতাদের পক্ষে বিবৃতির পরিণাম ভয়াবহ হবে।
নাস্তিক মুরতাদদের ফাঁসির দাবিতে তৌহিদী জনতা রাজপথে।
মুরতাদ তসলিমার জন্য আনন্দবাজার গোষ্ঠী অস্থির হয়ে পড়েছে। মুরতাদ মহিলা তসলিমার জন্য ভারতের আনন্দবাজার গোষ্ঠী বড় বেচায়েন হয়ে পড়েছে। তারা জানিয়েছে, তসলিমা তাদের আত্মার আত্মীয়। আনন্দবাজারীদের এমন আপনজন বাংলাদেশের সকল স্তরের মানুষের কাছ থেকে ঘৃণা, ধিককার ও অবমাননাকর বিষাক্ত শেলে যেভাবে জর্জরিত হচ্ছে, তাতে তারাও অস্থির হয়ে পড়েছে। কারণ, এ শেল যে তাদের উপরও আঘাত হানছে, তসলিমার মত এমন ভ্রষ্টা নারীকেই তাদের প্রয়োজন যে ভ্রষ্টা হতেই গৌরব বোধ করে, যে নীতি-নৈতিকতার তোয়াককা করে না, যে দেশের স্বাধীনতাকে আনন্দবাজারীদের হাতে তুলে দিতে চায় এবং দেশের সার্বভৌম স্বাধীন সীমানাকে মুছে দিয়ে ভারতের সাথে এককার হয়ে যেতে চায়। এই উপমহাদেশে মুসলমানদের মানসম্ভ্রম, ঐতিহ্য গৌরবকে ধুলায় ভূলণ্ঠিত করতে সহায়তা করতে পারে, এমন মুসলিম নামধারী কোনও পা চাটা কুলাঙ্গারকেই আনন্দবাজারীদের প্রয়োজন। এমন প্রয়োজনের ভ্রষ্টা নারী বাংলাদেশে অসুবিধার মধ্যে আছে, আনন্দবাজারীরা তা সইবে কেমনে! তারা অস্থির হয়ে উঠেছে, তসলিমা নামের কুলাঙ্গারকে উদ্ধার করার জন্য। তাদের উদ্বেগ যন্ত্রণা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে তসলিমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় ইতোমধ্যে ভারতের উগ্র হিন্দু সংগঠন বিজেপি, যুবকংগ্রেস এবং নিখিল ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি পৃথক পৃথক বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে। আনন্দবাজার গোষ্ঠী এতেও তৃপ্ত হতে পারছে না। যেন তাদের তর সইছে না। তারা চাইছে গোটা ভারতে ঝড় উঠুক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। আনন্দবাজারীরা তাই বিভিন্নভাবে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যসরকারসহ ভারতের বিভিন্ন সংগঠনকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উস্কিয়ে দেওয়ার মত ঘৃণ্য কাজে মেতে উঠেছে। আনন্দবাজার লিখেছে, দুনিয়ার কোথাও পান থেকে চুন খসলেই প্রতিবাদে সরব হতে যাদের তিলমাত্র বিলম্ব হয় না, সেই বামপন্থীদের পড়শি দেশের লেখিকা তসলিমা নাসরিনের ওপরে রাষ্ট্রযন্ত্রের আঘাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর ব্যাপারে প্রাথমিক জড়তা কাটতেই বেলা বয়ে গেল। আনন্দবাজার পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকার এবং কংগ্রেসকে এই মর্মে অভিযুক্ত করেছে যে তাদের ভোট নষ্ট হওয়ার ভয়েই তারা তসলিমার ব্যাপারে চুপ থাকছে। যারা প্রতিবাদ জানাতে এগিয়ে আসতে বিলম্ব করছে, আনন্দবাজার শক্ত ভাষায় তাদের আক্রমণ করছে। তবে দিল্লিতে সিপিএমএর মহিলা সংগঠন গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি বাংলাদেশের হাই কমিশনারের কাছে তসলিমার পক্ষে যে স্মারকলিপি দিয়েছে, তারা তাতে যেন তসলিমার জন্য কিছু করার পথে আশা দেখতে পেয়েছে। আনন্দবাজারীরা আরও কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে এই দেখে যে, বাংলাদেশের ভেতরের গুটিকয়েক মুরতাদ তসলিমার অপকর্মকে প্রকাশ্যে সমর্থন করার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছে। আনন্দবাজার এখন এটাকে ঢালাওভাবে প্রচার করছে যে তসলিমার পক্ষেও এখন ঢাকা সরব। আনন্দবাজার লিখেছে, আজ একেবারে প্রকাশ্যেই তসলিমার সমর্থনে সরব হয়েছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও বাংলাদেশ সমাজতন্ত্রী পার্টির মত দল।
আত্মার আত্মীয় তসলিমার জন্য অস্থির আনন্দবাজার গোষ্ঠী ভারতীয় কর্তৃপক্ষ, বিভিন্ন সংগঠন তসলিমার পক্ষে এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে না কেন, সে জন্য যেমন প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ, বাংলাদেশের গুটিকয়েক বিপথগামী তসলিমার পক্ষে কথা বলায় তেমনি আবার পুলকিত।
ইনকিলাবের লোকেরা ভারত বিরোধী হলেও ভারতে কোথাও আমার নিন্দা করা হলে সেটিকে লুফে নিয়ে পুনঃপ্রকাশ করে। ভারতীয় হিন্দু সোমক দাসকে রীতিমত সম্মান করছে ইনকিলাব গোষ্ঠী। রবিবারের প্রতিদিনএ প্রকাশিত সোমক দাসের তসলিমা নাসরিনের নারীবাদ ও লেখক সত্তা ইনকিলাবে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে। —তসলিমা নাসরিনের হাতে দুটো তাস, যৌনতা ও ইসলাম। এই তাস দুটিকেই নানাভাবে ব্যবহার করে যাচ্ছেন তিনি একের পর এক রচনায়, আলোচনায় ও সাক্ষাৎকারে। তাঁর নারীবাদে নারী স্বাধীনতার প্রশ্ন যৌন য়েচ্ছ!চারে পর্যবসিত। আসলে পশ্চিমী দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্মের ব্যাখ্যা। লেখক হিসেবেই তিনি কতখানি বিষয় ও ভাষা সচেতন? এই প্রশ্ন তিনি নিজেই করেছেন এবং নিজে যা উত্তর দিয়েছেন তা ইনকিলাব গোষ্ঠীর খুব পছন্দ হয়েছে।
আমাকে এখনও গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন, এ নিয়ে এখন অনেকের সন্দেহ। সরকার কি ইচ্ছে করেই আমাকে গ্রেফতার করছে না! সত্যসন্ধ তাঁর নিয়মিত কলামে লিখেছেন, তসলিমা নাসরিন সরকারের দৃষ্টিতে আছেন বহুদিন থেকেই। সরকারি চাকুরে হওয়া সত্ত্বেও সে পরিচয় গোপন করে বিদেশে যাবার সময় তাঁকে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাধা দেয়া হয়েছিল এবং সেই সুবাদে তার পাসপোর্ট বহুদিন আটক ছিল। অতি সম্প্রতি বিদেশ সফরকালে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও এ দেশের গণমানুষের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি কটাক্ষ করার কারণে সারাদেশে তার বিচারের দাবিতে জনমত ফুঁসে উঠেছে। এ প্রেক্ষিতেই তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কিন্তু গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা সত্ত্বেও পুলিশ তাকে আজও গ্রেফতার করতে সম্ভব হয়নি। এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী উচ্চারণে যার রচনাবলী কণ্টকিত, যার অবৈধ বহির্গমন প্রয়াসের কারণে পাসপোর্ট আটক হতে পারে এবং যিনি বিদেশে গিয়ে এ দেশের আইন ও সার্বভৌমত্বের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখিয়ে বক্তব্য দেবার স্পর্ধা রাখেন, যার সঙ্গে আন্তর্জাতিক কুচক্রী মহলের গভীর সম্পর্ক সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত, তার গতিবিধি সম্পর্কে পুলিশ খোঁজ রাখে না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা? তা হলে পুলিশ বা স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রয়োজনটা কোথায়? আমরা নিশ্চয়ই গোটা পুলিশ বিভাগের কথা বলছি না। আমাদের আইন শৃঙ্খলা সংস্থার অধিকাংশ সদস্য কর্তব্যপরায়ণ না হলে দেশ এতদিন নিশ্চয়ই মনুষ্যবাসযোগ্য থাকত না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেশ সৎ এবং কর্তব্যপরায়ণ। আমরা জানি যে তসলিমা নাসরিনের মত বির্তকিত ব্যক্তিদের গতিবিধি সম্পর্কে কড়া নজর রাখা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্ব এবং আমরা বিশ্বাস করি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পূর্বেও এ দায়িত্ব যথারীতি পালিতই হয়ে থাকবে। সুতরাং প্রশ্ন জাগে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর পরই তসলিমা নাসরিন উধাও হয়ে যাবার সুযোগ পেলেন কাদের প্রশ্রয় বা সহযোগিতায়। তাই বলি,বাংলাদেশে বুঝি সরকারের মধ্যেও আরেক অদৃশ্য শক্তি আছে যার কাজ নিয়মতান্ত্রিক সরকারের সব নীতি ও কর্মকাণ্ডকে নস্যাৎ করে দেওয়া।
সরকার ব্যর্থ হলে জনগণই মুরতাদদের বিষদাঁত ভেঙে দেবে–চট্টগ্রামে জামাতে ইসলামির সভায় বলা হয়েছে। সরকার ধর্মদ্রোহী তসলিমা নাসরিন, আহমদ শরীফ, কবীর চৌধুরী গংদের শাস্তিদানে ব্যর্থ হলে দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণই ঐক্যবদ্ধভাবে এসব ধর্মদ্রোহীদের বিষদাঁত ভেঙে দেবে। বিশ্বব্যাপী ইসলামী পুনঃজাগরণ ঠেকানো এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারত উপমহাদেশে একটি রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে টেস্ট কেস হিসেবে এ দেশীয় এজেন্টদের দিয়ে এসব ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ঈমান আকিদায় আঘান হেনে পরীক্ষা করছে কতটুকু প্রতিবাদ আসে। অপরদিকে সরকার এসব ষড়যন্ত্রে মদদ যোগাচ্ছে। তসলিমাকে গ্রেফতার করতে না পারা জনগণকে ব্ল্যাকমেইল করা ছাড়া আর কিছু নয়। আল্লাহর আসমানী কিতাব পবিত্র কোরান সম্পর্কে তসলিমার ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তির বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা, ক্ষোভ ও ধিককার জানিয়ে আন্তর্জাতিক ইসলাম বিরোধী চক্রের অন্যতম সদস্য তসলিমার প্রকাশ্য ফাঁসির ব্যবস্থা করা আর ধর্মদ্রোহীতার শাস্তি বিল পাস করার দাবি জানানো হয়। পবিত্র কোরানের সম্পূর্ণ পরিবর্তনের দাবি করে এবং ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করার মত অপরাধ করে কুখ্যাত লেখিকা তসলিমার আর আল্লাহর এই জমিনে বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই। সরকার আজ তসলিমাকে বাঁচানোর জন্য ফন্দি ফিকিরে রয়েছে, না হলে তাকে গ্রেফতার করা সরকারের জন্য এত কঠিন হয়ে দাঁড়াতো না।
রাজশাহীতে জামাতে ইসলামীর বিশাল বিক্ষোভ মিছিল শেষে সভায় বলা হয়েছে, নাস্তিক মুরতাদদের স্পর্ধা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ইসলামের জাগরণের জোয়ার দেখে সাম্রাজ্যবাদীরা ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। তাদের বেতনভোগী দালাল তসলিমাসহ কতিপয় বিকৃত মানসিকতার লেখক লেখিকা আল্লাহ রসুল ও কোরান হাদিস নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বলছে। সরকার যদি তাদের রহস্যজনক নীরবতা ভেঙে মুরতাদদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আপামর জনগণ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। আমার পক্ষে বুদ্ধিজীবীরা বিবৃতি দিয়েছেন, তার সমালোচনা করে জামাতে ইসলামি দলের পত্রিকায় আজকের সম্পাদকীয়, ধর্মদ্রোহী রাহুর গ্রাস।
.. .. কয়েকজন আঙুলে গোনা চিহ্নিত বুদ্ধিজীবী ও কবি বাংলাদেশ থেকে ইসলামকে উৎখাতের জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা শুরু করেছেন। যখনই তারা নিজেরাই দলবদ্ধভাবে প্রগতির নামে কিছু করেন তখন যেমন ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রকাশ্যে আহত করার একটা চেষ্টা থাকে। তেমনি ব্যক্তিগতভাবে তাদেরই দ্বারা অনুপ্রাণিত কোনও ব্যক্তিবিশেষ তার কোনও রচনায় কিংবা বক্তৃতা বিবৃতিতে যখন ইসলামি চেতনার ওপর আঘাত হানেন তখন আহত মুসলমানগণের প্রতিক্রিয়াকে বিপথে চালিত করার জন্য ঐ কয়েকজন মাত্র ব্যক্তি নানা বক্তৃতা বিবৃতি প্রচার করে ইসলামকে আঘাতকারী অন্যায়ের পক্ষপাত শুরু করেন। তাদের ধারণা ইসলাম, পবিত্র কুরআন এবং নবী রসুলকে আক্রমণ করে কিংবা আঘাত করে কিছু রচনা করা বা বলাটা হল তাদের প্রগতিশীল অধিকার। আর ধর্মের পক্ষে দাঁড়ানোটা প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ। কেউ ইসলামের পক্ষে দাঁড়ালে সেটা মহা অপরাধ। কারণ ধর্মটা হল তাদের দৃষ্টিতে ধাপ্পাবাজি।
এই দৃষ্টিভঙ্গিকে তারা প্রচার করতে চান গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিরূপে। ফলে তসলিমা নাসরিনের মত দেশ ও ধর্মদ্রোহিনীর পবিত্র কুরআন অবমাননাকেও তারা অত্যন্ত সাহসের সাথে সমর্থন করেন। তার অন্যায়ের সাফাই গাইতে এগিয়ে আসেন। তসলিমা যখন পবিত্র কুরআনের শুদ্ধির পরামর্শ দিয়ে বিদেশি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেন কিংবা দেশের সার্বভৌম সীমানা তুলে দিয়ে ভারতের সাথে মিশে যেতে বলেন তখন তার ঐসব মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাদী মুরুব্বীরা আড়ালে আবডালে বাহবা দিয়ে বেড়াতে থাকেন। যখন এরই প্রতিক্রিয়ায় সারাদেশের আধ্যাত্মিক চেতনা সহসা প্রচণ্ড আঘাতে গুমড়ে ওঠে, পথে পথে ক্ষিপ্ত জনগণের মিছিল বেরিয়ে আসে এবং ধর্ম সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন ক্ষমতাসীন সরকার তসলিমা নাসরিনকে গ্রেফতার করা হবে বলে তাকে আত্মগোপনের সুযোগ করে দিয়ে মজা দেখতে থাকেন, তখন ঐসব প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবীরা তাদের গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে ক্রমাগত বিবৃতিতে সই করতে থাকেন, তসলিমার গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। সরকার মৌলবাদীদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে তসলিমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। সরকারের উচিত এক্ষুনি তা তুলে নেওয়া ইত্যাদি। বিবৃতিতে সচরাচর যাদের স্বাক্ষর দেখে আমাদের চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেছে সেই কবীর চৌধুরী, কবি শামসুর রাহমান, খান সারওয়ার মুরশিদ, ফয়েজ আহমেদ ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর স্বাক্ষর থাকবেই। আমাদের ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিটি আঘাতকারী বিষয়ে কেন এরাই বার বার বিবৃতির স্বাক্ষরদাতা হন? এ দেশে এগারো কোটি মুসলমানের ইসলামের প্রতি আগ্রহ কি তবে তাদের ধারণায় কোনও মৌলিক অধিকারের আওতায় পড়ে না? কেবল তসলিমা নাসরিনের ইসলাম ও পবিত্র কুরআন অবমাননার অধিকারটাই মৌলিক নাগরিক অধিকার? তসলিমা নাসরিনের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনাশকারী গ্রন্থ লজ্জা নিয়ে যখন ভারতে দাঙ্গা বাঁধে এবং সেখানকার মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা জুলুম এবং অগ্নিসংযোগের মধ্যে ফেলা হয়, মুসলিম মেয়েদের নির্বিচারে ধর্ষণ করা হয় তখন কবীর চৌধুরী, শামসুর রাহমান, ফয়েজ আহমেদ, খান সারওয়ার মুরশিদ এবং জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীরা কোথায় থাকেন?
ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্বেষ প্রচার এ দেশের মানুষ এতদিন দমবন্ধ করে কেবল মৌলিক নাগরিক অধিকারের কথা ভেবেই কিনা জানি না, সহ্য করে এসেছে। এতে এটা ভাবা কারও উচিত নয় যে এগারো কোটি মুসলমান তাদের পবিত্র কুরআনকে বদলে ফেলার কথাও হজম করার পর্যায়ে চলে এসেছে। এখন যা খুশী তাই বলা যায় এবং কেউ বললে বিবৃতি দিয়ে সমর্থনও করা যায়। হ্যাঁ, বর্তমান সরকারের আমলে আপাত দৃষ্টিতে এটাই প্রতীয়মান হয় বটে। কিন্তু আমরা সরকারকে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জানিয়ে দিতে চাই এটা সত্য নয়। বর্তমান সরকারের সাধ্য না থাকলেও এ দেশের এগারো কোটি মুসলিম নর নারীর সাধ্য আছে তাদের পবিত্র ধর্মকে নাস্তিক্যবাদী শয়তানের গোটা কয়েক সন্তানের বিদ্রূপ এবং অবহেলা থেকে বাঁচাবার।
কেবল বিবৃতি দিয়ে মৌলবাদী শক্তিকে ঠেকানো যাবে না, পথে নেমেছে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। গতকাল বিকেল চারটায় নির্মূল কমিটির সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেছেন, স্বাধীনতা বিরোধী পরাজিত শক্তি যে উদ্দেশ্যে একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল সেই একই উদ্দেশ্যে আজ তারা আমাদের মুক্তবুদ্ধির সংবাদপত্রগুলোর ওপর হামলা করছে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি তারাই পরাজিত শষনুকে মাথা তুলতে দিয়েছি। এই শক্তি এখন দেশটাকে পাকিস্তান বানাতে চায়, পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীত বদল করতে চায়। তাদের বিরুদ্ধে আবার নতুন করে জেহাদে নামতে হবে। সমাবেশে জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের ওপর থেকে মামলা এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা তুলে নেবার জোর দাবি জানানো হয়। ডঃ কামাল হোসেন গতকাল বরিশালের অশ্বিনী কুমার টাউন হলে গণফোরাম আয়োজিত সভায় বক্তৃতা করেছেন, বলেছেন, ধর্মের নামে যারা বিভিন্ন ব্যক্তির ফাঁসি চায় তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হোন। বর্তমান সংসদ কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। এ সংসদ দেশে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগাতে পারেনি। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল, সবাই ব্যর্থ। বহু ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাকে রক্ষা করা সকল নাগরিকের দায়িত্ব। দেশে ইসলাম বিপন্ন হয়নি। ধর্ম ব্যবসায়ীরা ইসলামকে বিপন্ন করেছে। আফ্রিকার নেলসন ম্যাণ্ডেলা শ্বেতাঙ্গদের সাথে আলোচনায় বসতে পারেন। আরাফাত ইজরাইলের সাথে আলোচনা করতে পারেন, কিন্তু আমাদের দুই নেষনী দেশের উন্নয়নের জন্য আলোচনায় বসতে পারেন না। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে এখনও পৃথক করা হয়নি। .. সরকার সংবাদপষেনর স্বাধীনতার নামে পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেফতার ও সাংবাদিকদের হয়রানি করছে। জনগণকে উপেক্ষা করে দেশ চালাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
মাথার মূল্য ধার্য করার প্রতিবাদ করেছে সেই সাজু, সেই জাহেদা, সেই লাভলী এবং তাদের দল। এছাড়া আজকের পত্রিকায় আমার মাথা নিয়ে আর কারও মাথা ব্যথা দেখা যায়নি। তবে মাথা নিয়ে বিবিসি একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করে। খবরটি এভাবে বেরিয়েছে। খুলনায় মৌলবাদীদের একটি জনসভায় লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে হত্যার জন্য ১ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রসচিব আজিমউদ্দিন আহমেদ গতকাল শনিবার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, যে মাওলানা ওই ঘোষণা দিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে, তিনি ঠিক কি বলেছিলেন এবং খুলনাতে ঠিক কি ঘটেছিল সরকার তা জানার চেষ্টা করছে। তিনি আরও বলেন, এটা যদি সত্যি হয় তাহলে যার বিরুদ্ধে এই কথা বলা হয়েছে তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। তসলিমা এখন আত্মগোপন করে আছেন এমন অবস্থায় তিনি কি করে নিরাপত্তার জন্য অনুরোধ করবেন? সচিব বলেন, তসলিমার উচিত সরকারের কাছে অথবা আদালতের কাছে আত্মসমর্পণ করা। মৌলবাদীরা সংবাদপষেনর ওপর আর তসলিমার বাড়িতে হামলা করেছে, এতে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কি কোনও তদন্ত করছে? এটা একটা সাধারণ অপরাধ নয়, এটা কোনও সাধারণ ভাঙচুর বা গুণ্ডামির অপরাধ নয়। এটা অন্য কিছু। কিন্তু কেউ যদি কোনও সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করে, অন্য কাউকে আহত করে, অথবা অন্য যে কোনও কাজ করে যা আইনের চোখে অপরাধ তাহলে ব্যবস্থা অবশ্যই নেওয়া হবে। এটুকু সংবাদ দেওয়ার পর বিবিসির সাংবাদিক জানান, আমি তাঁকে বাংলায় সাক্ষাৎকার দেবার জন্য অনুরোধ করেছিলাম, জবাবে তিনি জানান, তাঁর মাতৃভাষা বাংলা নয়, তাঁর মাতৃভাষা উর্দু।
আজ সকাল গেল, দুপুর গেল, বিকেল গেল কোনও খবর নেই ক বা ঙর। আমার যে যাবার কথা ছিল হাইকোর্টে! কেন আজকের এই যাওয়া বাদ দিতে হল, কিছুই আমি বুঝতে পারি না। চ আমাকে সঙ্গে নিয়ে রাতের খাবার খেলেন। খাওয়ায় রুচি নেই আমার, অল্প কিছু খেয়ে উঠে পড়ি। চ যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন, ব্যস্ত থাকেন তাঁর কন্যা নিয়ে। আজ রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে তিনি আমার কাছে এসে বসলেন কিছুক্ষণের জন্য। কিছু পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে বললেন যে আজ আপিসে এক মহিলার সঙ্গে আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল, মহিলাই তুলেছিল প্রসঙ্গ,বলল লজ্জা একটা বাজে বই, লজ্জা বইটি লিখে আমি খুব ভুল করেছি। আমি চুপ হয়ে থাকি, মনে মনে ভাবি চ নিশ্চয়ই ওই মহিলার মতের সঙ্গে একমত হননি। কিন্তু চ এরপরেই বললেন, আপনার সব বইই আমি পড়েছি, লজ্জাটা আমারও ভাল লাগেনি। খুব একপেশে লেখা।
একপেশে?
হ্যাঁ একপেশে। অনেক কিছু তো সত্য নয়। এ দেশে হিন্দু পলিটিশিয়ান আছে, হিন্দু আর্টিস্ট আছে, ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হিন্দু আছে, হিন্দু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার আছে, হিন্দু সাইন্টিস্ট আছে। লজ্জায় তো এদের কথা লেখেননি। কত বড় বড় মুভমেন্ট হল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, এসব কিছুই লেখা নেই লজ্জায়।
আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি। মাথা নিচু করে বুকের ধুকপুক শব্দ শুনতে থাকি। চর মুখের দিকে ভয়ে তাকাই না। যদি চ এখন ঘ এর মত বলেন যে এ বাড়িতে আমার আর থাকা হচ্ছে না!
৩. অতলে অন্তরীণ – ১০
তেরো জুন, সোমবার
গভীর রাতে ক আর খ এসে আমাকে একটি গাড়ির পেছনে শুইয়ে নিয়ে গেলেন একটি দেয়ালঘেরা মাঠ অলা বাড়িতে। বাড়ির ভেতর বৈঠকঘরে বড় এক সোফা জুড়ে বসেছিলেন একজন রাশভারী মহিলা। আমাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলেন। এটি এমন এক দৃষ্টি যে দেখলে গা ছমছম করে। আমাকে বসতে বললেন গমগমে গলায়। গা ছমছম করলেও তিনিই আমার রক্ষক। তিনি আমাকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছেন। জীবনে অনেক মেয়ের উপকার করেছেন তিনি, আমারও করছেন। আসলে চর বাড়ি ছাড়ার কারণটি হল, ক যা বলেছেন, যে, এক বাড়িতে বেশিদিন থাকা ঠিক নয়। আত্মগোপনেরও পদ্ধতি আছে, আমার জানা ছিল না এতসব। এক জায়গায়, জায়গাটি নিরাপদ হলেও, দীর্ঘদিন থাকা চলবে না, স্থান বদল করতে হবে ঘন ঘন। আমার ধারণা, ক যদি আমার জন্য আশ্রয়ের জায়গা পেতেন, তবে তিনি প্রতিরাতেই আমাকে বেড়ালের মা যেমন তার ছানাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যায়, তেমন নিতেন। একটি ব্যাপার লক্ষ করেছি আমাকে যখন এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়, ক তখন কাউকে বলেন না কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। চ কে বলেননি যে ছ এর বাড়িতে যাচ্ছেন, ছ কেও বলেননি যে চ এর বাড়ি থেকে আমাকে আনা হল। ক এমনকী আমাকেও বলেন না কোথায় যাচ্ছেন। কোথাও পৌঁছে টের পেতে হয় কোথায় এসেছি। ছর বাড়িতে তুলে ছকে দেখিয়ে আমাকে বললেন, ইনি ছ, ইনি বহুকাল থেকে নারী উন্নয়নের কাজে জড়িত। আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবার দরকার হয় না। আমি ফেরারি আসামী। ফেরারি আসামীকে যে কেউ দেখলে চেনে। কর কাছে জামিনের ব্যাপারে উকিল তাঁকে কিছু বলেছেন কি না জানতে চাই। ক আমাকে যা বললেন তা হল আমার উকিল শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পাল্টেছেন, কারণ গতকাল আদালতে যে বিচারক বসেছিলেন, তিনি ঘোর মৌলবাদী লোক। ওই বিচারক যে জামিন দেবে না, এ নিশ্চিত। যে কোনও বিচারকের সামনে আদালতে আমার জামিনের জন্য আমার উকিল চাইছেন না আবেদন করতে। ব্যাপারটি আমার জীবন মরণের ব্যাপার। কোনও বিচারকের ব্যাপারে যদি নিশ্চিত হওয়া যায় যে তিনি জামিন দিতে পারেন বা দেবেন তবেই আমাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আদালতে হাজির করার কথা বিবেচনা করা যায়। এ সময় আরেকটি ব্যাপারে ডঃ কামাল হোসেন চেষ্টা করছেন, তা হল আমার অনুপস্থিতিতে জামিন নেওয়া। এটি যদি হতে পারে, খানিকটা দেরি হলেও, ভাল। আততায়ীর গুলিতে আদালতে নিহত হবার ঝুঁকিটি তবে থাকে না। নিম্ন আদালত ইতিমধ্যে জামিনের আবেদন নাকচ করে দিয়েছে, এখন ভরসা উμচ আদালতই। জামিন দেওয়া হবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে তিনি এগোতে চাইছেন না। আমার বাড়ির কারও সঙ্গে কোনও যোগাযোগ হয়েছে কি না জানতে চাইলে ক বললেন, উকিলের আপিসে ছোটদা আর দাদার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। ক মিলনের কথা জিজ্ঞেস করে জানলেন যে মিলন এখনও বাড়ি ফেরেনি। দাদা আর ছোটদাকে কিছুক্ষণের জন্য মাত্র দেখেছেন ক, এটুকু শুনে আমার স্বস্তি হয়– যেন ক নয়, আমিই ওঁদের দেখেছি। দাদা এখন তবে ঢাকায়! যে লোক ময়মনসিংহ ছেড়ে কোথাও যেতে চাননা, তিনি এখন ঢাকায় আমার উকিলের আপিসে বসে আছেন! আমি অনুমান করতে পারি, আমার পরিবারের কারও জীবন আর আগের মত নেই। জীবন পাল্টে গেছে সবার।
ছ যে ঘরে আমাকে থাকতে দিয়েছেন, তা এ পর্যন্ত যত ঘরে থেকেছি তার মধ্যে সবচেয়ে ভাল। পুরু গদির বিছানা, মাথার ওপর পাখা। বিছানার পাশে টেবিল, টেবিলে টেবিলল্যাম্প। দোযখ থেকে বেহেস্তে গেলে যেমন আনন্দ হয়, ঠিক তেমন না হলেও কাছাকাছি ধরনের একরকম আনন্দ আমার হয়। বেহেস্ত বাস অনিশ্চিত বলেই বোধহয় আমার আনন্দ হলেও আনন্দ তেমন তীব্র হয় না। বেহেস্তে আমার আয়েশের জন্য বিছানা পাতা। বিছানায় পরিষ্কার চাদর। আপাতত সুনিদ্রা যাও তসলিমা, মনে মনে নিজেকে বলি। আসলে আজকাল আমি লক্ষ্য করেছি নিজেকে অনেক সময় তসলিমা বলে আমার মনে হয় না। আগের তসলিমা আর এই তসলিমাকে আমি মেলাতে পারি না। আমি তসলিমার মত দেখতেই শুধু, আর কিছু মিল দুজনের মধ্যে নেই। সেই সাহসী মেয়েটির ফাঁসি হয়ে গেছে, এখন ধুকধুক আত্মা নিয়ে বেঁচে আছে একটি ভীতু, ভীরু, ত্রস্ত, শঙ্কিত একটি নির্জীব মেয়েমানুষ, ঘোমটা মাথার মেয়ে, নত চোখের মেয়ে, গলা শুকিয়ে আসা, জিভ শুকিয়ে আসা, স্বর বুজে আসা, একটি কাতর করুণ মেয়ে। নিজের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে মনে হয় এই আমাকে হাতের কাছে পেলে মোল্লাদেরও মায়া হবে মাথাটি কেটে নিতে।
বিছানায় আধশোয়া হয়ে আজকের পত্রিকাগুলো পড়ি রাতে। সুনিদ্রা কোথায় কখন পালিয়ে গেছে আমাকে একা রেখে, টের পাইনি। মিছিলের ছবির দিকে তাকালেই গা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, টুপির সংখ্যা বাড়ছে, কালো মাথার সংখ্যাও বাড়ছে। কালো মাথা যখন সাদা মাথার সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়ায়, সেটি শুভ লক্ষণ নয়। এবারের ব্যানার
তসলিমা নাসরিনের ফাঁসি, ব্লাসফেমি এক্ট প্রবর্তন, এবং
দৈনিক জনকণ্ঠ নিষিদ্ধের দাবিতে
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল
ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতা প্রতিরোধ মোর্চা গঠনের লক্ষ্যে সমন্বয় কমিটি
বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে বা দক্ষিণ গেটে প্রথম জনসমাবেশ ঘটে, মঞ্চে বড় বড় নেতা বক্তৃতা করেন, এরপর মিছিল বেরোয় শহরের বড় বড় রাস্তায়। একটি জিনিস লক্ষ করি, বক্তৃতায় আগের চেয়ে তাপ বেশি, তেজ বেশি। লোকসংখ্যা বাড়লে মনের জোর বাড়ে, মনের জোর বাড়লে মন ক্রমে শক্ত হতে থাকে। যে যত বেশি শক্ত কথা বলতে পারে, সে তত বেশি হাততালি পায়। বিরাট সমাবেশে নেতারা বলেছেন, কুখ্যাত তসলিমা নাসরিনের ফাঁসি কার্যকর ও জনকন্ঠসহ ধর্মদ্রোহী পত্রিকাগুলো নিষিদ্ধ করতে সরকার যদি ব্যর্থ হয় তবে আগামী নির্বাচনে এই সরকার আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। জনগণের ঈমানী রোষে সরকার, তসলিমা ও জনকণ্ঠের সমর্থকদের কোনও ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ধর্মদ্রোহী তসলিমাগংদের যারাই সাফাই গাইবে তাদেরও ফাঁসি দিতে হবে। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে হলেও দ্বীনদার মুসলমানরা ধর্মদ্রোহীদের যে কোনও ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে বদ্ধ পরিকর। যে সমস্ত নেতা নেষনী ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবী তসলিমা নাসরিন ও জনকণ্ঠের সাফাই গাইছে তারা ইহুদি ও ভারতীয় দালাল। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় যে সব নেতা নেষনী কোনও প্রতিবাদ ব্যক্ত করেনি তারা এখন ইসলাম বিরোধী জনকণ্ঠের পক্ষে বিবৃতি দিয়ে বেড়াচ্ছে। ধর্মদ্রোহী ও রএর এজেন্ট জনকণ্ঠের পক্ষে বিবৃতি দিয়ে শেখ হাসিনা নিজের মর্যাদা নষ্ট করেছেন। বিরোধী দলীয় নেষনী যদি তৌহিদী জনতার সমর্থন চান, তাহলে তাঁকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এখন কথা বলার সময় শেষ, এখন ইসলাম বিরোধীদের বিরুদ্ধে জেহাদে নেমে পড়ার সময়। এটা মহরমের মাস, এই মাস বিপ্লবের মাস, এই মাস থেকে আমরা ইসলামি বিপ্লব শুরু করলাম। আমরা জ্বালাও পোড়াও চাই না। কিন্তু আমাদের জ্বালালে আমরাও তাদের জ্বালিয়ে ছাড়ব। ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এই দেশ দখল করতে পারবে না। ইনশাল্লাহ আমরা দিল্লির মসনদে ইসলামের পতাকা উত্তোলন করব। চিহ্নিত একদল নাস্তিক অখণ্ড ভারতের বুলি আওড়িয়ে দেশে বিচ্ছিতত! আন্দোলনকে উস্কানি দিচ্ছে, তাদের শেকড় উপড়ে ফেলা হবে। তসলিমা নাসরিনের ফাঁসির দাবি যদি সরকার বাস্তবায়ন না করে তবে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে হলেও ফাঁসির দাবি জনগণ বাস্তবায়ন করে ছাড়বে ইনশাল্লাহ। সভায় সকল বক্তাই এই ফাঁসির দাবিতে ৩০ জুন দেশব্যাপী হরতাল পালনের জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানান। ৬ দফা দাবির স্মারকলিপি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পেশ করে ইসলামি মোর্চা, তা হল, ১. তসলিমা নাসরিনসহ ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহীদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও ফাঁসি, ২. জনকণ্ঠ ও আজকের কাগজ সহ সকল ধর্মদ্রোহী পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষণা, ৩. ব্লাসফেমি এক্ট প্রবর্তন, ৪. এনজিওসমূহের অপতৎপরতা বন্ধ, ৫. রেডিওটিভিসহ সকল প্রচার মাধ্যমে ইসলামী আক্বিদা ও বিশ্বাসের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রচারণা বন্ধ, ৬. কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করা।
জনকণ্ঠের সঙ্গে এখন আজকের কাগজ যোগ হল। পত্র পত্রিকার সঙ্গে যোগ হল রেডিও টেলিভিশন। আমার ধারণা দিন দিন ওরা আরও অনেক কিছু যোগ করবে। এখন তাদের মুঠোর মধ্যে জনগণের ধর্মীয় অনুভূতি।
আরও খবর, নারী জাতির কলঙ্ক কুখ্যাত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে গ্রেফতার করে বিশেষ ট্রাইবুন্যালে বিচার ও জনকণ্ঠের ডিক্লারেশন বাতিল এবং ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের দাবিতে চট্টগ্রামে ঢাকার মত বিরামহীন সভা চলছে, মিছিল চলছে। নতুন আরও সংগঠন যোগ দিচ্ছে আন্দোলনে, আল্লামা তৈয়বিয়া সোসাইটি, কুতুবদিয়া ফাউণ্ডেশন , আলআমীন জামে মসজিদ পরিচালক কমিটি, বাংলাদেশ সোসাইটি অব ফর সোসাল ওয়েলফেয়ার। কেবল চট্টগ্রাম আর ঢাকায় নয়, সারা দেশেই এই হচ্ছে। জাতীয় সংগঠন বুঝি আর একটিও বাকি নেই, বাংলাদেশ মজলিসে হেফাজতে ইসলাম, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, বাংলাদেশে ইসলামী জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র, বাংলাদেশ জমিয়াতুল আনসার, মুসলিম সাহিত্য পরিষদ, মাদ্রাসাই উলুমে দ্বীনিয়া ও এতিমখানা, জাতীয়াবাদী ওলামা দল, দেশীয় চিকিৎসক ও ক্যানভাসার কল্যাণ সমিতি। আমার একটি ধারণা হয়, আন্দোলন জোরদার হচ্ছে বলে অনেকে তড়িঘড়ি কিছু সংগঠনও দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। আমার আরও একটি ধারণা, কোনও আন্দোলন যদি বলিষ্ঠ হয়, তবে লোকে উৎসাহ পায় সেই আন্দোলনে যোগ দিতে। এমন নয় যে মৌলবাদীরাই কেবল সংগঠিত হচ্ছে, অনেক অমৌলবাদী কেবল ইসলাম ধ্বসে যাচ্ছে আশংকা করে সংগঠিত হচ্ছে। এটিই মারাত্মক।
৩০ তারিখে হরতাল সফল করার জন্য টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত ধর্মপ্রাণ মানুষ জেগে উঠেছে। জামাতে ইসলামী ১৭ই জুন দাবি দিবস পালন করার ঘোষণা দিয়েছে। ফ্রীডম পার্টি আর যুব কমাণ্ড মৌলবাদী দলের দাবি সমর্থন করে ইসলামী মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজেদের রাজনৈতিক বক্তৃতা করে যাচ্ছে। এই দলের মূল শষনু আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করে বলে যাচ্ছে, ভারতীয় দালালচক্র পুনরায় দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে, শেখ হাসিনা ধর্মবিদ্বেষী তসলিমার পক্ষ সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। জামাতে ইসলামী ফ্রীডম পার্টির সঙ্গে এক মঞ্চে দাঁড়াচ্ছে। জামাতে ইসলামী বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ দু দলেরই যদিও সমালোচনা করছে, কিন্তু জামাতের নেতারা জানে আগামী নির্বাচনে দুই বড় দলের একটির সঙ্গে তাদের দলকে মেলাতে হবে। শেখ হাসিনা এখন মৌলবাদী দলের খুব বিপক্ষে যাবার চিন্তা করছেন না, কারণ আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে হারাতে হলে তাঁর দরকার জামাতে ইসলামির সহযোগিতা। এই মৌলবাদী উত্থানে আশ্চর্যভাবে শেখ হাসিনা নীরব। ক্রমাগত দোষ দিয়ে যাচ্ছেন যাবতীয় কিছুর জন্য বিএনপিকে। কিন্তু জামাতে ইসলামী বা অন্য মৌলবাদী দলের বিরুদ্ধে রা শব্দ নেই। জামাতে ইসলামীর মত মূল্যবান এ মুহূর্তে আর কোনও রাজনৈতিক দল নেই। বিএনপিও চাইছে জামাতে ইসলামীকে হাতে রাখতে। শেখ হাসিনার জন্য এ একটি অস্বস্তিকর অবস্থা, বুঝতে পারি। এখন মৌলবাদীদের জাগরণ থামাতে তিনি যদি আন্দোলনে নামেন, তবে তাঁকে ধর্মবিরোধী হিসেবে দোষ দেওয়া হবে। এই কাজটি তিনি করতে রাজি নন। কারণ মৌলবাদীর ভোট না জুটলেও তিনি দেশের পঁচাশি ভাগ মুসলমানের ভোট থেকে বঞ্চিত হতে চান না। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করার বিরুদ্ধে বললেও তসলিমার মামলার বিরুদ্ধে তিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। কারণ জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের গায়ে ধর্মহীনতার কালি তত নেই, যত আছে তসলিমার গায়ে। মূলত জনকণ্ঠের সাংবাদিকরা সকলেই আস্তিক, তাঁদের কেউ কখনও কোনওদিন দাবি করেননি যে তাঁরা ধর্মপ্রাণ মুসলমান নন। তসলিমার পক্ষে মুখ খুললে হাসিনার কোনও লাভও নেই, কারণ তসলিমার কোনও দল নেই, জনসমর্থন নেই।
গতকাল সংসদে তসলিমা নাসরিন প্রসঙ্গ উঠেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরীকে ব্যাখ্যা করতে হয়েছে যে আমার পাসপোর্ট আটক করা হয়েছিল এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। আমার অপকর্মের জন্য এই মামলা করার আগেও যে এই সরকার আমাকে কিছু শাস্তি দিয়েছে সে সম্পর্কে বলে তিনি প্রশ্নকারী সাংসদদের শান্ত করেন। এদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি ও জাতীয় সমন্বয় কমিটির ঢাকা মহানগরীর আহবায়ক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া উর্দুভাষী স্বরাষ্ট্র সচিবের অপসারণ দাবি করে বিবৃতি দিয়েছেন। বলেছেন, বাঙালিরা বুকের রক্ত দিয়ে লড়াই করে মাতৃভাষা বাংলা ভাষাকে অর্জন করেছে। স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের একজন সচিব হয়ে রাষ্ট্রীয় ভাষাকে অস্বীকার, হেয় প্রতিপন্ন, অবমাননা করে সচিব বলেছেন যে তাঁর মাতৃভাষা বাংলা নয়, উর্দু, এতে প্রমাণ হয় যে তিনি এ দেশের নাগরিক নন। একজন বিদেশী নাগরিক, ভিন্নভাষী রাষ্ট্রীয় উμচপদে ক্ষমতায় থাকতে পারে না।
ছোট খাটো ভুল ষনুটি ধরে ছোট খাটো দল প্রতিবাদ করছে। কিন্তু মূল যে ইস্যু ইসলাম, সেটি নিয়ে কথা বলার সাহস কোনও দলেরই নেই। কেউ জোর বলতে পারছে না যে না আমরা ইসলামি শাসন চাই না, ব্লাসফেমির বিরুদ্ধে আইন চাই না, তসলিমা ধর্মদ্রোহী হলেও তাঁর ফাঁসি আমরা চাই না। আমরা বাক স্বাধীনতায়, মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাস করি। যদি ধর্মের গীত গাওয়ার অধিকার থাকে মানুষের, ধর্মের সমালোচনা করারও অধিকার তেমন আছে।
আজকের আরেকটি খবর, মৃত্যুর হুমকি থেকে বাঁচার জন্য তসলিমার পরিবার আইনবিদদের সাথে আলোচনা করছেন।
মৃত্যুর হুমকি আমার পরিবারও পাচ্ছেন। আমার মৃত্যু হয় হোক, আমার কারণে কেন নিরপরাধ কিছু মানুষের মৃত্যু হবে! চোখে কি জল জমছে আমার। জমছে। দুফোঁটা জল পত্রিকায় মৃত্যুর হুমকি শব্দদুটোর ওপর টুপ করে পড়ে। তসলিমার পরিবার — এই শব্দদুটোয় আমি আলতো করে আঙুল রাখি। যেন স্পর্শ করছি আমার বাবাকে মাকে, স্পর্শ করছি দাদাদের, স্পর্শ করছি ইয়াসমিনকে, ভালবাসাকে। জীবনে আর হয়ত ওদের সঙ্গে দেখা হবে না আমার। তাই স্পর্শ করি। মা নিশ্চয়ই কাঁদছেন দিন রাত। বাবার চোখে তো জল কখনও দেখা যায় না, এ সময় তিনিও সম্ভবত কাঁদছেন। কাঁদছে ইয়াসমিন। বাড়িতে নিশ্চয়ই নাওয়া খাওয়া বন্ধ সবার। আমার কি হয় সেই ভয় তো আছেই, তার ওপর এখন নিজেদের কি হয় তা নিয়েও আশঙ্কা। গভীর গম্ভীর আশঙ্কার সঙ্গে মানুষ কতদিন একটানা বাস করতে পারে!
চোখের জল কাগজে আরও পড়ে, যখন পড়ি কুমিল্লার ছোট একটি শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছোট একটি গ্রাম নাসিরনগর থেকে ছোট একটি মানুষ আজহারুল ইসলাম সরকারের লেখা ছোট একটি পত্রিকা সংবাদে ছোট একটি চিঠি–সরকারের বোধগম্য হওয়া উচিত যে মোল্লাতন্ত্রের ফতোয়ায় সমগ্র দেশ আজ আক্রান্ত। সেই ফতোয়াবাজদের মদদে সরকার যদি তসলিমা নাসরিনকে গ্রেফতার করেন তবে জাতির বিবেক কলঙ্কিত হবে। মুক্তচিন্তার স্বাধীনতায় কারও হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। তাই এসব অপতৎপরতা বন্ধে এবং জননন্দিতা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহারের জোর দাবি জানাচ্ছি।
৩. অতলে অন্তরীণ – ১১
চৌদ্দ জুন, মঙ্গলবার
সকালে আমার ঘরে ট্রেতে করে নাস্তা এল। রুটি তরকারি ডিম। ছ আমাকে এত সমাদর না করলেও পারতেন, কিন্তু ছ করেন। তিনি আমার নোংরা কাপড় ধুতে দেবার জন্য বলেন। ঘরের ভেতর ঘোমটায় মাথা ঢেকে বসে থাকার যুক্তি নেই, বলেন। ফাঁক ফোকর! নাহ ফাঁক ফোকর দিয়ে কেউ দেখতে পাবে না। কাজের লোক! কাজের লোকের সাহস হবে না কোনও কিছু রাষ্ট্র করা। তিনি নিজের কথা অনেকক্ষণ বললেন, ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু লেখাপড়া ছাড়েননি। জীবনে অনেক বাধা এসেছে, সব বাধা অতিক্রম করেছেন নিজের একার মনোবল দিয়ে। শুনতে খুব ভাল লাগে সাহসী মেয়েদের কথা। আমি মন দিয়ে শুনি তিনি কেমন কেমন বাধার মুখোমুখি হয়েছেন, কেমন করেই বা ডিঙিয়ে এসেছেন। বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা হয়েছে, স্বামী অত্যাচার শুরু করলে স্বামীকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, ডিগ্রি নিয়েছেন, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। কারও কোনও কুকথার পরোয়া করেননি। তিনি একটি নারী উন্নয়ন সংস্থা খুলেছেন, নিরক্ষর মেয়েদের জন্য এই সংস্থার ইশকুল আছে। সেলাইএর, বুননের কাজও দিয়েছেন বেকার মেয়েদের। বললেন, মেয়েদের জন্য কিছু করতে চাও তো তোমার যেতে হবে গ্রামে, গ্রামের মেয়েরা অসম্ভব পরিশ্রমী, ওরা শিক্ষিত হলে, স্বনির্ভর হলে দেশে কোনও সমস্যা থাকবে না। আমি সায় দিই ছর কথায়। এত বড় কাজ করার সুযোগ আমার কখনও হয়নি। এখন তো বেঁচে থাকারই সুযোগ হচ্ছে না। লেখালেখি না করে গ্রামের মেয়েদের স্বনির্ভর করার কাজে সাহায্য করলে সত্যিকার কিছু করা হত, আমি বুঝি। নিজেকে বড় তুচ্ছ মনে হয়, বড় অপদার্থ মনে হয়।
ছ র পড়া শেষ হলে আজকের দুটো পত্রিকা ছ আমাকে পড়তে দেন। ৩০শে জুন হরতাল সফল করার আহবান জানানো হচ্ছে দেশের সমস্ত অঞ্চল থেকে। হরতালের কথা প্রথম তুলেছিল ইয়ং মুসলিম সোসাইটি, এরপর হরতালের প্রস্তাবটি খাচ্ছে দেশের সব মৌলবাদী রাজনৈতিক অরাজনৈতিক দল। দেশের সর্বত্র সভা মিছিল চলছে হরতাল সফল করার দাবিতে। মসজিদের নিরাপদ আঙিনা ছেড়ে মৌলবাদীরা এখন সভা করছে তাদের দাপট নেই এমন এলাকাতেও। ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় গতকালের সভায় মুফতী আমিনী বলেছেন, মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পাবার জন্য তসলিমা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। স্পীকারের কাছে লেখা আমার চিঠি সম্পর্কে বলেছেন যে আমি কোরান সংশোধনের কথা এখন অস্বীকার করছি, ভয়ে করছি। বলেছেন, সামান্য অপরাধের কারণে সরকার যদি আসামীদের গ্রেফতার করার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করতে পারে, তবে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পবিত্রতম গ্রন্থ সম্পর্কে ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি করার অপরাধে তসলিমাকে গ্রেফতারে পুরস্কার ঘোষণার বাধা কোথায়? ২৫শে জুন সকাল ১১ টায় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয় মুফতীর দল থেকে। বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র পরিষদের সভায় বলা হয়েছে, কুখ্যাত লেখিকা মুরতাদ তসলিমা নাসরিনকে রহস্যজনক ভাবে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। পরিস্থিতি বেশিদূর অগ্রসর হতে না দিয়ে এখনও সময় আছে তাকে গ্রেফতার করে বিচার করা হোক। তসলিমার ফাঁসির দাবিতে আগামীকাল সংসদ ভবন ঘেরাও করার জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলমান ভাইদের তিনি আহবান জানিয়েছেন। সচেতন মুসলিম যুব ফোরাম, মান্দারপুর ইসলামি পাঠাগার, পাঞ্জেরী পাঠাগার হরতাল সমর্থনের বিবৃতি দিয়েছে। পাঠাগারের লোক পর্যন্ত সংগঠিত হচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় উত্তেজনা এখন। এ কিসের লক্ষণ! আরও একটি বিবৃতি আমাকে কাঁপিয়ে দেয়। ১০১ জন আইনজীবী তসলিমার গ্রেফতার ও বিচার দাবি করেছে। ইত্তেফাকের খবরটি এরকম, বাংলাদেশে সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের ১০১ জন আইনজীবী গতকাল সোমবার এক যুক্ত বিবৃতিতে ইসলামের শষনুদের মদদ যোগাইতে পবিত্র কোরান শরীফ সম্পর্কে তসলিমা নাসরিনের অবমাননাকর উক্তিতে মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনায় চরম আঘাত ও সমাজকে উμছৃঙ্খলতার দিকে ধাবিত করার অপপ্রয়াসে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। আইনজীবীগণ ভবিষ্যতে এই ধরনের কাজ করিতে কেহ যেন সাহস না পায় উহার দৃষ্টান্ত সৃষ্টির জন্য অবিলম্বে তসলিমাকে গ্রেফতার ও বিচারের মাধ্যমে তাহাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদানের দাবি জানান। তাহারা বলেন, অন্যথায় উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য সকল দায় দায়িত্ব সরকারকেই বহন করিতে হইবে। বিবৃতিদানকারী আইনজীবীদের মধ্যে রহিয়াছেন এস এম আবুল কাসেম, সাবেক বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহাব, ব্যারিস্টার শহীদ আলম, ব্যারিস্টার সৈয়দ এমদাদুর রহমান, ব্যারিস্টার ফরিদ উদ্দিন, মোঃ রেজা, ব্যারিস্টার কোরবান আলী, মোঃ গোলাম মাওলা বকুল, মুঃ খলিলুর রহমান রোকনী, সৈয়দা মায়মুনা বেগম ও মোঃ মাহমুদ হোসেন।
আরও একটি খবর, প্রকাশ্যে জনসমাবেশে লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে হত্যার হুমকি ও তার মাথার দাম ঘোষণা করে তাকে হত্যা করতে অন্যকে প্ররোচিত করার অভিযোগে লেখিকার ভাই ফয়জুল কবীর নোমান গতকাল খুলনা মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে ৯ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেছেন। .. দাদা খুলনা গিয়েছেন মামলা করতে। মুফতী সৈয়দ নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা, যে মুফতী সেদিন আমার মাথার মূল্য এক লক্ষ টাকা ঘোষণা করেছে। মামলা করার সিদ্ধান্তটি কবে কখন নেওয়া হল, কে নিল কিছুই আমি জানি না। আমি ধারণা করি, উকিলের আপিস থেকেই দাদাকে পাঠানো হচ্ছে খুলনায়। বুক ভরে শ্বাস নিই। এই শ্বাসের সঙ্গে একটি শক্তি আমার শরীরে নেমে আসে। হাতদুটো মুষ্ঠিবদ্ধ করতে পারি অনায়াসে। হাতের মুঠিদুটো আলগা হয়ে আসে যখন খুলনায় দাদার নিরাপত্তাহীনতার কথা ভাবি। দাদার ওপর অভিযোগ ছিল আমার অনেক, বিয়ের পর তাঁর হঠাৎ বদলে যাওয়া, অসহ্য রকম কৃপণ হয়ে যাওয়া, স্বার্থপর হয়ে যাওয়া। আজ দাদাকে তাঁর সব অন্যায়ের জন্য আমার ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে করে। আজ মনে হয় দাদা সত্যিই আমাকে ভালবাসেন, সেই ছোটবেলায় যেমন ভালবাসতেন, তেমন আজও। সেই যে আমার জন্য জামার কাপড় কিনে আনতেন, শীলার কাছে দিতেন নানারকম কায়দা করে জামা বানিয়ে দেবার জন্য, সেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের খাবার পয়সা বাঁচিয়ে ফুটপাত থেকে পুরোনো জামা কিনে আনতেন, রঙ কিনে দিতেন ছবি আঁকার জন্য, আমার আঁকা রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের ছবি টাঙিয়ে রেখেছিলেন দেয়ালে, সেই যে নিজে কবিতা লিখে আমার নামে ছেপে দিতেন তাঁর পাতা পত্রিকায়, চিত্ররূপা স্টুডিওতে সঙ্গে নিয়ে ছবি তুলতেন, সিনেমায় নিয়ে যেতেন, সেই যে সেঁজুতির পাণ্ডুলিপি নিয়ে যেতেন প্রেসে, টাকা দিতেন সেঁজুতি ছাপার, এই দাদাকে আমার সেই দাদা বলে মনে হয়। দাদার সঙ্গে কখনও কি আমার আবার দেখা হবে! খুব ইচ্ছে করে তাঁকে দেখতে। কিন্তু সে কি এ জীবনে আর সম্ভব! আমার সঙ্গে কারওরই কি আর দেখা হবে! পত্রিকাগুলো সরিয়ে আমি শুয়ে থাকি, শৈশব কৈশোর এসে আমার হৃদয় জুড়ে গোল্লাছুট খেলে। গোল্লাছুট খেলাটি হঠাৎ থেমে যায়, যখন চোখ পড়ে সাহাবা সৈনিক পরিষদের কর্মসূচিতে। সিলেটে সাহাবা সৈনিক পরিষদের জনসভায় ২৩ জুন সিলেটে অর্ধদিবস হরতাল পালনসহ দু সপ্তাহের লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, আজ মঙ্গলবার ১৪ই জুন থেকে ১৬ই জুন পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সাথে যোগাযোগ ও মতবিনিময়, ১৭ জুন বেলা দুটোয় পরিষদ কার্যালয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময়, ১৮ থেকে ২১ জুন জনসংযোগ সপ্তাহ পালন, ২২ জুন হরতালের সমর্থনে মিছিল ও সমাবেশ এবং ২৩ জুন অর্ধদিবস হরতাল।
বাহ চমৎকার। খালি মাঠ পেয়েছো, খেলে যাও। গোল দিয়ে যাও যত ইচ্ছে। তোমাদের তো বাধা দেওয়ার কেউ নেই। বীভৎস কাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে! প্রতিদিন, তোমাদের কোনও বিরোধী দল তোমাদের মত পথে নামছে না আজও। সুতরাং জয় তোমাদের। মেরে ফেলো আমাকে। মেরে ফেলো যত বুদ্ধিজীবী আছে দেশে সবাইকে, বন্ধ করে দাও প্রগতির পক্ষের সব পত্রিকা। আইন আনো ব্লাসফেমির বিরুদ্ধে। ইসলামি শাসন কায়েম কর। মেয়েদের ধরে ধরে পুড়িয়ে ফেলো, পাথর মারো। তোমাদের জয় হবেই ইনশাল্লাহ।
দুপুরে খাবার দিয়ে যায় কাজের মহিলা। গোগ্রাসে শুরু করি। ফাঁসির আসামীদের তো ভাল খেতে হয়। খেয়ে নাও তসলিমা, মাছ মাংস খেয়ে নাও, কাল হয়ত তোমার আর খাবার সুযোগ হবে না। বলি কিন্তু খেতে গিয়ে দেখি পারছি না। সুস্বাদু খাবার, কিন্তু খেতে ইচ্ছে করে না, দুমুঠো খেয়েই মনে হয় গলা পর্যন্ত ভরে গেছে খাবারে। বমি বমি লাগে।
বিকেলে ভেজানো দরজা খুলে ছ ঢোকেন ঘরে।
চল, বারান্দায় বসবে চল।
বারান্দায়? চমকে উঠি প্রস্তাব শুনে।
ঘরের মধ্যে যার লুকিয়ে থাকতে হয় দরজা জানালা বন্ধ করে, সে কিনা বাইরের আলো দেখবে! মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিয়ে ছর পেছন পেছন গিয়ে বারান্দার একটি চেয়ারে বসতে হয়। ভেতর বারান্দাতেই তিনি আমাকে ডেকেছেন বসতে। এখানে বসলে আশেপাশের বাড়ি থেকে কারও দেখার সুযোগ নেই। চেয়ারে হেলান দিয়ে তিনি বলেন, আমার বাড়িতে কত আণ্ডারগ্রাউণ্ড পার্টির লোক এসে থেকেছে। আমি জানি কি করে তাদের রাখতে হয়।
এরপর তিনি বলতে থাকেন সেই কথাগুলো, যেগুলো আজ সকালেই তিনি বিস্তারিত বলেছেন। কি করে তিনি এই জায়গায়, যেই জায়গায় তিনি এখন, এসে পৌঁছলেন, কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাঁর, মনের জোর তাঁর কি রকম প্রচণ্ড ছিল।
হঠাৎ বললেন, আমি একটা জিনিস বুঝতে পারি না, তোমার মত নিরীহ মেয়ে, যার গলায় স্বর নেই, মনে তেজ নেই, তোমাকে মোল্লারা মারতে চায় কেন?
আমি মাথা নত করি।
জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী লেখ যে মোল্লারা ক্ষেপে যায়?
–ওই ধর্ম নিয়ে লিখেছিলাম বলে।
–ধর্ম নিয়ে কী লিখেছিলে?
–আসলে ধর্ম তো মেয়েদের স্বাধীনতার পথে বাধা ..
ধমকে ওঠেন ছ। –কে বলল তোমাকে বাধা?
ধমকে চমক লাগে।
–আমার যে এনজিওতে এত মেয়েরা কাজ করে, গ্রামের মোল্লারা কি কোনও রকম অসুবিধা করতে পেরেছে? চেয়েছিল দুএকবার, পারেনি। আমি সোজা মসজিদের ইমামের কাছে গিয়েছি কোরান নিয়ে। কোরানের সুরা পড়ে পড়ে তর্জমা করে দিয়ে এসেছি, বলেছি এই দেখ কি লেখা, এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে মেয়েদের অধিকারের কথা..। কোরান তারা আমাকে শেখাবে কি, আমিই তাদের শিখিয়েছি।
–তাহলে কি আপনি মনে করেন যে ধর্মীয় আইনে মেয়েদের ..
আমি কথা শেষ করতে পারি না, তিনি বলেন, এ দেশে যে ধর্মীয় আইন আছে, তা যদি মেনে চলা হত, মেয়েদের ৯০ ভাগ দুর্দশাই কেটে যেত।
–ধর্মীয় আইনে তো….
–তালাক হলে স্ত্রীকে খরপোষ দেওয়ার কথা আছে। কজন স্বামী খরপোষ দেয় স্ত্রীকে? দেয় না। মেয়েরাও জানে না যে এত ভাল আইন তাদের পক্ষে আছে। বিয়ের সময় যে দেনমোহরের কথা বলা হয়, কজন স্বামী দেনমোহর দেয় স্ত্রীকে? দেয় না। আইন অমান্য করে। মেয়েরা যদি জানত এইসব আইনের কথা, তারা মামলা করতে পারত স্বামীদের বিরুদ্ধে। চার বিয়ের কথা বল? কোরানে স্পষ্ট লেখা আছে, যদি চারজন স্ত্রীর প্রতি সমান ব্যবহার করতে না পারো, তবে চারটে বিয়ে করবে না, একটি করবে। এটাই তো প্রমাণ যে চারটে বিয়ে না করার জন্য বলা হয়েছে। কোন স্বামী পারবে তার চার স্ত্রীকে একইরকম মর্যাদা দিতে, একই রকম ভালবাসতে? পারবে না, নতুন বউএর প্রতি তাদের বেশি আকর্ষণ থাকবে। না, ধর্ম আমাদের জন্য কোনও সমস্যা নয়। সমস্যা হল অর্থনৈতিক সমস্যা। মেয়েরা যদি শিক্ষিত হয়, স্বাবলম্বী নয়, তবেই তাদের সব সমস্যা দূর হবে। ধর্ম তো কাঠমোল্লাদের নয়, ধর্ম আমাদের। আমাদের দাবি করতে হবে যে আমরা ধর্ম মানি। ধর্মকে বাজে লোকের সম্পত্তি করতে দিলেই তারা বাজে ভাবে ধর্মের ব্যাখ্যা করবে। ইসলাম ধর্মে মেয়েদের যত মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, অন্য অনেক ধর্মেই তত মর্যাদা দেওয়া হয়নি। মেয়েরা উত্তরাধিকার সূষেন বাপের সম্পত্তি পায়, হিন্দু ধর্মে তো তা পায় না, ভারতে আইন করতে হয়েছে মেয়েদের সম্পত্তি দেবার জন্য। ইসলাম ধর্মে আছে যে সম্পত্তির ভাগ মেয়েদের দিতে হবে, কজন মেয়ে সেই সম্পত্তি সত্যিকারের পায়? পায় না, কেন পায় না? কারণ তাদের দেওয়া হয় না। ধর্মে যে অধিকারগুলো আছে, সেই অধিকার পাওয়ার জন্য আগে চেষ্টা করতে হবে। হঠাৎ করে তুমি ধর্মীয় আইন পাল্টে ফেলে একটা সমান অধিকারের আইন চালু করলে, তাতে কী হবে মনে করছো? মনে করছো ব্যাস এখন থেকে আর কোনও বৈষম্য থাকবে না সমাজে? ভুল।
আমি মন দিয়ে শুনি ছ র কথা। আমার মনে হয় না ছ কিছু ভুল বলছেন, বিশেষ করে সমান অধিকারের আইন চালু করলেই যে নিমেষে বৈষম্য দূর হবে না সে কথা। বৈষম্য তো পিতৃতান্ত্রিক সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এত সহজে এই সমাজে নারী তার অধিকার পাবে, তা আমিও মনে করি না। তারপরও আমাকে যেন তিনি ভুল না বোঝেন আমি বলি, তাঁর বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরের পাশে আমার কণ্ঠটি বড় মৃদু, বড় নরম, বলি যে আমি কেবল ধর্ম সম্পর্কে লিখেছি তা নয়, মেয়েদের শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা লিখেছি। শিক্ষা আর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার পাশাপাশি সমঅধিকারের আইনও যদি থাকে তবে তো আরও ভাল। সেই আরও ভাল অবস্থার জন্য আমার স্বপ্ন ছিল।
–স্বপ্ন স্বপ্ন স্বপ্ন …. বসে বসে স্বপ্ন দেখলে কচু হবে। কাজ করতে হবে। বাস্তব জগতের মুখোমুখি হতে হয়। হয়েছো কখনও? কখনও গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেছো? কথা বলতে হবে তাদের ভাষায়। জানো তাদের ভাষা? আমি চুপ করে থাকি। মাথাটি ধীরে ধীরে নত হতে থাকে।
–দেশের আশি ভাগ মেয়ে অশিক্ষিত। তুমি যে দাবি করছ তুমি মেয়েদের জন্য লেখ, কজন মেয়ে তোমার লেখা পড়তে পারে? কোন মেয়েরা তোমার লেখা পড়ছে? লেখাপড়া জানা মেয়েরা পড়ছে। লেখাপড়া জানা মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ থাকে, তারা যদি সুযোগ না নেয়, তবে সেটা তাদের দোষ। যাদের স্বাবলম্বী হওয়ার ইচ্ছে, যাদের সুযোগ নেই, তাদের সাহায্য করতে হবে।
হঠাৎ উঠে পড়লেন ছ। অনেকক্ষণ বসে থাকলে পিঠে তাঁর যন্ত্রণা হয়। তাঁর এখন শুয়ে বিশ্রাম নিতে হবে দু ঘণ্টা।
আমি উঠে যাই ঘরে। ঘরে বসে থাকি। নিজেকে বড় তুচ্ছ, বড় অকর্মণ্য, বড় বোকা বলে মনে হতে থাকে। নিজের ওপর আমার রাগ হতে থাকে, ঘৃণাও হতে থাকে। নিজের দু গালে দুটো চড় কষাতে ইচ্ছে করে।
৩. অতলে অন্তরীণ – ১২
পনেরো জুন, বুধবার
ঙ আসেন ছর বাড়িতে। ঙ ছকে চেনেন ভাল করে। একসময় তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী ছিলেন। ছ ঙকে তাঁর ঘরে নিয়ে সেই তাঁদের আগের সময়ের গল্প করেন। দীর্ঘক্ষণ। এত জোরে কথা বলেন ছ যে আমার ঘর থেকে সেসব কথা শোনা যায়। ঙ কি বলছেন, তা শুনতে চেয়েও পারি না, ঙর স্বর অনেক খাদে। ছর গল্পের মধ্যে খানিকটা ফাঁক পেয়ে ঙ আমার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চান ছর কাছে। অনুমতি পেলে ঙ আমার ঘরে ঢোকেন। ঙকে দেখে কি যে ভাল লাগে আমার! একদমে জিজ্ঞেস করি, জামিনের খবর কি কিছু জানেন? ক কি জানেন জামিন হবে কি না? উকিলের কাছে ক বা আপনি কেউ গিয়েছিলেন? মৌলবাদীদের এই উত্থান ঠেকাতে কোনও দল কি পথে নামবে না? কর কাছে কি আমার দাদারা কেউ গিয়েছিলেন? আমার বাড়ির মানুষগুলো কি বেঁচে আছে? আমার উকিল কি আশা ছেড়ে দিয়েছেন? জনকণ্ঠের সাংবাদিকদের তো জামিন হয়েছে, আমার হবে না কেন?
ঙর কপালে বিন্দু বিন্দু দুশ্চিন্তা। ঙ আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি, কেবল বললেন, এই সময়ে কি করা উচিত আমাদের, কিছু বুঝতে পারছি না। জামিনের ব্যাপারে তোমার উকিল এখনও এগোতে পারছেন না।
হঠাৎ ছ চিৎকার করে ঙকে ডাকলেন। ঙকে আমার ঘর ছাড়তে হল। ছ চা খেতে ডেকেছেন ঙকে। ও ঘরে চা বিস্কুট দেওয়া হয়েছে। আমার খুব ইচ্ছে করছিল ছর ঘরে আমিও যাই, কিন্তু আমাকে না ডাকলে আমার যে ওঘরে ঢোকা উচিত হবে না। আমি একটি ডাকের অপেক্ষায় থাকি। অপেক্ষায় থাকি ঙ আবার আমার ঘরে ঢুকবেন। অপেক্ষার অস্থিরতা একবার আমাকে বিছানা থেকে উঠে চেয়ারে বসায়, চেয়ার থেকে আবার বিছানায়। আধঘন্টা পার হলে ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে উঁকি দেন ছ, ছর ঘাড়ের পেছনে ঙর মাথা। ছ বললেন, ঙ চলে যাচ্ছেন। ঙ পেছন থেকে কেবল বললেন, যাচ্ছি তসলিমা।
ঙর কপালে তখনও বিন্দু বিন্দু দুশ্চিন্তা। আমার চোখের আকুলতাটি ঙ পড়তে পারেন। আমিও পড়তে পারি ঙর ব্যগ্রতা আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার। কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের সে সুযোগ দেয় না।
ছ কি কারণে আমাকে ঙর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে দিলেন না, তা আমি বুঝতে পারি না। ঙ তো এ বাড়িতে আমার সঙ্গে দেখা করতেই এসেছিলেন। ঙর জন্য মায়া হয় আমার। ঙ চলে গেলে ছ আমার ঘরে এলেন। বসে তিনি বলতে লাগলেন, কি করে তিনি নিজের পায়ে দাঁড়ালেন, কে কে তাকে সাহায্য করেছিল, কে কে করেনি, তাঁর কন্যারা কে কোথায়, কি করছে ইত্যাদি। ছ র কন্যারা বড় বড় ডিগ্রি নিয়েছে, বড় বড় কাজ করছে। কেউ দেশে থাকে, কেউ বিদেশে থাকে। ব্যস্ত জীবন তাদের। ছর জীবন খুব সার্থক জীবন। খুব সুখী তিনি। অতৃপ্তির লেশমাত্র নেই। কিছু পাওয়া হয়নি বলে কোনও আফসোস নেই ছর। ছ জীবনে যা চেয়েছিলেন, তারও চেয়ে বেশি পেয়েছেন। এত সুখী তৃপ্ত মানুষটির দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে হঠাৎ আমার মনে হয় সব অর্জন করা ছ তাঁর পিঠের যন্ত্রণার মত একটি সূক্ষ্ম একাকীত্বের যন্ত্রণাতেও ভোগেন।
৩. অতলে অন্তরীণ – ১৬
উনিশ জুন, রবিবার
শামসুর রাহমান কলাম লিখেছেন ভোরের কাগজে, নইলে বড় বেশি দেরি হয়ে যাবে। শুরুতে বলেছেন জ্ঞআমরা যারা লেখক শিল্পী এবং সাংবাদিক তারা আজ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন এবং বিপন্ন। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষে আমরা স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। পথে নেমেছি, বহু ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করেছি আমরা। .. স্বৈরশাসককে হটিয়ে আমরা উল্লসিত হয়েছিলাম, তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়িত হবে ভেবে আশান্বিত হয়েছিলাম। .. জনগণের রায়ে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হল। বহুদিন পর গণতন্ত্রের উজ্জ্বল মুখ দেখার আশায় উদগ্রীব হয়ে রইলাম। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়েই বেমালুম ভুলে গেল তিন জোটের রূপরেখার কথা। গণতন্ত্রের লেবাসের আড়ালে স্বৈরাচারই বহাল রয়েছে। বর্তমান সরকারের ক্রিয়া কলাপে আজ গণতন্ত্র সঙ্কটাপন্ন। গণতন্ত্রের একটি প্রধান শর্ত বাক স্বাধীনতা। প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাক স্বাধীনতা খর্ব করার কোনও অবকাশ নেই। যত মত তত পথ। প্রত্যেকেরই নিজের মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। ঈশ্বরে বিশ্বাসী কোনও ব্যক্তি যেমন নিজের মত প্রকাশ করতে পারবেন, তেমনি একজন নিরীশ্বরবাদীও স্বমত প্রকাশ করতে পারবেন। নিজ নিজ মত প্রকাশের জন্যে কেউ নিগৃহীত, উৎপীড়িত হবেন না — এটাই গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবাই সমান অধিকার ভোগ করবেন। আস্তিক এবং নাস্তিকের অধিকার অভিন্ন থাকবে। ফরাসি লেখক ভলতেয়ার বলেছেন, তোমার মতের সঙ্গে আমি একমত নই, কিন্তু তুমি যাতে অকুণ্ঠচিত্তে নিজের মত প্রকাশ করতে পারো, সেজন্যে আমি আমার রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে লড়ব। ভলতেয়ারের এই অমর উচ্চারণ প্রকৃত গণতন্ত্রেরই বাণী। কিন্তু আমাদের দেশে কী হচ্ছে? সত্যিকার গণতন্ত্রচর্চা কি হচ্ছে এখানে? সখেদে বলতে হচ্ছে, না। মত প্রকাশের জন্য খণ্ডিত হচ্ছেন লেখক ও সাংবাদিক। মসিজীবীদের ওপর সবসময় খাঁড়া ঝুলছে। কবে কার গর্দান যাবে, কেউ বলতে পারে না। যে লেখক যা বলেননি তা লেখকটির ওপর আরোপ করে তাঁকে দণ্ড দেওয়া হচ্ছে। এখানে স্বাভাবিকভাবে তসলিমা নাসরিনের কথা এসে পড়ে। . .’ এরপর আমার প্রসঙ্গে কিছুক্ষণ বলে সাংবাদিকদের প্রসঙ্গে আসেন, আহমদ শরীফের বাড়িতে হামলার প্রসঙ্গ টানেন। তারপর বলেন, ‘বিএনপি সরকার দেশটিকে ফতোয়াবাজ ও মৌলবাদী দলগুলোর কাছে বন্ধক দিতে আদা জল খেয়ে লেগেছেন। যারা বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে ছিল আগাগোড়া, যাদের নেতা (গোলাম আযম) বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও বিদেশে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, যারা একাত্তরে ভুল করিনি সগর্বে বলে বেড়ায়, তারাই যখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তিদের দেশদ্রোহী আখ্যা দেয়, তখন তাদের কী আখ্যা দেওয়া যায় তা জনসাধারণের উপরই রইল।’ এরপর, আগাগোড়া নাস্তিক শামসুর রাহমানকে খানিকটা ডিপ্লোমেট হতে হয়, তিনি বলেন, ‘ইসলাম, আমরা জানি, শান্তির ধর্ম। ইসলামের নামে যারা অশান্তির সৃষ্টি করে, ক্ষমতা দখলের জন্যে ধর্মান্ধতার আশ্রয় নেয়, ধর্মকে ব্যবহার করে সওদাগরের মত তখন কি আমরা মারহাবা মারহাবা বলে উল্লাসে ফেটে পড়ব? ইসলাম বিপন্ন, এ কথা সেই শৈশবকাল থেকে শুনে আসছি। যারা প্রকৃত আলেম এবং ধার্মিক, তাঁরা বোঝেন ইসলাম রক্ষার সর্বশক্তি আল্লাহতালার আছে। ইসলামের বিপন্নতা ঘোচানোর অজুহাতে কারো ইসলামের রাখওয়ালা সেজে অন্যদের শান্তি নষ্ট করার, দাঙ্গা ফ্যাসাদ করার কোনও প্রয়োজন নেই। যাকে তাকে মুরতাদ বলে গলাবাজি করাও নিরর্থক। যারা কোনও লেখকের মাথার বিনিময়ে লক্ষ টাকা ঘোষণা করে প্রকাশ্য জনসভায়, সর্বক্ষণ সরলমতি মানুষকে প্ররোচিত করে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার জন্যে, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আবর্জনা বলার ঔদ্ধত্য দেখায়, হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে, সেসব ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে সরকার কেন গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করেন না? কাউকে হত্যা করতে উৎসাহ দান কি দণ্ডনীয় অপরাধ নয়? সরকারের কাছে আমাদের আরেকটি প্রশ্ন, আপনারা হরতাল বিরোধী, হরতাল হলে আপনাদের উন্নয়নের জোয়ারে ভাটা পড়ে, এমন কথা জোরে শোরে বলে থাকেন। কিন্তু ৩০ জুন যে তথাকথিত হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে আপনারা নিশ্চুপ কেন? এই হরতাল সফল করতেই যেন নীরবে সমর্থন জানাচ্ছেন তাদের প্রতি। ..’
শেষের এই কথাগুলি খুব প্রয়োজনীয়। –‘যে প্রতিক্রিয়াশীল, ফ্যাসিবাদী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির দাপট বাড়ছে বৈ কমছে না, তাদের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির প্রতি। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের প্রতি। এই অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করতে না পারলে বিপণ্ন হবে আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি। মানবতাবাদী, প্রগতিশীল চিন্তাধারা রুদ্ধ হয়ে যাবে। আমরা নিমজ্জিত হব মধ্যযুগীয় অন্ধকারে, কূপমণ্ডুকতায় আবিল হয়ে উঠবে আমাদের জীবন। যাদের পূর্বসুরীরা কাজী নজরুল ইসলামের মত মহৎ প্রাণ কবিকে কাফের আখ্যা দিতে পারে, তারা এ দেশের সৃজনশীল লেখক ও ভাবুকদের বাকরুদ্ধ করতে এতটুকু দ্বিধা করবে না। এখন থেকেই সেই পাঁয়তারা চলছে তাদের। আমরা কি এদের বশ্যতা স্বীকার করবো, না কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো, এর সদুত্তর এই মুহূর্তেই দিতে হবে আমাদের। নইলে বড় বেশি দেরি হয়ে যাবে। যেসব ফতোয়াবাজ মনে করে যে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলা তারা ফণা তুলেছে, সেই ফণা দেখিয়ে অনেককে দলে টানার অপচেষ্টায় মেতেছে। সূক্ষ্ম রাজনৈতিক তত্ত্ব বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে এখন ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই ফণার ছোবল থেকে বাঁচাতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগে অর্জিত আমাদের প্রাণের স্বদেশকে পাকিস্তান বানানোর চক্রান্তকে নস্যাৎ করতে হবে।’
আজ কবীর চৌধুরী আর সৈকত চৌধুরী দুজন মিলে একটি কলাম লিখেছেন আজকের কাগজে। মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়? এই প্রশ্ন তাঁদের। কলামটি আমার প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছেন, মামলার ব্যাপারটি তুলে মন্তব্য করেছেন, আবেগ এবং যুক্তির কথা বলেছেন। জ্ঞধর্ম পুরোপুরিভাবেই ব্যক্তির আবেগ, অনুভূতি ও বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে সঞ্চারিত হয়, মানুষ যখন আবেগের স্রোতে গা ভাসায়, তখন যুক্তির চোখ অন্ধ হয়ে যায়। বলেছেন, যুক্তি মানুষকে সভ্য হতে শেখায়, প্রগতি, কল্যাণ এবং এবং সভ্যতার ধারাবাহিত ক্রমবিকাশের গতিবেক ত্বরান্বিত করে। অন্ধ আবেগ সকল যুক্তির শালিনতাকে বর্বর ভাবে বর্জন করে, যা স্বাভাবিকভাবেই মানবসমাজ এবং মানবতাবাদের গুরুতর ক্ষতি সাধন করে। আর আবেগের এই সর্বগ্রাসী ক্ষুধা সঙ্গত কারণেই কুসংস্করাচ্ছত, অজ্ঞ, পশ্চাৎপদ ও দারিদ্র্যপূর্ণ জনজীবনে জায়গা করে নেয়। কারণ নিয়তিবাদী মানুষ ধর্মগ্রন্থ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং জীবন যাপনে ধর্মের পারলৌকিক বীজমন্ত্রে দীক্ষিত হয়। আবার এই আবেগকে পুঁজি করে একদল কায়েমী স্বার্থপর বংশীবাদক সমাজে তাদের সীমাহীন লালসার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়। একচোখা, বৈষম্যপূর্ণ এই সমাজব্যবস্থায় নিপীড়নের শিকার জন সাধারণ মানুষ। রিক্ত নিঃস্ব এই মানুষগুলো পরবর্তীকালে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না যার ফলশ্রুতিতে সভ্যতার ক্রমবিকাশ ব্যবস্থায় পুরোপুরি ধস নামে। ..
এদিকে মৌলবাদীরা যখন নুরজাহানকে মাটিতে পুঁতে হত্যা করছে, ধর্মের নামে অমানবিক ফতোয়া দিয়ে জনহিতকর প্রতিষ্ঠান এবং সংবাদপত্র অফিসগুলোতে হামলা চালাচ্ছে, গত ৩ জুন পুরানা পল্টন সিপিবি অফিস সংলগ্ন বইয়ের দোকান পাঠকমেলায় অবাধ লুটতরাজ এবং কোরান হাদিস শরীফের অবমাননা করেছে তখন ধর্মের ভেকধারী এই সরকার কেন তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না? গোটা জাতির কাছে আজ এই প্রশ্নের জবাব সরকারকে দিতে হবে। নয়ত সরকার, প্রগতিশীল সকাল কার্য রোধ করার মাধ্যমে নিন্দিত, ঘৃণিত, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে তুষ্ট করছে বলে প্রমাণিত হবে। মূলত এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সরকার স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে মদদ যোগাচ্ছে। দলগুলোর লাগাতার সংসদ বর্জন, বাজেট অধিবেশনে বিরোদী দলগুলোর অনুপস্থিতি সম্ভাব্য রাজনৈতিক সংকট থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর কৌশল হিসেবে সরকার এই রাজনৈতিক অপকৌশল বেছে নিয়েছে । কিন্তু এই কৌশল সরকারের জন্যে আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত সময়ে তসলিমার জীবননাশের হুমকি, মাথার জন্য পুরস্কার ঘোষণা, লজ্জা উপন্যাস নিষিদ্ধকরণ এবং তসলিমার পাসপোর্ট আটককে সরকার নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্বের কাছে পরিচিত করতে চেয়েছিল। অবশ্য তসলিমার নিরাপত্তার ব্যবস্থাসহ জীবননাশমূলক উস্কানিদাতাকে গ্রেফতার না করায় সরকারের প্রতি সকল সচেতন মহলের নিন্দা অব্যাহত ছিল। বর্তমানে উদ্ভূত সংকট নিরসন না করে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর চেষ্টায় সরকার তসলিমার বিরুদ্ধে একতরফা এই অপতৎপরতা শুরু করেছে। কিন্তু এর ফলে দীর্ঘ সময় ধরে লুকিয়ে রাখা সরকারের মৌলবাদী রূপটি জনসমক্ষে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। যতই এই ছদ্মবেশ খসে পড়ছে, আমরা ততই আতঙ্কিত হচ্ছি। কারণ সীমাহীন কূপমণ্ডুকতা, পশ্চাদপদ চিন্তা চেতনা সরকারের চরিষেন স্থায়ী ছাপ এঁকে দিচ্ছে। এতে করে খুব শিগগিরই আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বাংলাদেশ মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। বস্তুত, তসলিমার বিরুদ্ধে সরকারের এই বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ সম্পূর্ণভাবে পূর্ব পরিকল্পিত। বিগত সময়ের ফতোয়ার মাধ্যমে তসলিমার মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তসলিমা আইনের আশ্রয় চেয়ে বসেন। বাধ্য হয়ে শুধু লজ্জা উপন্যাস নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং পাসপোর্ট আটকের মধ্য দিয়ে সরকারকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। পরবর্তী সময়ে তসলিমার স্বপক্ষে এবং সরকারের বিপক্ষে বিশ্বব্যাপী যে জনমত গড়ে ওঠে তাতে সরকার তার পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সরকার তককে তককে ছিল কবে, কখন, কোথায় তসলিমা সর্বজনীনতা উপেক্ষা করে নিজস্ব কোনও মন্তব্য করেন এবং সরকার তাঁর বিরুদ্ধে আইনের(!) মাধ্যমে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এ কথা আজ সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কর্তৃক তসলিমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, এবং জলে স্থলে অন্তরীক্ষে তসলিমার বহির্গমনের বিধিনিষেধের সরকারি মৌলবাদী চরিষেনর মুখোশ উন্মোচিত করে দিয়েছে, যা তাদের ক্রোধান্বিত জিঘাংসারই বহিঃপ্রকাশ। তসলিমার প্রতি সরকারের এই আগ্রাসন লেখকের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। তাই আমরা সরকারের প্রগতিবিরোধী সকল মৌলবাদী কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই এবং এর বিরুদ্ধে সকল প্রগতিশীল সকল বিবেকবান মানুষ, সমাজ ও সম্প্রদায়কে সোচ্চার হবার অনুরোধ জানাই।’
এ দুটো লেখা আমার মন ভাল করে দেয়। দেশের প্রধান দুজন বুদ্ধিজীবী আজ আমার কথা স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতে কোনও দ্বিধা করেননি, এবং এ সময়ে সব চেয়ে জরুরি যে বিষয়টি, মৌলবাদীদের প্রতিহত করা, তার আহবান তাঁরা জানিয়েছেন। আমার আর মনে হতে থাকে না যে আমার ফাঁসির ব্যাপারটি আজ খুব বড় একটি ইস্যু। আমার মাথার চেয়ে অনেক মূল্যবান এই দেশটি। দেশটিকে মৌলবাদের কবল থেকে রক্ষা করা এখন সবচেয়ে জরুরি। আমার দুঃখ হয়, মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে আমার অনুপস্থিতির জন্য। আমাকে ব্যস্ত থাকতে হবে নিজের ফাঁসিটি ঠেকাতে। ব্যস্ত থাকতে হবে যায় যায় জীবনটিকে যেতে না দিতে। ঙর বাড়িতে আমি, অথচ ঙর সঙ্গে মন খুলে কথা বলার সুযোগ নেই। ঙ এ ঘরে আমার সঙ্গে কথা বললে শব্দ শুনে নিচতলা থেকে যে কেউ উঠে আসতে পারে ওপরে। যে কারও সন্দেহ হতে পারে যে এ ঘরে ঙ ছাড়া অন্য কেউ আছে। ঙ যদি তাকে বাধা দেয় এ ঘরে ঢুকতে, তখন তার সন্দেহ আরও ঘন হতে পারে যে এই ঘরে নিশ্চয়ই নিষিদ্ধ কেউ আছে। এবং তখন এই সন্দেহ একজন থেকে আরেকজনে সংক্রামিত হবে, এবং অবশেষে রাষ্ট্র হবে। নিঃশব্দে বসে থাকা, নিঃশব্দে শ্বাস ফেলা এখন আমার জন্য যেমন জরুরি, ঙর জন্যও তেমন। আমি আমাকে আর ঙকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শ্বাস বন্ধ করে বসে থাকি, যখনই সিঁড়িতে কারও পায়ের শব্দ শুনি। দোতলায় ঙর শোবার ঘরের পাশেই এই লাইব্রেরি ঘরটি। নিচের তলায় অন্যদের ঘর, বৈঠক ঘর, রান্নাঘর, খাবার ঘর ইত্যাদি। ঙ সকালে আমাকে পত্রিকা দিয়ে গেছেন পড়তে, আর ইশারায় বলে গেছেন, বাথরুমে যেতে হলে যেন একটি টোকা দিই টেবিলে, তাতে তিনি বুঝবেন, আশেপাশে দেখবেন কেউ আছে কি না, তারপর আমাকে ইঙ্গিত করলে আমি ঙর ঘরে দ্রুত ঢুকে লাগোয়া বাথরুমটি যেন ব্যবহার করি। ঙ পাশের ঘরে শুয়ে বসে বই পত্রিকা পড়বেন, কান খাড়া থাকবে আমার টোকায়। আর যেহেতু বাড়ির খাবার আমাকে দেওয়া সম্ভব নয়, আমার জন্য তিনি বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসবেন। দুশ্চিন্তায় গলা জিভ এমন শুকিয়ে আছে ঙর যে কথা তিনি চাইলেও শব্দ করে বলতে পারেন না।
মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনে ৩০ জুনের হরতাল প্রতিরোধ কর্মসূচির আহবান প্রথম কোনও রাজনৈতিক দল জানায়নি, জানিয়েছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। ২৭টি সাংস্কৃতিক সংগঠন একাত্মতা প্রকাশ করেছে জোটের সঙ্গে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, আরণ্যক, ঢাকা থিয়েটার, নাট্যচক্র, দেশ নাটক, নাট্যকেন্দ্র, ঢাকা নাট্যম, পদাতিক নাট্য সংসদ, গ্রাম থিয়েটার, মুক্ত নাটক দল, নবধারা নাট্য সম্প্রদায়, ঢাকা সুবচন, বাংলাদেশ থিয়েটার, প্রেক্ষাপট, ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী, গণশিল্পী সংস্থা, ঢাকা থিয়েটার মঞ্চ, স্বরশ্রুতি, কণ্ঠশীলন, মুক্তধারা, কারক নাট্য সম্প্রদায়, শ্রোত আবৃত্তি সংসদ, নটরাজ, দিব্য ঢাকা, বিশ্ববিদ্যালয় চারু শিল্পী পরিষদ। বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) আহবায়ক খালেকুজ্জামান এক বিবৃতিতে মৌলবাদী শক্তি কর্তৃক আহুত ৩০ জুনের হরতাল প্রতিহত করার জন্য সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহবানকে স্বাগত জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘মৌলবাদী শক্তি দীর্ঘদিন থেকেই গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ধ্যান ধারণার ওপর আঘাত হানার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। ফলে তসলিমা নাসরিনকে উপলক্ষ্য করে ফতোয়াবাজ মৌলবাদী শক্তি বিভিন্ন মতামতের মধ্যে উন্মুক্ত তর্ক বিতর্কের পরিবেশ হরণ করতে চায় যা মত প্রকাশ ও লেখকের স্বাধীনতার পরিপন্থী।’ এদের অপতৎপরতা প্রতিহত করার জন্য সর্বস্তরের গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল মহল ও ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন তিনি। আজ বিকেল ৫ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করবে বাসদ। জাতীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আশেক খান ও সাধারণ সম্পাদক সুরঞ্জন ঘোষ ফতোয়াবাজ, ধর্মান্ধ, কট্টর মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে প্রতিহত করার জন্য দেশের সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতি আহবান জানান। ওয়ার্কাস পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য হায়দার আকবর খান রনো বলেছেন ধর্মের আবরণে নৈরাজ্য সৃষ্টি ও ক্ষমতা দখলের চক্রান্তের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সজাগ থাকতে হবে। ওয়ার্কাস পার্টি ৭ দফা কর্মসূচী নিয়ে ২৭ জুন সমাবেশ করবে। ২৭ জুন ঐক্যবদ্ধ নারীসমাজ ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে মিছিল করবে। বাংলাদেশ লেখক শিবির হরতাল প্রতিরোধ করার জন্য আহবান জানিয়েছে। আজ গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য পরিষদ প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদ থেকে হরতাল প্রতিরোধের আহবান জানানো হয়েছে।
আবার একটু শোনা যাচ্ছে যে মৌলবাদীদের হরতাল নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে বিরোধ চলছে। দেশে আওয়ামী লীগ কোনও হরতাল ডাকলে সরকার থেকে হরতালের বিরুদ্ধে বাণীর পর বাণী দিতে থাকে, কিন্তু এবারের হরতালের ব্যাপারে একেবারে নিশ্চুপ। কিন্তু কিছু কিছু বিএনপির মন্ত্রী হরতাল বন্ধ করার কথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলেও কোনওরকম মুখ খোলাতে পারেননি। বিরোধী দলের কেউ কেউ বলছে, যে, সরকারই এই হরতাল করাচ্ছে।
ওদিকে ইবলিসের দোসর তসলিমার ফাঁসির দাবিতে ৩০ জুন হরতাল সফল করার জন্য সভা সমাবেশ মিছিল চলছেই সারাদেশে। ইসলামী ঐক্যজোট ৩০ জুন যে করেই হোক হরতাল করার কথা বলছে। মুসলিম লীগ বলছে। মসজিদে মসজিদে সভা হচ্ছে। ফজলুল হক আমিনী চকবাজারের শাহী মসজিদ চত্বরের বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আমাদের ঘোষিত ৩০ জুন তারিখের হরতাল হবে কোরানের ইজ্জত রক্ষার জন্য হরতাল। এই হরতাল প্রতিহত করার শক্তি এদেশে নেই। এই জমিনে আল্লাহর কোরানকে অবমাননা করা হয়েছে, ইনশাল্লাহ এই জমিনেই কোরানী শাসন কায়েম হবে। বর্তমান সংসদে যে অচলাবস্থা চলছে, কোরানী প্রতিষ্ঠা ছাড়া এ অবস্থা থেকে উন্নতি সম্ভব নয়। এদেশের সংসদ চলবে কোরানের বিধান অনুযায়ী, অন্যথায় শান্তি আশা করা যায় না। জাতি আজ দুই শিবিরে বিভক্ত, একদল হল কোরানের ইজ্জত রক্ষা করতে চায়, অন্যদল চায় ইসলাম ও কোরানকে মিটিয়ে দিতে। আগামী ৩০ তারিখেই প্রমাণ হবে কারা থাকবে আর কারা ধুলোয় মিশে যাবে।’
এসব হচ্ছে, তারপরও আমার মন ভালো। ভালো এইজন্য যে মৌলবাদ প্রতিরোধের জন্য প্রগতির পক্ষের লোকেরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে।
ঙ আমার জন্য ঠোঙায় করে দুপুরের খাবার নিয়ে এলেন। ফিসফিস করে আমাদের কথা হল কিছুক্ষণ দেশের পরিস্থিতি নিয়ে। মৌলবাদী দল সরকারি দলের সহযোগিতায় প্রতিপক্ষের চেয়েও শক্তিমান হয়েছে, একে কি কোনও রকম প্রতিরোধ দিয়ে ঠেকানো সম্ভব! সম্ভব না হলেও সম্ভব করার সবরকম চেষ্টা করতে হবে, এছাড়া আমাদের আর উপায় নেই। প্রতিরোধের আভাস পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু আমার জীবনের ঝুঁকি যে একবিন্দু কমেনি, তা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন ঙ।
বাথরুমে যাওয়ার ঝুঁকি না নেওয়ার জন্য সারাদিন খুব না হলেই নয় কিছু মুখে দিই। আমার ক্ষিধে তেষ্টাও পায় না আজকাল। একদিক দিয়ে ভালই। রোবটের মত জীবন। ঘুম নেই। সারারাত জেগে থাকি। নিঃশব্দে বই পড়ি। কাশি এলে মুখে বালিশ চেপে শব্দ গোপন করি। কান্না এলেও তাই।
৩. অতলে অন্তরীণ – ১৭
কুড়ি জুন, সোমবার
গতকাল প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ আয়োজিত মতবিনিময় সভায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির অপতৎপরতা রোধ করতে জাতীয় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রগতির পক্ষের সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকরা ছিলেন, নামী সাংবাদিকরা ছিলেন, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, কে এম সোবহান, নীলিমা ইব্রাহিম ছিলেন। দুজন আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন, আবদুর রাজ্জাক আর আমির হোসেন আমু। পাঁচ দলের নেতা কাজী আরেফ আহমেদ ছিলেন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির লোকও ছিলেন। কমিটিতে শামসুর রাহমান আহবায়ক, আজকের কাগজের সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমদ সদস্য সচিব। আগামী ৩০ জুন সকাল ১০টায় ঢাকাসহ সারাদেশে প্রেসক্লাবে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিয়েছে জাতীয় প্রতিরোধ কমিটি। সেদিন সকলকে সাইকেল-রিক্সা, মটর সাইকেল, গাড়ি, বাস, ট্রাকসহ যে যেভাবে পারেন যানবাহনযোগে ঢাকাসহ সারাদেশে সংশ্লিষ্ট প্রেসক্লাবে সমবেত হওয়ার জন্য কমিটির পক্ষ থেকে আহবান জানানো হয়েছে। দেশের সকল স্তরে জাতীয় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করারও আহবান জানানো হয়।
জামাতে ইসলামী বা কোনও মৌলবাদী দল আজ পর্যন্ত এ দেশের কোনও ক্ষুদ্র অঞ্চলেও হরতালের ডাক দেওয়ার সাহস পায়নি। আজ তাদের সাহস কতদূর পৌঁচেছে যে তারা দেশব্যাপী হরতালের ডাক দিচ্ছে। এ সাংঘাতিক একটি ঘটনা বটে।
সাম্প্রদায়িক অপশক্তি প্রতিরোধের লক্ষ্যে সামাজিক সাংস্কৃতিক মোর্চা গড়ার চিন্তা ভাবনা করছে অনেকে। দেশজুড়ে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ধ্বংসের চক্রান্তে লিপ্ত ফতোয়াবাজ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল সামাজিক, সাংস্কৃতিক শক্তির সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য একটি মোর্চা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
লেখক শিবির বলছে হরতাল প্রতিরোধ কর। জাসদ বলছে, কেবল প্রতিরোধ নয়, স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী চক্রকে সমূলে উচ্ছেদ করতে হবে। ঢাকার রাজপথে এতদিনে মিছিল বেরোলো মৌলবাদ বিরোধী দলের।
ধর্মের নামে ফতোয়াবাজি, উন্মাদনা, উস্কানি রুখে দাঁড়াও
সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও।
নেতারা বলেছেন, ৩০ জুন হরতাল কর্মসূচির দাঁতভাঙা জবাব এদেশবাসী দেবে। বলেছেন, আমাদের স্বাধীনতা ও পতাকার ওপর বিষ ফণা তুলে আছে একটি অশুভ শক্তি, যে কোনও মূল্যে এদের রুখতে হবে। ছাত্রনেতারা ইনকিলাব আর দৈনিক সংগ্রাম নিষিদ্ধ করার দাবি জানায়। ২৩ জুন মিছিল, সমাবেশ, ২৫ জুন ফতোয়াবাজদের প্রতিরোধ করার দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশ করবে। হরতাল প্রতিরোধ কর্মসূচির প্রতি সমর্থন এসেছে টেলিভিশন এবং মঞ্চ নাটকের বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেষনীর কাছ থেকে।
ওদিকে গতকাল মাদ্রাসার ছাত্ররা সংসদ ভবনের দিকে বিশাল মিছিল নিয়ে গেছে। তসলিমার ফাঁসির দাবিতে সংসদ ভবন ঘেরাও অভিযান। ৩০ জুনের হরতালবিরোধী মহল মুতরাদচক্রের দোসর ও সমর্থক, এই ঘোষণা দিয়েছে ইতিমধ্যে। বাংলাদেশের শহর বন্দর , গ্রাম গঞ্জ নির্বিশেষে সর্বত্র জোর আওয়াজ উঠেছে ধর্মদ্রোহী তসলিমা ও নাস্তিক আহমদ শরীফসহ তাদের সাঙ্গপাঙ্গ ও মদতদাতাদের ফাঁসি দিতে হবে। তসলিমা নাসরিনের ফাঁসি কার্যকর, জনকণ্ঠ নিষিদ্ধ, কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা এবং এনজিওদের. ব্লা ব্লা ব্লা। ইসলামী ছাত্র শিবির বলেছে, দেশ থেকে মুরতাদচক্রকে উৎখাত করতে হবে। ইসলামী চিন্তাবিদরা ঐক্যের আহবান জানিয়েছেন। জাতীয় সুন্নী গণআন্দোলন প্রস্তুতি পরিষদের নেতারা বলেছেন সারা বিশ্বের মুসলমানদের মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
কেবল ছাত্রঐক্যের মিছিল নয়। বাসদের মিছিল বেরিয়েছে।
যুদ্ধাপরাধী ও ফতোয়বাজদের অশুভ আঁতাত রুখে দাঁড়াও
মৌলবাদীদের মিছিল, এবং মৌলবাদবিরাধী দুটো দলের মিছিল। এ দুই মিছিলের মধ্যে মৌলবাদীর মিছিলে যদি ৩০ হাজার লোক, মৌলবাদ বিরোধীতে ৩০০ লোক। এটি শুনতে ভাল লাগে না, এটি দেখতে ভাল লাগে না, এটি বিশ্বাস করতে ভাল লাগে না, তবে এটিই সত্য ঘটনা।
কলাম লেখা চলছে পুরোদমে। দু দলের পত্রিকায় সমানতালে। ফয়েজ আহমেদ লিখেছেন দেশের স্বার্থে ৩০ জুন অপশক্তির বিরুদ্ধে সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। কৃষ্ণপদ সরকার লিখেছেন জাতীয় জীবনে এখন এসেছে বড় কঠিন সময়। বিপক্ষ দল থেকেও একটি ভাষায় আক্রমণ চলছে।
৩. অতলে অন্তরীণ – ১৮
একুশ জুন, মঙ্গলবার
ঙর সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছে একজনের। ঙ গিয়েছিলেন একটি অনুষ্ঠানে যেখানে শিল্পীরা মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন। জ নিজে একজন শিল্পী। শিল্পীর চোখ বোঝে ঙর চোখ দুটোয় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, শঙ্কা। ঙর চোখ যেন কিছু খুঁজছেও, কাউকে খুঁজছে। জ ও তাকিয়ে থাকেন ঙ র দিকে। ঙর চোখ দুটো চারদিকে ঘুরে ঘুরে জ র চোখে গিয়ে স্থির হয়। আবার দুজনের চোখ চারদিকে ঘুরে এসে স্থির হয় দুজনের চোখে। সেই চারচোখে একটি ভাষা আছে। ভাষাগুলো দুজনই পড়তে চেষ্টা করেন। পড়তে পড়তে দুজন এগোতে থাকেন পরস্পরের দিকে। কাছে এসে খুব হালকা দুএকটি কথা শুরু হয় এভাবে।
–কেমন আছেন?
–এখন কি আর ভাল থাকার কোনও অবস্থা আছে!
–ভাবাও যায় না এইসব হচ্ছে দেশে। প্রতিরোধ ছাড়া আর উপায় নেই।
–নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।
জ বোঝেন ঙর ঠিক মন নেই এই প্রতিরোধের আন্দোলনে। ঙ কিছু নিয়ে গভীর চিন্তা করছেন।
জ হঠাৎ বলেন, আমি কি কোনও রকম সাহায্য করতে পারি আপনাকে?
ঙ চমকে ওঠেন, জিজ্ঞেস করেন, কি রকম সাহায্য?
–যে কোনও সাহায্যই। আমি পারব করতে। জ ধীরে গম্ভীর কণ্ঠে ইতি উতি তাকিয়ে বলেন।
–কি পারবেন?
–আপনার যে সাহায্যটা এখন দরকার সেটা আমি করতে পারব।
–আমার যে কোনও সাহায্য দরকার তা কি করে বুঝলেন?
–আমি অনুমান করছি।
–কি রকম শুনি।
ঙ আর জ এগিয়ে যেতে থাকেন মানুষের ভিড় থেকে দূরে..
–আপনার কি কোনও নিরাপদ কোনও জায়গা দরকার?
–নিরাপদ জায়গা?
–হ্যাঁ নিরাপদ জায়গা। যদি দরকার হয় তাহলে আমাকে জানাবেন। আর একটি কথা, আমাকে বিশ্বাস করবেন।
জ ঙর হাতে তাঁর টেলিফোন নম্বর লেখা একটি কাগজ দিয়ে ভিড়ে মিশে যান।
আশ্চর্য এই জ। জ আমার চেনা। ঙ আমার চেনা। কিন্তু জর সঙ্গে কোনওদিন ঙকে নিয়ে, অথবা ঙর সঙ্গে জ কে নিয়ে কোনও কথা আমার কোনওদিন হয়নি। জ এবং ঙ কারও জানার কথা নয় যে দুজনই আমার চেনা বা পরিচিত।
ঙ এরপর জর সঙ্গে কথা বলে নিরাপদ জায়গাটির সন্ধান পান। এরপর গভীর রাতে, হঠাৎ, এমন কী আমাকেও বলা হয় না সেটি যে আজ রাতেই, আমার মুখ মাথা, গা হাত পা ঢেকে গাড়িতে উঠতে হয়, গাড়িতে ওঠার সময় কারও যদি চোখ পড়ে আমার দিকে, ভেবে নেবে এবাড়ির কোনও পর্দানসীন বৃদ্ধা (ঙর মা ) কে বুঝি হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে অথবা বৃদ্ধা তাঁর কন্যার বাড়িতে নাতনির অসুখ দেখতে যাচ্ছেন। গাড়ির পেছনে আমাকে শুয়ে পড়তে হয় কুকুর কুণ্ডুলি হয়ে, আমার শরীরখানা ঢেকে রাখা হয় হাবিজাবি জিনিস দিয়ে। গাড়ি কোথায় যাচ্ছে, কোন দিকে — আমার সাধ্য নেই অনুমান করি। যখন থামে, আমাকে দ্রুত নেমে আসতে হয়। ক আর ঙ আমার দু পাশে এমন ভাবে হাঁটেন যেন আমি আড়ালে পড়ে থাকি। কেউ নেই সামনে আমাদের দিকে নজর দেওয়ার। সামনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন ঝ। এটি ঝর বাড়ি। ঝ আমাদের অপেক্ষায় বাড়ির সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমরা ঢুকে যেতেই তিনি দরজায় বড় একটি তালা লাগিয়ে দিলেন। এখন ঝ কে নিঃশব্দে অনুসরণ করছেন ক, ককে আমি, আমাকে ঙ। ঝ যে পথটি দিয়ে আমাদের তাঁর ঘরের ভেতর নিয়ে গেলেন, সেটি বাড়ির পেছন দিকের পথ। আড়াইতলায় একটি ঘরে আমাদের নিয়ে ঢুকলেন ঝ। ছোট্ট একটি ঘর। ঘরের মেঝেয় একদিকে একটি তোশক পাতা, অন্যদিকে দুটো চেয়ার। মাঝখানে কাঠের তৈরি একটি ভাস্কর্য। একটি দাড়িঅলা দৈত্যের মুখ, এক হাত লম্বা জিভ বেরিয়ে এসেছে মুখ থেকে।
ঝ আমার আগে থেকে চেনা। চেনা কাউকে দেখলে মানুষের মুখে হাসি ফোটে। সম্ভাষণ জানায়। অথচ ঝ র মুখ থমথমে। আমার মুখ ফ্যাকাসে। কেউ আমরা পরস্পরকে জিজ্ঞেস করছি না কেমন আছেন বা কেমন আছো। আমরা জানি আমরা কেমন আছি। আমাদের জিজ্ঞেস করার কোনও প্রয়োজন হয় না। ক আর ঙর সঙ্গে খুব নিচু স্বরে কথা বললেন ঝ। বললেন এ বাড়িতে অনেক মানুষ আছে, আট বছর বয়সী ঝর একটি পুত্রসন্তান আছে, আর আছে তিনজন কাজের মানুষ, একজন দারোয়ান। সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমাকে এ ঘরে বাস করতে হবে। ঘরের সঙ্গেই লাগানো ছোট একটি গোসলখানা, এটি ব্যবহার করতে হবে যথাসম্ভব নিঃশব্দে, যেন কোনও শব্দ নিচ তলায় না পৌঁছোয়। এ ঘর বাইরে থেকে তালা বন্ধ থাকবে। বাড়ির লোকেরা জানবে এ ঘরে কোনও প্রাণী নেই। এ ঘরের প্রাণীকে তাই অগাধ নৈঃশব্দ্য আর অন্ধকারের মধ্যে জীবন কাটাতে হবে। তৃষ্ণা মেটাতে হলে গোসলখানার জলই যথেষ্ট, ক্ষুধা মেটাতে ঝ বাড়ির লোকদের চোখ এড়িয়ে খাবার দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। এই হল নিয়মাবলী। কতদিন আমি এখানে থাকতে পারব, এই প্রশ্ন করা হলে ঝ বলেন, যতদিন আমার প্রয়োজন। ঝর এই উদারতায় চোখে জল চলে আসে আমার। জল আড়াল করি হঠাৎ ঘরের পাশে বারান্দাটি দেখতে জানালায় উঁকি দিয়ে। ক আর ঙ চলে যান। কবে তাঁরা আসবেন, কবে আমি জানব জামিনের খবর, তা কিছুই জানি না। তাঁরাও আমাকে জানান না কিছু।
রাতে ঝ আমাকে ঘরে রেখে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দরজায় চলে যান। যাবার আগে কাঠের জিভঅলা দৈত্যের মুখটি দেখিয়ে কেবল জিজ্ঞেস করেছেন, চিনতে পারছো এই মুখটি কার? আমি উত্তর দেবার আগেই ঝ বললেন, গোলাম আযম। সারারাত আমার পার হয় অন্ধকারের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে। কাঠের মত বসে থাকি, পাশে কাঠের গোলাম আযম।
৩. অতলে অন্তরীণ – ১৯
বাইশ জুন, বুধবার
সকাল হয়। পাখির, মানুষের, যানবাহনের শব্দ শুনে বুঝি সকাল। বন্ধ জানালাটির ফাঁকে আটকে থাকা টুকরো টুকরো সাদা আলো দেখে বুঝি যে বাইরে সকাল। শুয়ে থাকতে ভাল লাগে না। বসে থাকি। একটানা বসে থাকতেও আর কতক্ষণ ভাল লাগে! একসময় দাঁড়াই। দাঁড়িয়ে থাকি। কতক্ষণ আর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা যায়। হাঁটি। খুব আস্তে পা ফেলে এক পা দু পা। কিন্তু মনে হতে থাকে পা ফেলার শব্দ খুব জোরে হচ্ছে। নিচতলায় শুনতে পাচ্ছে কেউ। অগত্যা বসে থাকি। সকাল দুপুরের দিকে হেলে পড়ে, আমি হেলে পড়ি মেঝেয়। ঝিমঝিম করে মাথা। শরীর অবশ অবশ লাগে।
যখন ঝ ঢুকলেন ঘরে, তখন বিকেল। ঝ আপিস থেকে ফিরে ফাঁক খুঁজছিলেন এ ঘরে আসার। ছেলে ঘুমিয়ে গেলে, ওদিকে কাজের মানুষগুলো একটু জিরোতে গেলে ঝ তাঁর নিজের ভাতের থালাটি নিয়ে উঠে এলেন এ ঘরে। ঝর ভাগের ভাতে আমার ভাগ বসাতে হয়। যে থালাটি ঢাকনা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটির মধ্যে আমার জন্য ভাত তুলে দেন ঝ। তরকারি, মাছ সমান সমান ভাগ করেন। এই অর্ধেকে না হবে আমার, না হবে ঝর। কিন্তু এ ছাড়া আর করার কিছু নেই। এবাড়ির দক্ষ রাঁধুনি যখন পাঁচজনের জন্য রাঁধেন, তখন পাঁচজনের জায়গায় ছ সাতজনও খেতে পারে, কিন্তু বাড়তি খাবার কি করে এ ঘরে পাচার করবেন ঝ! কোনও উপায় নেই। অন্তত ঝ কোনও উপায় দেখছেন না। পাচার করলে জানাজানি হবেই। হলে বাড়ির সকলের সন্দেহ হবে যে ওপরতলায় কোনও প্রাণী নিশ্চয়ই বাস করছে। প্রাণীটি কে, তা জানার জন্য তারা কৌতূহলী হবে। এটি ঝর বাড়ি হলেও, কাজের মানুষগুলো ঝর প্রতিটি আদেশ উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেও ঝ এখন কাউকে বলতে পারছেন না যে এ বাড়িতে তাঁর একজন অতিথি আছে। অতিথির জন্য ঝর এ বাড়িতে যা ইচ্ছে তা করার অধিকার থাকলেও আমার জন্য একটি আলাদা থালায় ভাত বেড়ে আনতে পারেন না তিনি, ঝকে হাত গুটিয়ে রাখতে হয়। হাতের পায়ে পায়ে আশঙ্কা, কেউ জেনে যেতে পারে অতিথির পরিচয় এবং জানিয়ে দিতে পারে আশেপাশের কাউকে। তারপর এক কান থেকে একশ কান। এইসব ঝামেলার চেয়ে ঝ মনে করেন তাঁর নিজের খাবার থেকে আমাকে ভাগ দেওয়াটাই নিরাপদ। ঝর জন্য কষ্ট হয়। আপিস করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে আধপেট খাচ্ছেন। নিজের ভাগে আমি কৌশলে কম খাবার নিতে চেষ্টা করি।
খেয়ে ঝ একটি সিগারেট ধরান। মেঝেতেই আধশোয়া হয়ে সিগারেট ফোঁকেন। গলা চেপে, প্রায় শব্দহীন স্বরে বললেন যে আপিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে তিনি বিশাল এক মিছিল দেখেছেন মোল্লাদের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হরতাল যদি করে ফেলতে পারে মোল্লারা তবে সব্বনাশ হয়ে যাবে। এটা এখন বড় একটা চ্যালেঞ্জ আমাদের জন্য। মোল্লারা ডাকলেই যে হরতাল হয় না এ দেশে, তা আমাদের প্রমাণ করতেই হবে।
ঝর হাতে তাঁর তারহীন ফোনটি। তার কণ্ঠস্বর যদি কারও কানে যায়, ভেবে নেবে বুঝি ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। ঝর কাছে সরে এসে ঘরের বাইরে শব্দ না যায়, এমন স্বরে বলি,আপনার কি মনে হয় হরতাল বন্ধ করা সম্ভব হবে?
–এখনও বুঝতে পাচ্ছি না। মোল্লাদের মিছিল তো বিশাল হচ্ছে। ওরা অরগানাইজড। আমাদের গুলোই অরগানাইজড না। এর এটা ভাল লাগে তো ওর ওটা ভাল লাগে না। হাসিনা কি করছে এ সময়? কিচ্ছু না।
ঝ একটি সিগারেট আমার দিকে ছুঁড়ে দেন। সিগারেটে আগুন জ্বালিয়ে একটি টান দিতেই কাশি শুরু হয়। দু হাতে মুখ চেপে কাশি থামাই। সিগারেটটি আমার আঙুল থেকে আলগোছে নিয়ে ঝ সেটি ফুঁকতে থাকেন।
ঝ এখানে বেশি ক্ষণ বসে থাকতে পারেন না। তাঁকে খোঁজা শুরু হলে মুশকিল। তিনি চলে যান। আমি কাতর অনুরোধ করি আজকের পত্রিকাগুলো দিতে। ঘন্টা পার হলে দরজার তল দিয়ে কিছু পত্রিকা ঢুকে যায় এ ঘরে। যেন সারাদিন উপোস থাকার পর এই মাত্র কিছু খাবার জুটেছে, গোগ্রাসে খাবার গেলার মত করে গোগ্রাসে খবর গিলি।
দেশে এখন এটিই সবচেয়ে বড় সংবাদ। হরতাল এবং হরতাল প্রতিরোধ। এমনই অবস্থা এখন যে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি প্রতিরোধ জাতীয় কমিটিকে ঘোষণা দিতে হয়েছে, যে আমরাই কোরআনের পক্ষ শক্তি। ৩০ জুনের হরতালের সপক্ষে স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তিসমূহ পবিত্র কোরআন শরীফকে রক্ষার জন্য হরতাল বলে যে অপপ্রচার চালাচ্ছে তা সম্পূর্ণ ভাঁওতাবাজি। কারণ এটা বিশ্বজনীনভাবে স্বীকৃত যে মওদুদী কোরআনের অপব্যাখ্যা করেছে এবং তারই সংগঠন জামাতে ইসলামী কোরআনকে বিকৃত করে অপব্যবহার করে ধর্ম ব্যবসা চালাচ্ছে। এরা আসলে ধর্মের নামে ব্যক্তি স্বার্থ, ব্যবসায়ী স্বার্থ এবং রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চায়। তাদের এবারের টার্গেট হচ্ছে প্রগতিশীল সংবাদপষেনর কণ্ঠরোধ করা। অতএব ৩০ জুনের হরতালের সপক্ষে তাদের দাবি সর্বৈব মিথ্যা এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপকৌশল। একাত্তরের হত্যাকারী ভণ্ড মওলানারা কি করে কোরআন ও ইসলাম রক্ষা করতে পারে? বরং এরা কোরআনের কথা বলে মওদুদীবাদকে রক্ষা করার হীন চক্রান্ত করছে। এদেরকেপ্রতিরোধের মাধ্যমেই পবিত্র কোরআনকে রক্ষা করা যাবে এবং এই কমিটি পবিত্র কোরআনকে রক্ষা করার জন্যই এ হরতাল প্রতিরোধের আহবান জানাচ্ছে। প্রকৃত ইসলামের ক্ষতি করার সাধ্য এ ধরনের মওলানা ও স্বার্থা−ন্বষী ধর্ম ব্যবসায়ীদের নেই। সাধারণত হরতাল ডাকা হয় অধিকার আদায়ের জন্য, অথচ ঐ অপশক্তিরা সংবাদপত্রসহ গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের জন্য এই হরতাল ডেকেছে। সভায় সর্বসম্মত অভিমত ব্যক্ত করা হয়, আমরাই কোরআনের পক্ষ শক্তি।
শামসুর রাহমান যে কমিটির সভাপতি, যে কমিটির অনেকে নাস্তিক, অনেকে কোরআন কোনওদিন পড়ে দেখেনি, ছুঁয়ে দেখেনি, সেই কমিটিকে বলতে হয়, দাবি করতে হয়, আমরা কোরআনের পক্ষ শক্তি। এটিই বুঝিয়ে দেয় যে মৌলবাদ বিরোধী শক্তি এখন প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে মৌলবাদীদের বাধা দিতে। এখন যদি কোরআনকে ব্যবহার করলে বাধার কাজটি ভাল হয়, তবে এটিকে ব্যবহার করতেও আপত্তি নেই। এই প্রতিরোধ কমিটি একটি ভুল করছে, আমার মনে হয়। কেবল জামাতে ইসলামীকে মওদুদীবাদী বলে দোষ দিয়ে নিজেদের কোরআনের পক্ষ শক্তি বলে লাভ হবে না কিছু। কারণ জামাতে ইসলামী এই আন্দোলনে কেবল যোগ দিয়েছে, আন্দোলন জামাতে ইসলামী দ্বারা শুরু হয়নি, হরতালের ডাকও জামাত দেয়নি। সুতরাং প্রতিরোধ কমিটি জামাতে ইসলামীকে কোণঠাসা করতে চাইলে অন্য মৌলবাদী শক্তিদের কিছু যায় আসে না। তারা মওদুদীবাদীও নয়, তারা জামাতের নয়, কিন্তুু তাদের শক্তি অনেক বড়, জামাতকে সঙ্গে না নিলেও তাদের চলবে। আসলে জামাতে ইসলামীকে ওরা সঙ্গে নেয়নি। জামাতই গিয়ে ভিড়েছে বড় মৌলবাদী আন্দোলনে।
নতুন এক নিয়ম শুরু হয়েছে। মত বিনিময় সভা। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট মতবিনিময় সভা করবে পরশুদিন।
এদিকে মোর্চার বক্তারা যে কোনও ত্যাগের বিনিময়ে আগামী ৩০ জুন আহূত হরতাল সফল করে তোলার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানাচ্ছেন। আগামী ৩০ জুনের হরতাল জাতিকে সুস্পষ্ট দুটি ভাগে ভাগ করেছে। ঐদিন প্রমাণ হবে কারা কোরআন হাদিসের পক্ষে, এবং কোন দল বিপক্ষে। তসলিমা, আহমদ শরীফের দালালরা হরতাল প্রতিহত করার ডাক দিয়েছে। তাদের সেই স্বপ্ন কোনওদিন বাস্তবায়িত হবে না।
খেলাফত মজলিস, প্রতিরোধ আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, তাহাফফুজে হারমাইন, ঈমান বাঁচাও দেশ বাঁচাও, ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন, জমিয়াতুস সাহাবা, মসজিদ পরিষদ বাংলাদেশ, ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র, পোস্তগোলা ট্রাক মালিক সমিতি, ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস, অপসংস্কৃতি প্রতিরোধ কমাণ্ড, অনুপম সাহিত্য সংসদ এরকম কয়েক হাজার ইসলামপন্থীদের সংগঠন সভা সমাবেশ করে হরতালের পক্ষে সমর্থন জানাচ্ছে। জামাতে ইসলামী পবিত্র আশুরা উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। অন্য কোনও বছর আশুরা কোনও ঘটনা নয়, এ বছর একটি ঘটনা বটে। মতিউর রহমান নিজামী এই অনুষ্ঠানে এজিদের বিরুদ্ধে ইমাম হোসেনের আপোসহীন সংগ্রামের ইতিহাস বর্ণনা করেন। খোলাফায়ে রাশেদীনের পর ইসলামের নেতৃত্ব নির্বাচনের মৌলিক পদ্ধতিকে বিকৃত করে রাজতন্ত্র কায়েম করা হয়েছিল। ইসলামী জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আস্থা ও সমর্থনই হল ইসলামে নেতা নির্বাচনের স্বীকৃত পদ্ধতি। নবী করিম ওরফে হযরত মোহাম্মদ ওরফে আল্লাহর পেয়ারা বান্দা ওরফে আললাহর রসুলের পর চার জন খলিফা একই সঙ্গে মসজিদের ইমামতি ও রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা দান করেছেন। নিজামী সেই খলিফার আমলের সুন্দর ব্যবস্থার কথা স্মরণ করেন এবং তেমন ব্যবস্থা এখন এ দেশে চান সৃষ্টি করতে। নিজামী বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য হয়ে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কী অবলীলায় বলে গেলেন, বর্তমানে যেসব মুসলিম দেশে শরিয়তি আইন কানুন চালু রয়েছে সেগুলোকে ইসলামী রাষ্ট্র বলা যায় না কারণ সেখানে ইসলামী পদ্ধতিতে নেতৃত্ব নির্বাচনের ব্যবস্থা নেই। তিনি কোনও রাজতন্ত্র চান না, গণতন্ত্র চান না, তিনি সত্যিকার ইসলামতন্ত্র চান এ দেশে। তসলিমা এবং ধর্মদ্রোহী মুরতাদদের সম্পর্কে বলল