সকাল এগারোটায় ঙ জানিয়ে দেন আজ হচ্ছে না। আজ কেন হচ্ছে না, তার কিছুই তিনি জানেন না। কালও যেন সকালে তৈরি থাকি, হয়ত কাল হবে। আজ আমাকে আদালতে যেতে হবে না, এটি আমাকে স্বস্তি দেয় আবার দেয়ও না। দুটোই আমার গা কাঁপিয়ে দেয়। আদালতে যাওয়ার এবং না যাওয়ার খবর।
এ ঘরে তিনবেলা খাবার আনছেন ঠ। খেতে ইচ্ছে করে না আমার। মনে হয় খেলেই বুঝি বমি হয়ে বেরিয়ে যাবে সব। ঠেলে সরিয়ে দিই খাবার। ঠ আমাকে দেশের অবস্থার কথা বলেন, কিছু আমার কানে ঢোকে, কিছু ঢোকে না, কিছু শুনে হাসি পায়, কিছু শুনে রাগ হয়, কিছু শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, কিছু শুনে চোখ বুজি, কিছু নিয়ে ভাবি, কিছু এড়িয়ে যাই। ঠ বলেন এখন নিশ্চিতই সরকারের শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা। একদিকে বাইরের দেশগুলো চাপ দিচ্ছে আমাকে যেন দেশ থেকে বেরোবার সুযোগ করে দেওয়া হয়, আরেক দিকে ভোটের চিন্তা, ইসলামি ভোটগুলো হারবার ভয়। বিদেশে বাংলাদেশের ইমেজ খুব খারাপ হয়ে উঠছে, অনেক দেশ সাহায্য বন্ধ করে দেবার হুমকি দিচ্ছে, বিদেশি বিনিয়োগও কমে যাওয়ার আশংকা দেখা দিচ্ছে। মৌলবাদবিরোধীরা রাস্তায় আর পেরে উঠছে না, এখন মামলা করছে। মামলা করার ধুম পড়েছে। গোলাম আযমের লোকেরা চট্টগ্রামে ছজনকে খুন করে শান্ত হয়নি, ছাত্রঐক্যের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করা শুরু করেছে। আর প্রগতিশীলরা বায়তুল মোকাররমের খতিবের বিচার দাবি করেছে, মামলাও করেছে তাঁর বিরুদ্ধে, কারণ লং মার্চের মহাসমাবেশে তিনি বলেছিলেন একদল লোক গাদ্দারি করে পাকিস্তান ভেঙেছে। গোলাম আযমের বিরুদ্ধেও মামলা করার চেষ্টা চলবে মনে হচ্ছে। আদম সৃষ্টির হাকীকাত নামে গোলাম আযম একটি বই লিখেছেন, ওই বইতে লেখা, সুরা আল বাকারার প্রথম চারটি রুকু গোটা কোরানের প্রথমেই দেয়া উচিত ছিল। গোলাম আযম খোদার ওপর খোদগারি করছে বলে এখন মামলা করা হবে। চরমোনাইয়ের পীর এক সভায় বলেছিলেন, যারা নিজেদের মৌলবাদী মনে করে না, তারা জারজ মুসলমান, এ নিয়ে বরিশালে এক লোক পীরের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, বলেছে পীরের কথায় তার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে।
ঠ আমাকে বলেন না, কিন্তু ঠর কণ্ঠস্বর থেকে রঙিন রঙিন অনেকগুলো কাচ বেরিয়ে আসে, কাচের মধ্যে আমি স্পষ্ট দেখতে থাকি–যুদ্ধ লেগেছে দু দলে। আমি মধ্যিখানে। আমার পক্ষে দুদলের কেউ নেই, আমি একা। সকলের তরবারির আঘাতে ক্ষত বিক্ষত আমি, একা আমি, টুকরো টুকরো হচ্ছি আমি, একা আমি।
সারারাত আমি কিন্তু বসে থাকি। শুতে পারি না। শুলে আমার শ্বাসকষ্ট হয়। সারারাত জেগে বসে থাকি। একা একা রাতভর রাতের কান্না শুনি বসে বসে।
৩. অতলে অন্তরীণ – ৬২
চার আগস্ট, বৃহস্পতিবার
কাল রাতেই ঠ আমাকে জিজ্ঞেস করে গেছেন সকালে নাস্তা কি খেতে চাই। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলাম, যা হয় তাই। ঠ সকালে ট্রেতে করে চা তো আছেই, ঘি এ ভাজা পরোটা, মাংস, ডিম ভাজা, ফল ইত্যাদি নানা কিছু নিয়ে এলেন। আমাকে নটার মধ্যে তৈরি হয়ে নিতে বললেন। চা ছাড়া আর কিছু আমার খেতে ইচ্ছে হয় না। একটি শাড়ি বের করে দিলেন ঠ। খেয়ে দেয়ে গোসল করে শাড়িটি পরে নিতে বললেন। আমি গোসল করে শাড়ি পরে নিই। একটি কালো চশমা দেন আমাকে পরতে। তাঁর নিজের একটি ওড়না আমার মাথায় পরিয়ে দেন। ঘড়ির দিকে তাকাই, ঘড়ির কাঁটা এত দ্রুত আগে আর চলেনি। আমার বুক কাঁপে। কাঁপনের শব্দ শুনি । ফাঁসিকাঠে ঝোলার আগে বুঝি এই হয় আসামীর। ওড়না-মাথার আমাকে কুৎসিত দেখতে লাগে। কিন্তু বোধবুদ্ধিহীন আমি মূর্তির মত নিশ্চুপ। ওড়নায় মাথা ঢাকার বিরুদ্ধে, এসব অর্থহীন পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন থেকে লিখছি আমি, মেয়েদের মনে মন্ত্র দিচ্ছি নির্যাতনের প্রতীকটিকে মাথা পেতে বরণ না করার জন্য, অথচ আজ আমিই এটিকে মাথায় তুলে নিচ্ছি, আজ আমাকেই পরতে হচ্ছে ওড়না। এবার আর লুকিয়ে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাওয়ার জন্য নয়। নিজের পরিচয়খানি ওড়নায় আড়াল করে নয়। পর্দাবিরোধী তসলিমা আজ পর্দানশীন নারী হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে যাবে, জনসমক্ষে যাবে, নিজের তসলিমা পরিচয়টি নিয়েই সে যাবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলি, তুমি কি তসলিমা? না। আমাকে আমিই চিনতে পারি না। মুখখানা এতদিনে শুকিয়ে লম্বাটে লাগছে। চোখদুটোর তলায় কালি পড়েছে। কালো চশমায় চোখ ঢাকা পড়লে নিজেকে আরও অচেনা লাগে। অচেনা লাগে লাগুক, তবু তো জানি যে এ আমি। এ আমি বলেই আমার রাগ হয়। এ আমি কী করছি! এ কি আমি করছি! আমি কি নিজেকে লুকোচ্ছি এভাবে! না। আমি কিছুই করছি না। তসলিমা মরে গেছে। তসলিমার শরীরে এ এক শক্তিহীন সাহসহীন বোধহীন মেয়েমানুষ কেবল। এ আমি অন্য কেউ। এই অন্য কেউটিকে আমার শরীরে ধারণ করতে আমার ঘৃণা হয়। যন্ত্রণার মত একটি অনুভব আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে আমাকে অস্থির করে মারে। একবার আমি আয়নার সামনে যাই, আরেকবার বিছানায় এসে বসি। দাঁড়িয়ে থাকি মাঝপথে দরজা ধরে, ঘরময় হাঁটি, শ্বাস কষ্ট অনুভব করে জানালার কাছে যাই, জানালার পর্দা সরিয়ে ইচ্ছে করে হাট করে জানালা খুলে শ্বাস নিই। কিন্তু পারি না। হাত শক্ত করে চেপে রাখি হাতে। এ হাত কি আমার হাত? না এ হাত আমার হাত নয়। এ হাত সেই অন্য কেউটির হাত। মনে মনে আজও আমি এই তারিখটি নাকচের আশঙ্কা নয় আশা করেছিলাম, কিন্তু ঙ ফোনে জানিয়ে দিলেন এ বাড়ির দরজায় ঠিক সোয়া দশটার সময় একটি গাড়ি এসে থামবে, ছোটদা থাকবেন গাড়িতে, খুব দ্রুত গাড়ি চলবে, ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে গাড়িটিকে গিয়ে পৌঁছতে হবে হাইকোর্টে। ঠর কাছে খবরটি শুনে আমার বুক ধ্বক করে ওঠে। শরীর শীতার্ত হতে থাকে শুনে যে সত্যি সত্যি আজ ঘটতে যাচ্ছে ঘটনা। আমাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ঠ। বুঝি, তিনিও বুঝতে পারছেন আজ আমার মৃত্যু হতে পারে, আজ আমি নিহত হতে পারি পথে বা আদালতে কোনও আততায়ীর গুলিতে।অন্য কেউ এ সময় হলে আল্লাহর নাম নিত, আল্লাহু লা-ইলাহা ইল্লাহুয়াল হাইয়ুল কাইয়ুম লা তা খুজুহু.., হে আল্লাহ আমাকে বালা মুসিবত থেকে রক্ষা কর এসব বলত। আমার তো নাম নেবার কোনও আল্লাহ নেই, ভগবান নেই, নিজের নামটিও অনেকটা ভুলে বসে আছি। আগের মতই আমি স্তব্ধ বসে থাকি। দশটা বাজার আগে আগে ঙ জানান, সোয়া দশটা নয়, সাড়ে এগারোটা। এরপর সাড়ে এগারো বেজে যাবার পর আরেকবার ফোন ঙর, সাড়ে এগারোয় হচ্ছে না, বারোটা চল্লিশে। বারোটা চল্লিশ অবদি ঠায় বসে থেকে মৃত্যুর নানা রং দেখা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।