তোমার একাকীত্বের কথা মনে হলেই মনেপড়ে শীতের সন্ধেগুলোর কথা। ডাল পাতা খড় যোগাড় করে কোনও কোনও রাতে উঠোনে আগুন জ্বালাতে। সেই আগুনে মাঝে মাঝে দেখতাম তুমি হাত পা তাপাতে। জ্বলন্ত কয়লার দুপাশে পা রেখে তুমি দাঁড়াতে। তাপটা নিতে ঊরুতে, ঊরুসন্ধিতে। ওই তাপ কি তোমাকে কোনও সুখ দিত? তোমার মুখটায় লজ্জা, ভয় আর কীসব যেন মিশে থাকতো। শীতে তোমাকে খুব কাবু করতো, নাকি মাঝে মাঝে যৌন তৃষ্ণাও? এত ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিলো তোমার শরীর, একটু আগুন দরকার ছিলো তোমার। মা জাতীয় মানুষদের আবার ওইসব নোংরা জিনিসের কোনও উপদ্রব থাকে এ আমার কখনও মনে হতো না। পুরুষহীন জীবনই তো কাটিয়েছে, প্রায় সবটা জীবনই। যতই তোমাকে দাসী বা ক্রীতদাসীর মতো রাখুক, বাবাকে ভালোবাসতে তুমি। প্রচণ্ড ভালোবাসতে। অতভালোবেসেও বাবার সামান্য ভালোবাসাও
তুমি পেতে পারোনি। বাড়ির বাইরে বাবা যার তার সঙ্গে মিশতে, কোনও বাছবিচার ছিল না। তোমার বেলাতেই ছিল নাক সিটকানো। দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তোমার। পরের বছরেই দাদাকে পেটে ধরেছো। ঋতু দেখেছো কী দেখনি, গর্ভবতী হলে। আমার চেয়ে বড়জোর কুড়ি একুশ বছরের বড় ছিলে বয়সে। তুমি যখন তোমার যৌবন জুড়ে একা, বাবা তখন তার ফর্সা ফর্সা রোগিণীদের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। একাকীত্ব কী, আমি জানি। আমারও তো সারা শরীরে একাকীত্ব। জীবনে আমিও সত্যিকার কোনও প্রেমিক পাইনি। সত্যিকার বলছি এই জন্য যে, ‘তোমাকে ভালোবাসি’ ইত্যাদি বলার লোকের অভাব ছিল না, ও শুধু মুখের বলা, হৃদয়ের নয়। সত্যিকার ভালোবাসা, সে কারওরই ছিল না। তোমার কষ্ট অনুভব করার জন্য বোধহয় জীবন আমাকে এক-জীবন একাকীত্ব উপহার দিয়েছে। –বাবা ইওরোপে আমার কাছে এসেছিলো। বাবাকে ডেনমার্ক, জার্মানি, ইংলন্ডে নিয়ে গেছি। আমাকে দেওয়া বিদেশিদের অনেক সম্মান, সংবর্ধনা দেখেছে বাবা। দাদাও এসেছিলো, দাদা অবশ্য আমার ওপর বিদেশের বড় বড় কোনও অনুষ্ঠানই দেখেনি। কিন্তু দাদাকে আমি স্পেন আর পর্তুগাল বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম। ছোটদাও এসেছিল। চাইতাম সবাই আসুক আমার কাছে। দেশে যদি না-ই যেতে পারি এখন, আমার সঙ্গে দেখা যোক আমার স্বজনদের সবাইকে তো আমার কাছে আসতে বলতাম। কিন্তু কখনও তোমাকে আসতে বলিনি। আর যার কথাই মনে আসুক, তোমার কথা আসে না। তোমাকে তো কোনওদিন কোথাও বেড়াতে নিইনি দেশে থাকাকালীনও। বিদেশে কেন আসতে বলবো। তুমি নিজে থেকেই আসতে চেয়েছে অনাহুতের মতো। হঠাৎ করে তুমি জানালে যে তুমি আসছো আমার কাছে। আমি অবাক হয়েছিলাম। তুমি যখন আসবে বললে, সুইডেনের উপলান্ডস ভিয়েসবি, চার নম্বর মুনিনভ্যাগেনে মস্তিষ্কে-মনে একশ ভাগ সুইডিশ ভদ্রলোক সুয়েনসনের শহরতলির ঘোর নির্জন বাড়ি আমার ঠিকানা। এমনিতে সুইডেন দেশটাই ফাঁকা, ওই উপলান্ডস ভিয়েসবি তারও চেয়ে বেশি ফাঁকা। পরের বাড়িতে উঠতে রুচিতে আমার চিরকালই বাধে। নিজের দেশে নিজের বাড়ি রেখে পরের দেশে পরের বাড়িতে থাকা, নিজের দেশে নিজের গাড়ি রেখে পরের দেশে পরের গাড়ি চড়া যে খুব স্বস্তির নয়, সুখের নয়, তা আমার মতো আর কে জানে মা। সুয়েনসন মানুষটা কেমন, মানুষটা কী, তার কতই আর জেনেছি। দেখা হয়েছে সাকুল্যে চারবার। সুয়েনসনের বাড়িতে উঠেছিলাম জার্মানি থেকে ফিরে এসে। বিদেশে কোথাও চাকরি করি না। ইওরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বের হওয়া বইয়ের রয়্যালটি আর কিছু পুরস্কার পাওয়ার টাকা আমার সম্বল। বসে খেলে রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়, আমার ধনও ফুরোবে, এই আশংকা আমার ভেতর বাসা বেঁধেছে। তোমাকে তো জীবনের কোনও গল্পই বলিনি মা। অনেককে বলেছি, তোমাকে বলার কোনও প্রয়োজন বোধ করিনি। কখনও যদি ফোনে তোমার সঙ্গে কথা বলেছি, তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে চেঁচিয়ে তোমাকে কাঁদিয়েছি। তুমি কেঁদেছো। শরাফ মামা আমার বাড়িতে কেন এল, তুমি কেন ঢুকতে দিলে? আমার পুরোনো দুটো সালোয়ার কামিজ, গায়ে আমার আঁটে না, দিয়েছিলে বড় মামার দুই মেয়ে শিপ্রা আর শুভ্রাকে। বড়মামার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়, মেয়েদুটো অভাবে থাকে, তাই। আমি তোমাকে ধমকে বললাম, ‘আমার অনুমতি ছাড়া কেন তুমি আমার জিনিস অন্যকে দেবে? ’ ‘তুমি তো অনেক বছর ধরে ওগুলো আর পরো না মা।‘ তুমি খুব মোলায়েম স্বরে বলেছো। তোমার মোলায়েম স্বর আমাকে সামান্যও মোলায়েম করতে পারেনি। আমি চিৎকার করি, আমি পরি কী নাপরি সে আমি বুঝবোনাপরি, ওগুলো থাকবে, যেভাবে ছিল। আমি যখন ফিরবো দেশে, তখন দেখবো আমার পুরোনো ছোট হয়ে যাওয়া কাপড়গুলোও। যেভাবে যা রেখে এসেছি, সেভাবেই যেন সব থাকে। তুমি বললে, ‘আমি ভেবেছিলাম গরিব দুঃখীকে সাহায্য করলে বোধহয় তোমার ভালো লাগবে। মনে আছে কী রকম রুক্ষ কণ্ঠে তোমাকে বলেছিলাম, কোনও গরিব দুঃখীকে আমার দেওয়ার দরকার নেই। তুমি টাকা দিয়ে বরং ওদের কাপড় চোপড় কিনে দাও। আমার স্মৃতি তুমি নষ্ট করো না। তুমি ওদের জামা কাপড় যা দান করেছিলে, ফেরত নিয়ে এসেছিলে মা। সম্ভবত ওদের গা থেকে খুলে নিয়ে এসেছিলে। এখন যখন ভাবি তোমার কেমন লেগেছিল কাজটা করতে, বুক ফেটে যায়। মাথা তোমার কতটুকু নত হয়েছিলো বড়মামার সামনে, শিপ্রা আর শুভ্রার সামনে, বুঝি। তুমি তো গুছিয়ে রাখতে যা আমি রেখে এসেছিলাম সব, নিজের শাড়ি নেই, তবু আমার বড় কাঠের আলমারিগুলোর পাঁচশ শাড়ির একটিতেও তুমি হাত দাওনি। যেন পোকা না কাটে, যেন নষ্ট না হয়ে যায়, বারান্দায় শীতলপাটি বিছিয়ে রোদে দিতে শাড়িগুলো, রোদে দিয়ে পাশে বসে থাকতে। দেখতে শাড়িগুলো, যেন আমাকে দেখতে। স্পর্শ করতে, যেন আমাকে স্পর্শ করতে। তোমার চোখের জল টুপ টুপ করে পড়তো, বার বার মুছে নিতে হত জল তোমার, যেন শাড়ির ওপর পড়ে শাড়ি নষ্ট না হয়। এভাবেই তো যত্ন করেছিলে আমার সবকটা জিনিস। আঁচল দিয়ে মুছে মুছে রাখতে আমার পড়ার টেবিল, আমার বই, কাগজপত্র। ফ্রেমে বাঁধানো আমার ছবিগুলো। মুছতে আর কাঁদতে। কবে আমি ফিরে আসতে পারবো, জিজ্ঞেস করতে সবাইকে। কেউ তোমাকে কোনও উত্তর দিত না। কেউ বলতো, খালেদা গিয়ে হাসিনা এলেই ফিরতে পারবো। কেউ বলতে, বিশেষ করে ছোটদা, জীবনেও আমি ফিরতেপারবো না। শুনে তুমি হাউমাউ করে কাঁদতে। একবার ব্যারিস্টার কামাল হোসেনের কাছে যেতে বলতে। একবার সারা হোসেনকে আমাকে যেন দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে বলতে বলতে। কেউ কারও কাছে যেত না। তুমি দাদাকে অনুরোধ করতে, ছোটদাকে করতে। চোখের জল ফেলে ফেলে করতে। কে শোনে তোমার কথা! তুমি তো অশিক্ষিত। তুমি যে অশিক্ষিত, এ কথা বাবা আমাদের ছোটবেলা থেকেই বোঝাতো। আমরাও মাথার খুলি খুলে ঢুকিয়ে নিতাম বাবার দেওয়া জ্ঞান। তুমি নিজেও অবশ্য বলতে তুমি ইস্কুল পার হতে পারোনি, কলেজেও পড়া সম্ভব হয়নি, তাই অনেক কিছু জানো না বা বোঝো না। আমার বিষয়ে বাবা বা দাদারা কেউ যদি কোনও কথা বলতো, কোনও গুরুত্বপূর্ণ কথা, তোমাকে শুনতে দিত না, তুমি বুঝবে না বলে। তুমি জানতে চাইলে বাবা চোখ ইশারা করে দাদাদের মুখ বন্ধ রাখতো। এর মানে হচ্ছে, ও কিছু বুঝবে না, অকারণে ওকে বলে কী লাভ, বরং ও আবার মৌলবাদীদের কাছে খবর পৌঁছে দিতে পারে। হ্যাঁ এই দোষ তোমাকে দেওয়া হত, যে, তুমি বোধহয় কাউকে জানিয়ে দেবে আমার সম্পর্কে কোনও তথ্য। কারণ কী? কারণ তুমি বোকা। তুমি মূর্খ। তোমাকে কোনওদিনই তাই আমার কোনও ঠিকানা বা ফোন নম্বর দেয়নি ওরা। আরও না দেওয়ার কারণ তুমি আমার যোগাযোগের ঠিকানা বা নম্বর তোমার ভাইবোনদের দেবে, ওরা আমাকে ফোন করে নিজেদের দুঃখ দুর্দশার কাহিনী বলে আমার কাছে টাকা চাইবে। একটা জিনিসই ওরা খুব ভালো বুঝতো, সে হলো টাকা। দেশে আমার টাকা ছিল, বিদেশে আমার আরও টাকা, টাকার ওপর যেন গড়াগড়ি খাচ্ছি। এসব সত্য অনেক পরে জেনেছি মা। ফোনে তাই আমার কাছেও তুমি জানতে চাওনি আমি কোথায় থাকি, আমার ফোন নম্বর বা ফ্যাক্স নম্বর কী। কারণ, ওসব চাইতে তোমার ভয় হত। ভয় হত, কারণ আমি যদি তোমাকে সন্দেহ করি। ওদিকে আমি ভাবতাম, কেউ তো একটা চিঠিও আমাকে লেখে না। মা হয়ে তুমিও তো লেখো না। চোখের জলে ভিজিয়ে কত কত চিঠি তুমি আমাকে লিখে তোশকের তলায় রেখে দিয়েছো মা। পরে ওসব চিঠি আমি পেয়েছি, পেয়েছি যে, তুমি জানতেও পারোনি। জানবে কী করে, তুমি তো ছিলে না যে জানবে।