দাদা, ছোটদা, ইয়াসমিন কাউকে দেখি না এখন আক্ষেপ করতে যে, যে শ্রদ্ধা তোমার প্রাপ্য ছিল, তুমি তা পাওনি। তোমার প্রতি কোনও কর্তব্য বা দায়িত্ব পালনে তাদের কোনও ত্রুটি ছিল, এমন কথা ভুলেও কেউ উচ্চারণ করে না। সবাই অবিশ্বাস্য রকম শীতল, ভারমুক্ত, তৃপ্ত। অথচ আমি জানি মা, কতটা ভুল আমার মতো তারাও করেছে। আক্ষেপ আমার হয়, অনুতাপ আমার হয়। আমি খুব ভালো করেই জানি যে তোমাকে যত অবজ্ঞা করেছি, তত অবজ্ঞা আমি কাউকে করিনি। তত অসম্মান পৃথিবীর কাউকে আমি করিনি। যত ঘৃণা করেছি আমি তোমাকে, সত্যি বলতে কী, তত আর কাউকে করিনি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, অনুশোচনা আমি কেন করি এখন? তুমি নেই বলেই তো! তুমি যদি থাকতে, এই অনুশোচনাটা করতাম বলে মনে হয় না। যেমন তোমাকে ভুলে ছিলাম, তেমনই থাকতাম। কারও বোধোদয় হওয়ার জন্য যদি অন্য কারও মৃত্যুর প্রয়োজন হয়, তবে সেই বোধোদয়ের মূল্য কি সত্যিই কিছু? আমার এই বোধের জন্য, বিশ্বাস করো বা না করো, আমারই লজ্জা হয়।
তোমার একাকীত্ব নিয়ে কোনওদিন সামান্যও ভাবিনি। ছোটবেলায় না হয় ভাবিনি। বড়বেলাতেও কেন একবারের জন্যও মনে হয়নি, কী দুঃসহ জীবন তুমি কাটিয়েছো তোমার সারাজীবন। কেন একবারও ভাবিনি কী ভীষণ একা তুমি। বুদ্ধি হবার পর কোনওদিন দেখিনি বাবা আর তুমি এক বিছানায় ঘুমোচ্ছো। বাবা তো তোমার সঙ্গে শুতো না। তার মেয়ে ছিল শোয়ার। তুমি কেঁদে কেটে বুক ভাসিয়ে, চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে, বাবাকে ফেরাতে চেয়েছো, পারোনি। তুমি ব্যর্থতার আরেক নাম। বাবা তোমার সামনে দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে যেতে। মেয়েমানুষের অভাব বাবার থাকবে কেন, দেখতে অসম্ভব সুন্দর ছিল, তার ওপর ডাক্তার, আবার নামকরা ডাক্তার, রোগীতে ভরে থাকতো চেম্বার, হয় বাবা বড় সিভিল সার্জন, নয় মেডিকেল কলেজের প্রফেসর। এমন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, গুণে জ্ঞানে ভরপুর পুরুষ শহরের কজন দেখেছে! মেয়েরা বাবার প্রেমেপড়তো। তবে বাবার কপালও যে খুব ভালো ছিল, তানয়। কোন এক ফর্সা বিবাহিত মহিলার সঙ্গে বাবা সেই যৌবনেই এমন ভিড়ে গিয়েছিল যে সেই মহিলা তার স্বামীর কাছ থেকে তালাক নিয়ে বাবাকে চাপ দিয়ে বিয়ে পর্যন্ত করিয়ে নিয়েছিল। এসব আমরা কেউ জানতাম না। হঠাৎহঠাৎ লোকমুখে শুনতাম। লোকের কথা বিশ্বাস হত না। বাইরের প্রেম ভালোবাসা, সোহাগ সম্ভোগের খবর বাবা কোনওকালেই বাড়িতে আনেনি। বাবার না হয় শরীর জুড়োতো, তোমার কী হত! তোমাকে স্পর্শ করার কোনও প্রাণী তো কোথাও ছিল না। আমাণুদ্দৌলা কদিন তোমার সঙ্গে সম্ভবত গল্প করার ছুতোয় তোমার হাত ছুঁয়েছে, কিন্তু সে যে খুব বেশিদূর যেতে পেরেছিল, মনে হয় না। আমিই তো তোমার একটা বন্ধু সম্বোধন করে লেখা চিঠি কোত্থেকে আবিষ্কার করে বাড়ির সবার সামনে একদিন চিৎকার করে জানিয়ে দিয়েছিলাম। ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল তোমার মুখখানা। আমরা সবাই খাওয়ার টেবিলে বসে খাচ্ছিলাম, বাবা, দাদা, ছোটদা, আমি … ওইসময়ই ঘৃণা ছুঁড়তেছুঁড়তে বলেছিলাম সে কথা, যে, তুমি একটা প্রেমপত্র লিখেছো কাউকে, কী লিখেছো তাও বলেছি, অল্প বয়সে মস্তিষ্কের ঘর বারান্দা বড় তকতকে থাকে, দাঁড়ি কমাও মুখস্ত হয়ে যায়। সেই চিঠিটা কাকে লিখেছো, তা যে অনুমান করতেপারছি, এবং সেই অনুমানটিও সবাইকে আরও দ্বিগুণ চেঁচিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলাম, তা ওই ঘৃণার জন্য। তোমাকে, সত্যি কথা বলতে কী মা, আমি ঘৃণা করতাম। তোমার কিছুই আমার পছন্দ হতো না। তোমার অসহায়তা আমার ভেতরে কোনও করুণা সৃষ্টি করতো না। পৃথিবীর সব নির্যাতিত অসহায় মানুষের জন্য আমার মায়া হত, কিন্তু তোমার জন্য হত না। কেন আমি সেদিন ছোট একটা চিঠি, তোমার দুঃখ বুঝতে চাইছে বা পারছে, এমন কাউকে সমমর্মী মনে করে লিখেছো, পড়ে তোমাকে ছিছি করেছিলাম! আজ আমার ভাবতে লজ্জা হয় সেই কথা মনে করে যে পরিবারের সবার সামনে তোমাকে ওভাবে নির্লজ্জের মতো লজ্জা দিয়েছিলাম, তোমার জগৎ এক কুঁয়ে ধসিয়ে দিয়েছিলাম। ভাবতে লজ্জা হয় তোমার জন্য বাইরের মানুষের সহানুভূতি ছিল, আমার ছিল না। শুধু লজ্জা নয়, নিজের ওপর ঘৃণাও হয়। আমাকে হয়তো অনেকে সান্ত্বনা দেবে এই বলে যে, আমার মানসিকতাও আর সব মেয়ের মতোপুরুষতান্ত্রিক সমাজে থেকে থেকে পুরুষতান্ত্রিক হয়েই গড়ে উঠেছিলো, এ দোষ তাই আমার নয়। দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাবার অভ্যেস নেই আমার। দোষ আমারই। এ কথা সম্পূর্ণই ঠিক যে, আমি আসলেই ভেতরে ভেতরে বিশ্বাস করতাম মেয়েদের নিজের কোনও জীবন থাকতে নেই, তাদের জন্মই হয়েছে স্বামীসেবার জন্য, জন্মই হয়েছে পুরুষের দাসত্ব করার জন্য। পুরুষের অধিকার আছে স্ত্রীর বাইরে যে কারও সঙ্গে মানসিক বা শারীরিক সম্পর্ক করার, কোনও মেয়ের সে অধিকার নেই। ভালো মেয়ে হতে চাইলে একনিষ্ঠ হতে হয়, পতিব্রতা হতে হয়। আমার পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা তোমাকে একা পেয়ে, নিরীহ পেয়ে, শক্তিহীন পেয়ে চরম আঘাত করেছে।
ছোটবেলায় তুমি আমার মাথায় নারকেল তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দিতে। উকুন হলে উকুন বেছে দিতে, জামা কাপড় নিজে সেলাই মেশিনে তৈরি করে দিতে, নোংরা হলে কেচে দিতে। আমার বিছানা, আলনা, আলমারি, কাপড়চোপড়, বইপত্র গুছিয়ে রাখতে। দিন রাতপড়ছি, মাথাটা যেন ভালো কাজ করে, মাথাটা যেন পড়া মনে রাখে, সে কারণে আমার যে একটু ডিম দুধ খাওয়া দরকার, মাছ মাংস খাওয়া দরকার, একটু যে ফল দরকার –এগুলো বাবার কাছে কতভাবে যে বলতে। আমরা তো সবাই বাবার ওপরই নির্ভর ছিলাম, এরকম তোনয় যে তোমার সাধ্য ছিল কিছু কেনার। সাধ্য থাকলে কী না করতে তুমি! তোমার হাতে যখনই কিছু টাকা এসেছে, তখনই তুমি কারও না কারও জন্য কিছু কিনেছে। নিজের জন্য কিছুই কোনওদিন কেনননি। যখন নানি বাড়ি বা তোমার বোনের বাড়ি যেতে, সেই যাওয়াররিক্সাভাড়াটাও, দুটাকা কী তিন টাকা, তোমাকে চেয়ে চেয়ে নিতে হত বাবার কাছ থেকে। বেশির ভাগ সময়ই বাবা দিত না। তুমি তোমার ভাই বোনের কাছ থেকে চাইতে। সংকোচ হত তোমার। কিন্তু উপায়ই বা কী ছিল। তোমার ভাই বোনকে, তোমার বাবা মাকে তুমি অনেক কিছু, সামান্য কিছুহলেও উপহার দিতে চাইতে। কাউকে কিছু দিতে পারার ক্ষমতা ছিল না তোমার। তোমার মতো নিঃস্ব কী জগতে দ্বিতীয় কেউ ছিল! চাকরি করাকালীন আমি জানি না কখনও তোমার হাতে কোনও টাকা দিয়েছি কিনা। যদি দিয়েও থাকি কোনওদিন, টাকাটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই সামান্য কটা টাকা নিয়েই চলে যেতে আমার জন্য আমার ভালো লাগে এমন কিছু কিনে আনতে। মা, আমার আজ মনে হয়, তুমি বোধহয় তোমাকে ভালোবাসতে না। স্বামী সন্তানকে ভালোবাসলে যে নিজেকে ভালোবাসতে হয় না, কে তোমাকে শিখিয়েছিলো!