এই স্লোন কেটেরিংও যে আমাকে এত ভোগাবে কে জানতো। আমার কোনও ঘুম ছিল না মা, রাত দিন আমি কুঁদ হয়ে ছিলাম তোমার জন্য কোনও চিকিৎসা পেতে। খুঁজে খুঁজে যা পেয়েছিলাম, তাকেই বিশ্বাস করে তোমাকে বললাম চলে আসতে আমেরিকায়। তোমার আর বাবার ভিসার ব্যবস্থাও করলাম। কী করে যে এত সব করেছিলাম ভাবলে এখন অবাক হই। পেন আমেরিকার লেখকদের বলেই তোমার আর বাবার আমেরিকা আসার জন্য ভিসা করিয়েছিলাম। তুমি আসার আগে সাড়ে ছ হাজার ডলার জমা দিতে হয়েছিলো হাসপাতালে। তারপর যেদিন হাসপাতালে গেলাম ডাক্তার দেখাতে, অন্য সব রোগীদের সঙ্গে তোমাকে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হলো। সব রোগীকেই দেখছে, তোমার বেলায় বলা হলো, বিদেশি রোগী, বাকি টাকা জমা না পড়লে ডাক্তার দেখবে না। তখনই দৌড়ে হাসপাতালের বিদেশবিভাগে গিয়ে বাকি সাড়ে ছ হাজার ডলার জমা দিয়ে তোমাকে ডাক্তার দেখালাম। এমআরআই করা হয়েছিলো তোমার, তার রিপোর্ট দেখে আর তোমাকে খানিকটাপরীক্ষা করে ডাক্তার বলে দিল, লিভারে অনেকগুলো মেটাসটাসিসের নডল আছে। তিনটে থেকে এত দ্রুত কী করে অনেকগুলো হয়ে উঠলো, সে আমি অনুমান করতে পারি। তোমার ওই সাড়ে চার ঘণ্টার অপারেশন, আর ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত ঢালা, সে কারণেই। জিজ্ঞেস করলাম, লিভার অপারেশন করা যায় না? মেটাসটাসিস যেখানে যেখানে হয়েছে, সেসব জায়গা কেটে বাদ দেওয়া? ডাক্তার বললো, না। হবে না। লিম্ফ নোডে ছড়িয়েপড়েছে। বললো, লিভার অপারেশন করে লাভ নেই। তারপর খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে, এতটুকু কাঁপলো না ডাক্তারের কণ্ঠস্বর, এতটুকু মায়া নেই তার কণ্ঠে, বললো আর মাত্র তিন মাস তুমি বাঁচবে। তিনমাস, এই শব্দটা আমার বুকে বিষমাখা তিরের মতো ছুটে এসে বিধতে তিন মুহূর্ত সময় নেয়নি। আর কোনও চিকিৎসা? আর কোনও কি চিকিৎসা নেই? আমি কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম। পাথরের মতো মুখ ডাক্তারের। বললো, রোগীকে দেশে ফেরত পাঠান।
ডাক্তারের চেম্বারে শুয়ে থাকা তোমার কাছে ফিরে এসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। তুমি ফ্যাকাসে মুখে বললে, কাঁদছো কেন? কী বলেছে ডাক্তার? আমি মরে যাবো? ’আমি কিছু বলিনি নাকি মাথা নেড়ে না বলেছিলাম মনে নেই। তবে কাঁদছিলাম। চোখের জল থামাতে পারিনি অনেকক্ষণ। তুমি হয়তো যা বোঝার, বুঝেই নিয়েছে। বললে, খুব নরম স্বরে বললে, সবার মা কি আর সারাজীবন বাঁচে? তুমি কেঁদো না মা। তোমার চোখে একফোঁটা জল ছিল না।
ডাক্তারের ওই জবাব দিয়ে দেওয়ায় আমি কি তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি চলে যাবো নাকি! আমি তার পেছন পেছন গিয়ে বললাম, আমি নিজে একজন ডাক্তার, আমাকে বলুন কিছু। লিভার মেটাসটাসিস হলে নতুন যে ট্রায়াল দেওয়া হচ্ছে এই হাসপাতালে, কিছু তো ভালো ফল পাওয়া গেছে। আমার মার জন্য সেই ট্রায়ালের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়! সেই ডাক্তার, তুমি জানোনা মা, খেঁকিয়ে উঠে বললো, ”হেই তুমি কি ইংরেজি ভাষা জানো না? যা বলার বলেই দিয়েছি। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে আমাকে বিরক্ত করো না। যাও। ডাক্তার সরে গেল, আমার সঙ্গে আর কোনও কথাই বলতে চায়নি। আমিও তো হাসপাতালে ডাক্তারি করেছি। কোনও রোগী বা রোগীর আত্মীয়র সঙ্গে এমন অকথ্য ব্যবহার নিজে তো করিইনি, কাউকে করতেও দেখিনি। যে মেয়ে এইমাত্র শুনলো যে তার মা আর তিন মাস পর মারা যাবে, তার সঙ্গে ডাক্তাররা কী ভাষায় কথা বলবে, তা ওই ডাক্তার শেখেনি। হাসপাতালের ওয়েবসাইট থেকে অনেক লিভার মেটাসটাসিস বিশেষজ্ঞরমধ্যে ওই মহিলাকে আমি পছন্দ করেছিলাম। অনেক ডিগ্রিতার, অনেক পড়াশোনা, অনেক অভিজ্ঞতা। আমার মনে হয় না কোনও সাদা রোগীর সঙ্গে অমন ব্যবহারের সুযোগ সে পেত। আমাকে বা তোমাকে ওই ডাক্তার মানুষ বলে মনে করেনি। মনে করেছে। কোন জঙ্গল থেকে জন্তু জানোয়ার কিছু গেছি হয়তো তার কাছে। এখন ভাবি আমার তো আমেরিকার কিছু লেখক কবিদের সঙ্গে পরিচয় ছিল। লেখক সংগঠন পেন আমাকে যথেষ্টই গুরুত্ব দিত। তাদের কাউকে আমি সঙ্গে নিয়ে গেলাম না কেন! সঙ্গে নিলে এই আচরণ থেকে অন্তত রেহাই পেতাম, কিন্তু তোমার কি আর কোনও চিকিৎসা পেতাম! অন্তত লিভার মেটাসটাসিসের যে চিকিৎসা চলছে, সে সম্পর্কে কিছুক্ষণ তো কথা বলতে পারতাম। আসলে কী জানো, বিদেশের ভাবসাব দেখে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তাদের বিস্তর শ্লোগান টোগান শুনে বিশ্বাস হয়না সাদাদের বেশির ভাগের রন্ধ্রে রন্ধ্রেলুকিয়ে আছে বর্ণবাদ। বিশ্বাস হয় না যে সুযোগ পেলেই তারা তাদের ঘৃণা উগরে দেবে। ডাক্তার, সত্যি বলতে কী, আমাকে অনেকটা দূর করেই দিল তার চোখের সামনে থেকে। আমি যে ডাক্তার, তা বোধহয় বিশ্বাসও করেনি। আর, গরিব দেশের ডাক্তাররা যে ডাক্তার তা-ই বোধহয় মনে করে না। এই ব্যবহার পাওয়ার জন্য তেরো হাজার ডলার দিয়েছি।
তোমার অসুখের কথা আমি তোমাকে কিছু বলিনি। কী অসুখ, ডাক্তার কী বলেছে, তার কিছুই না। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলে কিছু একটা খবর গোপন করছি আমি। গোপন করলে কোন খবরটা গোপন করতে পারি, তা অনুমান করার মতো বুদ্ধি তোমার আছে! ডাক্তারকে আগেই অনুরোধ করেছিলাম যা জানানোর আমাকে যেন জানায়, তোমাকে নয়। বিদেশে ডাক্তাররা রোগীদের সব জানিয়ে দেয় কী অসুখ, কোথায় অসুখ, বাঁচার আশা আছে কী নেই, থাকলে কদিন বা ক’মাস, সব। জানার পর রোগীরা নিজের জীবনের বাকি কাজগুলো ওই সময়ের মধ্যে সেরে নেয়। গুছিয়ে নেয় সব। তোমার তো কোনও সহায় সম্পদ নেই গোছাবার। তোমার তো কোনও জমি জায়গা নেই কাউকে লিখে দিয়ে যাবার। তুমি নিঃস্ব এক মানুষ। কী দরকার জেনে কদিন বাঁচবে তুমি। কী দরকার জেনে ওই অসুখটির নাম। কী দরকার আর কষ্ট পেয়ে, জীবনে কষ্ট তো তুমি কম পাওনি। বাকি দিনগুলো অন্তত এটুকু জেনে স্বস্তি পাও যে তোমার চিকিৎসা চলছে, তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে শীঘ্র।