সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলে, হয়তো তারাই কোনও একদিন তোমার দুঃখ ঘোচাবে, কিছুই ঘোচায়নি কেউ। দাদা তোমাকে চাকরি পাওয়ার পর ঈদের সময় বছরে একটা সস্তা শাড়ি দিত। তাই পেয়েই কী ভীষণ খুশি হতে তুমি। এই দেওয়াটাও বন্ধ হয়ে গেল দাদাবিয়ে করারপর। দেওয়া বন্ধ হলেও কথা ছিল, কী ভীষণ অশান্তি আর অসুখ তোমাকে দিত দাদা আর তার বউ মিলে। ছোটদা তো অল্প বয়সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করলো। তোমার কোল খালি করে চলে গেল তোমার আদরের ছেলে। তার হিন্দু মেয়ে বিয়ে করাটাও মেনে নিলে তুমি। ছেলেকে বউসহ বাড়ি ফিরিয়ে আনলে। গীতাকে বড় আদর করে আফরোজা বলে ডাকতে। না, নামটা তুমি দাওনি। ওদেরই দেওয়া। কিন্তু ওইযে ঘেমে নেয়ে রান্নাঘরে সারাদিন পড়েপড়ে খাটতে দুই বউকে খাওয়ানোর জন্য, ওদের মুখে হাসি ফোঁটানোর জন্য, যেন তোমার ছেলেদের মুখে হাসি ফোটে, কী হল শেষ অবধি! ওরাও তোমাকে দাসীই মনে করেছে। দাসীর মতো খাটতে বলে দাসীরা যেমন ব্যবহার পায়, তেমন ব্যবহার পেয়েছে। আমরা চার ভাই বোন যেমন ব্যবহার করেছি, ওই দুই বউএর কাছ থেকে তেমনই পেয়েছে ব্যবহার। ছোটদার ছেলে হল, আর সেই ছেলে পোষার ভারপড়লো তোমার ওপর। তুমি পাগল হয়ে গেলে। সত্যি বলতে কী, পাগলই হয়ে গেলে তুমি। ওভাবে কেউ দেবশিশু পুষতে পারে, মানুষ নয়। দিন রাত্তির ব্যস্ততা তোমার। কী থেকে আবার কী হয়ে যায়, তটস্থ ছিলে তুমি। তোমার ঘুম হারাম হয়ে গেল। নাওয়া খাওয়ার কোনও ঠিক নেই। ভয়ে কাঁপতে। এদিকে আবার মায়াও তৈরি হল। ছেলেটার জন্য কী ভীষণ মায়া, কী অসম্ভব ভালোবাসা। তুমি পারোও ভালোবাসতে। পুষতে বলে ছোটদাও দেওয়া শুরু করলোপরবে উৎসবে তোমাকে শাড়ি পরব বলতে তো ওই একটাই। ঈদ। নতুনপরবহল, তার ছেলের জন্মদিন। তুমি খাটছো, তার ছেলেকে জন্মের পর থেকে মানুষ করছে। বিনিময়ে তোমাকে একটা সুতির শাড়ি। ঘরে পরার। তুমি ফিরেও তাকাতে না সে শাড়ির দিকে। দিনমান তাকিয়ে থাকতে দেবশিশুর দিকে না তাকিয়ে থাকলে ও যদি হাঁটতে গিয়ে পড়ে যায়, দৌড়োতে গিয়ে কোথাও লাগে। অসাবধানে কিছু যেন না হয়। হাত সাতবার গরম জলে ধুতে ওকে ছুঁতে গেলে, ওর দুধের বোতল, ওর থালা বাটি ফুটন্ত জলে সাতবার ডোবাতে পারলে নিজের সারা গা ডেটলে ডুবিয়ে রাখতে। পেট যেন খারাপ না হয় ছেলের। হঠাৎহঠাৎ ঢাকা থেকে লং ড্রাইভে ছোটদা আর তার বউ চলে আসতো, বেড়ানোও হল, ছেলে দেখাও হল। তুমি তটস্থ হয়ে থাকতে। যত্ন আত্তিতে আবার কোনও ত্রুটি ধরাপড়ে গেল কীনা। তোমার জীবনে বোধহয় অত কঠিন মানসিক চাপ আর কখনও আসেনি। সবচেয়ে বড় কোনও পরীক্ষার প্র্যাকটিক্যাল দেওয়ার মতো। ছোটদারা এলে ওদের সামনে ছেলেকে নিয়ে তুমি দেখাতে যে কত হাসছে, খেলছে। মা বলতে শিখছে। আরও বড় হলে বলতে হাঁটতে শিখছে, পড়তে শিখছে, আঁকতে শিখছে। ছোটদারা দেখে যেত কতটা শিখেছে। তাদের কোনও পরিশ্রম ছাড়াই ছেলে বড় হয়ে যাচ্ছে, বেস্ট বয় হচ্ছে, এতে খুশি হবেনা তোঅবকাশে এলেই গীতা মুখবিষকরে রাখতো। যেন তুমিমানুষ করছে ঠিকই, ঠিকমতো করছোনা। আচ্ছাওরকনুইয়ের কাছে আবার কিসের দাগ? পড়ে গেছলোনাকি? যেন এক্সামিনার প্রশ্নকরছেন। তোমার মুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যেত। দূরে গিয়ে কাঁদতে। আঁচলে মুছতে চোখের জল। একসময় এসে খন্ডন করতে গীতার অভিযোগ। আলোয় এনে দেখাতে সুহৃদের কনুইয়ে কোনও দাগ নেই। জামা জুতো খুলে সারা শরীর দেখিয়ে দিতে। নিটোল নিখুঁত। ওদের মুখে হাসি ফোঁটাবার জন্য কী রকম যে আকুল ছিলে, মা। দাসী ছিলে তুমি। কিন্তু তুমি তো মা, তুমি দাসী হবে কেন? দাসীরা তো মাইনেপায়, দাসীদের স্বাধীনতা থাকে বাড়ি বদল করার। ক্রীতদাসী ছিলে।
তোমাকে ভালোবাসার কোনও চল আমাদের বাড়িতে কখনও ছিলো না। বাবাকে যমের মতো ভয় পেতাম। বাবা ছিল আমাদের শিক্ষক। আমাদের নীতি আদর্শ বোঝাতো। সকাল সন্ধে কেবল জ্ঞান দিত। বড় হবার, ভালো হবার, সৎহবার, মানুষের মতো মানুষ হবার। বাবার টাকায় আমাদের খাওয়া হত। বাবা কিনে দিলে কাপড় জামা পেতাম। বাবাইস্কুলে ভর্তি করাতো, বইখাতা কিনে দিত, মাস্টার রেখে দিত। বাবা কলেজে পড়াতো, কলেজে যাবার রিক্সাভাড়া দিত। বাবার বাড়ি। বাবার টাকা। বাবার সব। বাবা ভালোবেসে কাছে টানতো। রাগ হলে পেটাতো। জন্মেরপর বাবাকেই দেখেছি পরিবারের সবচেয়ে বড় একজন মানুষ। যেসবচেয়ে বেশি বিদ্বান। যার আদেশে যার উপদেশে সংসার, সন্তান চলে। তুমি ক্রীতদাসী, পড়ে থাকতে রান্নাঘরে, দৌড়ে দৌড়ে বাবার আদেশ মতো কাজ করতে। বাবার ধমক খেতে। বাবাকে খুশি করার জন্য তোমার পরিশ্রমের শেষ ছিল না। সেই ছোটবেলায় বাবার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে তোমার প্রতি হব কেন বলো তো! যমের মতো ভয় পেতাম, আবার মানুষটিকে ভালোবাসতাম। তার অপকর্মের জন্য যত ক্ষমা তাকে করেছি, তার সামান্যও তোমাকে করিনি। অপকর্ম না করলেও তোমার পান থেকে চুন খসলেই গর্জে উঠেছি, বাবা যেমন গর্জে উঠতো। বাবা যেমন তোমাকে মানুষ বলে মনে করতে না, আমরাও করতাম না মা। বাবা ছিল আমার, আমাদের শিক্ষক। তুমি চাইতে বাবার কথা শুনি, বাবার উপদেশমানি, আবার তোমাকেও একেবারে হেলা না করি। শিক্ষক তোমাকে হেলা করতো, তাই হেলা করতে শিখেছি। শিক্ষক যা বলে, তাই কি শুধু শুনেছিলাম, শিখেছিলাম; শিক্ষক যা করে, তাও করেছিলাম! পুরোটা শৈশব, কৈশোর, যৌবন জুড়ে শিখেছি। তোমাকে হেলা করতেই শিখেছি। আসলে মানসিকতা ওই শৈশব কৈশোরেই গড়ে ওঠে। সেটি নিয়েই আমরা বাকি জীবন কাটাই। খুব বড় কোনও পরিবর্তন পরবর্তী জীবনে আসে বলে মনে হয় না। তা না হলে তোমার একাকীত্বের দিকে কখনও আমি তাকাইনি কেন? আমি তো কত কারও কষ্টে কেঁদেছি, তোমার কষ্ট আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি কেন? তোমাকে ক্রীতদাসী ভেবেছিলাম, ভাবতে শিখিয়েছিল বাবা, তোমার স্বামী, তোমার প্রভু। আমি জানি না বাবার দোষ দিয়ে আমি একরকম পার পেতে চাই হয়তো। নিজের দায়িত্ব বলে কিছুকি ছিল না আমার, যখন বড় হলাম? তোমার প্রতি কোনও দায়িত্ব আমি বোধ করিনি। তুমি মা। তাতে কি? যখন আঘাত পেতে, বারবার বলতে ‘আমি তো মা, আমি তো মা’। তুমি যে মা সে কথা ভুলে থাকি বলে অভিযোগ করতে। হয়তো অভিযোগও করতে না, একা একা কষ্ট পেতে পেতে স্বগতোক্তি করতে! তোমার সঙ্গে অত জঘন্য আচরণ করি কেন, তুমি তো মা। মা বলে তুমি ভালোবাসা আশা করতে না, না পেতে পেতে তোমার অভ্যেস ছিল না পাওয়ার, শুধু চাইতে তোমাকে অত বিচ্ছিরিভাবে অপমান যেন না করি। যেন অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে বাবার মতো না হই। বাবারমতোহওয়ার স্বপ্নই তো ছিল আমার জীবনভর। বাবার মতো আদর্শবান, পর্বতের মতো উঁচু, ভেঙে না পড়া, মচকে না যাওয়া, পরোয়া না করা, দৃঢ়, ঋজু। বাবার মতো বস্তুবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক, কুসংস্কার-না-মানা, ধর্ম-না-মানা, কর্মঠ, নিষ্ঠ। এই গুণগুলোকে না ভালোবাসার কোনও কারণ ছিল না। বাবার সঙ্গে আমার নানা বিষয়ে মতবিরোধ হওয়ারপরও বাবা হতে চাওয়া থেকে আমি বিরত থাকিনি। বাবার মতো সবল, সাহসী, সত্যবদ্ধ আর সুশৃঙ্খল আমরাও যেন হই, চাইতে। কিন্তু বাবার চেয়েও মানুষ হিসেবে বড় হই, সহিষ্ণু হই, বিনম্র হই, নিরহংকার হই, উদার হই, এও চাইতে। তুমি কি তোমার নিজের জন্য অপমানিত না হওয়া চাইতে! নিজেকে ভালো লাগা দিতে! আসলে আমাদের জন্যই চাইতে। যেন আমরা কাউকে ঘৃণা না করে, কাউকে অশ্রদ্ধা না করে মানুষ হই, বড় মানুষ। বাবাও চাইতো আমরা যেন মানুষ হই। তোমাদের চাওয়ায় কোনও কার্পণ্য ছিলো না। শুধু মানুষ বলতে দুজনে দুরকম বুঝতে।