প্রভুর যাওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই। কিন্তু আমি যাবোই। ভর্তি হওয়ার জন্য কিছু কাপড় চোপড়ও নিলাম। হাসপাতালে আরও কটা দিন থেকে যাওয়া উচিত, এ কথা ডাক্তাররাও বলেছিলেন। কিন্তু থাকতে দেওয়া হল না আমাকে। প্রভু এবং ডাক্তারদের মধ্যে কী কথা হল। যে ডাক্তাররা বলেছিলেন, থাকা জরুরি, তাঁরাই বলে দিলেন, জরুরি নয়। সরকারি হাসপাতাল এইমস হাসপাতাল। সরকারি আদেশ মাথা পেতে নেবেনই সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা।
আমি ভাবছিলাম, খুব গভীরভাবে ভাবছিলাম, আমাকে যে ভ’বাবু দেশ ছাড়ার কথা বলেছেন, তা অতটা অমানবিক নয়, যতটা অমানবিক সিসিইউ থেকে রক্তচাপের রোগী উঠিয়ে পনেরো মাইল দূরে নিয়ে গিয়ে সবচেয়ে ভয়ংকর সংবাদটি দেওয়া। এর চেয়ে অমানবিক আর কী হতে পারে! আমার দুর্বল হৃদপিণ্ডটি তো বন্ধ হয়ে যেতে পারতো!
আর কোনও রাখ ঢাক রইলো না। এ কথা এখন দিনের আলোর মতো, যে করেই হোক তারা চাইছেন চলে যাই। অসুখে বিসুখে মানুষের মন দুর্বল থাকে। দুর্বল সময়টাকেই বেছে নিয়েছেন কঠিন দাওয়াইটি দেওয়ার জন্য। আমি বললাম বটে আমি যাবো না, কিন্তু তিনি কি আর মানবেন! তিনি নিশ্চয়ই আগুন হয়ে আছেন আমার স্পর্ধা দেখে। হাল ছাড়েন নি। একা মানুষ। তার আবার শক্তি কতটুকু। কতদিন সে বইতে পারবে একাকীত্ব আর পরাধীনতার যন্ত্রণা!
হাসপাতালে গিয়েও ফেরত আসতে হল। ভর্তি নেয়নি।
বাড়িঘর ছেড়ে, প্রিয় বেড়াল ছেড়ে, বইপত্র, বন্ধুদের ছেড়ে, নিজের জীবন ছেড়ে, অনিশ্চয়তার বোঁটকা-গন্ধ-কাঁথায় মুখ-মাথা ঢেকে, দিনের পর দিন পড়ে থাকা কোথায় পড়ে থাকা কতদিন কিছুই না জানা –হৃদপিন্ডকে দাঁতে নখে কামড়েছে ভীষণ।
তারপর তো হৃদয় স্তব্ধ হলে অগত্যা সিসিইউ। যায়-যায় জীবনকে কোনওমতে টেনে আনা হল, ধুকধুক বুক ফিরে যেতে চায়, রুগ্ন শরীর ফিরে যেতে চায় ঘরে। বেড়ালের কাছে, বন্ধুর কাছে, স্পর্শের কাছে প্রিয়।
কে আর তোয়াক্কা করে হৃদয়ের! সিসিইউ থেকে তুলে নিয়ে তাকে শোনানো হল বড় গম্ভীর, গা কাঁপানো স্বর, অন্য কোনও দেশে চলে যাও, এ-দেশ ছাড়ো। কোথায় যাবো, কোথাও তো যাওয়ার নেই আর, মরলে এ মাটিতেই মাটি দিও।
মাটি খুঁড়ে দেখতে চাও তো দেখে নিও আমার শেকড়। কারই বা কী দায় পড়েছে দেখার, কারই বাদায় পড়েছে চোখের জলে ভেসে যাওয়া মানুষের কাতরানো দেখে কাতর হওয়ার! সিসিইউ থেকে আবার নির্বাসনে, আবার অন্ধকারের গায়ে আবর্জনার মতোছুঁড়ে হাত ধুয়ে বাড়ি চলে গেলেন ওঁরা, ওঁরা খুব বড় বড় লোক, হাতজোড় করে নতমস্তকে নমস্কার করি ওঁদের।
০৯.৩ ডায়রির পাতা (ফেব্রুয়ারি)
৫ ফেব্রুয়ারি
আমি কি শুধু আমার জন্য বাঁচি! আমি কি শুধু আমার কথাই ভাবি! তা হলে সেই কবেই আপোস করে ক্ষমা চেয়ে নিরাপদ জীবনের দিকেই যেতে পারতাম! যাইনি তো! আমার বাক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করি, এভাবেই আর সবার বাক স্বাধীনতা আর মত প্রকাশের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করি। যে দেশ বা যে রাজ্য থেকে আমাকে তাড়ানো হয়েছে, সেই দেশে বা রাজ্যে আমি ফিরতে চাই, যেন সেই দেশে বা রাজ্যে মত প্রকাশের অধিকারের মর্যাদা দেওয়া হয়। যেন সারা পৃথিবীতেই দেওয়া হয় মর্যাদা। যে কোনও বিষয়ে নিজের মত প্রকাশের অবাধ অধিকার থেকে যেন বঞ্চিত না হয় কেউ। যেন অন্ধত্ব আঁকড়ে ধরে সমাজকে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। যেন সামনে এগোয়। সামনে আলোর দিকে। নারী বিদ্বেষ, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কুশিক্ষা, মূর্খতা, কূপমন্ডুকতা থেকে দেশ বাঁচে, সমাজ বাঁচে, মানুষ বাঁচে। বেঁচে থাকতে বড় কোনও পরিবর্তনের সামান্য স্পর্শও আমি পাবোনা জানি, না পাই, মানুষ তো টিকে থাকবে আরও লক্ষ বছর। ভবিষ্যতের মানুষ বাঁচুক স্বস্তিতে, শান্তিতে, নিরাপত্তায়, নিশ্চিন্তে, বৈষম্যহীনতায়। মানুষ বাঁচুক ধর্ম, কুসংস্কার, ইত্যাদির নাগপাশ থেকে, মানুষ বাঁচুক ঘৃণার বীভৎস কামড় থেকে। দুধে ভাতে বাঁচুক, ফুলের সুবাস নিয়ে বাঁচুক, ভালোবেসে বাঁচুক।
.
৭ ফেব্রুয়ারি
দেশি টিভি পারেনি আমাকে দেখাতে, নিরাপদ বাড়িতে আমি কেমন আছি। ঠিকঠিক ফ্রান্সের টিভি দেখিয়ে ফেললো সব। ফ্রান্সের সাংবাদিকরা এসেছিলো ভারতে। কলকাতায় গেছে, আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে কথা বলেছে। মিছিল মিটিংএর ছবি নিয়েছে, আর স্কাইগে আমার ইন্টারভিউ নিয়েছে।
.
৯ ফেব্রুয়ারি
দিনগুলো ঠায় বসে আছে বলে মনে হয়। ঠেলেও এক সুতো এগোতে পারি না। দিনগুলো অহেতুক মন খারাপ করে বসে থাকে। দিনগুলো সামনে থেকে সরে না। অজ্ঞাতবাসে এখন শুধু অপেক্ষা সতেরো ফেব্রুয়ারিতে আমার ভারতে বসবাসের অনুমতি আদৌ হবে কী না। যদি না হয়, কোথায় যাবো, কী করবো, কিছু জানি না। অনুমতি পাবো, এরকমই তো জানতাম। অনুমতি নাও দিতে পারে, এই সংশয়টা হচ্ছে। সংসদে আমার ভিসা পাওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক বক্তব্য শোনার পরও আমার সংশয় যায় না।
.
২১ ফেব্রুয়ারি
অনেকদিন হল আমি কিছু লিখিনি। লিখতে ইচ্ছে করেনি। কত কিছু ঘটে গেল এই দীর্ঘ এক মাসে। লেখালেখির মধ্যে করেছি একটিই, কিছু কবিতা লিখেছি। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি।
এই দিন কী চমৎকার উদযাপিত হত বাংলাদেশে। বাংলাদেশ কি আমার দেশ! আমার বিশ্বাস হয় না ওই দেশ আমার দেশ। ভারতকেও, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গকে নিজের দেশ বলে ভেবেছিলাম। এও মুহূর্তে মিথ্যে হয়ে গেল। আমার স্বপ্ন সম্পূর্ণই নির্ভর করছিল দু’একজনের মর্জির ওপর।