ভ’বাবু যখন আমাকে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, বলছেন কিছু দিনের জন্য যেন যাই, আমি শিরদাঁড়ায় টের পাই, এ যাওয়া কিছু দিনের জন্য নয়। এ যাওয়া জন্মের মতো যাওয়া। সারাজীবনের জন্য যাওয়া। বাংলাদেশেও বলেছিলো, কিছু দিনের জন্য যাও, পরিস্থিতি শান্ত হলে ফিরে এসো। পরিস্থিতি শান্ত, আজ প্রায় চৌদ্দ বছর হতে চলল, হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ থেকেও আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার সময় বলেছে, দুদিনের জন্য যাও, দুদিন পর ফিরে এসো। তিন মাস হতে চললো, আজও পশ্চিমবঙ্গে আমার ফেরা হয়নি।
‘আপনি থাকুন কিছুদিন বাইরে, আপনি গেলে আমাদের পক্ষে সুবিধে হবে আপনাকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনা। তখন আপনি ফ্রান্স থেকে বাইওরোপের যে কোনও দেশ থেকে সোজা কলকাতায় ফিরতে পারবেন। আপনার কোনও দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। কী করে যাবেন না যাবেন, সব ব্যবস্থা আমরা করে দেব। আপনি এ দেশের সম্মানিত অতিথি। দেখুন, আপনার সঙ্গে কারও দেখা করতে দিচ্ছি না, আপনাকে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে দিচ্ছি না, সে নিরাপত্তার কারণে। পঁচানব্বইটা লোক ভালো, কিন্তু পাঁচটা লোক তো খারাপ হতে পারে। সে কারণেই কোনও রিস্ক আমরা নিচ্ছি না।
কথা যখন বলছেন উনি, মাঝে মাঝে তাকাই তাঁর মুখের দিকে। কপালের ভাঁজগুলোয় স্পষ্টতই বিরক্তি। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এই মানুষটিই সেই মানুষ, একসময় যাঁর বাড়িতে আমি যেতাম। চা খাওয়াতেন। আমি বই উপহার দিতাম। মিষ্টি, দই, ফুল এসব নিতাম তার জন্য। তিনি বসে বসে আমার কবিতা পড়তেন। বলতেন, কবিতা তাঁর খুব ভালো লাগে। একবার ভালো কবিদের সব ভালো কবিতার বইই তাঁকে দিয়ে এলাম তার বাড়িতে। যতদিনই তাঁকে ফোন করেছি, বলেছেন তাঁর বাড়িতে যেতে। দলের সাক্ষাৎপ্রার্থী কর্মীরা বসে থাকতেন, সবাইকে রেখে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন। সবচেয়ে বেশি সময় আমাকেই দিয়েছেন। আমার রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আগেই তিনি খোঁজ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বলে দিতেন। বলতেন আমাকে, যে, বলে দিয়েছেন। সেই ভ’ বাবু। ভ’বাবু শত্রুর মতো কথা বলছেন, কণ্ঠে তাঁর এতটুকু মমতা নেই, তারপরও আমার বিশ্বাস হয় না তিনি সত্যিই এখন আমার শত্রু। আমার এই এক মুশকিল, কাউকে মন্দ লোক বলে বিশ্বাস হতে চায় না। তিনি বলতে থাকেন, ওই একই কথা, বারবার নানারকম ভাবে নানা দিক থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে থাকেন। সংক্ষেপ করলে একটি বাক্যই বেরিয়ে আসে, আপনি ভারত ছাড়ুন। আমি কি ছাড়বো ভারত? এককালে যাকে আমি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতাম, যিনি আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, আজ রাজনীতি তাঁকে তার নীতি বা আদর্শ থেকে দূরে সরিয়েছে, আমার প্রতি মায়ামমতা স্নেহ যা ছিল সব ছুঁড়ে ফেলে তিনি একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাকে লোভ দেখাচ্ছেন, মুখোশটা পরে আছেন আমার শুভাকাঙ্ক্ষীর।
এখন বলার পালা আমার। খুব শান্ত কণ্ঠ আমার। অসম্ভব শান্ত স্বর। সবে মৃত্যুর মুখ দেখে আসা আমি। এখনও আমার আকাশ পাতাল করা রক্তচাপের কাঁধে বসে দুষ্টু মৃত্যু আমার সঙ্গে নিজে নিজেই লুকোচুরি খেলছে। জাগতিক সবকিছু আমার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ। সেখানে রাজনীতির মারপাঁচ, স্বার্থপরতা, নোংরামো আমার কাছ থেকে সহস্র আলোকবর্ষ দূরে। শান্ত কণ্ঠে বলি, ‘বিদেশে আমি দশ বছর ছিলাম। দশ বছরে একটি দিনের জন্য আমি ওই সমাজে, মনে করতে পারিনি যে আমি বিলং করি। আমি যদি কোনো সোসাইটিতে বিলং করি বলে না মনে করতে পারি, তবে সেই সোসাইটিতে জীবন খুব দুঃসহ হয়ে ওঠে। যদিও আমার অনেক নাম ছিল, অনেক পুরস্কার পেয়েছি বিদেশ থেকে, কিন্তু কোনওদিনই আমি মনে করতে পারিনি বিদেশ আমার দেশ। এই ভারতবর্ষ, এখানে আমি অফিসিয়ালি বিদেশি, ফরেনার। কিন্তু কখনো আমার মনে হয় না আমি এখানে বিদেশি। আমি এ দেশে নিজের ভাষায় কথা বলছি। এখানের কালচার আমার কালচার। আমি জন্ম থেকে বড় হয়েছি এই বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে। তাছাড়া শুধু বাংলা নয়, ভারতের যে অংশে, যে অঞ্চলেই আমি যাই না কেন, মনে হয়, আমি এ দেশের, এ মাটির মানুষ। কখনো মনে হয় না আমি ফরেনার, কখনো মনে হয় না আমি এ দেশে বিলং করি না। একটিবারের জন্যও এই দেশে আমার মনে হয় না আমি বিদেশি। আগে তো টুরিস্ট ভিসা দেওয়া হত, যখনই ভিসা পেতাম, চলে আসতাম কলকাতায়। আর যখন থেকে রেসিডেন্স পারমিট দেওয়া হল, তখন থেকে তো থাকতে শুরু করলাম। আমার যা কিছু ছিল বিদেশে, প্রায় সব নিয়ে এসেছি কলকাতার বাড়িতে। দেশ থেকে আমার দাদাদেরও পাঠিয়ে দিতে বলেছি আমার বইপত্র। আপনিই তো আমার রেসিডেন্স পারমিট এক্সটেনশন করায় সাহায্য করতেন, সবসময় এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করে এসেছেন। আপনি যদি আমার বাড়িতে যান কলকাতায়, দেখবেন, মনে হবে যেন তিরিশ বছরের সংসার, এমন। এই স্বপ্ন, এই সংসার ছেড়ে আমি যাবো কোথায়! আমি বাঙালি, বাংলায় লেখালেখি করি, তাই বাংলায় একটু জায়গা চাই। নিজের মতো করে থাকা, লেখালেখি করা। এর বেশি কিছু তো চাই না। বাংলাদেশে যদি সম্ভব হত, চলে যেতাম। চেষ্টা যে করিনি, তা নয়। ওখানে আমার ল’ইয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি…’।