কিছুই ঘটে না আর। কিছু একটা ঘটুক চাই।
.
১৭ জানুয়ারি
রাতে আবারও দুঃস্বপ্ন। সারারাত আবারও অস্থিরতায় ভুগেছি। দুঃস্বপ্ন আমার কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। জেগে ওঠার পরও অনেকক্ষণ এই কিডনি নষ্ট হওয়া, মরে যাওয়াটা গেঁথে ছিল ভেতরে। অনেক পরে, সূর্য ওঠারও পরে আমার বোধ হল যে, না, ওটা স্বপ্ন ছিল, সত্যি ছিল না। স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন সত্যি মিথ্যে সব কেমন একাকার হয়ে গেছে। আলাদা করে কোনওটাকে আমি এখন চিনতে পারি না। আজ কোথাও কিছু নেই। কোনও পত্রিকা কিছু লেখেনি। কেউ ফোন করেনি। তপন রায় চৌধুরীর বাড়িতে ফোন করে জানলাম, যে চিঠিটি তাঁর লেখার কথা ছিল ভ’কে, আমাকে একটু যেন বেরোতে দেওয়া হয়, একটু যেন বন্দিত্ব শিথিল করা হয়, সেই চিঠিটি এখনও লেখা হয়নি। তিনি রাজ্য সরকারের কারও সঙ্গে আমার বিষয়ে যে কথা বলবেন বলে বলেছিলেন, সে কথাটাও তাঁর আজও বলা হয়নি। আমার কী রকম বাজে লাগে কাউকে ফোন করে কিছুর জন্য অনুরোধ করতে। বিশেষ করে সেই কিছুটা যদি নিজের জন্য হয়।
আমার এই এখানে এই অচেনা জায়গায় পড়ে থাকা, কী রকম অদ্ভুত লাগে সব কিছু। জোরে জোরে শ্বাস নিই। জোরে শ্বাস নিলে শ্বাসকষ্ট কিছু কমে। কত কেউ কথা দিয়েছিলো রোজ ফোন করবে, অথবা প্রায়ই, তারা সব ভুলে গেছে। যে কেউ ফোন করলে কলকাতা থেকে, অনুরোধ করি, যেন ফোন করে, যেন আবার, যেন কাল, যেন পরশু। বুঝি আমি, কী রকম ভয়াবহ অসহায়তা আমাকে চেপে ধরেছে।
বিকেলে কিছু ঘটলো। সিএনএন এর এক ছেলে কিছু প্রশ্ন পাঠিয়ে তার উত্তরগুলো লিখে নিলো। ওদের ওয়েবসাইটে আমার সঙ্গে পাঠকের চ্যাটের আয়োজন করেছিলো। কিছুটা সময় কাটলো অন্তত প্রশ্ন উত্তরে। কিন্তু তারপর? তার আর পর নেই। আবারও একলা বসে থাকা। বসে থাকা আর জানালায় তাকিয়ে থাকা। তাকিয়ে থাকা আর দীর্ঘশ্বাস ফেলা। সত্যি কথা বলতে কী, আমার লেখায় পড়ায় কিছুতেই মন বসছে না। কবে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা স্বাভাবিক স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারবো, এই ভাবনা।
শিবানীর সঙ্গে ফোনে আমাদের সেই বইমেলা যাপনের কথা স্মরণ করছি শেষ বিকেলের দিকে। বলছি সেই কফি হাউজে আমাদের সেই দিনগুলোর কথা–পিপলস বুক সোসাইটির একটা ভালো ঘর হবে কলেজ স্ট্রিটে কোথাও, যাবো প্রায়ই, আড্ডা দেব, এরকম আমাদের স্বপ্ন ছিল। সেই ভালো ঘর শেষ অবদি নেওয়া হয়েছে। কবে মুভ করবে ভালো ঘরটিতে, কবে সাজাবে ঘরটি, কবে আচ্ছা! শিবানী বললো, ”তুমি ফিরে এলে।
কথোপকথন শেষ হলে চা খাচ্ছি, প্রভু টেলিভিশন দেখছেন আর হাসছেন, হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তার, আপনার ফ্ল্যাট কি বিক্রি করে দিলেন?
–কেন? আমার প্রশ্ন।
–ওই যে কথা বললেন ফোনে। ফ্ল্যাটের কথা কী বললেন?
–না। ওটা আমার ফ্ল্যাট নয়। ওটা আমার পাবলিশারের দোকান। নতুন দোকান নিয়েছে।
প্রভু আমার ব্যক্তিগত জীবন, ফ্ল্যাট ইত্যাদি নিয়ে নাক গলানোর লোকই নন। এই নাক গলানোটা, আমার আশংকা, তার চাকরির নাক গলানো। আমার মনে হতে থাকে, তাঁকে বলে দেওয়া হয়েছে আমার খোঁজ খবর রাখার জন্য, লক্ষ্য রাখার জন্য আমি কবে কাত হব, কবে বিদেয় হব, গুটিকয় আশা ফুরোতে ফুরোতে কবে আমি নিঃস্ব হব। এই নির্দেশগুলো একেবারে ওপরতলা, একেবারে ভ’ থেকে আসছে, ভ যে এত স্নেহ করতেন, সব এক ফুৎকারে উবে গেল। আমি তো কোনও অন্যায় করিনি। উনি কি জানেন না আমি কষ্ট পাচ্ছি। আমার জন্য একটুও কেন কারও মায়া হচ্ছে না?
সন্ধেয় ফোন এলো ফ্রান্স থেকে। ক্রিশ্চান বেসএর ফোন। যে করেই হোক, একটা বই চাইছেন ছাপাতে। ভারত সরকার দ্বারা ভারতেই নির্বাসিত হওয়ার কাহিনী নিয়ে বই। বললেন, ফরাসি প্রেসিডেন্টকে দিয়ে হয়তো সম্ভব হবে না, তার সঙ্গে যেমন্ত্রী বা উঁচুপদের সরকারি যারা আসবেন ভারতে, তাদের কাউকে দিয়ে চেষ্টা করছেন যেন সিমোন দ্য বোভোয়া পুরস্কারটি আমাকেই এই ভারতেই দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়!
খুব জোরে জোরে শ্বাস নিলাম ক’টা। জানি না সামান্য বল কোথাও থেকে পেলাম কী না। একটা সাদা কাগজে টেনে নিয়ে লিখে দিলাম, কী চাই আমি। প্রভুকে আমার এই চাওয়ার লিস্টিটি দিই। এই চাওয়াগুলো মুখে জানিয়েছি অনেকবার, বেশ অনেকদিন, অনেক সপ্তাহ।
দেখা করতে চাই।
১.জাবির হোসেন, সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত কবি এবং রাজ্যসভা সদস্য।
২.সুধীরনাথ, বন্ধু এবং কার্টুনিস্ট
৩.অরুণ মাহেশ্বরী, প্রকাশক এবং বন্ধু
৪.শীলা রেড্ডি, বন্ধু।
৫.একজন মেডিসিনের ডাক্তার, যে আমার উঁচু রক্তচাপ, রক্তের চিনি, কোলেস্টোরল পরীক্ষা করবেন এবং চিকিৎসা করবেন।
৬.একজন থেরাপিস্ট বা মনোবিশেষজ্ঞ, যিনি আমার চরম মানসিক অবসাদ, হতাশা, দুশ্চিন্তা ইত্যাদির চিকিৎসা করবেন।
৭.বাইরে বেরোতে চাই, মানুষ দেখতে, মানুষ হাঁটছে, চলছে, বেড়াচ্ছে, এসব দেখতে, জীবন দেখতে।
প্রভু বললেন, তিনি যথাস্থানে জানাবেন আমার আবেদন।
.
১৮ জানুয়ারি
কলকাতায় একটা পত্রিকাই ছিল আমার পক্ষে, আমার পাশে। দৈনিক স্টেটসম্যান। অন্য কাগজগুলো চুপ। ‘আজকাল’ সিপিএমের মুখপত্র। লজ্জা বেরোনোর পর থেকেই আমার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাচ্ছে। দৈনিক স্টেটসম্যান-এর মানস ঘোষকে অনেকদিন ধরে চিনিও। বাংলাদেশে গিয়েছিলেন অনেক বছর আগে, দ্য স্টেটসম্যান এর জন্য আমার সাক্ষাৎকার নিতে। সেই মানস ঘোষ যখন বাংলা দৈনিক স্টেটসম্যান শুরু করলেন, খুব স্বাভাবিক কারণেই খুব শুভাকাঙ্ক্ষী তিনি আমার। নিয়মিত আমি লিখতামও তার কাগজে। দুঃসময়ে যখন কোনও পত্রিকা পাশে নেই, তখন দৈনিক স্টেটসম্যানই দিনের পর দিন ছাপিয়ে গেছে আমার পক্ষে সবার নিবন্ধ, প্রবন্ধ, খবরাখবর। হঠাৎ স্টেটসম্যান হাউজ, টের পাচ্ছি, দূরে সরার সব আয়োজন আনুষ্ঠানিকভাবেই সেরেছে।