সন্ধেয় প্রভু ফিরলেন তৃতীয় বাড়িতে। প্রভুর ফেরা মানে বিদায় ঘণ্টা। এখন চলে যেতে হবে আবার সেই ঘরটিতে, লোকচক্ষুর আড়ালে, যে ঘরটিতে থাকার কারণ নিরাপত্তা নয়, কারণ রাজনীতি। যে রাজনীতি আমি বুঝি, কিন্তু মেনে নিতে পারি না। সারাপথ প্রভু শুধু একটিই তথ্য দিলেন, আমার সঙ্গে ইউটিভির রাম মার্চেনড়ানির দেখা হবে না। ইউটিভি আমার ওপর ছবি বানাতে চাইছে। কর্তারা দেখা করে চাইছেন কথা বলতে। দেখা হওয়ার জন্য যে প্রভুর কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম, তা নাকচ হয়ে গেছে। কে নাকচ করলো, তা প্রভুও বলেন না, আমিও জানতে চাই না। প্রভু বলেছিলেন, আমার আবেদন নিবেদন তিনি যথাস্থানে জানিয়ে দেন, সেই যথাস্থান থেকে যা আদেশ আসে, তাই তিনি মাথা নত করে পালন করেন।
প্রভু বিদায় না নিয়েই চলে গেলেন। এরকম হয় না কখনও। তাঁর রাগের কারণ আমি বুঝি। রাগ তাঁর, আমি কেন জ্যোতিবাবুর বক্তব্যের উত্তরে টিভিতে আমার অনুভূতি ব্যক্ত করেছি। প্রচুর সাংবাদিকের ফোন বেজেই চলছিল, একজন চেনা সাংবাদিককে শুধু বলেছি, ‘খুব ভালো লাগছে জ্যোতি বাবুর কথায়, আশা করি একদিন মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, একদিন আমিও ফিরতে পারবো আমার প্রিয় শহরটিতে। এইটুকু কেন বলবো না আমি! জ্যোতি বাবু আমাকে স্নেহ করতেন, তিনি স্বাগতম বলার পরও আমাকে কেন মুখ বন্ধ রাখতে হবে, কেনই বা আমি আমার ইচ্ছেগুলোর কিছুই মুখ ফুটে বলতে পারবোনা! প্রভুর কড়া আদেশ এবং অনুরোধ ছিল, প্রেস খারাপ, প্রেসের চৌদ্দ গুষ্ঠি খারাপ, প্রেসের সঙ্গে ফোনে কথা বলোনা। প্রভুর আদেশ আমি প্রথম দিন থেকেই মেনে চলছিলাম। ধীরে ধীরে প্রভুকে যত দেখছি, তত জানছি, প্রভু এবং প্রভুর ওপরওয়ালারা কেউই দেবতা নন।
.
২৭ ডিসেম্বর
সন্ধেবেলায় প্রভুর সঙ্গে বসে কথা বলছিলাম। টেলিভিশনে ‘টাইমস নাও’ চ্যানেলের হেডলাইন খবরে প্রণব মুখার্জির মন্তব্য দেখাচ্ছিল তখন, যে, কারও নিরাপত্তা দেওয়া রাজ্যের দায়িত্ব, কিন্তু রাজ্য যদি এ ক্ষেত্রে বাড়তি নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রকে বলে, কেন্দ্র সানন্দে সেই বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে। এই খবরের মধ্যে হঠাৎ রাওয়ালপিন্ডিতে বেনজিরের নির্বাচনী সভায় বোমা হামলার খবর। টেলিভিশনে চোখ আমার। কিছু লোক মরে পড়ে আছে, কারও ঠ্যাং নেই, কারও খুলি উড়ে গেছে, মানুষ ছোটাছুটি করছে, চিৎকার করছে, কাঁদছে। কী ভয়ংকর! কী বীভৎস দৃশ্য! নিচের স্ট্রিপগুলো দেখছি, বেনজির সেইফ। এর একমিনিট পর বেনজির ইনজুর্ড, এর কিছুক্ষণ পর বেনজির আনকনশাস। এর আধমিনিট পর বিশাল বড় ব্রেকিং নিউজ, বেনজির ডেড। স্তব্ধ হয়ে গেলাম। শুধু অস্ফুট উচ্চারণ, এ কী! এ কী কান্ড! এ কী সত্যি! এ কী হতে পারে!
হ্যাঁ হতে পারে। পাকিস্তান নামের দেশটিতে সবই হতে পারে। সন্ত্রাস ছড়াতে এবং সন্ত্রাসী তৈরিতে এর চেয়ে চমৎকার দেশ আর জগতে কোথাও নেই। ভয়, ও দেশের কোনও পাগল যদি পারমাণবিক বোমাগুলোর নাগাল পায়! জগৎটা নিমেষে ছাইয়ের মতো উড়িয়ে দেবে।
বেনজির আমার কাছে এমাসেই দুটো চিঠি লিখেছিলেন। প্রথম চিঠির উত্তর অনেকদিন পর দিয়েছিলাম। একটু একটু সন্দেহ ছিল। সত্যিই কি বেনজির ভুট্টো আমাকে চিঠি লিখেছেন। কেন তিনি এত ব্যস্ততার মধ্যে আমার মতো অরাজনৈতিক একজন মানুষকে চিঠি লিখে যাচ্ছেন। আমাকে সমর্থন করা মানে তো তাঁর মুসলমানের ভোট না পাওয়া। আমার এরকম একটি সংজ্ঞাই তো এই উপমহাদেশের গোপন অভিধানে করা হয়েছে। এ খবর যদি লোকে জেনে যায়, তবে তাঁরই বিপদ হবে ভীষণ। জীবনে আমি কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কোনও চিঠি-টিঠি পাইনি। এই প্রথম। তারপরও হটমেইলের ঠিকানা দেখে মনে খটকা তো লেগেই আছে, যে, বেনজির নয়, অন্য কোনও লোক মজা করার জন্য, অথবা কোনও বদ উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেছে। চিঠি সম্পর্কে প্রভুকেই কিছু বলিনি, যে প্রভুকে আমি সব কথাই বলি। কী করছি, কী ভাবছি, সব। প্রথম চিঠিটি পাওয়ার বেশ কিছুদিন পর বেনজিরকে একটি চিঠি পাঠাই আমি। সাদামাটা ধন্যবাদ জানানো চিঠি। চিঠি পাঠানোর দুদিনের মধ্যেই তার দ্বিতীয় চিঠিটি আসে। দ্বিতীয় চিঠি পাওয়ার পর কোনও উত্তর দিইনি। কারণ হটমেইল থেকে কোনও বড় রাজনৈতিক দলের চিঠি আসবে, এটা অনেক ভেবে দেখেছি, মানতে পারিনি। হটমেইল যদি কষ্টেসৃষ্ঠে মেনে নেওয়া যায়, সোনিয়া মানা যায়। তিনি একজন নেত্রী, আরেকজন নেত্রীকে মিসেস সোনিয়া গান্ধি অথবা সোনিয়া গান্ধি না বলে শুধু সোনিয়া বলে ডাকবেন না। কোথাও ভুল হচ্ছে। নিশ্চয়ই এই চিঠি বেনজিরের পাঠানো নয়। নিশ্চয়ই কেউ মজা করছে। কিন্তু কারইবা মজা করার দায় পড়েছে! মজাটা করে কার কী লাভ! দ্বিতীয় চিঠির কোনও উত্তর বেনজির ভুট্টো পাননি, সোনিয়া গান্ধিকে সোনিয়া লেখার অপরাধে।
এই সেই চিঠি, যেগুলো একবার পড়লে মনে হয় হ্যাঁ বেনজিরের লেখা। আবার মনে হয়, না, তাঁর লেখা নয়। হয়তো তাঁরই লেখা ছিল। মাত্র আট নদিন আগে পাঠিয়েছেন চিঠি। দ্বিতীয় চিঠির উত্তর না দিয়ে আমি হয়তো ভুলই করেছিলাম। না, চিঠি বড় কথা নয়। জলজ্যান্ত মানুষটা একটু আগে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়ে মঞ্চ থেকে নামলেন, নেমে গাড়িতে উঠলেন, গাড়ি সামান্য এগোতেই তাঁকে গুলি করা হল, তাকে মেরে ফেলা হল। আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ হল। কিন্তু আততায়ী কী করে বেনজিরের গাড়ির এত কাছে আসতে পারলো! পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের জন্য যে ধরনের কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা, সে রকম বেনজিরের জন্য ছিল না।