অন্ধকার কেটে যাচ্ছে, আলো ফুটছে। ভোরের ঘুম ঘুম রাস্তায় গাড়ি হাওয়ার বেগে ছুটছে। পুলিশগুলো বারবার পেছনে তাকাচ্ছে, দেখছে এ গাড়ির কেউ পিছু নিচ্ছে কি না। পেছন ফিরে একজন হঠাৎ হিন্দিতে বললো, দিল্লিতে যাচ্ছি, কারণ আমাদের সেরকমই বলা হয়েছে।
ত–কে বলেছে?
পু–সেরকমই অর্ডার।
ত–কে অর্ডার দিয়েছে?
পুলিশ চুপ।
ত–আমি তো কলকাতা ফিরবো। আমাকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন?
পু–আমরা অত সব জানি না।
ত–কলকাতায় না গিয়ে দিল্লি যাওয়ার কারণ কী?
পুলিশ চুপ।
ত–দিল্লিই যখন যাচ্ছেন, তখন দিল্লিতে প্লেনে না গিয়ে গাড়িতে যাচ্ছেন কেন?
এ কথাটা পাঁচবার জিজ্ঞেস করার পর উত্তর জোটে, সিকিউরিটি।
গাড়ি চলছে। এরমধ্যে ফোন। কলকাতা থেকে। খবর পেলাম, আমার গাড়িকে অনুসরণ করছে স্টার আনন্দের দিল্লি সংবাদদাতা। স্টার আনন্দতে সরাসরি প্রচার করা হচ্ছে অজানার উদ্দেশে আমার যাত্রা। গাড়ি জয়পুর ছাড়িয়ে যাচ্ছে, কোথাও না কোথাও যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে জানি না। একসময় স্টার আনন্দর অনুসরণ করা সাংবাদিক ফোন করলো আমাকে, ‘দিদি, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আপনাকে?’ উত্তেজিত কণ্ঠস্বর।
ত–জানি না। ওরা তো বলছে দিল্লি। কিছু বুঝতে পারছি না। দিল্লি কেন নেবে জানি না।
সা–এই আমার ফোন নম্বর। প্লিজ আমাকে জানাবেন কী হচ্ছে না হচ্ছে। আমরা আছি আপনার সঙ্গে। দিদি, কোনও চিন্তা করবেন না।
ত–কলকাতায় যাবো সকালের ফ্লাইটে। তাই কথা হল রাজস্থানের পুলিশের সঙ্গে। এখন আমাকে কি না দিল্লি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কী রকম ধন্দের মধ্যে পড়েছি, দেখুন তো!
সা–আমরা তো আছি। ঘটনাটা কোথায় গিয়ে গড়ায়, দেখিই না। শুধু আমি নই, আমার মতো লক্ষ লক্ষ লোক আপনাকে ভীষণ রেসপেক্ট করে, দিদি।
ওই দিদি ডাক, ওই বাংলায় কথা বলা, হোক না ভাঙা বাংলায়, আমাকে স্বস্তি দেয়। আমি একা নই, আমার এই ভয়াবহ নিরুদ্দেশ যাত্রায় কেউ পাশে আছে, এই ভাবনাটিই আমার দুশ্চিন্তা ঘুচিয়ে দেয়।
জানি না কতদূর গিয়ে একসময় গাড়ি ঢুকে পড়ে একটা মোটেলের পেছনের নির্জন কোণায়। এক পুলিশ গাড়িতে থাকে, বাকি পুলিশ নেমে যায়। কোথায় যায় কে জানে, আর ফিরে আসে না। নতুন কিছু পুলিশ গাড়িতে ওঠে আধঘণ্টা পর। গাড়ি চলতে শুরু করে রাজপথে। আবারও হাওয়ার বেগে। কিছুক্ষণ পর সেই স্টার আনন্দের সাংবাদিক, কণ্ঠে আতংক আর অস্থিরতা, বলে, আমাদের সব সাংবাদিককে গাড়ি থামিয়ে গাড়ি থেকে বের করে মেরেছে পুলিশেরা। এখন মোটেলের একটা রুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শেকল দিয়ে চলে গেছে।
ত–কী বলছেন এসব! ভয়ংকর কাণ্ড!
সা–ওরা আপনার গাড়িকে ফলো করতে দেবে না।
ত–তাই বলে মারবে?
সা–যাচ্ছেতাই ভাবে পিটিয়েছে।
ত–আহা। বেরোবেন কী করে এখন?
সা–জানি না। মনে হচ্ছে হোটেলের লোকদের বলে দিয়েছে শেকল না খুলতে।
একসময় পুলিশদের জিজ্ঞেস করলাম, দিল্লিতে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? দিল্লির কোথায়? কোনও জায়গা আছে নির্দিষ্ট? পুলিশদের মধ্যে একজনই আছেন, যিনি হিন্দিতে অন্তত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন। যদিও উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে তার আদৌ আছে বলে মনে হয় না। উত্তর দিতে পারা পুলিশটিও গোঁফওয়ালা, ডাকাত-ডাকাত।
পু–না। জায়গা আপনাকে বের করতে হবে। আমরা দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে দেব।
ত–দিল্লিতে পুলিশের হাতে দেবেন তো আমাকে? মানে সিকিউরিটি পুলিশের হাতে?
পু–দিল্লির যে ঠিকানায় যেতে চান, সে ঠিকানায় আমরা আপনাকে পৌঁছে দেবো৷ হোটেলের নাম টাম জানেন?
ত–আমার কোনও ঠিকানা নেই দিল্লিতে।
পু–কী নেই?
ত–ঠিকানা।
ভ’বাবুকে ফোন করি। সরকারের বড় পদে এই ভদ্রলোককেই আমি চিনি। খুব দ্রুত, খুব ব্যস্ত মানুষটিকে তথ্য জানিয়ে দিই, তিনি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই।
ত–‘আমাকে কলকাতা থেকে জয়পুর পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, কাল রাতে জয়পুর পৌঁচেছি। এখন ওখান থেকে কয়েক ঘণ্টা পরই আমাকে, সকাল হওয়ার আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে দিল্লি। কলকাতায় ফিরতে চাইলাম। কিন্তু না জানিয়ে দিল্লি পাঠানোর কোনও কারণ আমি জানি না। দিল্লিতে নাকি কোনো পুলিশের সঙ্গে ওদের কথা হয়নি। আমার কাছে জানতে চাইছে কোথায় যাবো আমি।
ভ’বাবু বললেন কেন আমাকে পাঠানো হচ্ছে দিল্লিতে, কী ঘটেছে রাজস্থানে, এসব খবর নিয়ে তিনি আমাকে জানাবেন। তিনি আর জানাননি। তার সেক্রেটারি ফোন করে বললেন, আমি যেন রাজস্থানী পুলিশদের বলি আমাকে দিল্লির পুলিশ-স্টেশনে নামিয়ে দিতে। ওখান থেকেই আমাকে তুলে নিতে আসবেন ভ’বাবুর লোক।
‘তাহলে সিকিউরিটির লোকেরা ওখান থেকে আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাক। আমি চলে যাবো কলকাতায়।‘
ওদিকে ভ’বাবুর সেক্রেটারি। শুনছেন।
‘দেখুন তো, এর কোনও মানে হয়। আমাকে জয়পুরে থাকতে দেবে না দুদিন, তো আমাকে বাড়ি ফিরতে দাও। জয়পুর থেকে কলকাতা চলে গেলেই ঝামেলা চুকে যেতো। এখন জয়পুর থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে কলকাতা। এত ঘুরপথের দরকার কী ছিল, বুঝি না।
ভ’বাবুর সেক্রেটারি বললেন, হুম।
আমি বললাম, ”আচ্ছা বলুন তো, দিল্লি শহর থেকে এয়ারপোর্ট কি খুব দূর? ঠিক মনে পড়ছে না। আজকেই তো ফ্লাইট ধরা যাবে, তাই না।
সেক্রেটারি বললেন, ‘আগে দিল্লি পৌঁছোন তো। পরেরটা পরে দেখা যাবে।