এত দুঃখ নিয়েও মা বাড়িঘর সাজান, খাট আলমারি টেবিল চেয়ার আলনা সরিয়ে নতুন জায়গায় ফেলেন। দেয়ালের কাছে খাট ছিল, সেটি একেবারে উল্টোদিকে জানালার কাছে নিয়ে যান, আলমারি ডানদিক থেকে সরে বাম দিকে আসে। মার এ কাজটি আমার খুব পছন্দ হয়। ঘর একেবারে নতুন নতুন লাগে। মনে হয় নতুন জীবন শুরু হল। কেবল ঘর সাজানোই নয়, মা উঠোন মাঠ ফলগাছে ফুলগাছে শাকে সবজিতে সাজিয়ে রাখেন। এক এক ঋতুতে এক একরকম। হেলে পড়া গাছগুলোর কিনার দিয়ে বাঁশের কঞ্চির বেড়া দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার করা, মাটি কাটা মাটি ফেলা নিজেই করেন। শাক সবজি মা খুব ভালবাসেন। ছড়া বলে বলে হলেও তিনি আমাদের তাজা ফল, টাটকা শাক সবজি খাওয়াতে চেষ্টা করেন। মার ধারণা ছড়া শুনলে খুশিতে নাচতে নাচতে শাক খাব আমরা। মার আরও ধারণা মার হাতে লাগানো শাক সবজির প্রতি মার মত আমাদেরও আলাদা দরদ আছে। সারাবছরই পাতে সবজি তুলে দিয়ে বলেন,গাছের লাউ, গাছের সিম, গাছের টমেটো, গাছের এটা, গাছের সেটা।
একদিন খেতে গিয়ে মার মুখে গাছের লাউ উচ্চাজ্ঞরত হতেই আমি খপ করে ধরি।
গাছের লাউ মানে? লাউ তো গাছেই ধরে। গাছ ছাড়া লাউ হয় নাকি!
মা বলেন, এইডা গাছের, এইডা কিনা লাউ না।
কিনা লাউ কি মাটির নিচে হয়?
ধুর, লাউ মাটির নিচে হইব কেন?
তার মানে লাউ গাছেই ধরে।
গাছেই ত ধরে!
তাইলে কও কেন যে এইডা গাছের লাউ! বাজার থেইকা কিন্যা আনা লাউও তো গাছের লাউ।
আরে এইডা বাড়ির গাছের।
সেইটা কও, বাড়ির গাছের। কথাও ঠিকমত কইতে পারো না।
আমি মখূর্ মানুষ,লেখাপড়া শিখি নাই। তোমরা শিক্ষিত, তোমরা গুছাইয়া কথা কইবা। মা থেমে থেমে বলেন।
লেখাপড়া নিয়ে মার আক্ষেপ সারা জীবনের। আমার মেট্রিক পরীক্ষার আগে আগে, আমি যখন টেবিল ভরা বইখাতার ওপর উবু হয়ে আছি, মা মিনমিন করেন, প্রাইভেটে মেট্রিকটা যদি দিয়া দিতে পারতাম।
আমি হেসে উঠি, এই বয়সে তুমি মেট্রিক দিবা?
কত মানুষে তো দেয়। গণ্ডগোলের সময় আমার চেয়েও কত বয়ষস্ক মানুষেরা মেট্রিক দিয়া দিল, তখন তো সবাইরে পাশ করাইয়া দিছে সরকার। ওই চাকলাদারের বউতো গণ্ডগোলের সময়ই নকল কইরা মেট্রিকটা পাশ করল। তোমার বাপেই তারে প্রাইভেটে মেট্রিক দেওয়াইছে।
তা ঠিক, একাত্তরের ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম যে মেট্রিকের আয়োজন হয়েছিল, যে যেমন ইচ্ছে বয়সে যত বড়ই হোক, অ আ ক খ হয়ত লিখতে জানে কেবল, বসে গেছে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিতে। গণহারে নকল। গণহারে পাশ। সেই গণহারে রাজিয়া বেগম পার হয়ে গেছেন।
এহন তো নকল চলে না, তুমি কেমনে পাশ করবা?
নকল করতাম কেন?
তাইলে পাশ করবা কেমনে?
আমি পইড়া পাশ করবাম।
এক পেট হাসিকে বুক-চাপা দিয়ে বলি, তোমার কি মনে থাকবে পড়া?
কেন মনে থাকবে না? থাকবে।
তুমি তো হাতের মধ্যে চাবি লইয়া সারা বাড়ি চাবি খুঁইজ্যা বেড়াও। মনে থাকবে কেমনে?
তুমি আমারে অঙ্কডা একটু দেখাইয়া দিলেই দেখবা আমি পাশ কইরা যাব। বাংলা ইংরেজি তো কোনও ব্যাপার না। ইতিহাস ভূগোল ঝাড়া মখু স্ত কইরা ফেলব।
মার দুচোখ চিকচিক করে স্বপ্নে। স্বপ্ন থাকে চোখে, স্বপ্ন চোখে রেখেই বলেন,পরীক্ষা দিলে ঠিকই পাশ করবাম। ক্লাসে আমি ফার্স্ট গার্ল ছিলাম, প্রত্যেক পরীক্ষায় ফার্স্ট হইতাম। বিয়া হইয়া যাওয়ার পরও ইস্কুলের মাস্টাররা কইছিল পড়াডা ছাড়িস না রে ঈদুন। মাকে নিঃসংশয়ে নিঃসংকোচে বলে দিই তুমি এই সব কঠিন জিনিস বুঝে উঠতে পারবে না। বলে দিই, তোমার ওই গণ্ডগোলের সময় এখন আর নেই, এখন আর যা ইচ্ছে তাই করা যায় না। বলে দিই তোমার বয়স অনেক, এত বেশি বয়সে মেট্রিক দিতে গেলে মানুষ হাসবে। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কোনও এক কালে ইশকুলের সেরা ছাত্রী থাকার গৌরব বয়সের লজ্জার আড়ালে ঢেকে যায়। মা অন্য ঘরে গিয়ে একা বসে থাকেন। অন্য ঘরে হু হু হাওয়ার সঙ্গে মা একা বসে কথা বলেন।
বাবার কানে খবরটি যায় যে মা মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। বাবা হা হা করে হাসলেন, সঙ্গে আমরাও। অবকাশ জুড়ে তখন হা হা হো হো হি হি। মা চপু সে যেতে থাকেন, মার স্বপ্নগুলো গেলাস পড়ার মত, এবাড়ির মেঝে যেহেতু শক্ত ইটের, পড়ে ভেঙে যায়। মা শেষ অবদি লেখাপড়ার শখ মেটান অন্যভাবে। পীরবাড়িতে মেয়েরা আরবি শেখে, বয়সের কোনও ঝামেলা নেই, যে কোনও বয়সের মেয়েই শুরু করতে পারে। পীরবাড়ি থেকে আরবি ভাষাশিক্ষা বই খান তিনেক নিয়ে এলেন মা আর নানির কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিনে আনলেন বড় বড় লম্বা খাতা। ওসব খাতায় গোটা গোটা অক্ষরে আরবি ব্যাকরণের বিধিবিধান অনুশীলন শুরু করলেন ঠিক যেভাবে আমরা ইংরেজি ভাষা শিখেছি—সে খেলা করে, সে খেলা করিতেছে, সে খেলা করিয়াছে, সে খেলা করিল, সে খেলা করিতেছিল, সে খেলা করিয়াছিল,সে খেলা করিবে। মার বাংলা হাতের লেখা যেমন সুন্দর, আরবিও তেমন।
আরবি পইড়া কি হইব মা? আমি জিজ্ঞেস করি।
মা মধুর হেসে বলেন,আল্লাহর কালাম পড়া যাবে। কোরান হাদিস বুইঝা পড়া যাবে।
আমাদের সামনে পরীক্ষা, আমরা যত না পড়ি, মা তার চেয়ে বেশি পড়েন, রাত জেগে পড়েন। মার চিঠি লেখা নেই। গপ্প মারা নেই। মার লেখাপড়া বাবার নজরে পড়ে। তিনি বাড়ি ফিরেই ডাকেন, ছাত্রীসকল এদিকে আসো।
আমি আর ইয়াসমিন বাবার সামনে দাঁড়াই। বাবা ধমক দিয়ে ওঠেন, বাড়ির বড় ছাত্রী কই?