বাবা বাড়ি ফিরে চামড়ার বাক্স খুলে ছুরি কাঁচি বের করেন। বাবার হাতেই মা’র দুটো ছেলে হয়েছে। এবার মেয়ে হবে, বাবা মেয়ে চেয়েছেন। সরোজিনি ধাত্রী হাত গুটিয়ে বসে থাকেন মা’র শিথানের কাছে। বাবা হাত ঢুকিয়ে দেন মা’র দু’উরু ফাঁক করে, ভেতরে। কলকল করে বেরিয়ে আসে ঘোলা পানি। সরোজিনি বলেন, এই তো জল ভাঙছে, আর দেরি নাই।
বাবা হাত ঠেলেন আরও ভেতরে, একেবারে থলের ভেতর। ঘাম জমে কপালে তাঁর। হাত কাঁপে। কাঁপা হাত বের করে কুয়োর পাড়ে যান। বালতি টেনে পানি তোলেন। হাত ধুয়ে ফেলেন পানিতে। নানি তাজ্জব, রজব আলী হাত ধোয় কেন অসময়ে।
বাবা বলেন, আম্মা, ঈদুনরে হাসপাতালে নিতে অইব। বাচ্চা বাড়িতে হইব না। নানি স্বর চেপে বলেন, এ কি কন! দুই বাচ্চা হইল বাড়িতে!
এই বাচ্চা পেটের মধ্যে উল্টা হইয়া বসা। অপারেশন ছাড়া বাচ্চা হওয়ানো সম্ভব না। হাসপাতালে না নিলে বিপদ। শার্টের হাতায় কপালের ঘাম বাবা মুছে বলেন।
পানি ভাঙার পর গলা কাটা গরুর মত চেঁচান মা, বাড়ির লোক জাগছে, পড়শি জাগছে, নানির তিন মাস বয়সী ছেলে ফেলু জাগছে।
কুয়োর পাড় থেকে আঁতুড় ঘরে ফিরে বাবা দেখেন পা একখানা বেরিয়ে এসেছে আগন্তুকের। হাসপাতালে নিতে নিতে যদি বাচ্চা পথেই মইরা যায়! সরোজিনি ধাত্রী বলেন, কপালে ভাঁজ ফেলে। শুনে বাবার কপালেও ভাঁজ পড়ে, সংক্রামক ভাঁজ। কালো বিচ্ছু ভুরুদুটো গায়ে গায়ে রেগে থাকে যমজ ভাইএর মত। কানে নল লাগিয়ে বাচ্চার হৃদপিন্ডের শব্দ শোনেন লাব ডা…ব লা..ব ডাব লা–ব ডা–ব লাব ডা—-ব লা—-ব ডাব লা——ব ডা——। ভিজে পিঠের সঙ্গে রেগে থাকে পরনের শাদা শার্ট। এনাটমির ডাক্তার তিনি, লিটন মেডিকেল ইস্কুলে হাড়গোড় পড়ান ছাত্রদের, লাশ কাটা ঘরে মরা মানুষ কেটে মাংসের শিরার-ধমনির- স্নায়ুর পথঘাট চেনান। ফরামালিনে ডুবিয়ে রাখা হৃদপিন্ড, যকৃত, জরায়ু ট্রেতে করে এনে যেন চা বিস্কুট, শেখান নাড়িনক্ষত্র। প্রসূতি আর ধাত্রীবিদ্যায় বাবা দক্ষ নন তেমন। কিন্তু ঝুঁকি তাঁকে নিতেই হবে, হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নন তিনি। আবার ঢুকিয়ে দেন হাত, থরথর দ্বিধার আঙুল, ভেতর থেকে হাঁটু মোড়া পা খানি বের করে আনেন। দুটো পা ঝুলে থাকে বাইরে। এই আঁতুড় ঘরে, যেখানে একটি ছোট কাঁচি, দুটো ছুরি আর কিছু সুঁই সুতো ছাড়া অন্য কোনও যন্ত্র নেই, কি করে সম্ভব প্রসব করানো! বাবা তাঁর ঘামে ভেজা শার্ট খুলে রেখে উদ্বিগ্ন তাকিয়ে থাকেন বেরিয়ে থাকা পা দুটোর দিকে, আর মা’র ত্রাহি চিৎকারের দিকে, সরোজিনির গুটিয়ে রাখা হাতের দিকে। গলায় যদি নাভির নল পেঁচিয়ে থাকে, বাবা ভাবেন, শ্বাস বন্ধ হয়ে মরবে আগন্তুক। তিনি নিজের হৃদপিন্ডের শব্দ শোনেন ঢিপঢিপ, আগন্তুকের হৃদপিন্ডের খবর নিতে তাঁর সাহস হয় না। সরোজিনি ধাত্রী মা’র শিথান থেকে সরে পৈথানে বসে বলেন, পা দুইটা ধইরা টান দেন ডাকতার সাব। টানাটানি করলে আবার কি না কি কান্ড ঘটে! বইয়ে পড়েছেন, বাচ্চা হয় মাথায় আঘাত খেয়ে, নয় গলায় নাভির ফাঁস লেগে মরে। ঝুঁকি না নিয়ে অপরাশেন কর, ফরসেপ নয় সিজারিয়ান। দ্রুত তিনি আঁতুড় ঘর খেকে বেরিয়ে নানিকে ডেকে বলেন–রিক্সা আনতে পাঠান কাউরে, হাসপাতালে নিতে হইব।
আবার ঘরে ফিরে তিনি অস্থির হাঁটেন। ঘামে ভিজে হাতকাটা গেঞ্জি সপসপ করছে। মাথায় তাঁর বই পড়া বিদ্যে, তিনি জানেন পা দুটো ধরে সামনে টানলে বেরিয়ে আসবে পিঠ। তাই করেন, পিঠ বেরোতে শুরু করে।
নিচের দিকে চাপ দেও। মুখ বন্ধ কইরা শরীলের সমস্ত শক্তি দিয়া চাপ দেও।
বাবা দাঁত খিঁচে মা’কে বলেন। এবার আগন্তুকের গলা আটকে শরীর ঝুলে থাকে নিচে।
সরোজিনি বলেন, মেয়ে হইছে। আপনে মেয়ে চাইছিলেন, পাইছেন।
কিন্তু মেয়ের চাঁদমুখখানা তো আর জগতের আলো দেখে না। ডাক্তারি বিদ্যার ভাল ছাত্রের মাথায় গিজগিজ করা বিদ্যে। এনাটমির নামি শিক্ষক ঘরের বউএর ওপর তাঁর বিদ্যে খাটান। আগন্তুকের বুকের ওপর নল চেপে বেঁচে আছে কি না পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেন, এখনও বেঁচে। দু’হাত ঢুকিয়ে মেয়ের মাথার দু’দিকে, আঙুল ঘি তোলে যেমন, তেমন করে ঢিলে করে সরাতে থাকেন গলায় পেঁচানো নাভি। সরোজিনি ধাত্রী মাকে বলেন–ভগবানের নাম লও ঈদুন।
দরজার ওপাশ থেকে নানি বলেন–আল্লাহরে ডাক। আল্লাহরে ডাক ঈদুন।
মা চিৎকার জুড়ে দেন ও আল্লাহ ও আল্লাহ বলে।
শেষ অবদি জগতে অবতরণ করি বটে, শ্বাসকষ্টে ভুগে, যায় যায় হৃদপিন্ড নিয়ে। আমার চিৎকারের তলে মা’র ও আল্লাহ, ও আল্লাহ ডাক ম্লান হয়ে যায়। গামলায় কুসুম গরম জলে আমাকে ভেজান সরোজিনি, গা সাফ করেন।
আঁতুড় ঘর থেকে ছোঁ মেরে আমাকে নিয়ে যান রুনু খালা। রুনু খালার হাত থেকে ঝুনু খালা, ঝুনু খালার হাত থেকে বড় মামা, বড় মামা বলেন–এ তো দেখি আস্ত একটা রাজকন্যা। এই বাড়িতে রাজকন্যা হইছে।
তখন সুবেহ সাদিক, আকাশ ফর্সা হচ্ছে। উঠোনে খুশির ধুম পড়ে যায়। দু’ছেলের পর এক মেয়ে। রাজকন্যার মুখ দেখতে ভিড় করেন হাশেম মামা, টুটু মামা, শরাফ মামা। ফজলি খালা রাজকন্যার মুখ দেখার আগে আতুঁড় ঘরে ঢুকে বলেন–বড়বু, কী ভাল দিনে তোমার মেয়ে জন্মেছে গো! বারোই রবিউল আওয়াল, নবীজি এ দিনে জন্মেছিলেন। এ মেয়ে খুব পরহেজগার হবে। তোমার কপাল ভাল বড়বু।