বলেছিলাম, চিঁড়া খাইতে ইচ্ছা করতাছে।
নানি ধমকে ওঠেন, চিঁড়া খাইতে অইব না। ভাগ।
নামাজ প্রায় পড়া শেষ করে এনেছেন, এমন সময় কালো ফটকে শব্দ হয় ভীষণ। ভীষণ সেই শব্দ, যেন এক পাল বুনো হাতি এসেছে কলাগাছের মত দাঁড়ানো বাড়িটি খেতে।
রাসু খালু দৌড়ে এসে নানিকে বলেন, পালান পালান মিলিটারি।
মা বসে কোরান পড়ছিলেন ঘরে, যে ঘরে ছটকু আমি ইয়াসমিন সবে শুয়েছি। রাসু খালুর পালান পালান শব্দ কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে কোরান ফেলে, পড়তে গিয়ে কোরানের ওপর রাখা ছিল অনন্ত বালা দুটো, ফেলে, মা ছুট ছুট।
মা আর নানি উঠোনের অন্ধকারে হারিয়ে যান, মেথর ঢোকার দরজা গলে খাঁ খাঁ করা প্রফুল্লদের বাড়ি।
বাবার শরীর পড়ে থাকে মেঝেয়। নানি অন্ধকার থেকে ফিরে জায়নামাজ পাতা জায়গায় হাতড়ান, আবছা আলোয় হাতড়ান আর বিড়বিড় করে বলেন, আমার ঝুড়ি কই, এই রাসু এই ঈদুন, আমার ঝুড়ি কই?
রাসু খালু চাপা স্বরে বলেন, বাড়ি লুট হইয়া গেছে।
মা ঘর থেকে ঘরে মোমবাতি হাতে ঘোরেন। আলমারি খোলেন, টাকা পয়সা নেই। কোরান আছে, কোরানের ওপর রাখা অনন্ত বালা নেই। নানির ঝুড়ি নেই।
পলকের মধ্যে এত কিছু ঘইটা গেল, নোমানের বাপরে মাইরা ফালাইয়া রাখল, বাড়ি লুট অইল। কী পাপে যে শহরে আইছিলাম! ও মা গো এ কী অইল গো! মা ফুঁপিয়ে বলতে থাকেন।
নানি হাতড়াতে থাকেন সারা ঘর। ঝুড়ি নেই। বাবার মুখ থেকে শব্দ বেরোয় আহ উহ, পানি দেও। রাসু খালু পানি ঢালেন বাবার মুখে। বাবার শরীর নড়ে না, ঠোঁট নড়ে। রাসু খালুর গা কাঁপে, ভয়ে। বাড়ির মেয়েমানুষদের বাইরে পাঠিয়ে তড়িঘড়ি তিনি লুকিয়েছিলেন খাটের তলে। মেয়েমানুষের প্রতি এদের বিষম লোভ, দেখলেই, কিশোরী কি মাঝবয়সী, এদের পান্তলুন ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে শক্ত দন্ড। বিছানার চাদরে গা মুড়ে বসেছিলেন তিনি খাটের তলে যেন দেখলে মনে হয় লেপ কম্বলের বস্তা। বিড়বিড় করে কলমা পড়ছিলেন, মরার আগে আগে কলমা পড়লে ঈমান মজবুত থাকে। বেরিয়ে এসেছেন কালো ফটকের বাইরে বুটের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ারও পর। গা এখনও কাঁপছে তাঁর, খাটের তলে যেমন কেঁপেছিল। বাবাকে পানি খাইয়ে গায়ের গেঞ্জি তুলে বুকে থু থু দেন রাসু খালু।
মার শরীরখানা ধপাশ করে মেঝেয় পড়ে–সব্বনাশ অইয়া গেছে। মা’র ঝুড়ির ভিতরে চল্লিশ ভরি সোনা ছিল। বিশ হাজার টাকা ছিল। ঝুড়ি নাই।
এত সোনা কই পাইছেন আম্মা? রাসু খালু চোখ গোল করে জিজ্ঞেস করেন। বাড়ির সব বউ ঝিগোর সোনা। পাড়া পড়শির সোনা। পারুলের, ফজলির, রুনুর, ঝুনুর, সোহেলির মা’র, সুলেখার মা’র, আর সাহাব ভাইএর বউএর গয়নাগাটি। মা আমার লক্ষ্মী বইলা মা’র কাছে ওরা রাখতে দিছিল। মা ঘুমায় নাই। এক রাইতও ঘুমায় নাই। মাইনষের আমানত আগলাইয়া রাখছে।
ভূতে পাওয়া চিকন গলায় মা বলেন।
ঘরে মোমবাতি জ্বলে নিবু নিবু। মা বসে থাকেন মেঝেয়, বাবার না নড়া শরীরের কাছে। ফুঁপিয়ে কাঁদেন মা।
রাসু খালু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, মাইনষে ত মাটির নিচে গয়নাগাটি টাকা পয়সা রাইখা দিছে। আম্মা আবার এইগুলা নিয়া চলতে গেছেন ক্যান? জান বাচানি ফরজ বড়বু। আপনাগোর ইজ্জত বাঁচছে, এইডা বড় কথা।
নানি হাতড়ান সারাঘর। খাটের তলে, সোফার তলে, জায়নামাজের তলে। ঝুড়ি নেই তবু ঝুড়ি খোঁজেন।
গ.
নানি হাতড়ান হাড়গুলো। শহরের বড় মসজিদের কুয়ো থেকে হাড় তোলা হয়েছে। হাজার হাজার হাড়। হাড় দেখতে ভিড় করেছে অগুনতি মানুষ, হারিয়ে যাওয়া ছেলের হাড়, স্বামীর হাড়। নানি হাড়গুলো হাতড়ান। পায়ের হাড়, বুকের পাঁজর, হাতের হাড়, মাথার খুলি। নানি হাশেমের হাড় খোঁজেন। সন্ধে হয়ে আসে। মানুষেরা রুমালে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরে যায়। নানি মসজিদের কুয়োর পাড়ে বসে, হাড়ের পাহাড়ে ডুবে হাশেমের হাড় খোঁজেন।
০২. জন্ম, আকিকা এসব
ক.
আমার জন্মের আগে দুটো ছেলে জন্মেছিল মা’র। ছেলে জন্মেছিল বলে রক্ষে। তা নইলে বংশের বাতি কে জ্বালাতো! মেয়েরা তো আর বংশের বাতি জ্বালানোর জন্য নয়। মেয়েরা ঘরের শোভা বাড়ানোর জন্য, সংসারের কাজে মা’কে সাহায্য করার জন্য, ঘরদোর সাফ রেখে ঘরের পুরুষের মনোতুষ্টি করার জন্য।
দুটো ছেলে হবার পর বাবা বললেন এবার মেয়ে চাই। ব্যস মেয়ে হল। মেয়ে হল উল্টো। ঠ্যাং আগে, মাথা পরে।
মা’র আঁতুড় ঘর ছিল এঁদো গলির ভেতর খলসে মাছে ভরা পুকুর পাড়ে নানির চৌচালা ঘরের পাশে ছোট্ট একটি চালা ঘর, যে ঘর মা’র জন্য বরাদ্দ হয়েছিল পাঁচশ টাকা দেনমোহরে রজব আলীর সঙ্গে বিয়ের পর। রজব আলী মোক্তার বাড়িতে জায়গির থেকে ডাক্তারি পড়তেন, ঈদুল ওয়ারা বেগমের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর শ্বশুর বাড়িতে উঠেছেন, কথা ছিল পাশ দিয়ে আলাদা বাড়িতে উঠে যাবেন। রজব আলীর পাশ হয়, চাকরি হয়, চালা ঘরেই দুই ছেলে হয়, রজব আলীর বউ পোয়াতি হন আবার, তবু চালা ঘর ছেড়ে কোথাও আর যাওয়া হয় না। পড়শিরা বলে ঈদুনের জামাই দেখি ঘরজামাই হইয়াই রইল। অপমানে মা’র মুখ বেগুনি হয়ে ওঠে। মা স্বামীকে ফাঁক পেলেই বলেন ডাক্তার হইছ, টেকা কামাই কর, বউ পোলাপান লইয়া আলদা থাকার জো নাই? আর কতদিন শ্বশুরের বাড়িত থাকবা? মাইনষে ভালা কয় না।
সরোজিনি ধাত্রী মা’র পেটের ওপর ত্যানা বিছিয়ে তার ওপর আংড়ার হাঁড়ি রেখে সারা পেট বোলান। মা ব্যথায় খামচে ধরেন ধাত্রীর হাত। মা’র হাতে পিয়াঁজের গন্ধ, নখের তলে হলুদ। খাচ্ছিলেন পাকঘরে বসে, খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই ব্যথা ওঠে, থাল ঠেলে পিঁড়ি ডিঙিয়ে চলে এসেছেন শোবার ঘরে, বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে শুরু হয় কাতরানো। নানি তাঁর কাতরানো মেয়ের মাথায় বাতাস করতে করতে বলছিলেন সহ্য কর,সহ্য কর। মেয়ে মাইনষের সহ্যশক্তি না থাকলে চলে না। নানা হনহনিয়ে হেঁটে গেছেন সরোজিনি ধাত্রীকে ডেকে আনতে। তিন মাস আগেও সরোজিনি ধাত্রী এ বাড়ি এসেছেন, নানি যেদিন জন্ম দিলেন ফেলুর। নানি নিঃশব্দে বিয়োন। পাড়া পড়শি কেন, বাড়ির লোকও টের পায় না। ব্যথা উঠলে পাকঘরে পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়েন। সরোজিনি ধাত্রী এসে চুলো থেকে মাটির হাঁড়িতে আংড়া তুলে পেটে আলতো করে বোলান। নানিকে আজকাল আর সরোজিনি ধাত্রীর বলতে হয় না সহ্য করেন মাসি। নানি নিজেই সহ্য করেন। দাঁতে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকেন পাটিতে। ষোল বাচ্চার জন্ম দিয়ে বাচ্চা হওয়া তাঁর কাছে এখন ডাল ভাত। ডাল ভাত হলেও এই বয়সে বিয়োতে তাঁর আর ভাল লাগে না। নাতি নাতনি বড় হচ্ছে, সংসার লোক বাড়ছে কচুরিপানার মত। এ সময়, সধবা কন্যারা পোঁয়াতি হবে, ছেলের বউ পোয়াতি হবে, তা না, নিজে ফি বছর আঁতুড় ঘরে ঢুকছেন। সরোজিনি ধাত্রী মা’কে বলেন, আগুনের তাপটা লাগলে বেদনা কমে, বাইচ্চা নিচের দিকে নামে। আরও একটু সহ্য কর ঈদুন। এইতো হইয়া গেল।