বন্দুক নিয়ে, খানিকটা নুয়ে, যেহেতু তাঁর মাথা দরজার মাথা ছাড়িয়ে যায়, খালেদ চলে যাওয়ার পর আমার হাড়ের ভেতর সেই ঠান্ডা সাপটি আবার হাঁটে। আমি চোখ খুলে রাখি যদি দেখতে পাই বুট পায়ে কেউ আসে, মাথায় হেলমেট পরা কেউ, জলপাই রঙের পোশাক পরা। খড়ের ওম, গায়ের কাঁথা, কিছুই আমার ঠান্ডা হয়ে থাকা শরীরকে উষ্ণ করে না। সাপ আমার শরীর ছেড়ে নড়ে না।
ওভাবে কতক্ষণ পড়ে ছিলাম আমি! কতক্ষণ ঘুমের মত করে না ঘুমোনো মেয়ে! মনে হচ্ছে বছর পার হচ্ছে, ওরা তবু টর্চের আলো নিবোচ্ছে না, যুগ পার হচ্ছে তবু মশারি ছাড়ছে না হাত থেকে। মনে হচ্ছে, ঠান্ডা হয়ে হয়ে আমি মরে যাচ্ছি। হালকা হয়ে যাচ্ছে সমস্ত শরীর, কবুতরের গা থেকে ঝরা একটি পালকের মত। আমি আর ঘুমে কাদা ছটকু আর ইয়াসমিনের মধ্যিখানে শোয়া নেই, আমাকে উত্তুরে হাওয়া এসে নিয়ে যাচ্ছে চাঁদের দেশে। সামনে বুট পরা কেউ আর দাঁড়িয়ে দেখছে না, সবার নাগাল ছেড়ে আমি অন্য এক দেশে।
চাঁদের বুড়ি চরকা কাটছে আর হাত নেড়ে আমাকে বলছে এসো হে এসো। ও চাঁদের বুড়ি গো আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে, জল দেবে? জল? চাঁদে তো জল নেই। কী বল, চাঁদে জল নেই! আমি যে তবে মরে যাব। তেষ্টায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। বুটের শব্দগুলো দূরে চলে যাচ্ছে, এ ঘর থেকে দূরে, আরেক ঘরে। চাঁদের বুড়ি বলে চোখ খোল মেয়ে, তুমি ঘামছ কেন শীতের রাতে! না বুড়ি আমি চোখ খুলব না, চোখ খুললে আমি আগুন দেখব আর লালা দেখব, ঠান্ডা একটি সাপ দেখব আমার গায়ে, আমি চোখ খুলব না। চোখ বুজেই ছিলাম, ইয়াসমিনের পেটের ওপর আমার হাত, আমার ঠ্যাংয়ের ওপর ছটকুর ঠ্যাং।
দূর থেকে ভেসে আসে বাঁশির সূর, কে বাঁশি বাজায় এত রাতে। কে আমার ঘুম ভাঙাতে চায় অসময়ে, আমি আজ রাতে আর জাগব না, শুনশান রাতে সকলে ঘুমিয়ে পড়, চোখ বোজ সকলে, ঘুমমেঘ তোমাদের ওড়াতে ওড়াতে চাঁদের দেশে নিয়ে যাবে, চাঁদের বুড়ি কোনও টুঁ শব্দ করবে না, চরকা কাটা ফেলে বুড়িও মেঘের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যাবে।
এ আসলে বাঁশির মত, বাঁশি নয়। এ আমার মা’র ফোঁপানো কান্না। মা কোথাও কাঁদছেন, ঘরে নয়, ঘরের বাইরে। মা সেই মাটিতে লুটিয়ে কাঁদছেন, যে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন বাবা। রাসু খালু বলছেন না মরে নাই, বড়বু কাঁইন্দোন না, দুলাভাই মরে নাই। কিন্তু মরার মত। রাসু খালু নারকেল গাছের পেছনে দু’হাত বাঁধা বাবার বাঁধন খুলে দিলেন আর তাঁর কাঁধ থেকে বাবার মাথা পিছলে গেল, পিছলে যেতে যেতে মাটিতে, ঘাসে, উপুড় হয়ে।
বাবার শরীরখানা টেনে ঘরে তোলেন তিনি। ঘরের মেঝেয় পড়ে থাকে প্রায় নিস্পন্দ শরীর, রক্ত ঝরছে মুখ থেকে, বুক থেকে, পেট থেকে। রাসু খালুর এ বাড়িতে থাকার কথা নয়, এসেছিলেন দরদালানের ফাঁক ফোকরে লুকোতে। আমাদের থাকার কথা দাপুনিয়া। হাঁসপুরে ঘরপোড়া ধোঁয়া ওড়ে, তাই হাসঁপুর থেকে অন্ধকারে পালাতে হয়েছিল দাপুনিয়া। সেখানে, পাকা রাস্তার কিনারে বাড়ি খালেদের, হাশেম মামার হরিহর আত্মার, সে বাড়ির ভেতরে গা ঢেকে বসে ছিলাম। শহর থেকে বাতাস ভেসে আসে খবর নিয়ে, গন্ডোগোল থামছে। সেই বাতাসের পেছন পেছন তহবনের ফতফত শব্দ তুলে হাত বৈঠার মত নেড়ে হন হন করে হেঁটে এসে নানা, দাপুনিয়া বাজারের দক্ষিণে, খালেদের বাড়িতে, বলেন–চল চল বাড়ি চল, গন্ডোগোল থামছে। নানার চিবুকের দাড়ি বাতাসে নড়ে, ডানে বাঁয়ে। শুনে, পুঁটলি-পাঁটলিসহ, প্লাস্টিকের ঝুড়িসহ নানি আমি মা ছটকু ইয়াসমিন রওনা দিই শহরের দিকে। নানি চলে গেলেন এঁদো গলির পুকুর পাড়ে, চৌচালা ঘরে। আর মা তাঁর দু মেয়ে নিয়ে অবকাশের কালো ফটক খুলতেই বাবা বলেন–এ কী করলা, শহরে আইছ কেন, যুদ্ধ শেষ অয় নাই তো!
যুদ্ধ শেষ হয়নি তা পাড়া দেখেই টের পেয়েছি। অর্চনাদের বাড়ি খাঁ খাঁ করছে, প্রফুল্লদের বাড়িও। বিভাদের বাড়িতে বিভারা নেই, অদ্ভুত সব মানুষেরা, ভিন ভাষায় কথা বলে।
বাবা বলেন, বিহারিরা সব হিন্দু বাড়ি দখল কইরা রইছে।
উঠোনে ঘাসগুলো আমার মাথা সমান লম্বা হয়ে গেছে, যেন এ বাড়িতে হাজার বছর ধরে কেউ থাকে না। মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ি দেখেছিলাম এমন, দালান থেকে চুনসুরকি ইট খসে পড়ছে, লম্বা ঘাসের ভেতর সড়সড় করে সাপ হাঁটছে আর ঘরগুলোর ভেতর হু হু হু হু করে ভুতের সঙ্গে ডাংগুটি খেলছে বাতাস।
উৎকণ্ঠার গলা-জলে ডুবে বাবা বলেন, শহরের অবস্থা ভাল না। ডাক বাংলায় মিলিটারি ভর্তি। রাইতটা কাটাইয়া সকালে রওনা দেও।
হ্যাঁ, তাই কথা ছিল। মা বড়দাদাকে পাঠিয়ে নানিকে ডেকে আনেন অবকাশে। চৌচালা ঘরে, টোকা দিলে খসে পড়বে দরজা জানালা, আবার না ডাকাতি হয়ে যায়। নানিও বোরখার তলে দু’হাতে প্লস্টিকের ঝুড়ি চেপে রিক্সা করে পৌঁছে যান দালানে, নিরাপত্তায়। রাত গিয়ে সকাল হলেই দাপুনিয়া রওনা হতে হবে। নিঝুম বাড়িতে নানি পেতেছিলেন জায়নামাজ। জায়নামাজের কিনারে, দেয়াল ঘেঁসে রেখেছিলেন নীল প্লাস্টিকের ঝুড়ি। চিঁড়ামুড়ি,গুড়। নামাজে বসলেও নানি ক্ষণে ক্ষণে দেখেন ঝুড়িটি, ঠিক ঠিক আছে কি না। ঝুড়ি নড়ে না, নানি নড়েন। হাঁসপুকুরের বাড়িতে ঝুড়ির ভেতর হাত ঢুকিয়েছিলাম চিঁড়ে গুড় খাব বলে, নানি তখন নামাজে দাঁড়িয়ে হাতদুটো হাঁটুতে রেখে নুতে যাচ্ছিলেন, তাঁর আর নোয়া হয়নি, সেজদা হয়নি, চিলের মত ছোঁ মেরে নিয়ে নিলেন ঝুড়িটি।