উত্তেজনা আমার পেছন পেছন নাকি আমি তার পেছন, নাকি উত্তেজনা আমার কাঁধের ওপর, নাকি আমি তার কাঁধের ওপর, না বুঝেই দৌড়ে যাই আবার সেই জটলার দিকে, মিছিলের দিকে। মিছিলে খালেদকে দেখি সবার সামনে, হাতে বাঁশের কঞ্চির ওপর বাঁধা পতাকা, সবুজের মধ্যে লাল এক গোল্লা, গোল্লার মধ্যে তোবড়ানো হলুদ কাপড়। খালেদের পেছন পেছন গ্রামের ছেলে কী ছোকরা কী যুবক, সব।
ভিড়ের মধ্যে ছটকুর হাতেও দেখি ঠিক ওরকম এক পতাকা। আমারও ইচ্ছে করে একটি পতাকা হাতে পেতে। এ একেবারে নতুন পতাকা। ইস্কুলে সবুজের মধ্যে চাঁদ তারা আঁকা পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের গাইতে হত পাক সার জমিন সাদ বাদ। ছোটদা যখন মিছিল করতেন আয়ুব শাহি ধ্বংস হোক বলে, একদিন তোশকের তল থেকে চাঁদ তারার সবুজ পতাকাটি নিয়ে গিয়েছিলেন হাতে করে। মিছিল থেকে সন্ধেয় ফিরে এসে ছোটদা বাড়িতে জানিয়ে দিলেন, আইজকা মিছিলে পতাকা পুড়াইছি।
মিছিল শেষ করে রাস্তার কিনারের এক কাঁঠাল গাছের ডালে চড়ে হাতের পতাকাটি উড়িয়ে খালেদ বলেন এইটা হইল জয় বাংলার পতাকা। এখন থেইকা এইটাই আমাদের পতাকা। সবাই বল জয় বাংলা। সবুজ রং হচ্ছে গিয়া আমাদের সবুজ ধানক্ষেত, মধ্যে লাল সূর্য, আর সূর্যের মাঝখানে আমাদের মানচিত্র। নয় মাস যুদ্ধ করে আমরা একটা দেশ পাইছি, দেশের নাম আজ থেইকা পূর্ব পাকিস্তান না, দেশের নাম জয় বাংলা। সবাই বল জয় বাংলা।
সবাই বলে জয় বাংলা। খালেদ নেমে আসেন ডাল থেকে। পরনে তাঁর শাদা লুঙ্গি, শাদা শার্ট। কালো চুল, কালো মুখ, মুখে লাল ব্রণ ওঠা খালেদ। চোখদুটো বড় বড়, দুটো কালো ভ্রমর যেন। রাতে, বাড়ির সব যখন ঘুমিয়ে গিয়েছিল আর আমি বালিশ থেকে মাথা তুলে বেড়ায় হেলান দিয়ে রাখা বন্দুকের দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম, কারও পায়ের আওয়াজ পেয়ে আবার কাঁথার তলে ডুবে গিয়েছিলাম, বন্দুকে গুলি ভরার শব্দ শুনে কাঁথা সরিয়ে ভ্রমর চোখদুটো দেখেছিলাম, খালেদ বলেছিলেন–এইটা কি জানো? মাথা নেড়ে বলেছি, জানি, বন্দুক।
বন্দুকের এই হচ্ছে বাঁট, আর এইখানে বুলেট থাকে, এইটার নাম হইল ট্রিগার, এইখানে টিপলেই গুলি বার হয়। খালেদ বন্দুকের গায়ে হাত রেখে রেখে বলেন। আপনে কি মানুষ মারেন? প্রশ্ন করে শুকনো মুখে থাকি উত্তরের তৃষ্ণায়। খালেদ হেসে বলেন, আমি শত্রু মারি।
বন্দুকটি খড়ের নিচে লুকোনো ছিল অনেকদিন, যে খড়ের ওপর বিছানা পেতে আমরা ঘুমোই, তার; কে জানতো! আচমকা বাড়ি ফিরে বিছানা সরিয়ে খড় সরিয়ে বন্দুক বের করে আনেন খালেদ। আর রাত ঘন হলে গা খানা কালো চাদরে মুড়ে বন্দুক হাতে বেরিয়ে যান।
দাপুনিয়ার এ বাড়িতে আসার পর সে রাতেই প্রথম খালেদকে দেখেছি। আর আজ দ্বিতীয়বার। খালেদ দেখতে হাশেম মামার মত। দু’জন নাকি হরিহর আত্মা। এক ইস্কুলে পড়েছেন। এক থালায় ভাত খেয়েছেন। হাশেমমামা যুদ্ধে গেছেন শুনে খালেদও গেছেন।
কাঁথা মুড়ে শুয়ে পড়ি খড়ের ওপর, খড় ওম দেবে শীতে। ছটকু ঘুমিয়ে কাদা। ছটকু সেরাতে এভাবেই ঘুমিয়েছিল, মাথায় বালিশ পড়তেই ছটকুর ঘুম এসে যায়। ও না ঘুমোলে নির্ঘাত চেঁচাত, আর ওরা ঠিক গুলি করে মারত ওকে, কেবল ওকে কেন, যারা ঘুমিয়ে ছিলাম ও বিছানায়–আমাকে, ইয়াসমিনকে। আমি অবশ্য ঘুমোইনি, ঘুমের ভান করে পড়েছিলাম, যেন ঘুমের মধ্যে আমি তখন ঘুমরাজ্যের ঘুমপরীর সঙ্গে খেলা করছি, দোলনা দুলছি, যেন আমি আর মানুষের দেশে নেই, যেন আমি কিছুই টের পাচ্ছি না ঘরে অনেকগুলো বুট পরা লোক হাঁটছে, কাঁধে তাদের বন্দুক, তারা যে কোনও সময় হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে ইয়ার্কি করতে করতে গুলি করে মারতে পারে যে কাউকে, কেউ ঘুমিয়ে নেই জানলেই তার খুলি উড়ে যাবে গুলিতে, তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে ক্যাম্পে, ক্যাম্পে নিয়ে চাবকে চাবকে বেয়নেটের গুঁতোয় গুঁতোয় হাড়গোড় গুঁড়ো করা হবে। বুট পরা লোক যা খুশি করুক, তুমি ঘুমিয়ে থাকো মেয়ে, তোমার চোখের পাতা যেন না নড়ে, তোমার গা হাত পা কিছু যেন না নড়ে, হাতের কোনও আঙুল যেন না নড়ে, তোমার বুক যেন না কাঁপে, যদি কাঁপেই যেন বুকের কাঁপন ওরা, যখন মশারি তুলে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে, টর্চের আলো ফেলবে তোমার ওপর, তোমার মুখে, তোমার বুকে, তোমার উরুতে, চোখ থেকে লালা গড়াবে, জিভ বেয়ে আগুন ঝরবে আর কথা বলবে এমন ভাষায় যা তুমি বোঝ না, টের না পায়। টের না পায় তোমার এক ফোঁটা অস্তিত্ব, টের না পায় তুমি আছ, তুমি জেগে আছ, যদিও তুমি আছ, জেগে আছ।যদি পায়ই টের, তবে যেন ওরা বলতে বলতে চলে যায়, তুমি ঢেঙ্গি মেয়ে কেবল, তুমি কিশোরী হওনি, যুবতী হওনি, এখনও তোমার বুনি উডে নাই।
আমার গা বেয়ে ঠান্ডা একটি সাপ হাঁটছিল, সাপটি আমার গলা পেঁচিয়ে ছিল, আমার কষ্ট হচ্ছিল নিঃশ্বাস নিতে, তবু আমি নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম, টর্চের আলোয় আমার চোখের পাতা কাঁপতে চাইছিল, তবু আমি চোখের পাতা রাখছিলাম চোখের ওপর, ছটকুর ঠ্যাং একটি তোলা ছিল আমার ঠ্যাংয়ের ওপর, ঠ্যাংটিকে ওভাবেই পড়ে থাকতে দিচ্ছিলাম, আমার হাত একটি পড়ে ছিল ইয়াসমিনের পেটের ওপর, সেটিকে ইয়াসমিনের পেটের ওপরই পড়ে থাকতে দিচ্ছিলাম, কোলবালিশ ছিল আমার পিঠের পেছনে, সেটিকে পিঠের পেছনে দিচ্ছিলাম পড়ে থাকতে।
বুটজুতোর লোকগুলো দাঁড়িয়েছিল খাটের কিনারে, এক হাতে মশারি, আরেক হাতে টর্চ আর চোখগুলো জিভগুলো লালাঝরা আগুনঝরা আমার চুলে চোখে নাকে কানে গলায় বুকে পেটে তলপেটে উরুতে ঠ্যাঙে পায়ে। ওদের গা থেকে গড়িয়ে ঠান্ডা সাপ সড়সড় করে নেমে এল আমার শরীরে, সারা শরীর হেঁটে বেড়ালো, পিঠে পেটে তলপেটে, যৌনাঙ্গে, শুঁকল। সাপ ঢুকে গেল আমার মাংসের ভেতর, হাড়ের ভেতর, রক্তে, মজ্জার ভেতর।