হাম করে তারু খলিফা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বুড়ো চোখে ভাল দেখেন না, হাতে বাঁশের লাঠি, পরনের গেঞ্জিখানা ছিঁড়ে ত্যানা ত্যানা, লোকে বলে এ বুড়োর খতিতে আসলে ম্যালা পয়সা, বুড়ো ছিলেন ত্রিশাল বাজারের দরজি, বাঁ চোখ নষ্ট হওয়ার পর দরজিগিরি ছেড়ে ছেলের বাড়িতে, হাঁসপুরে থাকেন, মাঝে মাঝে এ বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যান, কই যান কেউ জানে না, মাস গেলে ফেরত আসেন। যুদ্ধ বাঁধার পর তারু খলিফা হাঁসপুর গ্রাম ছেড়ে আর কোথাও উধাও হননি। সন্ধে হলে রেডিও শুনতে এ বাড়িতে আসেন। তারু খলিফা কথা কম বলার লোক, বেশির ভাগই মাথা ডান কাঁধে ফেলে অন্যের কথা শোনেন, পছন্দ না হলে থেকে থেকে হাম বলেন, এরপর ফাঁক পেলে নিজের যা মত তা গুছিয়ে বলেন। তারু খলিফার হাম শোনার পর হুঁকোর গড়ড়ড় গড়ড়ড় শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। টাক মাথা গাল ফোলা সবুজ লুঙ্গির পিঠ ছিল তারু খলিফার দিকে, তিনি গা ঘুরিয়ে বসেন। বুড়ো আরও দু’তিনটে হাম বলার পর বলেন, মুক্তিবাহিনীরা দেশ স্বাধীন করবই। আমগো গেরিলারা আগাইতাছে। দরকার অইলে ভারতের সৈন্য নামব দেশে। এই দেশ আমাগো অইব। শেখ মুজিবর দেশ চালাইব, আয়ুব ইয়াইয়ার আমল যাইব, জম্মের মত যাইব।
তারু খলিফার কথা শেষ হলে সবুজ লুঙ্গি গলা তুলে বলেন, এই সিরাজ্যা, একটা পাঙ্খা দিয়া যা।
হলুদ দাঁতের ছেলেটি ঝাঁ করে উড়ে এসে ঘর থেকে একটি তালপাতার পাখা এনে দেয় সবুজ লুঙ্গিকে। গায়ে ধুলো কাদা নেই, মাছ টাছ ধরে সাফ সুতরো হয়ে ঘরে ফিরেছে হলুদ দাঁত। সবুজ লুঙ্গি এক হাতে গা চুলকোন, আরেক হাতে বাতাস করেন নিজেকে। ঘরের বউ ঝিরা ঘরের বেড়ায় কান পেতে উঠোনে বসা পুরুষের কথা বার্তা শোনেন। বিছানার ওপর পুঁটলির মত বসে থাকেন নানি, নানির চোখের তারা নড়ে না। ভূতের ভয়ের ওপর মিলিটারির ভয় বুকে বাবুই পাখির মত বাসা বাঁধে আমার।
তারু খলিফার কথাই ঠিক, মুক্তিবাহিনীরা শেষ অবদি স্বাধীন করেছে দেশ। আমরা তখন দাপুনিয়া নামের এক গ্রামে। শীতের সকালে বৈঠক ঘরের দাওয়ায় বসে রোদ পোহাচ্ছি আর মুখ থেকে ফকফক করে ধোঁয়া ছাড়ছি। হঠাৎ শুনি চিৎকার, চিৎকার। চিৎকারের উৎস দেখতে পাকা রাস্তার দিকে দৌড়োয় পোলাপান। কান পেতে থেকে বুঝি উৎস ক্রমে ক্রমে এগোচ্ছে এদিকেই। লোকের চোখে কৌতূহল, কী হল, কী হল, কারা আসে আবার দাপুনিয়ায়! আবার কি ঘর পোড়ার খবর, লাশের খবর! গত সাতদিন ধরে নাগারে গুলির শব্দ শুনে দাপুনিয়া গ্রামের কানে তালা রেগে গেছে। উৎকণ্ঠায়, উদ্বেগে দাপুনিয়া শ্বাসের মত করে শ্বাস নেয়নি। এখন কে আসে চিৎকার করে এই গ্রামে! কে আসে এই সকালে পাকা রাস্তা ধরে? মিলিটারি? না, এ ঠিক মিলিটারির শব্দ নয়। মুখ চাওয়া চাওয়ি করে এ ওর। বাড়ির মেয়েরা জানলার পর্দা ফাঁক করে তাকিয়ে থাকে এখনও না আসা উৎসের দিকে। আমি পর্দা ফাঁকের মধ্যে নেই, ছেলেপিলেদের ভিড়ে মিশে যেতে পারি, এখনও ডাঙর হইনি, ঢেঙ্গি ছেড়ির বুনি উডে নাই। উৎসের এ চিৎকার অন্যরকম, রোম দাঁড়িয়ে যায় গায়ের, আশায়। মনে আমার একশ পায়রা ওড়ে ডানা মেলে।
উৎস এগোতে থাকে দাপুনিয়া বাজারের দিকে, বন্দুক হাতে বিশ পঁচিশজন যুবক, শম্ভুগঞ্জে আমাদের তিন চাকার গাড়ি আটকানো যুবকগুলোর মত দেখতে, ট্রাকে দাঁড়িয়ে জয় বাংলা বলে চিৎকার করছে। কী তেজি এই রোল, কী বিবশ করা এই উত্তেজনা! দাপুনিয়ার স্তব্ধতা চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়ে। মানুষ যেন আঁধার গুহা থেকে এক যুগ পর বেরিয়েই দেখছে আলো ঝলকানো জগত। হিম-ঠাণ্ডা নদীতে ডুবতে ডুবতে হাতের কাছে পেয়েছে পাল তোলা নৌকো। দাপুনিয়া গ্রামের মানুষ এতকাল মনে মনে, বড়জোর ফিসফিসিয়ে এ ওর কানে কানে বলেছে জয় বাংলা। আজ তারা হররা শুনছে জয় বাংলার। ত্রাসের চাদর ছুঁড়ে ফেলে মানুষ গলা ফাটায় জয় বাংলা বলে। আমিও। ওদের মত হাতের মুঠি তুলে চিৎকার করি। মানুষ ছোটে ট্রাকের পেছন পেছন, জয় বাংলার পেছন পেছন, মুক্তির পেছন পেছন। আমি দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকি, মা’কে খবর দিতে। মা জানালায় দাঁড়িয়েছিলেন।
মা জয় বাংলা কও। দেশ স্বাধীন অইছে। দু’পাক নেচে বলি।
মা হাসছেন আর গাল বেয়ে চোখের জল পড়ছে তাঁর। আঁচলে মুছছেন জল, আবারও ঝরছে। আবারও হাসছেন তিনি। একই মুখে হাসি, কান্না দুটোই।
নানির চোখের তারা নড়ে না। সেই কবে থেকে পাথর হয়ে আছেন তিনি, পাথরে টোকা দিলে ঠমঠম শব্দ হয়, নানির গা থেকে সে শব্দও হয় না। নানি কেন তাঁর পান খাওয়া খয়েরি দাঁত মেলে হাসছেন না, মন কি মরে আছে প্লাস্টিকের ঝুড়িটির শোকে, যেটিকে আর তাঁর শক্ত করে ধরতে হয় না, পেটের ভেতর পুঁটলি করে পুঁটলি হয়ে বসতে হয় না!
রাস্তায় এখনও জটলা, মানুষ দৌড়োচ্ছে, জয় বাংলা জয় বাংলা বলে দাপুনিয়া মাথায় তুলছে। কাল ছিল গুলির শব্দ, মরাকান্না, আজ হাসি, আজ উল্লাস, আজ হৈ হৈ, আজ জয় বাংলা। জয় বাংলা মানে কেউ আর কারও বাড়ি পুড়বে না, আর কেউ কাউকে গুলি করবে না, কোথাও বোমা পড়বে না, কেউ আর কাউকে ধরে নিয়ে যাবে না চোখ বেঁধে, বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসবে না, আকাশে ভিড় করবে না শকুনের দল, আমরা ফিরে যাব শহরের বাড়িতে, আমার ফেলে আসা ঘরটিতে ঘুমোব কোলবালিশ বুকে জড়িয়ে, আমার মাপুতুল মেয়েপুতুল এখনও ওদের ছোট্ট খাটে ঘুমিয়ে আছে, গিয়ে ওদের ঘুম ভাঙাব।