হাঁসপুরের বাড়িটি কাসুর বোন ডালিমের শ্বশুর বাড়ি। বাড়ির মাঠে বসে মোষদুটো জিরোয়। মোষঅলাও। কাসু আগে আগে হাঁটে, শহরের ইষ্টিরা কাসুর পেছনে, কাসু হাঁটে আর পেছনে তাকায়, হাসুর চোখের ইঁদুর কাসুর চোখে নেই।
হাসুর দুই চোখে দেখেছি দুইটি ইঁদুর,
তাই, বাঁশবন পার হয়ে চলি হাঁসপুর।
লেখাপড়া জানা, দরদালানে থাকা, মটরগাড়ি চড়া শহরের মানুষদের এ বাড়ির সবাই খাতির করে। সবচেয়ে বড় ঘরটি ছেড়ে দেওয়া হয় আমাদের জন্য, আলমারি খুলে রঙিন ফুল পাতা আঁকা কাচের গ্লাস আর চিনেমাটির থালবাটি বার করা হয়। কই মাগুরের ঝোল রাঁধা হয়, ডাক পড়লে আমরা ঝাঁক বেঁধে পিঁড়ি পেতে বসি পাকঘরে। অতিথ খাইয়ে, পোলাপান খাইয়ে, ক্ষেত ফেরা পুরুষদের খাইয়ে, বেলা ফুরোলে বাড়ির মেয়েরা খেতে বসেন। বিছানায় নকশি কাঁথা বিছিয়ে দেওয়া হয়, লাল নীল সুতোয় ভুলো না আমায় লেখা ওয়াড় লাগানো হয় বালিশে। মাথা গুনে বালিশ। মাথার বালিশই দু’ঠ্যাংএ চেপে ঘুমোই, কোলবালিশের অভ্যেস মরে না যুদ্ধেও। স্বপ্নের ভেতরে ভাসি হাঁসের মত হাঁসপুরের জলে, উড়ি ছটকু আর কাসুর লাল ঘুড়ির মত হাওয়ায়।
এ বাড়িতে আমার বয়সী মেয়েরা এক প্যাঁচে শাড়ি পরে, কারও কারও শুনি বিয়েও হয়ে গেছে। ভোরে উঠে ওরা হাঁস মুরগির খোঁয়াড় খোলে, উনুনে ফুঁকনি ফোঁকে, মশলা বাটে, ঢেঁকি পাড় দেয়, কুলোয় চাল ঝাড়ে, ওদের ডেকে বলি–খেলবা এক্কা দোক্কা, কুতকুত? শুনে ওরা ঠোঁট টিপে হাসে, খেলতে আসে না। ছেলেরা গাছে উঠে আম পাড়ে, গাব পাড়ে, ডাব পাড়ে, ওদের মত আমারও ইচ্ছে করে গাছে উঠতে। ওরা বলে: মেয়েমানষরা গাছে উঠলে গাছ মইরা যায়।
ওরা হাডুডু খেলে লুঙ্গি কাছা মেরে। আমি খেলতে চাইলে বলে: মেয়েমানষের হাডুডু খেলতে হয় না।
ওরা কাঁধে গামছা ফেলে বিলে যায় মাছ ধরতে। ওদের পেছন পেছন আমিও রওনা হই, পেছন ফিরে বলে ওরা–মেয়ে মানষের মাছ ধরতে নাই।
ঘুট্টি উড়াইতেও নাই?
না, ঘুট্টি উড়াইতেও নাই।
কে কইছে নাই? আমি কোমরে দু’হাত রেখে বুক টান করে দাঁড়াই।
গায়ে কাদা মাখা, কালো মিশমিশে, মুখ ভর্তি হলুদ দাঁতের ছেলে দু’পা পেছনে এসে বলে, কও তো কাচা গাব পাকা গাব কাচা গাব পাকা গাব! খুব তাড়াতাড়ি কইতে হইব। বলতে পারলে মাছ ধরতে নেবে আশায় বলে দেখি কাচাগাবপাচাবাপকাকাপাপ ধরনের শব্দ বেরোচ্ছে। হলুদ দাঁত খাঁক খাঁক করে হাসে। ওর সঙ্গে বাকিরাও খাঁক খাঁক। আমাকে পেছনে রেখে ওরা চলে যায় বিলের দিকে। আমি একা দাঁড়িয়ে থাকি রেডিমেড ফ্রক পরা শহুরে মেয়ে। দুপুরবেলা পুকুরে নেমে মেয়েরা যখন এক সাঁতারে আরেক পাড়ে চলে যায়, এক ডুবে মাঝপুকুর থেকে ঘাটের কাছে এসে মাথা তোলে, আমি মুগ্ধ চোখে, ঘাটে বসে, দু’পা ভিজিয়ে জলে, ওদের দেখি। আমাকে খালি গায়ে দেখে মেয়েরা বলাবলি করে, ঢেঙ্গি ছেড়ির অহনো বুনি উডে নাই।
শরাফ মামা খলসে মাছে ভরা পুকুরে উল্টো সাঁতার, ডুব সাঁতার দিয়ে শাপলা ফুল ছিঁড়ে এনে পাড়ে বসে থাকা আমাকে বলতেন, সাঁতার শিখবি? বেশি কইরা পিঁপড়া খা, তাইলে সাঁতার পারবি। পিঁপড়ে ধরা চিনি গুড় খেয়ে পুকুরে নেমে সাঁতরাতে চেষ্টা করেছি অনেকদিন, জল আমার দু’পা টেনে পাকে ফেলে নিয়ে যায় জলের তলে। হাঁসপুর গ্রামের ন্যাংটো পোলাপানও জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরায়, দেখে শরম লাগে, এত বড় ধিঙ্গি মেয়ে আজও কোমর জলে কলমিলতার মত দাঁড়িয়ে থাকি। মনে মনে ওদের মত সারাপুকুর সাঁতার কাটি, এক পাড় থেকে আরেক পাড়। গা পোড়া দুপুরে ঠাণ্ডা জলে ঢেউ তুলে সাঁতরানোর মত আনন্দ আর হয় না! মা খবর পাঠান, পুষ্কনিতে বেশিক্ষণ পইরা থাকলে ঠাণ্ডা লাইগা জ্বর আইব। কোমর জল থেকে শহুরে মেয়েকে উঠে আসতে হয় ডাঙায়। ডাঙা তো নয়, আস্ত একটি চুলো।
ডাঙায় অনেক কাণ্ড ঘটে বটে। পাঞ্জাবিরা পুড়িয়ে দিচ্ছে গ্রামের বাড়িঘর, পোড়া বাড়ির বউঝিরা হাঁসপুরের বাড়ি বাড়ি ঘুরে কপাল চাপড়ায়। হাঁসপুর থমথম করে, যেন এক্ষুণি বোমা পড়বে হাঁসপুরের চাঁদিতে। গ্রামের দুটো বাড়িতে রেডিও আছে। যে বাড়িতে বেমক্কা উঠেছি আমরা, আমি মা নানি ছটকু ইয়াসমিন, সে বাড়িতে; আরেকটি রেডিও কাসেম শিকদারের বাড়ি। সন্ধের পর দু’বাড়িতে লোক ভিড় করে রেডিওর খবর শুনতে। রেডিও শুনতে আসা লোকেরা উঠোনের শীতল পাটিতে বসে হুঁকো টানেন, হুঁকো ঘোরে এক মুখ থেকে আরেক মুখে। গেল দু’মাস ধরে টাক মাথা গাল ফোলা সবুজ লুঙ্গি লোকটি বলে আসছেন–স্বাধীন বাংলার খবরে কইছে মুক্তিবাহিনী আইতাছে, আর দেরি নাই।
ডালিমের শ্বশুর জলচৌকিতে বসে তাঁর মিশমিশে কালো পিঠে ছপছপ করে গামছা মেরে মশা তাড়ান। আঙুলে থুতনির শাদা দাড়ি আঁচড়ে বলেন–মিলিটারির লগে কেমনে পারব হেরা? ভারত থেইকা নাকি টেরনিং লইয়া আইতাছে। গেরামের জমিরালি, তুরাব, জব্বর, ধনু মিয়া বেবাকে তো যুদ্ধে গেল। এগো নাক টিপলে দুধ বারয়, এরা কিয়ের যুদ্ধ করব! ঢাকায় তো মানুষ মইরা ছারখার! গেরাম কে গেরাম জ্বালাইয়া দিতাছে, মিলিটারিরা কি মানুষ! ওরা অইল জানোয়ারের জাত। আমারে তো ত্রিশাল বাজারে এক সিপাই জিগায় আপকা নাম কেয়া হায়? আমি কই আমার নাম দিয়া তুমার কাম কি হালা। চানতারা মজজিদের ইমাম দেখলাম, সিপাইএর পিছন পিছন চলে। ইমাম সাইবের মতলব আমার ভালা ঠেকল না।