চাল পড়া না খাওয়ার দলে নানা, শরাফ মামা আর ফুলবাহারি। নানা আর শরাফ মামা বাড়ি ছিলেন না, আর ফুলবাহারি বাড়ি থেকেও তার কালো গ্রীবা শক্ত করে দাঁড়িয়ে থেকে কোমরে শক্ত করে আঁচল গুঁজে বলেছে আমি চুরি করি নাই, আমি চাইল পড়া খাইতাম না। যে বেডা চাইল পইড়া দিছে, বেডারে আমি চিনি, বেডা একটা আস্তা বদমাইশ। মোলবি বেডার বাড়িত আমি কাম করছি, বেডার চরিত্র আমার জানা আছে। হে পড়ব চাইল পড়া, আর আমি তা মুহো দিমু! জীবনেও না।
ফুলবাহারি থুতু ছোঁড়ে মাটিতে। সে খাবে না তো খাবেই না।
মা ধমকান–মৌলবিরে বদমাইশ কও ক্যা ফুলবাহারি, গুনাহ হইব।
ফুলবাহারির শরীর তেলমাখা বাঁশের মত, কালো, ছিপছিপে। মুখে বসন্তের দাগ। বিড়ি খাওয়া কালো ঠোঁট। কানের ওপর বিড়ি রেখে সে মশলা বাটে, বাসন মাজে,.ঘর মোছে, উঠোন ঝাট দেয়, দিয়ে পাকঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেস দিয়ে বসে বিড়িতে আগুন ধরায়।
ফুলবাহারি চাল পড়া না খাওয়ায় কানের দুল চুরি করেছে যে সে ই, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয় সকলে। ও চাল পড়া খাবে না ঠিক আছে বাটি চালানের আয়োজন হোক। এরকম একটি প্রস্তাব দেন রুনুখালা। বাটি চালান দেবে জবেদা খাতুন, কানা মামুর বউ। উঠোনে এঁটেল মাটি লেপে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে কাসার বাটি, এই বাটিতে তুলা রাশির কেউ হাত রাখলে বাটি আপনা মতে চলবে, চোরের সামনে গিয়ে থামবে বাটি। বাটি চালান হচ্ছে বাড়িতে, জবেদা খাতুন তুলারাশি, বাটি তার হাতে চলছে, এ ঘরের আঙিনা ওঘরের কোণা পেরিয়ে আমাদের পাকঘরে বাটি এসে থামে, একেবারে ফুলবাহারির পাছার তলায়। ফুলবাহারি তখন মশলা বাটছে। বাটির পেছনে পেছনে বাড়ির লোক এসে জড়ো হয়।
হাশেম মামা চড়া গলায় বলেন–ফুলবাহারি দুল বাইর কইরা দেও।
ফুলবাহারি ফুঁসে উঠে পদ্ম গোখরার মত, ওর কানে ঝিলমিল করে সস্তা সোনালি দুল, বলে–আমি চুরি করি নাই। আমি গরিব বইলাই আপনেরা মনে করতাছুইন আমি চুর। মানুষ গরিব অইলেই চুর অয় না। চুর অইলে চুরিই করতাম, খাইটা খাইতাম না। আপনেগো বাটি ভুল চলে।
রুনু খালা ফুলবাহারির গায়ে ঠোনা মেরে বলেন–
যে নারী ঝনঝনাইয়া কয়রে কথা, ধপধপাইয়া হাঁটে
সেই নারীর খসমের জাতি মরে হাটে ঘাটে।
বাটি ভুল মানুষের কাছে গেছে এ কথা কেউ মানে না। নানি বলেন–ফুলবাহারি, দুল জুড়া দিয়া দেও। যেহানে রাখছ কও, আমরাই বাইর কইরা লই।
ফুলবাহারির হাত ভরা হলুদ, দাঁড়িয়ে আছে হলুদ হাত শূন্যে ধরে, শুকিয়ে চড়চড় করা বিড়ি খাওয়া কালো ঠোঁট ফুলিয়ে ফুলবাহারি বলে–আপনেগো মদ্যেই কেউ চুরি করছুইন দুল। আমি করি নাই।
কথা শেষ হওয়ার আগেই মা ঝাঁপিয়ে চুলের গোছা ধরে টেনে ওকে নিয়ে আসেন পাকঘরের বাইরে উঠোনে, আমগাছ তলায়। ফুলবাহারির চুল যায় আগে আগে, শরীর যায় পেছনে, পা পারে না আঁকড়ে রাখতে চেয়েও মাটি। টুটু মামা চুলো থেকে আধপোড়া খড়ি এনে বেদম পেটাতে শুরু করেন ফুলবাহারিকে। ওর কানের বিড়ি মাটিতে পড়ে গায়ের নিচে চিপসে যায়, সারা উঠোন গড়াতে গড়াতে গলা ছেড়ে চেঁচায়–ফুলবাহারি চুরি করে না।
ফুলবাহারিকে সেদিনই কাজ ছেড়ে চলে যেতে হল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল ফুলবাহারি। ওকে দেখে আমার মনে হয়েছিল ঝুনুখালার দুল ও চুরি করেনি। ও ঠিকই বলেছে যে বাটি ভুল চলেছে।
ফুলবাহারি চলে যাওয়ার পরদিনই বস্তির মাঝবয়সী মেয়েমানুষ তইতইকে কাজে রাখা হল। তইতইএর নাম আসলে নূরজাহান। নূরজাহানের কিছু পোষা হাঁস আছে, হাঁসগুলোকে সন্ধে হলে সে বাড়ি নিয়ে যায় আয় আয় তই তই বলে ডেকে ডেকে। হাঁসেরা পুকুরঘাট থেকে প্যাঁক প্যাঁক করে উঠে এসে নুরজাহানের পেছন পেছন হেঁটে বাড়ি ফেরে। গোঁধুলির আলস্য ভেঙে পুকর পাড়ে দাঁড়িয়ে নুরজাহানের তই তই ডাক শুনে টুটুমামা নূরজাহানকে তইতই বলে ডাকা শুরু করল। সেই থেকে তাকে তইতই বলেই সবাই ডাকে, এক নানি ছাড়া। তইতই ওরফে নুরজাহান ওরফে আলেক খালেকের মা, বেটে, পান খাওয়া লাল দেঁতো, আমাদের তখন ছুটা কামের বেটি। তইতই সকাল দুপুর বাড়ির মশলা বাটার, থাল বাসন ধোয়ার, ঘর দোর ঝারু দেওয়ার কাজ করে। আমাদের আলাদা সংসারের চুলোয় রান্নাবান্না করে। মাসিক পাঁচ টাকা বেতন তইতইএর, ভাত পায় এক বেলা।
বাড়িতে ছুটা বা বাঁধা কামের বেটি পাওয়া মোটে মুশকিল নয়। পা বাড়ালে বস্তি, হাত বাড়ালে মেয়েমানুষ। একটিকে বিদেয় করলে জোটে আরেকটি। ফুলবাহারি কানের দুল চুরির দায়ে চেলা কাঠের মার খেয়ে বাড়ির বার হল, তইতই এল। তইতইকে ছাঁটাই করা হল কাজে ফাঁকি দেওয়ার অপরাধে। কি রকম ফাঁকি, না, সন্ধের আগেই তড়িঘড়ি বাড়ি ছাড়ে সে, ঘরে তার আলেক খালেক আছে, আছে ছ’জোড়া হাঁস। মা নানিকে বললেন– তইতইর কামে মন নাই। রাইতের রান্ধাবাড়া আমারে একলা করতে হয়। বান্ধা কামের বেটি ছাড়া আমার পুষাইত না।
নানি বললেন–দেখ আর কয়ডা দিন। নুরজাহানের স্বভাব টভাব ত ভালাই। চুরি টুরি করে না।
মা নানির কথায় গললেন না। আধা মাসের আড়াই টাকা হাতে ধরিয়ে তইতইকে বলে দিলেন–যতদিন কাম করছ, হিশাব কইরা বেতন লইয়া যাও। আমি নতুন কামের বেডি রাইখ্যা লইয়াম।
তইতই বিদেয় হলে কারও কোনও আফসোস নেই।
বস্তিতে কি আর মেয়েমানুষের অভাব!
তইতই নেই, মাকে একাই রান্নাঘরে বসতে হয়, চুলো ধরাতে হয়, আনাজপাতি কুটতে হয়, মাছ মাংস ধুয়ে রান্না চড়াতে হয়। চুলোয় আগুন ধরাতে মা দেশলাই খোঁজেন, ফুলবাহারি বা তই তই চুলো ধরাতো, দেশলাই ওরাই জানে রেখেছে কোথায়।