ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি দরজায়, এক পাও নড়ে না আমার।
মা কাছে এসে পিঠে হাত বুলিয়ে নরম কণ্ঠে বলেন–যাও, মামারা কিচ্ছা শুনাইব, যাও। ফিতা লইয়া যাও, ঝুনু তুমার চুল বাইন্ধা দিব।
আমি নড়ি না। বাবা বলেন–থাক, যাইতে যহন চাইতাছে না।
–বড় বেয়াদ্দপ। মা বলেন।
আমি, মা ভাবেন, হয়েছি অদ্ভুত। বাড়িতে কোনও অতিথি এলে দৌড়ে গিয়ে লুকোই মা’র পেছনে। এত ভয়, এত লজ্জা, এত দ্বিধা আমার কোত্থেকে এল মা বোঝেন না। আমার মুখ দিয়ে রা শব্দ বেরোয় না, গল্প বলতে বললেও শব্দ হাতড়াই, কিন্তু শুনতে বেলায় কান খাড়া। নানা জনের নানা গল্প শুনি, কিন্তু নিজে গুছিয়ে গল্প বলতে পারি না। পড়তে বেলায়ও। এর মধ্যেই ব্যঙ রাজকুমার, ঠাকুরমার ঝুলি, সোনার কাঠি রূপোর কাঠি নানারকম রূপকথার বই পড়ে সারা। আমি পড়ি না তো, গিলি, গোগ্রাসে। আমি মুখচোরা গোছের, মনের কথা খুলে বলি না খুব, এই যে নানির ঘরে আমি ঘুমোতে গেলাম না, মামাদের সঙ্গে শুয়ে কিচ্ছা শোনার মত লোভনীয় ব্যাপারটিকে দিব্যি বাতিল করে দিলাম, কেন, কি কারণ, তা মুখ ফুটে বলি না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি ধমকালে। কানমলা, গুঁতো, চড় চাপড় সারাদিনই খাচ্ছি, তারপরও মুখে শব্দ নেই। কাঁদিও না প্রাণ খুলে। রবিউল আওয়াল মাসের বারো তারিখে জন্ম। শর্মিলার বাড়িতে কোনও খাবার খাইনি শর্মিলা হিন্দু বলে, কপালে হিন্দু মেয়েদের মত টিপও পরতে চাই না, হয়ত আমার খুব অন্যরকম হবার কথা ছিল, ঈমানদার। কিন্তু আরবি পড়তে গেলে আমি খুব খুশি হই না, কায়দা সিফারা ফেলে কখন রূপকথার একটি বই হাতে নেব, ছবি আঁকব, দৌড়ে রেললাইনে যাব, মাঠে খেলব, সেই তালে থাকি। কত বলা হয়েছে মানুষের ছবি আঁকিস না, মানুষের ছবি আঁকলে গুনাহ হয়, মানুষের যদি প্রাণ দিতে পারস, তাইলেই সে ছবি আঁক, তবু মানুষের ছবি আঁকার প্রচন্ড উৎসাহ আমার মরে না।
ফজলিখালার শ্বশুরবাড়ি থেকে মা লাল রঙে আঁকা হযরত মহাম্মদের জুতোর ছবির ওপর আল্লাহর আয়াত লেখা একটি কাগজ, মা বলেন নাল শরিফ, তাবিজের খোলে পুরে অকারণ ভয় দূর করতে আমার গলায় পরিয়ে দেন।
০৫. সাপ
মানুষের ছবি আঁকা পাপ জেনেও আমি বুঝি না কেন আমার ভাল লাগে মানুষের ছবি আঁকতে।
আমাকে ছবি আঁকতে দেখলেই মা বলেন–গাছপালা আঁক, ফুল আঁক , ক্ষতি নাই। মানুষের প্রাণ দিতে না পারলে মানুষের ছবি আঁকিস না। এক আল্লাহ ছাড়া মানুষের প্রাণ কেউ দিতে পারে না।
সেদিন আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়–গাছ যে আঁকতে কইলা, গাছেরও তো প্রাণ আছে।
মা ঠোঁটজোড়া মুখের ভেতর ঠেসে টাসেল বাঁধতে বাঁধতে চুলে, বলেন–যা কইছি, তাই কর। বেয়াদ্দপি করিস না।
মা যা বলেন তাই করতে হবে, যেহেতু মা বলেছেন। মা আমাকে গু খেতে বললেও গু খেতে হবে, ব্যাপারটি এরকম। ছবি আঁকলে প্রাণ যে দিতেই হবে এমন কি কথা! আমি তো মানুষ বানাচ্ছি না, আঁকছি। দুটোর মধ্যের তফাৎটুকু মা বোঝেন না। যুক্তিহীন কথা বলেন, অনেকটা গায়ের জোরে, নাকি মায়ের জোরে কে জানে। নিষেধ করার পরও মানুষের ছবি আমি এঁকেছি সে মানুষের ছবি আঁকব বলে নয়, এঁকেছিলাম নৌকো, নৌকোর প্রাণ নেই বলে সে ব্যাপারে কারও কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু দোষ হয়েছে নৌকোয় মাঝি বসিয়েছি। নৌকোর কি নদীতে একা একা ভাসা মানায়! বৈঠা হাতে নৌকোর গলুইতে একটি মাঝি না বসিয়ে পারিনি। নানিবাড়ি বেড়াতে এসে হুমায়রা সে ছবি দেখে ছি ছি করে যাওয়ার পর মা সন্ধে বেলা আমার রঙপেনসিল আর ছবি আঁকার কাগজ কেড়ে নিয়ে বললেন–আঁকাআঁকি থইয়া লেখাপড়া কর।
ভ্যাঁ করে কাঁদার মেয়ে আমি নই, ঝিম ধরে বসে থাকি।
খোলা জানলার পাশে শুয়ে গায়ের ব্লাউজ খুলে বাঁ হাতে বুকের ঘামাচি মারেন আর ডান হাতে হাতপাখা নাড়েন মা। আমার কাগজ পেনসিল কেড়ে নেওয়াটা মা’র কাছে উঠোনের আবর্জনা কুড়িয়ে পাগারে ফেলার মত তুচ্ছ ঘটনা।
জোরে পড়। পড়া ত শুনা যায় না। মা’র ধমকে ঝিম ভাঙে আমার।
গলার স্বর বুজে এলে কি চড়া স্বরে পড়া যায়! সেটিও আমার দ্বারা হয় না।
সে রাতেই মা যখন মাথায় আমার হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বললেন আসো মা, আমার সাথে নামাজে দাঁড়াও।
মা’র ওইটুকু ষ্পর্শে আমার সব ক্ষোভ উড়ে যায় দখিনা বাতাসে। মা এরকম, মেরে ধমকে আবার কোলে নিয়ে আদর করতে বসবেন। দাদাকে সকালে কঞ্চি দিয়ে পিটিয়ে পিঠ লাল করে দুপুরে সে পিঠে নিজের হাতে সর্ষের তেল মালিশ করে দিয়েছিলেন। নামাজ পড়লে মা বলেন আল্লাহ তোমারে ভালবাসবেন, তুমি যা চাইবা আল্লাহ তুমারে তাই দিবেন।
যা চাইব তাই আল্লাহ দেবেন, এর মত মজা আর হয় না। মা ওঠবস করেন, সেটিই অনুসরণ করে মোনাজাতের হাত তুলে চোখ মুদে মনে মনে বলি যেহেতু আল্লাহ মনে মনে বলা কথাও শুনতে পান, আল্লাহগো আমারে দুইটা পোড়াবাড়ির চমচম দেও। মোনাজাত শেষ করে চোখ খুলে দেখি কোথাও পোড়াবাড়ির চমচম নেই। জায়নামাজের তলেও খুঁজি, নেই। মা’কে পরে প্রায় কেঁদে বলি–কই যা চাইছি আল্লাহ তো দিল না।
মা বলেন–মন দিয়া চাস নাই, তাই পাস নাই।
এরপর প্রায় রাতেই মা’র সঙ্গে নামাজে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে আল্লাহর কাছে নানা জিনিস চেয়েছি–চাবি দিলে ঘোরে এমন গাড়ি, মুক্তাগাছার মন্ডা, বয়াম ভর্তি মার্বেল, বাঁশিঅলা বেলুন, পাইনি। এর চেয়ে বেশি মন কি করে দিতে হয় আমি জানি না। নিজেকে আমার বিষম এক পাপী মানুষ বলে বোধ হতে থাকে। তবে কি সেটিই আমার পাপ ছিল যে শরাফ মামা আমাকে ন্যাংটো করেছিলেন একা ঘরে! সেই পাপের কারণে কি আল্লাহ আমাকে ঘৃণা করছেন! হবে হয়ত। মন ভরে থাকে বিষাদে। বিষাদাচ্ছ্বন্ন আমাকে মা যেদিন নানির ঘরে গিয়ে ঘুমোতে বললেন, আমার যেতে ইচ্ছে করেনি, মামাদের সঙ্গে ঘুমোতে আমার ভয় হয়। মা জানেন না আমার ভয়ের কারণ। আমাকে ন্যাংটো করার কদিন পরই চুম্বকের খেলা দেখাতে পুকুর ধারে ডেকেছিলেন তিনি, যাইনি। মাথায় আমার চাটি মেরে চলে গেছেন শরাফ মামা। টুটু মামা ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রায় বিকেলেই সিরাজউদ্দোলার অভিনয় করেন। বাড়ির ছেলেমেয়েরা সে ঘরে বসে টুটু মামার যাত্রা দেখে হাত তালি দেয়। দরজায় উঁকি দিয়ে যখন দেখেছি ঘর অন্ধকার, ঢুকিনি। অন্ধকার কোনও ঘরে আমার ঢুকতে ইচ্ছে করে না। চাঁদনি রাতে উঠোনে বসে কানা মামু হরিণ শিকার করতে করতে কি করে একদিন তাঁর চোখ অন্ধ হয়ে গেল, সে গল্প বলেন। বাড়ির লোকেরা জলচৌকিতে নয়ত শীতল পাটিতে শুয়ে বসে কানা মামুর শিকারের গল্প, আমির হামজা, সোহরাব রুস্তমের পালা শোনে। আমি শুনি মা’র গা ঘেঁসে বসে। গা এত ঘেঁসে বসি যে মা বলেন–শইল ছাইড়া ব। গরম লাগে।