বাবা বলেছেন–পুষাইতে হইব। নিজের মায়ের পেটের ভাই যখন। আমি ত আর ভাইরে ফেলাইয়া দিতে পারি না। আর ও থাকলে তুমারও লাভ হইল। বাজার সদাইটা ওরে দিয়াই করাইতে পারবা।
–বাজার সদাই তো নোমান কামালই, বড় হইছে, করতে পারে। মা ঠান্ডা গলায় বলেন।
পরদিন মা’র জন্য একটি ছাপা সুতি শাড়ি কিনে আনেন বাবা। মা খয়ের ঘসে একটি পান খান সেদিন। ঠোঁট লাল টুকটুক করে, নতুন শাড়িটি পরে বাবার গা ঘেঁসে বিছানায় বসে বলেন–কাপড়ের বাইনটা খুব ভালা।
শাড়িটি মা’কে কেমন মানাচ্ছে এসব কথায় না গিয়ে বাবার ব্যাকুল প্রশ্ন।–আমানরে খাওন দিছ?
মুহূর্তে মা’র বুকে একটি কাঁটা এসে বেঁধে। আসলে কি বাবার এই আদর, সোহাগ সবই আমান কাকার যেন ভাল দেখাশোনা করেন মা, সে কারণে! লোকে চাকর বাকরকে মাঝে মাঝে এটা ওটা দিয়ে সন্তুষ্ট রাখে যেন চাকর ভাল রাঁধে বাড়ে, যেন বিশ্বস্ত থাকে মনিবের! নিজেকে এ সংসারে এক দাসী ছাড়া মা’র আর কিছু মনে হয় না। মা’র সুখ কিসে, কিসে অসুখ বাবা তার খবর রাখেন না। আমান কাকা বাড়িতে আসার দিন সাতেক পর মা একবার বলেছিলেন–সুলেখার মা’র বাড়িতে তোমারে আর আমারে দাওয়াত দিছে, সুলেখার বিয়া। চল যাই।
বাবা সাফ বললেন–না।
মা পীড়াপিড়ি করলে বিরক্ত স্বরে বললেন–টেকা রাখো, যা উপহার কিনার, কিইনা তুমি একলা যাও।
এরকম এক অদ্ভুত মানুষের সঙ্গে জীবন যাপন করেন মা। লোকে জানে তিনি ডাক্তারের বউ, লোকে জানে সুখে টইটম্বুর তাঁর জীবনের চৌবাচ্চা। কেবল তিনি জানেন বাবার শরীর থেকে ভেসে আসা অন্য এক নারীর গন্ধ তাঁর সব সুখ স্বপ্ন ধুলোয় উড়িয়ে দিয়েছে, তিনিই জানেন শরম লজ্জা থুয়ে শরীর মেলে দেওয়ার পরও বাবা বিছানায় পাশ ফিরে ঘুমোন, তাঁর নির্ঘুম রাতের সঙ্গী হয় কেবল দীর্ঘশ্বাস।
ছোটদাকে সঙ্গে নিয়ে সুলেখার বিয়ে খেয়ে আসেন মা। মা সারা বাড়ির ভিড়ের মধ্যে বড় একা বোধ করেন। বাবা রাতে ফেরেন গুনগুন গান গাইতে গাইতে, জিভ লাল পানের রসে। টেবিলের বাড়া ভাত সে রাতে ছোঁন না বাবা। কুন বেডির বাড়িত থেইকা খাইয়া আইছ যে ভাত খাইতে বও না? মা কথার তীর ছোঁড়েন বাবার দিকে।
বাবা হেসে বলেন–দাওয়াত আছিল এক রুগির বাড়িত।
–পুরুষ রুগি নাকি মেয়ে রুগি? বিছানায় দ হয়ে শুয়ে মা বলেন।
— রুগি রুগিই। পুরুষ আর মেয়ে কী! বাবা ধমকে বলেন।
— অইতা চালাকি আমি বুঝি। রাজিয়া বেগম তুমার রুগিই আছিল। আছিল না? হের বিছনা থেইকা তুমারে আমি তুইলা আনি নাই? আনছি। আমারে সরল সহজ পাইয়া তুমি যা ইচ্ছা তাই কইরা যাইতাছ। বলে মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
মা’র পাশে সটান শুয়ে বাবা বলেন–যা ইচ্ছা করতে পারলে ত ভালই ছিল। করতে পারি কই!
সকালে ছোটদার গিটারে তুমি কি দেখেছ কভু, জীবনের পরাজয়! দুখের দহনে করুণ রোদনে তিলে তিলে তার ক্ষয়, গানের সুর শুনে বাবা লাফিয়ে বিছানা ছাড়েন। ভেসে আসা সূরের সঙ্গে তিনি গাইতে থাকেন–প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে, জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে।
মা থালায় করে হাতগড়া রুটি আর ডিম-পোচ নিয়ে ঘরে ঢুকে বাবাকে গান গাইতে দেখে চমকান। ওহ, মাকে আরও চমকে দিয়ে বাবা বলেন, কামাল ত ভালই বাজায়। গানটাতে একেবারে আমার মনের কথা কইছে। শুনছ!
সেই সকালে হাসপাতালে যাওয়ার আগে বাবা ছোটদাকে ডেকে বললেন–কুন মাস্টারের কাছে গিটার শিখ তুমি! মাস ত শেষ, টাকা লাগব না মাস্টারের! কত টাকা!
বলে মানিব্যাগ খুলে টাকা বের করে দিলেন ছোটদার হাতে। ছোটদার সারা মুখে উপচে পড়ে খুশি। বাবা বললেন–ভাল কইরা লেখাপড়া না করলে, খালি গান বাজনা লইয়া থাকলে চলব! গান বাজনা কি তোমারে খাওন দিব! সকালে ব্রেনডা পরিষ্কার থাকে। সকালে পড়তে বসবা। একটা রুটিন কইরা লও। খাওয়ার সময় খাওয়া। পড়ার সময় পড়া। গান বাজনার সময় গান বাজনা।
কোথায় এক অজপাড়াগাঁয়ের রাখাল ছেলে শহরের বড় হাসপাতালের সরকারি ডাক্তার হয়ে গেল! জীবনে এত সফল হয়েও পরাজয়ের, দুঃখের এই গানটি বাবার ভাল লাগল, মা বুঝে পান না, কেন। মা’র হিশেবে মেলে না কিছুই। মানুষটি পাথরে গড়া, আবার মনে হয়, কাদায়।
সেরাতে বাবা বাড়ি ফিরলে মা কুঁচি কেটে শাড়ি পড়েন, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে বাবাকে হাতপাখায় বাতাস করতে করতে, বাবা যখন রাতের খাবার খান, আমাকে বললেন যা তর নানির ঘরে ঘুমা গিয়া।
নানির ঘরে যাওয়ার কথায় লাফিয়ে ওঠা মেয়ে আমি, মা তাই জানেন। কিন্তু অবাক হন শুনে যখন বলার পরও আমি ও ঘরের দিকে ছুটি না।
মা আবার বলেন—যা তর নানির ঘরে ঘুমাইতে যা।
আমি মাথা নেড়ে বলি–না।
মা চকিতে ঘাড় ফেরান আমার দিকে–কি রে, যাইবি না তুই!
আমি স্পষ্ট স্বরে না বলি।
–কি হইছে তর? কেউ মারছে? টুটু, শরাফ, ফেলু কেউ?
খাটের রেলিংএর কাঠ থেকে পুডিং তুলতে তুলতে নখে, বলি–না।
–না, তাইলে যাস না ক্যা?
মা আমাকে দরজার দিকে ঠেলেন।
আমি দরজার পাল্লা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। সামনে অন্ধকার উঠোন।
মা বলেন–ছেড়িডারে লইয়া আর পারা গেল না। ও মুটেই কথা শুনে না। কই, ঘরো বইসা থাক। না বাইরে খেলবো। সারাদিন খেলা খেলা। খেলার মধ্যে মাইর খাইয়া প্যানপ্যান কইরা কান্দো। শইলে মাংস নাই, পাখির দানা মুহে দেয়। ছুটবেলায় তিনজনে হাত পা ঠাইসা ধইরা দুধ খাওয়াইতে হইছে। দুধ খাইব না, ডিম খাইব না। দিন দিন বেয়াদ্দব হইতাছে। কইতাছি তর নানির ঘরে গিয়া ঘুমা। যায় না। অইন্যদিন তো খুশিতে লাফ দিয়া দৌড় লাগাস।