–কি রে ডিসিপ্লিন মানস না শুনলাম!
ছোটদার কানের লতি ধরে টেনে ঘরে এনে চোখের তারার ওপর তারা রেখে জিজ্ঞেস করেন বাবা।
–মানি মানি। ছোটদা রাগে সশব্দে শ্বাস ছেড়ে বলেন।
–তর স্যারেরা তাইলে মিছা কথা কয়! বাবা বলেন।
ছোটদা দিব্যি বলে দিলেন–হ।
গালে কষে থাপ্পড় মেরে বাবা বলেন–ইস্কুলের রেডিও ভাঙছস ক্যান?
ছোটদা ফুঁসে উঠে বলেন–আমি রে রেডিও শুনতাছি, এক ছেড়া আইয়া রেডিও কাকাইড়া লইতে চাইছিল। তাই ভাঙছি।
–বা বা, সুন্দর যুক্তি দিছ! এত সুন্দর যুক্তি আমার ছেলের, ছেলেরে এহন মাথায় তুইলা নাচতে হয়। আমি রাইতদিন পরিশ্রম করি, ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জ্ইন্য। ছেলেমেয়েরা যেন লেখাপড়া কইরা মানুষের মত মানুষ হয়। আর এরা যদি অমানুষই হয়, কিসের এত খাটাখাটনি! ছোটদার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে পড়ার টেবিলে পাঠিয়ে বাবা বলেন– মায়ের আশকারা পাইয়া ছেলেডা নষ্ট হইয়া যাইতাছে।
এ বাড়িতে কেউ একবার মার খেলে তার জন্য চমৎকার উপঢৌকন অপেক্ষা করে থাকে। ছোটদা বাবার হাতের মার খাওয়ার পরদিনই বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে মা ক্রিকেটের ব্যাট বল কিনে দিলেন ছোটদাকে। সেই ব্যাট অবশ্য তিনি বলে মারার চেয়ে ঘরের চেয়ার টেবিলে মেরে আনন্দ পেতেন বেশি। ছোটদার মিছিলে যাওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকেই মা’র নতুন আবদার ছেলেকে গিটার কিনে দিতে হবে, গান বাজনা নিয়ে পড়লে মিছিল মিটিং থেকে ছোটদার মন উঠবে, এই আশা। বাবা একখানা হাওয়াইন গিটার কেনার টাকা দেন, গিটার কিনে গিটারের হলুদ একখানা জামাও নিজের হাতে বানিয়ে দেন মা। ছোটদার প্রতি মা’র আদর দাদার চোখে পড়ে, তিনি মা’কে বলেন আমারে একটা বেহালা কিইনা দিতে কন।
–তুই ক। তর কি মুহে রাও নাই? মা’র স্বরে বিরক্তি।
দাদা চুপসে যান। বাবার কাছে বেহালা চাওয়ার সাহস দাদার নেই। তিনি হাত পা গুটিয়ে ঘরে বসে আঙুলে টেবিল ঠুকে তাল দেন নিজেই নিজের গানে। গান দাদার একটিই, চার বছর বয়সে যেটি শিখেছিলেন মা’র কাছেএকবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি। ছোটদা গিটারে সা রে গা মা শিখে চলতি সিনেমার গান বাজাতে শুরু করেন। প্রতিমাসে ছোটদার গিটারের মাস্টারের বেতনের টাকার জন্য হাত পাতেন মা। প্রতিমাসেই টাকা দেওয়ার আগে বাবা বলেন–লেহাপড়া কতদূর করতাছে খবর নিছ? নাকি গান বাজনা নিয়া থাকলে ওর জীবন চলব? তিনটা প্রাইভেট মাস্টার রাইখা দিছি– অঙ্কের, ইংলিশের, সাইন্সের। ঠিকমত মাস্টারের কাছে যায় কি না জানো? রাইত কয়টা পর্যন্ত পড়ে? সুলেখার মা’র ছেলেগুলা রাইত দশটা পর্যন্ত পড়ে।
গিটারের মাস্টারের টাকা প্রতিমাসেই বাবা ছুঁড়ে দেন টেবিলে, বিছানায়, মেঝেয়। আর তিন মাস্টারের টাকা মাস্টারদের বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসেন।
বাবাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না মা। এত জটিল চরিত্র আর কোনও সংসারে আছে বলে মা’র মনে হয় না। এই মনে হয়, সংসারের জন্যই তাঁর খাটাখাটনি, সন্তানের মঙ্গলের জন্য সব উজাড় করে দিচ্ছেন আবার মনে হয় সংসারের কারও জন্য তাঁর কোনও মায়াই নেই, লোকে মন্দ বলবে বলে তিনি সংসার নামের একটি লোক দেখানো জিনিস হাতে রেখেছেন, আসলে রাজিয়া বেগমকে জীবন সঁপেছেন বাবা। আবার, বাবা যেদিন আমানউদ্দৌলাকে মাদারিনগর থেকে এনে আমাদের বাড়িতে ওঠালেন, চটের থলে করে এক সেরের জায়গায় দু’সের খাসির মাংস নিয়ে বাড়ি ফিরলেন, চেম্বার থেকে সকাল সকাল ফিরে মা’কে বললেন–গোসতটা বেশি কইরা পিঁয়াজ দিয়া ভুনা কর, আর লাউশাক রান্ধো সিম দিয়া, পাইন্যা ডালের বদলে ডাইল চচ্চড়ি কর–মা’র মনে হল যেন সকল খাটাখাটনি আসলে মাদারিনগরের মানুষদের জন্য।
সে রাতে দাদাদের কাছে ডেকে বাবা বলেছিলেন–তোমাদের লেখাপড়ার খবর কি? মাস্টারের কাছে পড়তে যাও ঠিকমত?
দাদার মাথা ঝুলে থাকে ঘাড়ে, মেঝেয় বুড়ো আঙুল ঘসতে ঘসতে বলেন–হ যাই।
–খেলা বেশি না পড়া বেশি, কুনটা কর? বাবা জিজ্ঞেস করেন।
যে উত্তরটি তিনি শুনতে চান, দাদা তাই শোনান–পড়া।
লেখাপড়া করে যে, সে কি করে?
–গাড়িঘোড়া চড়ে। দাদা উত্তর দেন, চোখ মেঝেয়।
–আর তুমি? ছোটদার দিকে চোখ ফেরান।
ছোটদা বলেন–গা গাড়িঘোড়া চড়ে।
শুনে আমি বলতে চেয়েছিলাম–বাবা ত লেখাপড়া করছে। বাবা তো ঘোড়াতেও চড়ে না। মটর গাড়িতেও না। চড়ে রিক্সায়।
বলা হয় না। শব্দ গিলে ফেলার স্বভাব আমার, গিলে ফেলি।
— হুম। আমাদের বাড়িতে একটা নতুন লোক আইছে, আমানুদ্দৌলা নাম। সে তোমাদের কি হয়? কাকা হয়। তোমাদের কি হয় সে?
ছোটদা ঘরের থামে হেলান দিয়ে বললেন–কাকা হয়।
–কাকা হয়, ঠিক। বাবা ছোটদাকে টেনে সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন–এইভাবে দাঁড়াইতে হয়, সোজা হইয়া।
–আর এই যে, তুমি এইদিকে আসো বলে আমাকে ডাকেন।
–তুমি তোমার কাকারে দেখছ? আমার ভাইরে?
মাথা নাড়ি আমি। হ্যাঁ দেখেছি।
–ঠিক আছে, সবাই পড়তে বও গিয়া। ভাত রান্ধা হইলে খাইবা। কাকারে লইয়া খাইবা। কাকা আপন লোক। বুঝছ কি কইছি?
দাদা ভাল ছাত্রের মত মাথা নেড়ে বলেন–বুঝছি।
আমান কাকার জন্য খড়ির ঘরের খড়ি সরিয়ে চৌকি আর টেবিল চেয়ার পেতে দিলেন বাবা। তাঁকে শহরের এক কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়ে বাবা বাড়িতে জানিয়ে দিলেন এখন থেকে কাকা এ বাড়িতে থাকবেন। তাঁর খরচপাতি সব বাবাই দেবেন।
–নিজের ছেলে মেয়ে আছে। এত খরচ পুষাইবা কেমনে তুমি? বাবার আয়োজন দেখে বলেছিলেন মা।