ক’দিন পর শেখ মুজিব এলেন মিন্টুদের বাড়িতে। সে কী ভিড় শেখ মুজিবকে দেখতে। ছোটদা বলেছিলেন আহা সেদিন আমি মরলে আমগোর বাড়িতে ভিড় হইত, দেখতে শেখ মুজিব আসত। পুলিশের গুলিতে সেদিন মিন্টুর বদলে নিজের মরণ হলেই তিনি খুশি হতেন। মৃত্যু হল না বলে কাউকে এমন হা পিত্যেশ করতে আমি আর দেখিনি। আমিও দেখতে গিয়েছিলাম শেখ মুজিবকে। হাজার লোকের ভিড়ে শেখ মুজিবকে দেখা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রথম পায়ের আঙুলের ওপর ভর রেখে, এরপর ইটের ওপর ইট রেখে তার ওপর, এরপর দেয়ালে, প্রথম নিচু দেয়াল পরে পড়ে মরার ভয় তুচ্ছ করে উঁচু দেয়ালে দাঁড়িয়ে শেষ অবদি দেখেছিলাম শেখ মুজিবকে। গায়ে কালো কোট, চশমা পরা লম্বা একটি লোক। দেখতে আমাদের পাড়ার সাহাবউদ্দিনের মত। সাহাবউদ্দিনকে দেখতে তো এত লোকের ভিড় হয় না! শেখ মুজিব নামের মানুষটি যেন সাত আসমান থেকে নেমে এসেছেন এ পাড়ায়, যেন তিনি ঠিক আর সবার মত মানুষ নন। শেখ মুজিব মিন্টুর মা’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। বরই তলায় সেদিনও পড়ে ছিল মিষ্টি মিষ্টি বরই। বরই কুড়োনোর কোনও ইচ্ছে আমার হয়নি সেদিনও।
মানুষের নিয়মই এই, মানুষ বেশিদিন শোক বইতে পারে না। মাস পার হয়নি, আবার যে যার জীবনে ফিরে গেল। মাঠে খেলতে শুরু করল বাচ্চারা, পুরুষেরা থলে ভরে বাজার করতে লাগল, উনুনে ফুঁকনি ফুঁকতে লাগল বাড়ির মেয়েরা। আমিও সন্ধে নামলে উঠোনে পাটি পেতে হারিকেনের আলোয় দুলে দুলে পড়তে থাকলাম আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।
কেবল কবরখানার পাশ দিয়ে যেতে, ওটিই ছিল আমার ইস্কুলে যাওয়ার, মনু মিয়ার কিম্বা ঠান্ডার বাপের দোকানে যাওয়ার পথ, মা যেমন বলেছিলেন, দু’হাত মুঠো করে মাথা নিচু করে নিঃশব্দে হেঁটেছি। মা বলেননি, কিন্তু কোথাও ফুল ফোটা কোনও গাছ দেখলে, সে যার বাড়ির ফুলই হোক, ছিঁড়ে দৌড়ে দিয়ে এসেছি মিন্টুর বাঁধানো কবরে। আমার মনে হত মিন্টু ঘ্রাণ পাচ্ছে সে ফুলের।
এই ঠুনকো পাকিস্তানও ভাঙবে বলে মা’র মনে হয়, লোকের কথাবার্তার ধরনও মা দেখেন পাল্টে গেছে, আয়ুব খানের গুষ্ঠি তুলে লোকে বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গাল দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ব শাসনের দাবি তুলে ছেলেরা রাস্তায় নামছেই। পাকিস্তান সরকার ক’দিন পর পরই সারা দেশে কারফিউ দিচ্ছে, বাইরে বেরোনো মানা, ব্ল্যাকআউট ঘোষণা করছে, বাড়িঘর অন্ধকার করে বসে থাকতে হয়। সব শাসকের এক চরিত্র, মা ভাবেন। ইংরেজের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা কম অনাচার করছে না! পূবের ধন পশ্চিমে পাচার হয়ে যাচ্ছে, এ ঠিক ভারতের ধন ইংরেজ যেমন জাহাজ ভরে নিয়ে গেছে নিজেদের দেশে। পাকিস্তান দিয়ে মা’র হবে কি! দেশ ভেঙে আরও টুকরো হোক, দেশ কাকে খাক, চিলে নিক, কিছু তাঁর যায় আসে না, তিনি তাঁর ছেলেদের মিছিলে মরতে দিতে চান না। ছেলে মেয়ে ছাড়া তাঁর আর আছে কি! এদের নিয়ে দাঁড়াবার মাটি যদি তিনি পান, তাই যথেষ্ট। লেখাপড়া জানলে তিনি কোনও চাকরি পেতে পারতেন, যে কোনও একটি চাকরি, তাহলেই নিরুত্তাপ বাবাকে তিনি মুক্তি দিতেন, অথবা নিজে মুক্তি পেতেন। ছোটদাকে নিয়ে একবার রেলে চড়ে ঢাকা চলে গিয়েছিলেন চাকরি খুঁজতে, ঢাকা শহরের বাতাসে নাকি ভূরি ভূরি চাকরি ওড়ে, হাত বাড়ালেই ধরা যায়। ঢাকার এক হাসপাতালে নার্সের চাকরি চাইলে কর্তৃপক্ষ বললেন হুট করে তো আর নার্সের চাকরি জোটে না, আরও লেখাপড়া জানতে হবে, নার্সিং ইস্কুলের সার্টিফিকেট লাগবে। মা ফিরে এলে বাবা ফোঁড়ন কেটেছিলেন–কয় না, সুখে থাকলে ভুতে কিলায়!
ছোটদাকে চোখের আড়াল করতে ভয় হয় মা’র। মিন্টুর মত ছোটদাও যদি গুলি খেয়ে মরেন একদিন! নিমপাতার তেতোয় দুধ ছাড়ানো ছেলের জন্য মাজ্ঞর বুকের ভেতর টনটন করে মা’র। পাঁচ ছ’ বছর বয়সেও ছোটদার বুকের দুধ খাওয়ার অভ্যেস যায়নি। নানি বলেছিলেন বুনিত নিমপাতা বাইটা দে, তাইলেই ছেড়া বুনি খাওয়া ছাড়ব। তাই করেছেন মা, নিমপাতার রস মেখে রেখেছেন বোঁটায়, যেন জিভে তেতো স্বাদ পেতে পেতে দুধ খাওয়ার শখ যায় ছেলের। ছোটদা কথা বলেছেনও দেরি করে, দু’বছর পার করেও বা আ বা আ করতেন বাবা বলতে গিয়ে। ক্লাস সিক্সে ভর্তি হতে গেলে ইস্কুলের হেডমাস্টার একটি প্রশ্নই করেছিলেন বানান কর তো পুরস্কার, ছোটদা পুস পাস পাস, পাস পাস পুস, স্পু স্পা পুস বলে হাঁপিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। হেডমাস্টারের সঙ্গে বাবার খাতির ছিল বলে ছোটদাকে ভর্তি করে নেন ইস্কুলে। ছোটদাকে হাতঘড়ি আর জ্যামিতি বক্স কিনে দিয়ে বাবা বলেছিলেন লেখাপড়ায় ভাল করলে একটা সাইকেল পাইবা। ছোটদা হাতঘড়ি হারিয়ে ফেললেন তিনদিনের দিন, আর কাঁটাকম্পাস ব্যবহার করতে লাগলেন বাড়ির সবার দাঁতে আটকা মাংস তোলার কাজে। দাদাকে দেখে তাঁরও একদিন শখ হয়েছিল আমার মাস্টার সাজার। বই খুলে আমাকে বললেন–
পড়, পিঁড়া পিঁড়া কয়টা ডিম
একটা দুইটা তিনটা ডিম।
দাদা শুনে হাঁ হয়ে থাকেন। কপালে ভুরু তুলে বলেন এই এই কি পড়াস, পিঁড়া পিঁড়া কস ক্যান, এইডা ত পিঁপড়া পিঁপড়া কয়টা ডিম।
ছোটদা লকলক করে বড় হয়ে যাওয়ার পরও মা তাঁকে কোলের ছেলেই মনে করতেন। ছোটদাই, মা আশংকা করতেন, হবেন গবেট গোছের কিছু। কিন্তু দাদাই হলেন শান্ত শিষ্ট, সাত চড়ে রা নেই। ছোটদা উল্টো। ইস্কুল থেকে নালিশ আসে, ছেলে ডিসিপ্লিন মানে না।