মা সাড়া দেন না। দু’হাতে তাঁর চিবুকখানা নিজের দিকে ফিরিয়ে বলি ওই হাসু আমারে তেঁতুল কিনতে যাইতে দেয় না।
মা চিবুক ছাড়িয়ে ধমকে ওঠেন–তেঁতুল খাইতে হইব না, শইলের রক্ত পানি হইয়া যায় চুক্কা খাইলে।
মা’র চিরকালই তেঁতুলের বিরুদ্ধে এই এক অভিযোগ। মা যেন দেখতে না পান, ছাদের সিঁড়িতে বসে, তেঁতুলের গুলি নুনে ডলে, বুড়ো আঙুলে অল্প অল্প তুলে জিভে ট্টা ট্টা শব্দ করে খেতাম। জিভ শাদা করে, দাঁত টক করে, রক্ত পানি করে তবে আমার তেঁতুল ফুরোতো। হাত পা কোথাও কাটলে ভয় পেতাম, এই বুঝি ধরা পড়ে যাব, রক্তের বদলে যখন পানি বেরোবে। কিন্তু না, যখনই কাটে, কাচে বা শামুকে, গোলাপের কাঁটায় বা উঠোনের ভাঙা ইটে পড়ে, রক্তই বেরোয়। রক্ত মুছে ক্ষতে ডেটল মেখে দেন মা, আর ছেঁড়া ত্যানায় বেঁধে দেন আঙুল হলে আঙুল, ঠ্যাং হলে ঠ্যাং। আমি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রাখি হাসি, রক্ত পানি না হওয়ার হাসি।
বাড়িভর্তি লোক এ বাড়ির। মেয়েদের নামগুলো ফলের, ডালিম, পেয়ারা, আঙুর, কমলা আর ছেলেদের নাম হাসু, কাসু, বাসু, রাসু। রাসু আমার মেজ খালু, থাকেন শহরে, যুদ্ধের গন্ধ পেয়ে কোথায় কোন গ্রামে লুকিয়েছেন কেউ জানে না। রুনু খালার শাশুড়ির দু’গাল ফুলে থাকে পানে, রস গড়িয়ে পড়ে দু’ঠোঁটের কোণ বেয়ে। আঙুলের মাথা শাদা হয়ে থাকে চুনে, পানের বাটা থেকে চুন না লাগা আঙুলে এক চিমটি শাদা পাতা তুলে ফুলে থাকা গালে ঢুকিয়ে নানির কানের কাছে মুখ এনে বলেন–রাসুডা কই আছে কেডা জানে! বাইচা আছে না মইরা গেছে। শুনছি পাঞ্জাবিরা মানুষ মাইরা শহর উজাড় করতাছে।
পিঁড়িতে বসা নানির ছোট্ট শরীরখানা কাপড়ের একটি পুঁটলির মত দেখতে লাগে। কালো পাড় শাদা শাড়ির পুঁটলি নড়ে না। পুঁটলির ভেতর আরেক পুঁটলি, নীল প্লাস্টিকের ঝুড়ি, শক্ত হাতে ধরা, ঝুড়িতে চিঁড়ামুড়ি, গুড়। নানির চোখে পাথর হয়ে থাকে দুটো তারা। পুঁটলির মত এরাও নড়ে না। তারাদুটো দেখেছে গভীর রাতে দরজায় টোকা দিচ্ছেন হাশেমমামা, নানির মেজ ছেলে। নানি দরজা খুলতেই রেলগাড়ি যাওয়ার শব্দের তলে গুঁড়ো হয়ে যায় হাশেম মামার স্বর–মা আমি যাইতাছি।
এত রাইতে ডাকস কেন! হইছে কি! কুপির সলতে উসকে দিয়ে সিঁড়িতে নামেন নানি।
আমি গেলাম।
হাশেম মামা হনহন হাঁটতে থাকেন পুকুর পাড়ের দিকে। নানি পেছনে দৌড়ে বলেন, কই যাস এত রাইতে? থাম।
হাশেম মামা হাঁটতে হাঁটতে পেছন না ফিরে বলেন–যুদ্ধে যাইতাছি। দেশ স্বাধীন কইরা তবে ফিরবাম।
থামরে হাশেম থাম।
নানি গলা ছেড়ে ডাকেন তাঁর অবাধ্য ছেলেকে যতক্ষণ না অন্ধকারের পেটের ভেতরে ঢুকে যান ছেলে।
নিসাড় দাঁড়িয়ে থাকেন নানি। বুক টনটন করে, যে বুকের ওমে, যে বুকের দুধে পঞ্চাশের মন্বন্তরে জন্ম নেওয়া হাশেম মামাকে তিনি বাঁচিয়েছিলেন। পারুল মামি চৌকাঠে এক পা, আরেক পা চালা ঘরের সিঁড়িতে রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। লোকে বলে হাশেমের বউ পরীর মত সুন্দরী। অন্ধকারে নানি দেখেন পারুল মামির গা থেকে জ্যোৎস্না বেরোচ্ছে। বউটি আস্ত একখানা চাঁদ। এমন চাঁদকে এখন তিনি লুকোবেন কোথায়! ঘরে ঘুমোচ্ছে পারুল মামির ছ’মাসের মেয়ে। সংসার ফেলে এভাবে কেউ আচমকা হারায়! অন্ধকার হাতড়ে কোথায় তিনি খুঁজে পাবেন হাশেম মামাকে, জানেন না। নানি যুদ্ধ কী, মহাযুদ্ধ দেখেছেন, জাপানি বোমা পড়েছে দেশে, কিন্তু এভাবে সংসার ছত্রখান হয়নি। কাক ডাকা ভোরে পারুল মামিকে তাঁর বাপের বাড়ি রেখে সঙ্গে চার ছেলে আর একটি নীল প্লাস্টিকের ঝুড়ি, এসেছিলেন মেয়ের বাড়িতে, অবকাশে, শলাপরামর্শ করতে, টিনের চৌচালা ছেড়ে দালানে। মেয়ের জামাই বললেন–গ্রামে চইলা যান আম্মা, শহর নিরাপদ না।
সেই গ্রামে যেতে গিয়েই হাতছাড়া হয়ে গেল তিন ছেলে, এখন থলে ঝাড়া ছেলে, নিজের নাতনিরও ছোট, ছটকু, কেবল হাতের কাছে।
রাসুর খবর না পেয়ে রুনু খালার শাশুড়ি চোখের জল ফেলেন, আর পাশের পিঁড়িতে রোদে পিঠ দিয়ে বসা পুঁটলি-নানি ছেলে যুদ্ধে গেছে জেনেও টুঁ শব্দ করেন না। যুদ্ধে গেলে কেউ কি আর ফেরে! নানির চোখের তারা নড়ে না।
খ.
রুনু খালার শ্বশুর খবর পেয়েছেন মিলিটারি আসছে বেগুনবাড়ির দিকে, ছ’টি মুণ্ডু পড়ে আছে সিকি মাইল দূরে, পাটক্ষেতে। মুণ্ডু দেখতে লোক দৌড়োচ্ছে, আবার উল্টো দিকেও বোঁচকা হাতে ছুটছে লোক। আমাদের, শহরের ইষ্টিদের জন্য ঠিক হয় আরও গহন গ্রামের দিকে পালিয়ে যাওয়া। বেগুনবাড়ি থেকে মোষের গাড়ি করে গভীর রাতে রওনা দিই হাঁসপুর। মোষঅলাকে পথ দেখিয়ে নেয় কাসু, হাসুর ভাই কাসু। বন বাদাড়ের ঝিঁ ঝি ঝিঁ ঝি, হুক্কা হুয়া, ভুতুম ভুতুমের মধ্যে এসে আঁতকা থেমে যায় মোষ। কুণ্ডুলি পাকাতে পাকাতে মা’র পাছার তলে সেঁধিয়ে থাকি। শরাফ মামা বলতেন অন্ধকারে ভূতেরা সব বেরিয়ে আসে বাইরে, তারা খপ করে মানুষ ধরে, আর কপ করে খায়। ভূতের প্রিয় জায়গা হল গাছের মগডাল। আর মোষের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে অমাবস্যার রাতে শেওড়া গাছের তলে। সপ সপ করে কার যেন হেঁটে আসার শব্দ শুনি। মোষঅলা চাবুক কষান মোষের পিঠে, মোষ নড়ে না। হাট হাট হাট, সপাং সপাং। বাঁশবনের ভেতর দিয়ে হঠাৎ মোষ দৌড়োয়। ছইয়ের ভেতর মাথায় মাথায় ঠোকর লাগার শব্দ হয় ঠমঠম, ঠমঠম। ভুরু নেই, চোখের পাতা নেই, লোম নেই, চুল নেই, ব্যারামে ভোগা ছটকু পিঁ পিঁ করে কাঁদে। আবার হাট হাট, আবার সপাং। সপ সপ, সপ সপ। ছটকুর লিকলিকে হাত ধরে রাখে নানিকে, নানির হাতে শক্ত করে ধরা প্লাস্টিকের ঝুড়ি। ঝুড়িতে চিঁড়ামুড়ি গুড়।