উনসত্তরে রাজবাড়ি ইস্কুল ছাড়িয়ে আমাকে বিদ্যাময়ী ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হল। বিদ্যাময়ী ইস্কুলটি শহরের মধ্যিখানে, ইস্কুলের ডানে গাঙ্গিনার পাড়, বাঁয়ে নতুন বাজার। এ ইস্কুলে আগের ইস্কুলের চেয়ে দূর। রিক্সা করে ইস্কুলে যেতে চার আনা, আসতে চার আনা, বাবা গুনে আটআনা পয়সা দিয়ে যান মা’র হাতে। মা সে পয়সা সকাল দশটা অবদি বেঁধে রাখেন আঁচলের খুঁটে। সাড়ে দশটায় আমার ইস্কুল বসে। যেতে আসতে দেখি শহর যেন উল্টে পড়ে আছে রাস্তায়। কিল ঘুসি খেয়ে শহরের চেহারা এবড়ো থেবড়ো। রাস্তায় ইটপাটকেল, গাছের গুঁড়ি। মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে পুলিশের গাড়ি। ছোটদা প্রায়ই ইস্কুল কামাই করে মিছিলে চলে যান। আমারও ইচ্ছে করে ছোটদার মত মিছিলে যেতে। ছোটদা রাত করে বাড়ি ফেরেন, তাঁর বাড়ি না ফেরা অবদি বাবা পায়চারি করেন উঠোনে। মা হারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন বৈঠকঘরের দরজায়। ছোটদাকে বলা হয়েছে মিছিলে না যেতে। তিনি বাবা মা’র মোটে বাধ্য ছেলে নন, দাদা যেমন। দাদাকে ধমকে বসিয়ে রাখা যায় ঘরে, কিন্তু ছোটদাকে বাগে আনা মুশকিল, ফাঁক পেলেই তিনি পালান।
সেদিন চব্বিশে জানুয়ারি। সকাল থেকেই মিছিলের শব্দ শুনছি। কাকেরা পাড়ার আকাশ কালো করে চেঁচাচ্ছে। এত কাক ওড়ে কেন, মানুষই বা ছোটে কেন এত মিছিলের দিকে! মা যেমন ছিলেন রান্নাঘরের পিঁড়িতে বসা খালি পায়ে, এলো চুলে, আলুথালু শাড়িতে, নখে পিঁয়াজের গন্ধ, হাতে মশলার দাগ, তেমনই দৌড়ে গেলেন গলি পেরিয়ে ঘুমটিঘরের উল্টোদিকে বড় রাস্তার ওপর মুকুলদের বাড়ি। বাড়ির খোলা বারান্দায় দাঁড়াতেই দেখেন জিলা ইস্কুলের বোর্ডিং এর পাশ দিয়ে, ঠান্ডার বাপের জিলিপির দোকান পার হয়ে রেললাইনের দিকে দৌড়োচ্ছে মানুষ। মা, মুকুলের মা, শাহজাহানের মা, শফিকের মা ছুটতে থাকা পাড়ার ছেলেদের থামালেন। বারান্দায় জড়ো হতে লাগল পায়ে হাতে কাঁধে গুলি লাগা ষোল সতেরো বছর বয়সী ফারুক, রফিক, চন্দন। বাড়ির ভেতর থেকে আসতে লাগল বালতি ভরা পানি, ডেটলের শিশি, তুলো। মা’রা ছেলেদের ক্ষত মুছে দিয়ে পরনের শাড়ি ছিঁড়ে বেঁধে দিচ্ছিলেন ব্যান্ডেজ। কাউকে কাউকে পাঠিয়ে দিলেন রিক্সা করে সোজা হাসপাতাল।
দুপুরের দিকে বাবা ফিরে এলেন। কারও সঙ্গে কোনও কথা না বলে তিনি ঢুকলেন মিন্টুদের বাড়িতে। বাবার পেছন পেছন মা, মা’র পেছন পেছন আমি। আমাদের পেছনে পাড়ার আরও লোক। মিন্টুর মা’র মুখের দিকে বাবা করুণ চোখে তাকিয়েছিলেন, মিন্টুর একলা পড়ে থাকা টিনের ঘরখানার দিকেও।
কী হইছে, মিন্টুর কিছু হইছে? মিন্টুর মা বাবার হাত ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তিনি খবর পেয়েছেন আগেই যে মিছিলে মিন্টু ছিল সবার সামনে, গায়ে পুলিশের গুলি লেগেছে বলে লোকেরা হাসপাতালে নিয়ে গেছে ওকে। বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন খানিক পর পর, কিছু বলছিলেন না। আমরা ছিলামই ও বাড়িতে দাঁড়িয়ে। মিন্টুর বোন, মনু, পাড়া কাঁপিয়ে কাঁদছিল। মাথার ওপর ছিলই কাকের কা কা কা। পাড়ার মায়েরা মুকুলদের বারান্দা থেকে ফিরে এসে পানি ঢালছিলেন কেঁদে বেঁহুশ হয়ে পড়া মিন্টুর মা’র মাথায়। মনু থেকে থেকে মা’কে বলছিল ও ঈদুন আপা, আমার ভাইরে যারা মারছে, তাগোরে আমি খুন করুম। মনু বেরিয়ে যেতে চাচ্ছিল বাড়ির বাইরে। মা তাকে ফেরাচ্ছিলেন দু’হাতে। মনু কি করে খুন করবে খুনীদের। খুনীদের হাতে বন্দুক, কেউ কি পারে খালি হাতে সশস্ত্র কারও সঙ্গে যুদ্ধ করতে!
পাড়ার লোকেরা মিন্টুর ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে বলাবলি করছিল কী করে মিছিল এগোচ্ছিল পশু হাসপাতালের পাশ দিয়ে, তখন বলা নেই কওয়া নেই, কারও কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্রিম দ্রিম, ছেলেরা উল্টো দিকে দৌড়োল, কেবল মিন্টু পারেনি। মিন্টুদের বাড়িতে তখন ভিড় আরও বাড়ছে। খোকন, বাμচু, হুমায়ুন মিন্টুর ভাইগুলো ভিড় ঠেলে বাড়িতে ঢুকল। মিন্টুকেও আনা হল, খাটিয়ায় শাদা কাপড়ে ঢেকে।
আমি বরই গাছের তলে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম মিন্টুর গা মাথা ঢাকা। চুপচাপ লাজুক ছেলেটি, যে ছেলে সকালেও দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেছে উদাসীন, নাস্তা খেতে বাড়ির ভেতর ডাক পড়লে মা’কে বলেছে যে সে বাইরে বেরোচ্ছে খানিকক্ষণের জন্য, এই ফিরছে। রান্নাঘরে ঢেকে রেখেছিলেন মা তাঁর ছেলের নাস্তা। মিন্টু যখন ফিরে এল, তখনও তার নাস্তা ঢাকা।
বরই পড়ে তলাটি ভরে ছিল, পাড়ার সবচেয়ে মিষ্টি বরই। একটি বরইও আমার কুড়োতে ইচ্ছে করেনি সেদিন। সেদিন কেউ কান মলে দেবে বলে ভয় ছিল না, তবু ইচ্ছে করেনি। মা’কে দেখেছি মিন্টুর মা’র মাথায় হাত বুলিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলছেন কাইন্দোন না। মিন্টুর রক্ত ছুঁইয়া কত ছেলেরা কইতাছে এর শোধ তারা নিবই নিব। দিন পাল্টাইব, দিন ঠিকই পাল্টাইব। মিন্টু লাশ হয়ে বাড়ি ফিরে আসার পর পাড়ার মানুষও, কেবল মিন্টুর আত্মীয়রা নয়, কেঁদেছে। লিকলিকে ছেলেটিকে মানুষ এত ভালবাসত আমার জানা ছিল না।
ছোটদাও গুম হয়ে বসে থাকলেন। তিনি ছিলেন মিছিলে মিন্টুর ঠিক ডানে দাঁড়ানো। গুলি তাঁর ডান বাহু ঘেঁসে উড়ে গেছে মিন্টুর বুকে। গুলি ছোটদার বুকেও লাগতে পারত। সেদিন ছোটদাও মরতে পারতেন।
মিন্টুকে আকুয়ার কবরখানায় কবর দেওয়া হল সেদিন। পাড়ায় এত বিষাদ এর আগে আমি কখনও দেখিনি। বিকেলে বাচ্চারা খেলতে গেল না মাঠে। বড়রা গলির রাস্তার কিনারে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে নিচু গলায় কথা বলল। যেন পুরো পাড়া সেদিন আর খাবে না, দাবে না, হাসবে না, খেলবে না, ঘুমোবে না।