আমি তাজ্জব। হাফপ্যান্ট দু’হাতে ওপরে টেনে বলি–কি মজার জিনিস দেখাইবা, দেখাও। আমারে ল্যাংটা কর ক্যা?
শরাফ মামা তাঁর শরীরকে হাসতে হাসতে আমার ওপরে ধপাশ করে ফেলে আবার টেনে নামান আমার হাফপ্যান্ট আর নিজের হাফপ্যান্ট খুলে তাঁর নুনু ঠেসে ধরেন আমার গায়ে। বুকে চাপ রেগে আমার শ্বাস আটকে থাকে। ঠেলে তাঁকে সরাতে চেষ্টা করি আর চেঁচিয়ে বলি–এইটা কি কর, সর শরাফ মামা, সর।
গায়ের সব শক্তি দিয়ে ঠেলে তাঁকে একচুল সরাতে পারি না।
–মজার জিনিস দেহাইতে চাইছিলাম, এইডাই মজার জিনিস।
শরাফ মামা হাসেন আর সামনের পাটির দাঁতে কামড়ে রাখেন তাঁর নিচের ঠোঁট। –এইটারে কি কয় জানস, চোদাচুদি। দুনিয়ার সবাই চোদাচুদি করে। তর মা বাপ করে, আমার মা বাপ করে।
শরাফ মামা তাঁর নুনু ঠেলতে থাকেন বিষম জোরে। আমার বিচ্ছিরি লাগে। শরমে চোখ ঢেকে রাখি দু’হাতে।
হঠাৎ ইঁদুর দৌড়োয় ঘরে। শব্দে শরাফ মামা লাফিয়ে নামেন। আমি এক দৌড়ে হাফপ্যান্ট ওপরে টেনে দৌড়ে বের হয়ে যাই ঘর থেকে। ঝোপ পার হতে আমি আর সাপের ভয়ে ইতস্তত করি না। আমার বুকের মধ্যে সড়াত সড়াত শব্দ হয়, যেন একশ ইঁদুর দৌড়োচ্ছে। শরাফ মামা পেছন থেকে অদ্ভুত গলায় বলেন–কাউরে কইবি না। কইলে কিন্তু সব্বনাশ।
০৪. মা
পাড়ার ছেলেরা মিছিল স্লোগান দিতে দিতে বড় রাস্তা ধরে যায় লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, বীর মুজাহিদ নও জোয়ান, কবুল মোদের জান পরান, আনতে হবে পাকিস্তান, আনতে হবে পাক কোরান। মা এক্কা দোক্কা খেলা ফেলে দৌড়ে যান মিছিল দেখতে। মিছিল চলে গেলে মাও লাফিয়ে বলেন লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। কিছু না বুঝেই বলেন। হঠাৎ এক সকালে উঠে তিনি শোনেন, ভারত থেকে ইংরেজ চলে গেছে, পাকিস্তান নামের একটি দেশ মিলেছে মুসলমানের। পাড়ার ছেলেরা নেচে নেচে মিছিলে গায় পাকিস্তান জিন্দাবাদ। ইস্কুলে পাকিস্তানের জয়গান শেখানো হয়।
জীবন যেমন ছিল, পাকিস্তান হবার পর তেমনই থেকে যায় মা’র। নাসিরাবাদ মাদ্রাসায় মিয়াভাই আগেও যেমন যেতেন, এখনও যান; বাড়িতে মা’কে কোরান শরিফ পড়াতে সুলতান ওস্তাদজি আগেও যেমন আসতেন, এখনও আসেন; তফাৎটা কি হল তিনি দেখতে পান না। বাজান মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন পাঁচবেলা, এখনও যান। কেউ তো এসবে বাধা দেয়নি, তবে আল কোরান নতুন করে আনার জন্য লোক ক্ষেপেছিল কেন! মাঝখান থেকে কী হল, অমলারা কাঁদতে কাঁদতে হিন্দুস্তান চলে গেল। ওরা চলে যাওয়ার দিন মা কড়ইগাছ তলায় হতবাক দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাড়ি ঘর জমিজমা জলের দরে বিক্রি করে চলে গেল অমলারা। মা অমলার সঙ্গে সই পেতেছিলেন। সই চলে গেলে কার না বুক খাঁ খাঁ করে! মা’রও করেছে। মা ফেরাতে পারেননি কিছু, কারও চলে যাওয়া। ইস্কুল খালি হয়ে গেল দেখতে দেখতে, কোনও হিন্দু মেয়ে আর ইস্কুলে আসে না। খালি ক্লাসঘরে দু’চারটে মুসলমান মেয়ে তখন ইতিহাস বইএর নতুন অধ্যায়ে পাকিস্তান আমাদের দেশ, কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আমাদের জাতির জনক মুখস্ত করে। ছড়া কবিতার নতুন নতুন বই আসে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগচির কবিতার বদলে আসে গোলাম মোস্তফা, বন্দো আলী মিয়ার কবিতা। রবীন্দ্রনাথের বদলে কাজী নজরুল ইসলাম। মা কিন্তু থেকে থেকেই আওড়ান আগের পড়া কবিতা। অমলার দিদির কাছে শেখা একবার বিদায় দে না ঘুরে আসি, হাসি হাসি পরবো ফাঁসি মাগো দেখবে জগতবাসী অমলারা চলে যাওয়ার পরও, গান মা। যেমন জীবন, তেমনই চলে, ছোটছোট দুঃখ সুখে। পুকুরের কচুরিপানা সরিয়ে আগেও সাঁতার কাটতেন, এখনও। আগেও পিঁড়ি পেতে বসে মাছের ঝোল মেখে ভাত খেতেন, এখনও। দেশ বদলে যায়, মানুষ বদলায় কই! ইংরেজের বদলে কাবুলিঅলা হাঁটে রাস্তায়, পরদেশি বলেই ওদের ডাকেন মা। মা’র নিভৃত জগতে পুতুলগুলো আগের মত শুয়ে থাকে। কেবল মা’র পুতুলের সঙ্গে বিয়ে হওয়া অমলার পুতুলটিকে বড় দুঃখী দুঃখী লাগে। মা’র বুকের জলে এক মিহি কষ্ট গোপনে সাঁতরায়।
পুতুল খেলার বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় মা’কে। বাবার কাছে আবদার করতেন রথের মেলায় তাঁকে নিয়ে যাওয়ার, পুতুল কিনে দেবার। অবশ্য পুতুলের শখ মিটে যায়, যখন রক্তমাংসের একটি ছেলে জন্মায় মা’র। যে বছর ছেলে জন্মায়, সে বছরই,বায়ান্ন সন, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার করার দাবি নিয়ে যারা মিছিল করছিল, তাদের গুলি ছোঁড়ে উর্দুভাষীরা। মুসলমানরে যদি মুসলমানই মারে, তাইলে আর কি দরকার আছিল মুসলমানের আলদা একটা দেশ বানানির! মা ভাবেন।
ছেলেরা ছয় দফার দাবি নিয়ে রাস্তায় মিছিল করে। যে রাস্তা ধরে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের মিছিল যেত, সে রাস্তায় রাস্ট্রভাষা বাংলা চাই, উর্দুভাষী নিপাত যাক বলে মিছিল যায়। কি আশ্চর্য, মা ভাবেন, এঁদো গলির ভেতর, খলসে মাছে ভরা পুকর পাড়ে তাঁর বসে থাকতে থাকতেই মিছিলের চরিত্র পাল্টে গেল।
বাড়ি থেকে মনুমিয়ার দোকানে সদাই কিনতে যেতে আসতে আমাদের গলিতে লিকলিকে একটি লম্বা ছেলেকে দেখতাম প্রায়ই। পাড়ার সবচেয়ে মিষ্টি বড়ই গাছটির তলে ছিল তার ছোট এক টিনের ঘর। পেছনে অবশ্য বড় বাড়ি। ওখানে ওর মা আর বাকি ভাই বোনেরা থাকে। তখন বাড়ির বড় হয়ে যাওয়া ছেলের জন্য বারবাড়ির ঘরটি ছেড়ে দেওয়াই নিয়ম। দাদা আর ছোটদার জন্যও তাই হয়েছিল। ছোটদা একদিন বললেন লিকলিকে ছেলেটি খোকনের বড় ভাই, মিন্টু। খোকন ছিল ছোটদার বিষম বন্ধু। এমনই, যে, প্রেমেও পড়তেন ওঁরা একসঙ্গে, এক মেয়ের। মিন্টুকে আমার বড় একা মনে হত। তাকে দেখতাম ফিনফিনে শার্ট আর নীল লুঙ্গি পরে একা একা গলিতে হাঁটতে, ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আনমনে শিস বাজাতে। এত পাকা পাকা বড়ই ঝুলে থাকত যে আমি জিভে জল নিয়ে বড়ই গাছের তলে যেতে আসতে কিছুক্ষণ দাঁড়াতাম। বড় ইচ্ছে হত পড়ে থাকা কিছু বরই কুড়িয়ে নিই। মিন্টু যদি দেখে আবার আমার কান মলে দেয়, সেই ভয়ে আমি জিভের জল জিভে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। পাড়ার ছেলেপিলেরা আমাকে দেখলে কী কই যাও? গাড়িঘোড়া দেইখ্যা হাইট্যো এরকম শাদামাটা কিছু হলেও বলত। মিন্টু আমাকে দেখত কেবল, কিছু বলত না। ও সম্ভবত খুব লাজুক ছিল। পাড়ায় থাকে, অথচ পাড়ার ছেলেদের মত ওকে দেখতে লাগে না, যেন অন্য কোনও দেশের, অন্য কোনও শহরের, অন্য কোনও পাড়ার ছেলে মিন্টু। এ পাড়ার কারও সঙ্গে তার মেলে না। সে একা নিজের সঙ্গে কথা বলে নিঝুম দুপুরে। চাঁদনি রাতে খালি গায়ে কামিনী গাছের নিচে শুয়ে থাকে একা।