শরাফ মামা মুখ গম্ভীর করে বলেন–ঠিক আছে, আল্লাহর কসম।
ফিসফিসিয়ে বলি–মা সিনেমা দেখতে গেছে।
শরাফ মামা শুনে এতটুকু চমকালেন না। বললেন ও। যেন ব্যাপারটি এমন কোনও মারাত্মক নয়, মা পেশাবখানায় গেছেন বা সুলেখার মা’র বাড়ি গেছেন এমন। সিনেমা দেখা মা’র জন্য কড়া নিষেধ। ওসব দেখলে গুনাহ হয় এ কথা বলে নানা মা’কে হুমকি দিয়েছেন আবার যদি মাইয়া তুমি বাড়ির বাইরে যাও তাইলে তুমার রক্ষা নাই। তারপরও যে মা নানার নিষেধ অমান্য করে দিব্যি চলে গেলেন এরকম একটি রোমহর্ষক ঘটনা জেনেও শরাফ মামা মোটে কিছু আশংকা না করে বললেন–আমিও একটা সিনেমা দেখছি কাইলকা!
আমি অবাক হয়ে বলি–তুমি একলা গেছ সিনেমাত?
শরাফ মামা চোখ নাচিয়ে বলেন–হ।
–নানা যদি জানে তাইলে কি হইব? আমি ভয়ে ভয়ে বলি।
–আয় একটা মজার জিনিস দেইখা যা। বলে হঠাৎ শরাফ মামা উঠে হাঁটতে থাকেন পুবের উঠোনে দাদাদের ঘরের দক্ষিণে এ বাড়ির শেষ সীমানায় কালো টিনের ঘরের দিকে। পেছনে আমি। ঘরটির সামনের দরজা বন্ধ। পেছনের দরজা কায়দা জানলে খোলা যায়। বাড়িটির এ দিকটায় কোনও কোলাহল নেই। ভূতুড়ে স্তব্ধতা। ঘরের পেছন দিকটা ছেয়ে আছে বুড়ো সিম গাছে, গুল্ম লতায়, মরা পাতায়। এদিকটায় আমি কখনও আসি না সাপের ভয়ে, ছোটদা একবার ঢ়োঁড়া সাপ দেখেছিলেন এই ঝোপে। শরাফ মামার পেছন পেছন হেঁটে ঝোপে পা ফেলার আগে বলি শরাফ মামা এই জঙ্গলে সাপ আছে।
— ধুর ডরাইস না। তুই আসলেই একটা বুদ্ধু, একটা বিলাই। আয়, তরে একটা মজার জিনিস দেখাইয়াম, কেউ জানে না। শরাফ মামা এমন নিশ্চিন্তে ঝোপে গা ডুবিয়ে দেন যেন তিনি জানেন সাপ খোপ সব ঘুমিয়ে আছে গর্তে।
–কি জিনিস, আগে কও। যেতে ইতস্তত করে বলি।
–আগে কইলে মজাই ফুরাইয়া যাইব। শরাফ মামা বলেন।
বাইরে থেকে আঙুল ঢুকিয়ে দরজা খুলে শরাফ মামা ভেতরে ঢোকেন, এক দৌড়ে ঝোপ পার হয়ে আমিও পেছন পেছন। মজার জিনিসটি দেখতে আত্মা হাতে নিয়ে সাপের ঝোপ পার হয়ে এসেছি, এমনই লোভ আমার শরাফ মামার গোপন জিনিসে। ঘরে ঢুকতেই মরা ইঁদুরের গন্ধ নাকে লাগে। শব্দও শুনি ইঁদর দৌড়োনোর। ঘরের একপাশে খড়ি ঠাসা, আরেকপাশে ছোট একটি চৌকি পাতা কেবল। আমি ভয় পাচ্ছি বলে শরাফ মামা যদি বলেন, তুই একটা বুদ্ধু, একটা বিলাই, এই ভয়ে ভয় পেয়েও বলি না ভয় পাচ্ছি। শরাফ মামার বড় সাহস, একা একা সারা শহর ঘুরে বেড়ান, নদীর পারেও চলে যান। তাঁর সাহসের দিকে মুগ্ধতায় আর ভেতরের ভয় ভেতরে লুকিয়ে বিষম কৌতূহলে শরাফ মামাকে জিজ্ঞেস করি –নদীর পারে কি ফটিং টিং আছে মামা?
চৌকিতে পা ঝুলিয়ে বসে বলেন তিনি–না।
–আমারে নিয়া যাইবা একদিন? কাতর কণ্ঠ আমার।
–তুই ডরাইবি না? আমার পেটে খোঁচা মেরে আঙুলের, বলেন।
–না। ভয় লুকিয়ে বলি।
–তুই ডউর্যা। ডরাইবি। মাথায় আমার চাটি মেরে বলেন তিনি।
–বিশ্বাস কর আমি ডরাইতাম না। আমি তো বড় হইছি এহন, এহন আমি ডরাই না। ঝোপ পার হতে পেরেছি আমি , আমি কেন ভয় পাব, এরকম একটি বিশ্বাস উঁকি দেয় বলে বলি।
–না তুই ডরাইবি। শরাফ মামা খোলা দরজাখানা পা দিয়ে ঠেলে বন্ধ করে বলেন। শরাফ মামার হাত ছুঁয়ে বলি–সত্যি বিদ্যা আল্লাহরকসম, আমি ডরাইতাম না।
— জায়গাটা ভালা। কেউ নাই। কেউ বুঝব না আমরা কই। শরাফ মামা বলেন।
তাঁর এরকম অভ্যেস, হঠাৎ হঠাৎ আড়াল হয়ে যান সবার। একবার রান্নাঘরের পেছনে আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন একটা মজার জিনিস খাইবি?
পকেট থেকে দেশলাই বের করে একটি চিকন পাটশুলার মাথায় আগুন ধরালেন। আগুনে পাটশুলার মুখ জ্বলল আর শরাফ মামা সিগারেট টানার মত টান দিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে জ্বলন্ত পাটশুলাটি আমার হাতে দিয়ে বললেন–খা।
আমিও ধোঁয়া টেনে মুখে নিয়ে ফুঁ করে ছেড়ে দিই বাতাসে।
বলেন–কাউরে কইবি না তো!
কেশে মাথা নাড়তে নাড়তে–না বলি।
শরাফ মামা এরকম, বাড়ির কাউকে তোয়াক্কা করেন না। যা করার ইচ্ছে লুকিয়ে চুকিয়ে করে যান।
–নাসিমের টাকা দিয়া কি করছ মামা? অনেকদিনের ইচ্ছে আমার জানার.
–মাটির তলে পুঁইতা রাখছি। আমাকে প্রতিজ্ঞা না করিয়েই ফট করে বলে ফেলেন তিনি।
আমি এই সুনসান জায়গায়, বাড়ির কেউ জানে না শরাফ মামা আমাকে কথা দিচ্ছেন নদী দেখাতে নেবেন, বলছেন মাটির তলে পুঁতে রাখা টাকার গল্প, যা কেবল আমাকেই বলছেন তিনি, আর কাউকে নয়, নিজেকে আর মাথায় গোবর অলা ঢেঙ্গি ছেড়ি বলে মনে হয় না।
–কুন মাটির তলে? এই বাড়ির?
ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করি।
–হ। যহন বড় হইবাম, এই টাকা দিয়া একটা জাহাজ কিনবাম। মামা বলেন।
–জাহাজ? আমারে চড়াইবা? মন খুশিতে লাফায়। আমার চোখের সামনে তখন বিশাল এক জাহাজ, নদী পার হয়ে সাগরের দিকে যাচ্ছে। আমি জাহাজে ভেসে জলের খেলা দেখছি, রোদে চিক চিক করছে রূপোলি জল। এরকম একটি ছবি দেখেছিলাম ওষুধ কোম্পানির এক ক্যালেন্ডারের পাতায়।
শরাফ মামার চোখের তারা আবার নাচে। হাতে তাঁর পাটশুলাও নেই, দেশলাইও নেই। পকেটে কোনও চুম্বক আছে কি না কে জানে। আমাদের চুম্বকের খেলা দেখাতেন মামা। তখনও চুম্বক কি জিনিস আমি জানি না। যাদু দেখবি আয়, বলে হাতে লোহার একটি শাদামাটা পাত ছুঃ মন্তর ছুঃ বলে তিনি দরজার কড়ায়, টিউবয়েলের ডান্ডায়, বালতিতে, জানালার শিকে ছোঁয়াচ্ছেন আর বসে যাচ্ছে। আমি হাঁ হয়ে মুগ্ধ চোখে যাদু দেখছিলাম। আমিও শরাফ মামার মত ছুঃ মন্তর ছুঃ বলে কুড়িয়ে পাওয়া একটি লোহা দরজায় কড়ায় লাগাতে চেয়েছিলাম, লাগেনি। শরাফ মামা আমার কান্ড দেখে হাসতেন। চোখের বাদামি তারা নাচছে শরাফ মামার আর ঠোঁটের কিনারে একরকম হাসি, যার আমি ঠিক অনুবাদ জানি না। মজার জিনিসটা এই বার তরে দেখাই বলে একটানে আমাকে চৌকির ওপর শুইয়ে দেন মামা। আমার পরনে একটি কুঁচিঅলা রঙিন হাফপ্যান্ট শুধু। শরাফ মামা সেটিকে টেনে নিচে নামিয়ে দেন।