বারোই রবিউল আওয়ালে জন্ম হওয়া মেয়ের এত ছবি আঁকায় মন কেন বুঝে পান না ফজলি খালা। আমাকে মানুষের ছবি আঁকতে দেখে তিনি বলেন এত পবিত্র দিনে জন্ম হয়েছে, মানুষের ছবি আঁকিস কেন! মানুষের কি প্রাণ দিতে পারবি! মানুষের ছবি আঁকলে আবার প্রাণ দেওয়ার দরকার কি আমি বুঝে পাই না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি ফজলিখালার অপ্রসন্ন মুখে।
নিষিদ্ধ কাজে কেবল আমি নই, মা’ও মাতেন। বাবার শার্টের বুক পকেটে আবার রাজিয়া বেগমের চিঠি পাওয়ার পর মা’র পাগল পাগল লাগে। খাওয়া দাওয়া গোসল সব ভুলে গেলেন, চুলে তেল দেন না, বাঁধেন না, শাড়ির আঁচল খুলে মাটিতে গড়ায়। সংসার চুলোয় ফেলে মা দুয়োর বন্ধ করেন ঘরের। মা’র এমন দুঃসময়ে সোহেলির মা এসে একদিন সারাদিন ঘরে বইসা স্বামীর লাইগা কানলে তুমি মরবা। চল, মনডা অন্যদিকে ফিরাও বলে মা’কে শাড়ি পরিয়ে, মা’র চুল আঁচড়ে নিয়ে গেলেন অলকা হলে সিনেমা দেখাতে। প্রথম প্রথম সোহিলির মা, এরপর আর কারও জন্য অপেক্ষা নয়, মা নিজেই রিক্সা করে অলকা হলে চলে যান। ভিড়ে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটেন। হলের ভেতরে বসে বাদাম চিবোতে চিবোতে ছবি দেখেন। কালো কুৎসিত মা, এলোমেলো, আলুথালু শাড়ি পরা, সস্তা সেন্ডেল পায়ে মা। মা’র আর শাড়ি গয়নায় মন নেই। সোনার গয়না গড়িয়ে দিয়েছেন বাবা বউ আর দু’কন্যার জন্য, মা ওসব ফেলে রাখেন গোসলখানায়, চুলোর কিনারে, বালিশের নিচে। মন নেই। যে মা বারো বছর বয়স থেকে বোরখা পরেন, সে মা বোরখা ছাড়াই দৌড়োন সিনেমায়। দু’পায়ে দু’রঙের চটি পরে। মন নেই। মা’র মন উত্তম কুমারে। রাতে রাতে স্বপ্ন দেখেন, উত্তম কুমার এসে গলায় মালা পরিয়ে দিচ্ছেন মা’র, আবেগে চোখ বুজে আছেন মা।
আমি কখনও সিনেমায় যাইনি। আমার প্রথম ছবি, শীতের দুপুরে মাঠে বায়োস্কোপ অলা এসেছিল, কাঠের বাক্সের ফুটোয় চোখ রেখে বায়োস্কোপ দেখা, ছবি আসে আর যায়। আর বায়োস্কোপ অলা সুর করে ছবির গল্প বলেন। বায়োস্কোপের ছবি মন থেকে মুছতে না মুছতেই একদিন সারা পাড়ায় হৈ হৈ, সাহাবউদ্দিনের বাড়ির মাঠে পাবলিসিটির বোবা ছবি দেখাবে। পাড়ার ছেলেমেয়েরা সন্ধে হতেই ইট বিছিয়ে বসে গেল মাঠে, বড় পর্দায় ছবি দেখানো হল, ছবি বলতে মানুষ হাঁটল, দৌড়োলো, ঠোঁট নাড়ল। আমি ইটে বসে হাঁ করে ছবি গিলে ছবির মাথা লেজ কিছুই না বুঝে বাড়ি ফিরেছি। মামারা বলেছেন–ঢেঙ্গি ছেড়ির মাথায় খালি গুবর।
তা ঠিক, মাথায় আমার গোবর। তা নইলে সে কথা তো বাড়িতে আমি জানিয়ে দিতে পারতাম। পারিনি। মুখ বুজে ছিলাম। কখনও কেউ জানেনি বাড়ি ভর্তি লোকের মধ্যে কী ঘটে গেছে অলক্ষে। সেদিন ষোলই আগস্ট, উনিশশ সাতষট্টি সন, পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস পার হয়েছে দুদিন হল, ইস্কুল থেকে ফিরে মা’র জন্য অপেক্ষা করছি। বাড়ি ফিরে মা আমাকে খেতে দেবেন। নানির চৌচালা ঘরে প্রায় বিকেলে যেমন বই পড়ার আসর বসে, তেমন বসেছে। কানা মামু থামে হেলান দিয়ে জলচৌকিতে বসা, নানি পান চিবোচ্ছেন শুয়ে, ঝুনুখালা আধশোয়া, হাশেম মামা এক চেয়ারে বসে আরেক চেয়ারে পা তুলে হাতপাখায় বাতাস করছেন, আর রুনুখালা বালিশে বুকের ভর দিয়ে পড়ছেন দস্যু বাহরাম। এরকম দৃশ্য নানির চৌচালা ঘরে গরমের দীর্ঘ লম্বা দিনগুলোয়, দুপুরের খাবারের পর ছোট এক ঘুমের পর, বিকেলে, বাঁধা। রুনুখালা পড়েন, সবাই শোনেন। শুনতে শুনতে কেউ খিক খিক হাসেন, কেউ আহা আহা বলেন, কেউ বলেন ধুর। ঘরে ঢুকে পড়ার মধ্যে ছোটদের গোল করা নিষেধ। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, মা নেই, একা। হাশেম মামা বললেন–যা যা মাঠে খেল গিয়া।
মাঠে খেলার ইচ্ছে করে না আমার, ক্ষিধে পেটে, মা মিটসেফে তালা দিয়ে গেছেন। নানির উঠোন থেকে কুয়োর পাড় ঘেঁসে নারকেল গাছের তল দিয়ে আমাদের খাঁ খাঁ আঙিনায় ঢুকে একা বসে ছিলাম সিঁড়িতে, গালে হাত, পা ছড়ানো, তখন শরাফ মামা আসেন। ডাংএর গুটি উড়ে নাকি ক্রিকেটের বল এসে আমাদের উঠোনে পড়ল যে শরাফ মামা নিতে এসেছেন নাকি মার্বেল ফেলে গেছেন এ উঠোনে কে জানে! এক হাত লম্বা আমার চেয়ে শরাফ মামা, শরাফ মামার বাদামি চোখের তারা একবার গাছের পাতায়, একবার ঘরের দরজায়, একবার উঠোনের কালো বেড়ালে, একবার বৈঠকঘরের খালি চেয়ারে। পরনে তাঁর হাত কাটা গেঞ্জি আর শাদা হাফপ্যান্ট। জিজ্ঞেস করেন–বড়বু কই?
গালে হাত রেখেই মাথা নেড়ে বলি–নাই।
–কই গেছে? যেন তাঁর বিষম দরকার এখন মা’কে, এমন স্বরে প্রশ্ন করেন।
শরাফ মামা সিঁড়িতে আমার পাশে এসে বসে পিঠে দুটো চাপড় মেড়ে বললেন –তুই এহানে একলা বইয়া কি করস?
–কিচ্ছু না। শুকনো মুখে বলি।
শরাফ মামা বড়বু কহন আইবরে? বলে আমার গাল থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে খানিকক্ষণ চুপ থেকে নরম গলায় বলেন–গালে হাত রাহিস না। অমঙ্গল হইব।
আমার ইচ্ছে করে বলতে আমার খুব ক্ষিদা লাগছে, খাই কি? মা মিটসেফ তালা দিয়া গেছে। বলি না বরং বলি মা কই গেছে জানো? আরও কাছে সরে বসে, কও কাউরে কইবা না?
কইতাম না ক। শরাফ মামা বলেন।
–সত্যি?
–সত্যি।
–বিদ্যা?
–বিদ্যা।
–আল্লাহর কসম?
–আরে ক না, কারও কাছে কইতাম না ত। শরাফ মামা অস্থির হয়ে বলেন।
–আগে আল্লাহর কসম কও।
আল্লাহর কসম বললে কথার নড়ন চড়ন করার সাহস কারও নেই, এমনই বিশ্বাস আমার।