মা’র চিঠির ভাষা অন্যরকম। শহুরে মেয়ে, বাবার সঙ্গে বিয়ের পর পর দু’তিনটে দিলীপ কুমার মধুবালার সিনেমা দেখা মেয়ে গোটা গোটা অক্ষরে পাতা ভরে চিঠি লেখেন–প্রিয়তম, কেমন আছ? কবে আসবে তুমি? তোমাকে ছাড়া আমার ভাল লাগে না। আমি তীর বেঁধা পাখির মত ছটফট করি। তুমি আমাকে নিয়ে যাও। আমরা এক সঙ্গে আমাদের ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখে থাকব। তুমি রাজশাহি থেকে বড় ডাক্তার হয়ে ফিরবে। আমি কত মানুষকে যে বলি, গর্বে আমার বুক ভরে যায়। আমি তোমার যোগ্য নই জানি। তোমার মত জ্ঞান, বুদ্ধি আমার নেই। আমার কিছু না থাক, আমার তো তুমি আছ। তুমিই আমার সুখ। আমার শান্তি। এই পৃথিবীতে আমি আর অন্য কিছু চাই না।
উত্তরে বাবা লেখেন–প্রতিদিন দুই আড়াই টাকার বেশী বাজার করিও না। টাকা শেষ হইয়া গেলে মনু মিয়ার দোকান হতে বাকিতে জিনিস কিনিও। ছেলে মেয়ের যত্ন লইও। যাহা যাহা সদাই করিবে, জমা খরচের খাতায় লিখিয়া রাখিবে।
মা খাতায় লিখে রাখেন না, ইচ্ছে হয় না। আঁচলের খুঁটে পয়সা বেঁধে রাখেন, ছেলেমেয়েরা চানাচুর খেতে চায়, মালাই আইসক্রিম খেতে চায়, খুঁট থেকে পয়সা খুলে ওদের দেন। সকালে দাদাকে পাঠিয়ে ঠান্ডার বাপের দোকান থেকে গরম ডালপুরি কিনে আনেন, তা দিয়ে নাস্তা হয়। কোনওদিন সর্ষের তেল থাকে তো নুন থাকে না, নানির কাছ থেকে ধার করে রান্না চলে। কোনওদিন হারিকেনে সলতে থাকে তো কেরোসিন ফুরিয়ে যায়। সুলেখার মা’র কাছ থেকে ধার করে সে রাত চালিয়ে দেন। কোনওদিন ছোটদা টাকা হাতে বাজারে বেরোন, ফেরেন না ফেরেন না, চুলোয় আগুন ধরানো হয় না। হাশেম মামা তিন রাস্তার মোড় থেকে ধরে আনেন ছোটদাকে, কি, রাস্তায় বসেছিল, কেন, বাজারের টাকা নেই, কেন নেই, ফালতু কাগজ মনে করে পকেটের টাকা ফেলে দিয়েছে। দু’বছর পর রাজশাহি থেকে বড় পাশ দিয়ে বাবা ময়মনসিংহে ফিরে আসার পর বাড়ির সবার সঙ্গে বাবার দূরত্ব আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। আমার বয়স তখন দুয়ে দুয়ে চার। আমি তাঁর কাছ ঘেঁসি না আগের মত আর। মা’র সঙ্গে বাবার সম্পর্ক গড়ে ওঠে চাল ডালের, আনাজপাতির। মাও ধীরে ধীরে মুখে স্নো পাউডার মাখা কমিয়ে দিয়ে বাবার হাতে লিস্টি দিতে শুরু করেন সরিষার তেল তিন ছটাক, পিঁয়াজ এক সের, লবণ দেড় পোয়া, মশুরির ডাল আধা সের। বাবা লিস্টি পড়ে থলে ভরে সদাই কিনে বাড়ি নিয়ে আসেন। মা রান্না করে বাবাকে খাবার বেড়ে দেন দুপুরে, রাতের খাবার থালা উপুড় করে ঢেকে রাখেন। রাতে ঘরে ফিরে কুয়োর তোলা জলে হাত মুখ ধুয়ে, খেয়ে ঢেকুর তুলে বিছানায় শুয়ে পড়েন বাবা। বাবা ক্লান্ত বিরক্ত। তাঁর কাঁধে কেবল বউবাচ্চার দায়িত্ব নয়, মাদারিনগর বলে এক গ্রামের গরিব কৃষকের ছেলে তিনি, তা তিনি ভোলেন না। জাফর আলী সরকার মরে যাওয়ার পর বাবার ছোট দু’ভাই রিয়াজউদ্দিন আর ঈমান আলীকে পাঠশালায় পাঠানোর উৎসাহ কেউ দেখাননি। বড়দাদা ওঁদের ঢুকিয়ে দিয়েছেন হালচাষের কাজে। বাবার ইচ্ছে অন্তত বাকি ভাইদের লেখাপড়া করানোর দায়িত্ব তিনিই নেবেন, তিনিই হবেন সংসারের জাফর আলী সরকার। আমানুদ্দৌলা আর মতিন মিয়াকে শহরে এনে লেখাপড়া করানোর স্বপ্ন খেলা করে বাবার মনে। মাদারিনগরের জন্যও তাঁর স্বপ্ন অনেক, অন্তত সে স্বপ্ন তৈরি করেন সবুজ লুঙ্গি আর রাবারের জুতো পরে প্রায়ই শহুরে ভাইএর কাছে চলে আসা রিয়াজুদ্দিন, ঈমান আলী।
পুস্কুনির উত্তরের জমিডা কিইনা লইলে ভালা হয় ভাইসাব, খুশির বাপে জমি বেচতাছে। এইডা এহন না কিনলে জমির মুন্সি ঠিহই কিইনা লইব।
বাজান কইছে বলদ আরও দুইজোড়া কিইনা লইলে চাষের সুবিধা।
গরু চড়াতে গিয়ে দিগন্ত অবদি যে জমি দেখতেন, তিনি এ বয়সে মনে মনে বালক হয়ে সবুজ সেসব ধানক্ষেতে ছুটে বেড়ান। রিয়াজউদ্দিনের হাতে কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে বলেন–ঠিক আছে, কিইনা ল।
মা’র চোখ এড়ায় না বাবার উদার হস্ত।
জমি কিনতে টাকা দেওয়ার পরই তিনি লম্বা লিস্টি তৈরি করে বাবাকে দেন
১.দুইটা ঘরে পরার শাড়ি, ২.শায়া (শাদা) ৩. ব্লাউজ (লাল) ৪. এক জোড়া সেন্ডেল (বাটা) ৫.কানের দুল(ঝুমকা) ৬.কাচের চুড়ি(রেশমি) ৭.গায়ের সাবান। ৮.জবা কুসুম তেল। ৯.কাপড় ধোয়ার ৫৭০ সাবান। ১০. সোডা।
লিস্টি পেয়ে কী ব্যাপার, দুইমাস আগে না শাড়ি কিইনা দিলাম! চোখ কপালে তুলে বলেন বাবা।
মা ঠান্ডা গলায় বলেন–ছিঁইড়া গেছে। এক কাপড় পইরা রান্ধাবাড়া, ধোয়া পাকলা, বাড়ির বেবাক কাম, আর কত! শাড়ি তো আর চটে বানানি না।
–কই দেখি, কই ছিঁড়ছে! বাবা ভুরু কুঁচকে বলেন।
মা দু’আঙুল ছেঁড়া শাড়িকে এক টানে দু’হাত লম্বা করে ছিঁড়ে এনে বাবাকে দেখিয়েছিলেন। মা’র চোখ পাথরের মত স্থির। এক থোকা কষ্ট দলা পাকিয়ে গলার ভেতর আটকে ছিল।
–সেইদিন না নারিকেল তেল কিনলাম, শেষ হইয়া গেল? বাবা জেরা করেন।
–সেইডা ত কবেই শেষ। মা বলেন।
চোখের চশমা একটানে খুলে বাবা বলেন–কই শিশি কই, শিশিডা আনো।
–শিশি ফালাইয়া দিছি। মা’র উদাসীন স্বর।
বাবা চোখে আবার চশমা লাগিয়ে লিস্টির দিকে তাকিয়ে বলেন–কাপড় ধোয়ার সাবান কিননের লাইগা এই নেও এক টেকা রাখো। বাকি জিনিসের দরকার নাই। বাবা একটি টাকা রেখে গিয়েছিলেন টেবিলে। মা সেই টাকা ছোঁননি। টেবিলে পড়েই ছিল। টাকাটির দিকে তাকালে সংসারে নিজেকে বড় অপাংতেয় মনে হত মা’র।