মা’র বিশ্বাস হয় না তাঁর কপাল ভাল।
কপাল ভাল হলে নানাকে বেড়ালের মত পা টিপে টিপে মা’র ঘরে ঢুকে আশে পাশে কেউ আছে কি না পরখ করে পকেট থেকে বের করতে হয়েছিল কেন কাগজে মোড়ানো কৌটো! মা’র ডান হাতে কৌটোটি রেখে আঙুলগুলো বুজে দিয়েছিলেন তিনি যেন কাকপক্ষীও না দেখে! বলেছিলেন কেন জিনিসটা লুকাইয়া রাখিস, যেহেতু দেয়ালেরও কান আছে, ফিসফিস করে–আর রাইতে রাইতে মুখে মাখিস।
মা’র কালো মুখ ফর্সা করার ওষুধ দিয়ে দিয়েছিলেন নানা যেন বাবার চোখে মা অসুন্দরী না ঠেকেন যেন বাবা বউছেলেমেয়ে ফেলে আবার না কোথাও চলে যান। সেই কৌটোর ওষুধ মা রাতে রাতে মুখে মাখতেন, মুখের রং কিন্তু পাল্টাত না। চোখ আরও কোটরের ভেতরে যেতে থাকে, চোখের নিচে পড়তে থাকে কালি, নাক যেমন ভোঁতা, তেমন ভোঁতাই থেকে যায়। রূপ না থাক, গুণ তো আছে তাঁর, সেলাই জানেন, রান্না জানেন, মা নিজেকে স্বান্ত্বনা দেন। কিন্তু আদৌ কি গুণবতী তিনি! মা’র বিশ্বাস তাঁর চেয়ে নিখুঁত রান্না সেলাই অন্য অনেক মেয়েই জানে। রূপ গুণ না থাক, মা আবার নিজের কাঁধে মনে মনে চাপড় দিয়ে নিজেকেই বোঝান তিনি তো আস্ত একটি মানুষ, খোঁড়া নন, অন্ধ নন, পাগল নন। সোহেলির মা’র এক মেয়ে বদ্ধ পাগল, সত্য গোপন করে এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছে মেয়েকে। সে পাগল মেয়ের চেয়ে সংসারে নিশ্চয় এক ধাপ ওপরে মা, যে যত নিন্দা করুক মা’কে। মা পাগল না হলেও মাঝে মাঝে পাগল পাগল লাগে মা’র। বাবা যখন রাজশাহী চাকরি করছিলেন, তিনি দাদাদের নানির কাছে রেখে রওনা হয়েছিলেন একা। মা’র ভয়, বাবা তাঁকে ভালবাসেন না। নানা রং ফর্সা করার ওষুধ দিলে মা’র আরও ভয় ধরে। লাল রঙের ফ্রক মা’কে আর নীল রঙের ফজলিখালাকে যখন কিনে দিতেন নানা, মা খেজুর গাছের তলে দাঁড়িয়ে কাঁদতেন একা একা, সেই ছোটবেলায়। বিয়ের পর বাবা তাঁর জন্য শাড়ি কিনতে গেলে দোকানিকে বলতেন কালো রঙের মেয়েকে মানাবে এমন শাড়ি দিতে। শাড়ি পেয়ে মা কাঁদতেন না, ভয় পেতেন। সেই ভয় মা’র কখনও যায়নি। রাজশাহির পথে যেতে যেতে বুক ফুঁড়ে সে ভয় বেরিয়ে আসে, মা সামাল দেন। কখনও এর আগে একা একা ময়মনসিংহ ছেড়ে কোথাও যাননি মা, তা যাননি, তাই বলে কেন যাবেন না আজ, তিনি স্বামীর কাছে যাচ্ছেন, তাঁর দু’ছেলের বাবার কাছে, কোনও অবৈধ পুরুষের কাছে যাচ্ছেন না, কলমা পড়ে যে লোক তাঁকে কবূল করেছেন, তাঁর কাছে, ন্যায্য দাবিতে যাচ্ছেন। বাবা বলেননি যেতে, কিন্তু তাঁর সমস্ত শরীরে মনে তিনি বাবার কাছে যাওয়ার তীব্র আকাংখা অনুভব করছেন। বাবা ড্রাম ভরে চাল আর হাতে টাকা পয়সা দিয়ে গেছেন সংসার খরচ। কিন্তু সংসারে মন বসে না মা’র। সংসারে চাল ডালই তো সব নয়! টিঙটিঙে বোকাসোকা মেয়েরও যে মন থাকে, মন উথালপাথাল করে, কে বোঝে! বাড়ির কাউকে বোঝানো যায় না এ কথা। বাবার বদলির চাকরি, সারাদেশ ঘুরে ঘুরে চাকরি করতে হয়। রাজশাহি এসে অবদি চেষ্টা করছেন আবার বদলি হয়ে যেতে ময়মনসিংহ। কিন্তু আপিসের বাবুরা তা মানেন না। এমন সময় হঠাৎ দেখেন বউ এসে হাজির। ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক, মুখ শাদা হয়ে আছে পাউডারে। হাতে চামড়ার সুটকেস, সুটকেসে রঙিন শাড়ি, নানার দেওয়া রং ফর্সা হওয়ার কৌটো, আর একখানা তিব্বত পাউডারের ডিব্বা।
বাবা ভূত দেখার মত চমকে বলেছিলেন–তুমি এইখানে কেন? কেমনে আসছ? কে নিয়া আসছে?
–আসছি একলাই। মা শুকনো হেসে বলেন।
–একলা? এতদূর? কি ভাবে সম্ভব? বাচ্চারা কেমন আছে? বাবা একদমে জিজ্ঞেস করেন।
–ভালা আছে। তুমি কেমন আছ? চিঠি পত্তর দেও না। তুমি কি আমারে ভুইলা গেছ? মা’র স্বর বুজে আসে। চোখ ছলছল করে।
বাবা অস্থির পায়চারি করে ডক্টরস কোয়ার্টারের পুরোনো লোহার চেয়ারে বসে বলেন –তোমার কি মাথা টাথা খারাপ হইয়া গেছে? কোলের বাচ্চা ফালাইয়া আইছ?
–বাচ্চাগোর অসুবিধা নাই। দেখার মানুষ আছে।
বলে মা এক পা এক পা করে এগিয়ে আসেন বাবার দিকে।
–টাকা যা দিয়া আইছি, আছে তো! বাবা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন।
–ফুরাইয়া গেছে। বাচ্চাগোর দুধ কিইনা দেন বাজান আর মিয়াভাই।
কাছে এসে বাবার চেয়ারের হাতলে হাত রেখে মা বলেন। গা থেকে তাঁর মিষ্টি সুবাস ছড়ায়।
–আমারে জানাইলে তো আমি টাকাপয়সা যা লাগে নিয়া যাইতাম! আগামীকালই টাকা নিয়া ময়মনসিং ফিরো। বাবা চেয়ার ছেড়ে ঝট করে উঠে প্যান্টের দু’পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে বলেন।
–তুমার রান্ধাবাড়া কেডা কইরা দেয়? কি খাও? শইলডা তো শুগাইয়া গেছে। বাবার পিঠে কোমল একটি হাত রাখেন মা। ভারি নরম হাত। হাতেও মিষ্টি গন্ধ। বাবার মুখে উত্তর নেই, কালো ঘন ভুরু দুটো কুঁচকে থাকে। ক্লান্ত বিরক্ত।
দু’বছরের কনডেন্সড করতে যখন বাবা আবার যান রাজশাহি, মা’কে বলেন দেইখো তুমি আবার বাচ্চাকাচ্চা ফালাইয়া কুথাও রওনা দিও না। মা কেঁদে বুক ভাসান। বাবা কেশে সাফ গলা সাফ করে বলেন–টাকা পয়সা যা লাগবে রাইখা গেলাম, চারছয়মাস পরে আইসা দিয়া যাব আরও।
যে দু’একটি চিঠিপত্র লিখতেন বাবা, তা এরকম–নোমান কামাল নাসরিন কেমন আছে? চাল ফুরাইয়া গেলে নতুন বাজারের চালের আড়ত থেকে তোমার বাবাকে পাঠাইয়া চাল কিনিয়া লইও। সদাই পাতি যা লাগে মনু মিয়ার দোকান থেকে আনাইয়া লইও। নোমান কামালের লেখাপড়ার খোঁজ খবর লইও। মন দিয়া পড়ালেখা করতে বলিও। সুলেখার মা’র কাছে যে টাকা ধার লইয়াছ তাহা আগামি মাসে পাঠাব। টাকা পয়সা বাজে খরচ করিও না। অদরকারি কোনও জিনিস কিনিও না। সাবধানে থাকিও। ইতি রজব আলী।