সারাঘরে আলো ছড়িয়ে বেলি ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে শর্মিলা বলেন–এখনই চাঁদ উঠবে। ফুটফটে জোৎস্না হবে। জোৎস্নায় বসে আমরা গান গাইব আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে। তুমিও গাইবে।
বলে রিনরিন করে হেসে ওঠেন। আমি রুনু খালার গা ঘেঁসে ভাঙা গলায় বলি –রুনুখালা, চল। বাড়ি চল।
সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখি, চাঁদ ছিল শর্মিলাদের বাড়ির ওপর, উড়ে উড়ে আমাদের বাড়ির আকাশ অবদি এল। রুনুখালাকে পথে বলেছি দেখ দেখ চানটা আমগোর সাথে সাথে আইতাছে। রুনুখালা মোটে অবাক হলেন না দেখে। মা’কে বাড়ি ফিরেই বলেছি–জানো মা, চান আমরা যেইদিকে গেছি সেইদিকে গেছে। নন্দিবাড়ি থেইকা চানটা আমগোর সাথে আকুয়ায় আইছে।
মাও আমার কথায় অবাক হন না, জিজ্ঞেস করেন–কি খাওয়াইল শর্মিলাগোর বাড়িত?
গর্বে ফুলে রুনুখালা বললেন–কিচ্ছু মুহে দেয় নাই। হিন্দু বাড়ি ত, এইল্লিগা।
হিন্দু বাড়িতে আমি কিছু মুখে দিই না। কপালে কমুকুমের টিপ পরাতে চাইলে মুখ ফিরিয়ে নিই–মা’র ধারণা পবিত্র দিনে জন্মেছি বলেই আমি এমন করি। শর্মিলাদের বাড়ি থেকে ফেরার দু’চারদিন পর ফজলিখালার কাছে প্রথম কথাটি পাড়েন মা–দেখ ফজলি, অমন দিনে জন্মাইছে বইলাই তো মেয়ে আমার হিন্দু বাড়িতে খায় না, কপালে ফুটা দিতে চাই, দেয় না।
ফজলিখালা প্রায়ই হাজি বাড়ি জঙ্গল পেরিয়ে চলে আসেন নানির বাড়ি। এসেই আপাদমস্তক ঢেকে রাখা বোরখাটি গা থেকে খুলে বেরিয়ে পড়েন উঠোনে, পাকঘরে ঢুকে পাতিলের ঢাকনা খুলে দেখেন কি রান্না হচ্ছে বা হয়েছে, যে রান্নাই হোক, ইলিশ মাছ ভাজা বা চিতল মাছের কোপ্তা, নাক কুঁচকে ফেলেন। দেখে ধারণা হয় তিনি বিশ্রি গন্ধ পাচ্ছেন ওসব থেকে, অথবা আদৌ এসব খাবার তিনি পছন্দ করেন না। খেতে বসলে ফজলিখালার পাতে নানি দেখে শুনে ভাল পেটিটি, তলের না ওপরের না, মাঝের ভাত দেন, না পোড়া না থ্যাবড়ানো বেগুনের বড়াটি দেন। বড়ার ওপর ভাজা পেঁয়াজও দিয়ে দেন এক মুঠো। তিনি যতক্ষণ খান নাক কুঁচকেই রাখেন, যেন এ বাড়িতে এসে শ্বশুরবাড়ির চমৎকার খাবার থেকে ভীষণ বঞ্চিত হচ্ছেন তিনি আর নিতান্তই ভদ্রতা করে যা তা কোনওরকম গিলছেন এখানে যেহেতু এসেই পড়েছেন আর দুপুরও গড়িয়েছে। খেতে বসে কেবল নাক কুঁচকে থাকা নয়, ফজলিখালা বলেন শাকটা কে রেঁধেছে, বালু বালু লাগে। মাংসটায় গরম মশলা দেওয়া হয়নি নাকি! মাছ ভাজায় মনে হয় তেল কম হয়েছে। এসব।
সেদিনও, যেদিন মা আমার কপালে টিপ না পরা আর হিন্দু বাড়িতে না খাওয়ার খবর শোনালেন, তিনি খেয়ে দেয়ে মুখে পান পুরে শুয়ে শুয়ে চিবোচ্ছেলেন, সেদিন ফজলিখালার আপত্তি ছিল রসুন নিয়ে, কবুতরের মাংসে নাকি রসুন কম হয়েছে। কাঁচা চারটে রসুন ফজলিখালার পাতে দিয়ে বলেছিলেন নানি দেখ তো ফজলি এহন স্বাদ লাগে কি না। –আবার পাতে রসুন দিতে গেলেন কেন মা!
ফজলিখালা শুকনো হেসে বলেন, কাঁচা রঁসুন কি আর মাংসের ঝোলে মিশবে! মাংস সিদ্ধ হয়েছে তাই তো যথেষ্ট। ক্ষুধা মেটাতে আল্লাহ বলেছেন কোনওরকম সামান্য কিছু খেলেই চলে, খাবার নিয়ে বিলাসিতা আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন না। নবীজিও অল্প খেতেন।
ফজলিখালার ফর্সা কপালে কোঁকড়া ক’টি চুল ঝুলে থাকে। দুর্গা প্রতিমার মত তাঁকে দেখায়। শুয়ে থাকা পান চিবোনো ফজলিখালা ঘটনাটি ফাঁস করেন ভরা ঘরে, দুপুরের পর বিছানায় শুয়ে বা বসে যারাই জিরোচ্ছিল, শোনে–বলছিলাম না, এই মেয়ে ঈমানদার হবে। দেখ, হিন্দুর বাড়িতে ও কিছু খেলো না। কপালে টিপও পরাতে দেয় না, কারণ হিন্দুরা কপালে টিপ পরে। ওকে তো কেউ শেখায়নি এসব, ও জানল কি করে! আসলে আল্লাহ ওকে জানাচ্ছেন। ছোটবেলায় ঘুমের মধ্যে ও কি যে মিষ্টি করে হাসত, ফেরেসতাদের সঙ্গে ও খেলত কি না। বড়বুর কপাল ভাল।
যে যত বলুক বড়বুর কপাল ভাল, মা ভাবেন তাঁর কপাল খারাপ। তাঁর পড়ালেখা করার শখ ছিল খুব, সম্ভব হয়নি। ভাল ছাত্রী বলে ইস্কুলে নাম ছিল। নানা চাইতেন মেয়ে বোরখা পরে ইস্কুলে যাক। মা বোরখা পরেই যেতেন, দেখে ইস্কুলের মেয়েরা মুখ টিপে হাসত। বিয়ে হয়ে গেল বলে ইস্কুল ছাড়তে হল। ইস্কুল থেকে শেষদিন বিদায় নেওয়ার দিন মাস্টাররা চুক চুক করে দুঃখ করে মা’কে বলেছিলেন তর মাথাডা ভালা আছিল, বিএ এমএ পাশ করতে পারতি। বিয়ার পর দেহিস পড়ালেখা যদি চালাইয়া যাইতে পারস। বিয়ের পর বাবার কাছে মা একটি আবদারই করলেন আমি লেখাপড়া করাম। দাদাকে ইস্কুলে পাঠিয়ে নিজেও তিনি যেতে শুরু করেছিলেন, বাবার আপত্তি ছিল না। আপত্তি ছিল নানার। মা’র তবু লেখাপড়ার শখ যায়নি। বাবা রাজশাহী পড়তে গেলে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে মা নিজে ইস্কুলে ভর্তি হলেন। তখন দাদা পড়েন সেভেনে, জিলা ইস্কুলে। মহাকালি ইস্কুলে মাও সেভেনে। ইস্কুলে মাস্টাররা জানতেন মা’র বিয়ে হয়েছে, বাচ্চাকাচ্চা আছে। খবরটি গোপন রাখা হল ছাত্রীদের কাছে যেন মা কোনওরকম কুণ্ঠা ছাড়াই বয়সে ছোট মেয়েদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারেন, এক কাতারে বসে লেখাপড়া করতে পারেন। ক্লাস সেভেনের ষৈনমাসিক পরীক্ষায় সবচেয়ে ভাল ফল করলেন তিনি। গোপন ব্যাপারটি শেষ অবদি বাড়িতে গোপন থাকেনি। খবর জেনে বার্ষিক পরীক্ষার আগে মা’কে সাফসাফ বলে দিলেন নানা, সেই আগের মতই, মাইয়া মানষের অত নেকাপড়ার দরকার নাই। ঘরে বইসা পুলাপান মানুষ কর। বাবাও রাজশাহী থেকে চিঠি লিখে ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ করে মা’কে ছেলেমেয়ে মানুষ করতে পরামর্শ দিলেন। পায়ে অদৃশ্য এক শেকল পরিয়ে দিল কেউ। মা’র স্বপ্নসাধ ভেঙে চুরমার হল আরও একবার।