কিন্তু মেয়ের মুখের নূর রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে যায়। শরাফ মামা, ফেলু মামা আর টুটু মামার পেছনে দৌড়োতে দৌড়োতে। কড়ই গাছকে পাক্কা করে চোর চোর খেলার ধুম পড়ে বিকেল হলেই। চোর দৌড়ে যাকে ছোঁবে, সে হবে চোর, গাছের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে চোরকে বলতে হবে এক দুই তিন চার পাঁচ, তারপরই ভোঁ দৌড়, যাকে কাছে পায়, তার পেছনে। মামারা আমার থেকে বড়, দৌড়োতে পারেন আমার চেয়ে দ্রুত। আমাকেই বেশির ভাগ সময় চোর হয়ে থাকতে হয়। টুটু মামা কেড়ি কেটে দৌড়োন, চোর আমি ধন্দো পড়ি। খরগোসের মত দৌড়োন ফেলুমামা, সারাদিন তাঁর পেছনে দৌড়োলেও তিনি আমার নাগালের বাইরে থাকেন।
ডাংগুটি খেলতে গেলেও আমাকে খাটতে হয়। আমি গুটি ছুঁড়ি, শরাফ মামা নয়ত ফেলু মামা ডাং পিটিয়ে সে গুটি মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেন। আমার ইচ্ছে করে আমি ডাং হাতে খেলি, কেউ খাটুক, গুটি ছুঁড়ুক আমার ডাংএর দিকে। তা হঠাৎ খানিকক্ষণের জন্য ঘটে বটে, আবার ডাংএর গায়ে গুটি না লাগায় ডাং ফেরত দিতে হয়।
মার্বেল খেলতে গেলেও জিতে আমার সব মার্বেল মামারা নিয়ে নেন। শরাফ মামা কাচের বয়ামে মার্বেল রাখেন। প্রায়ই বিছানায় বয়াম উপুড় করে ফেলে মার্বেল গোণেন তিনি। আমি মুগ্ধ চোখে দেখি চকচক করা মার্বেলগুলো। আমার কেবল তাকিয়ে থাকার অধিকার আছে, ছোঁবার নেই। একবার হাত বাড়িয়েছিলাম বলে শরাফ মামা ধাম করে পিঠে কিল বসিয়েছিলেন।
সিগারেটের প্যাকেটগুলোও আমার হাতছাড়া হয়ে যায়। বগা, সিজার, ব্রিস্টল আর ক্যাপস্টেনের প্যাকেট রাস্তা থেকে কুড়িয়ে চ্যাড়া খেলতাম। উঠোনের মাটিতে চারকোণা ঘর কেটে ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে চ্যাড়া ছুঁড়তে হয়, এরপর যত ইচ্ছে প্যাকেট হাতের মুঠোয় নিয়ে দু’উরুর তলে লুকিয়ে অন্যপক্ষকে বলতে হয় পুটকির তল। মানে বাজি, তোমার চ্যাড়া আমার চ্যাড়ার চারআঙুলের সীমানায় এলে আমি পুটকির তলে যা আছে দিয়ে দেব, না হলে তুমি দেবে গুনে গুনে। আমাকেই দিতে হত।
চোর চোর, ডাংগুটি, মার্বেল, চ্যাড়া খেলে খেলে রং তামাটে হয়ে গেছে, মুখের নূরানি গেছে, ফজলি খালা তবু আশা ছাড়েননি, তাঁর তখনও ধারণা আমি বড় হয়ে আল্লাহর পথে যাব।
নন্দিবাড়ি থেকে আমার ঘুরে আসার পর ফজলিখালার ধারণা আরও পোক্ত হয়। রুনুখালার বান্ধবী শর্মিলার বাড়ি নন্দিবাড়ি নামে এক এলাকায়, হাজিবাড়ি জঙ্গলে যেতে গেলে হাতের বাঁদিকে। ও বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন রুনু খালা আমাকে নিয়ে। শর্মিলার বাড়িটি, চুন সুরকি খসা পুরোনো দালান। পোড়ো বাড়ির মত, যেন দেয়ালের ভেতরে সাপ বসে আছে মোহরের কলসি নিয়ে। যেন বটগাছ গজাচ্ছে বাড়িটির ফোকরে। বাড়িটি দেখলেই মনে হয় বাড়ির ছাদে গভীর রাতে কোনও রূপবতী মেয়ে পায়ে নূপুর পরে নাচে আর বাতি জ্বাললেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। বাড়িটি ঘিরে লিচু গাছ, লিচু পেকে ঝুলে আছে গাছের সবগুলো ডাল। নন্দিবাড়ির লিচুর বেশ নাম, কিন্তু লিচুর দিকে হাত বাড়াতে আমার ভয়, যদি পোড়োবাড়ির দালান থেকে উঁকি দেয় কোনও পদ্ম গোখরা। সিঁড়ির সামনে অদ্ভুত সুন্দর এক পুকুর, জলে তাকালে তলের মাটি দেখা যায়, আর জলের আয়নায় ভেসে ওঠে মুখ, জল নড়ে, মুখও নড়ে এলোমেলো হয়ে। আমি হাসি না, অথচ জলের মুখ হাসে আমাকে দেখে।
সন্ধেয় নিবু নিবু হারিকেন জ্বেলে শর্মিলা আমাদের মিস্টান্ন খেতে দিয়েছিলেন, আমি মাথা নেড়ে বলেছি খাবো না। খাবো না তো খাবোই না।
— কেন খাবে না? শর্মিলা জিজ্ঞেস করল।
ঠোঁট চেপে বসে থাকি। সাপের, জিনের, ভূতের ভয়ে গলার স্বর বেরোয় না।
শর্মিলা অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে, যে মেয়ে ছাদে গভীর রাতে নাচে বলে মনে হয়, ও ঠিক শর্মিলার মত দেখতে। শর্মিলার কোনও যমজ বোন নয়ত আগের জন্মে ও শর্মিলাই ছিল। শর্মিলার কালো চুল সাপের মত নেমে এসেছে হাঁটু অবদি। বাড়িতে তখন একা সে, পরনে শাদা শাড়ি, বেতের চেয়ারে বসেছেন গা এলিয়ে চুল এলিয়ে, হু হু করে সন্ধের বাতাস জানলা গলে এসে আরও এলো করে দেয় চুল, আবছা আলোয় দেখি তাঁর কাজল না পরা চোখও কালো, উদাস।
শর্মিলা ঠোঁট খুললে মনে হয় আকাশ থেকে ডানা করে এক শাদা পাখি বয়ে আনছে শব্দমালা–খুব মিষ্টি মেয়ে তো, নাম কি তোমার?
কান পেতে থাকলে শর্মিলার কথার সঙ্গে নূপুরের শব্দ শোনা যায়। আমি শুনি, অন্তত। রুনু খালা বলেন–ওর নাম শোভা।
–মিষ্টি খাও শোভা। শর্মিলা হেসে বলেন।
আমার নাম শোভা নয় কথাটি বলতে চেয়েও আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। শোভা নামটি আমার সত্যিকার নামের চেয়ে ভাল তা সত্যি কিন্তু নামটি আমার নয়। নামটি বলে আমাকে কেউ ডাকলে কেমন অস্বস্তি হয় আমার, ওই নামের ডাকে সাড়া দিলে নিজেকে মিথ্যুক মনে হয়, মনে হয় চোর, অন্যের নাম চুরি করে নিজের গায়ে সেঁটেছি। শর্মিলাকে হঠাৎ, হঠাৎই, আমার শর্মিলা বলে মনে হয় না, বসে আছে চুল খুলে শাদা শাড়িতে, যেন ও শর্মিলা নয়, ওর মরে যাওয়া যমজ বোন নয়ত আগের জন্মের ও বলছে। শব্দগুলো আসছে পাখির ডানায় করে। ও যখন কথা বলে নূপুরের শব্দ ভেসে আসে। মিষ্টি এক গন্ধ ঘরে, বেলি ফুলের। ঘরে কোথাও বেলি ফুল নেই, বাগানে বেলি ফুলের গাছ নেই, গন্ধ কোত্থেকে আসে আমি বুঝি না। ফুলের গন্ধ কি শর্মিলার গা থেকে আসছে! বোধহয়। রুনু খালার হাত চেপে বলি–চল, বাড়ি যাই।
হারিকেনের আলো ম্লান হতে হতে দপ করে নিবে যায়। শর্মিলার গায়ের আলো সারাঘর আলো করে দেয়।