খায়রুননেসা আকাল বুঝতে দেননি, মাচায় কিছু চাল জমিয়ে রেখেছিলেন অভাবে অনটনে কাজে লাগবে বলে, তাই মেপে রাঁধতেন। কোলের বাচ্চা বেঁচেছিল কেবল বুকের দুধেই। খায়রুননেসা হাল না ধরলে সংসার ঝড়ে উড়ে যেত অনেক আগে। মনিরুদ্দিনকে সবটুকু না পারলেও সংসারে যেমন তেমন টিকে থাকার মত মায়ায় জড়িয়েছিলেন খায়রুননেসা। ভয় ছিল, কখন না আবার উড়ে যায় পাখি।
আকিকার উৎসবে মেতে ছিল সবাই, কেউ লক্ষ করেনি রান্নাঘরে চুপচাপ মরে গেছেন নানির মা। নানির বাবা মরে যাওয়ার পর তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন এ বাড়িতে নানি। শিকারি ছেলের চেয়ে খায়রুননেসার কাছেই তিনি থাকতে পছন্দ করতেন। সমাজের নিয়মে অবশ্য শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী, বয়সকালে পুত্রের আশ্রয়ে থাকতে হয় মেয়েমানুষের। নানির মা’কে কাঠ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে মেঝেয় লুটিয়ে কেঁদেছিলেন নানা, যেন নিজের মা’কে হারিয়েছেন সেদিন।
সংসারে দুঃখ আছে, অভাব আছে, কিন্তু সুখও আছে নানা রকম। দাহে বেশিদিন কারও পোড়া হয় না, বর্ষার জল এসে সব ধুয়ে নেয়। জানলায় দাঁড়িয়ে পুকুরের পানিতে টুপটুপ করে ঝরা পানির খেলা দেখেন ঝুনু খালা। টিনের চালে রিমঝিম শব্দ হয় বৃষ্টির। জলের ভেতর জলের খেলা, রিমঝিম সুর সবার মন ভাল করে দেয়। মনের ভেতর পেখম মেলে ময়ূর নাচে। সেই শব্দের সঙ্গে গান করেন রুনু খালা। উঠোনের বৃষ্টিতে ভিজে দৌড়োদৌড়ি খেলেন টুটুমামা, শরাফমামা, ফেলুমামা। চৌচালা ঘরের থামে হেলান দিয়ে, আল্পনা আঁকা ঘরের মেঝেয় পাতা জলচৌকিতে বসে থাকেন মা’র মৃত্যশোক ঝেড়ে ওঠে কানা মামু।
কানা মামু, দেখে মনে হয় উঠোনের রোদের দিকে তাকিয়ে, বলেন–খালি গান গাইলে হইব রুনু? নাচো।
ঝুনু খালা প্রায় বলতে চান আপনি তো অন্ধ কানামামু, নাচ দেখবেন কেমনে? বলেন না। রুনু খালা কোমরে আঁচল গুঁজে পায়ে ঘুঙুর পরে নাচেন–নীল পাহাড়ের ধারে আর মহুয়া বনের ধারে, মন ভোলানো বংশী কে গো, বাজায় বারে বারে ও মহুয়া বনের ধারে, বনের ধারে ডাকছে পাখি, ব্যথায় আমার ভিজল আঁখি।
কানা মামু মেঝেয় লাঠি ঠুকে তাল দেন।
কেবল বাবাকে দেখি কোনও সুখের দোলনায় দোলেন না। তিনি ক্লান্ত বিরক্ত। তাঁর কাছে খরা বর্ষা সব এক। খরায় ক্ষেত ফেটে চৌচির হয়ে যায়, ফসল ফলে না, বর্ষায় ক্ষেত ডুবে ফসল নষ্ট হয়। বাবা বেতনের টাকা পুরোটাই মাদারিনগর পাঠিয়ে বড়দাদাকে চিঠি লেখেন–বাজান, দক্ষিণের জমিটা খুশির বাপের কাছ হইতে কিনিয়া লইতে দেরি করিবেন না। আগামী মাসে অধিক টাকা পাঠাইব। বাবার তখন উপার্জন অনেক। ছিলেন এল এম এফ ডাক্তার, হয়েছেন এম বি বি এস। জাতে উঠেছেন। নামের একটি নতুন রাবারস্ট্যাম্প বানিয়েছেন ডাঃ মোঃ রজব আলী, এম বি বি এস। নানিকে বাড়ি কেনার পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দিলেন, নিজেও মাঝের উঠোন জুড়ে পাঁচটি ঘর ভাড়া নিলেন সে বাড়িতে, একটি বৈঠক ঘর, একটি শোবার, একটি পাকঘর, একটি খড়ি রাখার, একটি এমনি পড়ে থাকার। ঘরগুলোয় পাকা মেঝে, টিনের চাল, টালির চাল, ইটের দেয়াল। কোনওটি আবার আগপাশতলা টিনের। আগের কেনা ঘরটি দাদা আর ছোটদাকে গুছিয়ে দেওয়া হল।
বাবার কাছে নাচ, গান, খেলা এসব অনর্থক হল্লা। বৃষ্টিতে ভিজে খেলতে দেখলে ঘাড় ধরে টেনে আমাকে ঘরে ঢোকান তিনি। সারা গা আমার কাঠ হয়ে থাকে ভয়ে। মা’কে যেমন রূপকথার গল্প শোনাতে বলি, বাবাকে কখনও পারি না, মুখের কাছে শব্দ এলেও ঢোঁকের সঙ্গে পেটে ঢুকে যায় আবার। বাবার চোখের দিকে তাকানো হয় না আমার, ভয়ে। যোজন দূরত্ব তাঁর সঙ্গে আমার।
এত দূরত্ব শুনেছি বাবার সঙ্গে আমার ছিল না। রাজশাহীতে বাবা পড়তে যাওয়ার আগে আমাদের বিষম ভাব ছিল। পাবনার জেলখানা থেকে সবে ফিরেছি। বাবা বাড়ি এলে বাবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতাম–বাবা আমালে বেলাইতে নিয়া দাও নদিল পালে।
নদীর পাড়ে আজ নেবেন কাল নেবেন বলে বলে বাবা আমাকে কোনওদিনই নেন না। বাবার কোলে ওঠা আমার গাল টিপে আদর করে দিয়ে মা বলেন–নদিল পালে যাইতে হয় না বাচ্চাদের। ছেলেধরা ধইলা নিয়া যাবে তুমালে।
— ছেলেধলা আমালে ধলবে না। আমি ত মেয়ে। বাবার কোলের ওপর জেঁকে বসে মা’কে বলি।
বাবা শুনে হো হো করে হাসেন।
–নদিল পালে ফটিং টিং থাকে। তিন মানুষের মাথা কাটা, পায়ে কথা কয়। যেন বাবাকেই ভয় দেখাচ্ছি, অমন করে ফটিং টিংএর শোনা গল্পটি একদিন বলি।
ফটিং টিং প্রসঙ্গে না গিয়ে আমার মাথায় কপালে গালে চুমু খেয়ে বাবা বললেন –কও তো তুমি আমার কি হও মা?
–আমি তুমাল মা।
এ বাবার শেখানো। গালে আবারও চকাশ করে চুমু খান বাবা। এলোচুলগুলো আঙুলে আচড়ে কানের পেছনে ঠেলে দেন। আমি তখন বাবা বলতে দুহাত পা ছোঁড়া এক পাগল মেয়ে। বাবা দু’ছেলের পর মেয়ে চেয়েছিলেন। সেই মেয়ে আমি, টুকটুকে মেয়ে, ফুটফুটে মেয়ে, আমার বাবার মা। অথচ সেই আমিই, দু’বছর পর যখন রাজশাহি থেকে কনডেন্সড পরীক্ষা দিয়ে এম বি বি এস পাশ করে ফেরেন বাবা, তাঁকে আর বাবা বলে চিনিনি, যেন এক অচেনা অদ্ভুত লোক আমাদের ঘরে উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন। বাবা আমাকে কোলে নিতে ডাকেন, আমি দৌড়ে পালাই। বাবাকে আর বাবা বলে ডাকি না। তুমি না, আপনি না। বাবাকে আজও আমি বাবা বলি না, তুমি না, আপনি না। বাবা আমার কাছে তখন সম্পূর্ণ বাইরের লোক, কিম্ভুত। নানি, রুনু খালা, ঝুনু খালা, হাশেম মামা, শরাফ মামা, ফেলু মামা, এমন কি বাউন্ডুলে নানাকেও আমার আপন বলে হয়, বাবাকে নয়। যেন বাবা এ বাড়িতে না এলেই ভাল ছিল, আমার, মা’র আর দাদা- ছোটদার সংসার চমৎকার চলছিল। যেন শান্ত একটি পুকুরে হঠাৎ এক ঢিল পড়েছে। যেন এক হিংস্র ফটিংটিং এসে আমাদের খেলাঘর ভেঙে দিয়েছে। বাবার সঙ্গে সেই যে আমার এক দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল, তা থেকেই গেছে। বাবা আমাকে ও মা, মা গো বলে কাছে ডাকেন, আমি পাথরের মত শক্ত হয়ে দাঁড়াই সামনে। আমাদের মাঝখানে অদৃশ্য এক দেয়াল থাকেই, এমনকি তিনি যখন আমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করেন।
০৩. বড় হওয়া
এক পবিত্র দিনে জন্ম আমার, বারোই রবিউল আওয়াল, সোমবার, ভোর রাত। এমন মেয়ের জন্মেই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহা মহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বলার কথা, আল্লাহর ওলিরা নাকি জন্মেই তা বলেন। ফজলিখালা বলেছিলেন, আহা কি নুরানি মুখ মেয়ের, হবে না কেন, কী পবিত্র দিনে জন্মেছে!