ইমামের এক ছেলে আছে, নামে মাত্র। সে ছেলের জঙ্গলের নেশা। ভারতবর্ষের সব জঙ্গল চষে শিকার করে বেড়ান। বাড়ি ফেরেন বছরে একবার, মাস দু’মাস থেকে আবার উধাও। ছেলের ওপর ভরসা হারিয়ে মনিরুদ্দিনের হাতে সম্পত্তির সব ভার দিয়ে শয্যা নেওয়ার পর ইমাম বলেছিলেন তুমি হইলা আমার ছেলে। মনিরুদ্দিন ছেলে বনতে পারেন, কিন্তু স্বভাব ফেরাবেন কি করে! বছর না যেতেই ইমামের আধেক জমিজিরেত বিক্রি করে ভিখিরিদের বিলিয়ে সারা। বাকি যেটুকু রইল, কিছুটা সরকার নিয়ে নিল ইস্কুলের বোর্ডিং করবে বলে আর কিছুটাতে এসে খায়রুননেসা টিনের ক’টি ঘর তুলে গাছগাছালি লাগিয়ে নিজের শেকড় গাড়লেন, অনেকটা মাটি কামড়ে পড়ে থাকার মত। বড় হৃদয়ে পোষায় না আর খায়রুনেনসার। বছর বছর ছেলে পিলে হয়, ক্ষিধেয় সারস পাখির বাচ্চার মত ওরা হাঁ করে থাকে। বাড়ি ঘর করে না হয় মাথা গোঁজার ঠাঁই হল, কিন্তু সংসারের খরচ যোগাবে কে! মনিরুদ্দিনের সেদিকে মোটে নজর নেই, তিনি ফূর্তিতে শহর বন্দর ঘুরে বেড়ান। টাকা ফুরিয়ে গেলে অবশ্য বাড়ি ফেরেন। ফিরে কই খায়রুননেসা খাওন দেও। এই পুলপান কে কই আছ, সব আসো, খাইতে বও বলে ঝিমিয়ে থাকা বাড়িকে কিলঘুসি মেরে জাগান। খায়রুননেসা মুখ বুজে মনিরুদ্দিন আর ছেলেমেয়েদের খাওয়ান। কিন্তু একবারই বলেছিলেন না খাওন নাই। মা’র তখন তিন কি চার বছর বয়স। নানা চমকে উঠলেন কি কইলা? খাওন নাই?
খায়রুননেসা ঠান্ডা চুলোর পাশে ঠান্ডা পিঁড়িতে বসে ঠান্ডা গলায় বললেন নাই। চাইল ডাইল কিচ্ছু নাই। পুলাপানরে পুস্কুনি থেইকা শাপলা তুইলা সিদ্ধ কইরা দিছি কয়দিন।
মনিরুদ্দিন শুনে মন বিষ করে ঘরে শুয়ে পড়লেন। দু’দিন শুয়ে থাকলেন।
খায়রুননেসা গাছের নারকেল কুড়িয়ে তকতি বানিয়ে মনিরুদ্দিনকে শোয়া থেকে উঠিয়ে বললেন–যাইন বাজারে নিয়া এইগুলান বেইচা চাইল ডাইল কিইনা আনেন। নারকেলের তকতি ভরা কাঠের বাক্সে মাথায় করে নানা দিব্যি কাচারির সামনে নাড়ু বেচতে গেলেন।
প্রতিদিন খায়রুননেসা তকতি বানিয়ে বাক্স ভরে রাখেন। তকতি বেচার টাকা কিছুটা রেখে কিছুটা বউএর হাতে দেন মনিরুদ্দিন। প্রতিদিন এক সিকি দু’সিকি গোপনে জমিয়ে, ঈদুল ওয়ারার যখন বয়স পাঁচ, বাঁশের ব্যাংক ভেঙে এক পুঁটলি টাকা মনিরুদ্দিনের হাতে দিয়ে খায়রুননেসা বলেন–একটা দুকান কিনুইন। দুকানে ভাত মাছ বেচবেন।
মনিরুদ্দিন বাধ্য ছেলের মত দোকান কেনেন। চেয়ার টেবিল বসান। বাবুর্চি রাখেন। নতুন বাজারের মধ্যিখানে দোকান তখন হু হু করে চলছে। ইংরেজের আমল তখন। ইংরেজের ওপর লোকের রাগ অনেক। মনিরুদ্দিনের কারও ওপর রাগ হয় না। জগতের সবাইকে তাঁর বড় ভাল মানুষ বলে মনে হয়। এমন কি তাঁর সৎ মা’কেও। দোকানে যেই খেতে আসে, তাকেই গদিতে বসিয়ে গপ্প করেন তিনি। চোর ছ্যাঁচোরও মনিরুদ্দিনের ভাল বন্ধু হয়ে ওঠে। রাস্তার কুকুর বেড়ালও এসে দোকানে ভিড় করে, ক্ষিধে লাগলে রান্নাঘরে ঢুকে এঁটোকাঁটা খেয়ে নেয়। পাগল ভিখিরি ডেকে দোকানে খাইয়ে দেন, কারও কষ্টের কথা শুনলে ক্যাশবাক্স খুলে মুঠো ভরে টাকাও দিয়ে দেন, ঘাম ঝরা কোনও হাটুরেকে রাস্তায় দেখলে চেঁচিয়ে ডাকেন, ও ভাইসাব, দৌড়ান কই, আহেন আহেন, এট্টু জিড়াইয়া যাইন। হাটুরেরা জিরিয়ে এক গ্লাস শরবতও মাগনা খেয়ে যান। মন্যা মুন্সির এইডা ত আর ব্যবসা না, মুসাফিরখানা–লোকে মন্তব্য করে। খায়রুননেসা ঈদুল ওয়ারাকে পাঠাতেন দোকান ঝাড়ু দিতে, টেবিল চেয়ার সাফ করতে। সিদ্দিকের পেছন পেছন ঈদুল ওয়ারা দোকানে পৌঁছে যখন দোকান ঝাড়ু দিতেন, মনিরুদ্দিনের সঙ্গে গদিতে বসে গরম জিলিপি খেতেন সিদ্দিক। সন্ধের আগে ছেলে মেয়ে দু’টিকে মাছ ভাত খাইয়ে মনিরুদ্দিন পাঠিয়ে দিতেন বাড়িতে। তাঁর নিজের বাড়ি ফিরতে রাত হত। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে হারিকেনের আলো টিমটিম করে রেখে খায়রুননেসা বসে থাকতেন অপেক্ষায়। মনিরুদ্দিন ফিরলে তাঁর অবাধ কামের তলে আত্মাহুতি দিতেন, চাইতেন বুনো পাখিটি আটকা পড়ুক সমৃদ্ধি, সন্তান আর সম্ভোগের এই সংসারখাঁচায়। নিজে তিনি মেয়েমানুষ বলে সম্ভব ছিল না বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ব্যবসায় নজর করা। ঘরে বাঁশ পুতে সে বাঁশে ছিদ্র করে পয়সা ফেলতেন খায়রুননেসা। রাতে রাতে মনিরুদ্দিনের তৃপ্ত শরীরের পাশে কালো ঘন চুল ছড়িয়ে শুয়ে তাঁকে হিশেবি হতে পরামর্শ দেন। মনিরুদ্দিনের টাকা গোণার অভ্যেস নেই, টাকার হিশেব করেন তিনি মুঠো ধরে, গুনে নয়। তাঁর জন্য আর যা কিছু হওয়াই সম্ভব, হিশেবি হওয়া নয়।
পঞ্চাশ সনে আকাল নামল। আকালে চোখের সামনে মরতে লাগল মানুষ না খেয়ে। এক বাটি ফ্যান চাইতে দুয়োরে দাঁড়ায় মানুষ! মনিরুদ্দিন দোকানে বিক্রিবাটা বন্ধ করে লঙ্গরখানা খুললেন, নিজে হাতে চালে ডালে সবজিতে লাবড়া রেঁধে খাবার বিলোতে লাগলেন না খেতে পাওয়া মানুষদের। পকেটে টাকা নিয়ে সারা শহরের বাজার ঘুরে লঙ্গরখানা চালাতে চাল খুঁজেছেন কিনতে, বাজারে চাল নেই। দিশেহারা হয়ে মসজিদে মসজিদে দৌড়োলেন, মোনাজাতের হাত তুলে আল্লাহর দরবারে–তুমি ছাড়া কোনও মাবুদ নাই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, তুমি ছাড়া কোনও আপন নাই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, বলে হাউমাউ করে কাঁদলেন, চোখের পানিতে ভেসে গেল মনিুরুদ্দিনের বুক। পুরো আকালের বছর তিনি কেঁদে পার করেছেন, উড়োজাহাজ থেকে চাল আর বিলাতি দুধ ফেলা শুরু হলে হাসি ফুটেছিল মুখে।