–আপনে কি আমারে অন্তত পাঁচ হাজার টেকা কর্জ দিতে পারবাইন নুমানের বাপ? বাড়িঘর না থাকলে পুলাপান লইয়া থাকবাম কই? নানি ভাঙা স্বরে বলেন।
বাবা কোনও উত্তর দেন না।
নানি কাতর স্বরে বলেন–আমি আপনেরে যেমনেই হোক মাসে মাসে টেকা শোধ কইরা দিয়াম।
বাবার নীরবতায় মা ছটফট করেন, বলেন–বাজান কি এই সংসারের লাইগা কম করছে? এহন মা’র এই বিপদের দিনে সাহায্য করার কেউ নাই। রাজশাহি পড়তে গেল গা, বাচ্চাগোর দুধ ছিল না। বাজান বড় বড় দুধের টিন কিইনা দিছে। বিয়ার পর থেইকা ত বাপের বাড়িতই থাকলাম।
নানি শাড়ির আঁচলে চশমার কাচ মুছে নিয়ে আবার পরেন। আবার ব্যাকুল কণ্ঠে বলেন–একটা কিছু উত্তর দেইন নুমানের বাপ। বসিরুদ্দিন কাইলকা আইব।
বাবা সে রাতে কোনও উত্তর দেননি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নানি যখন দরজার বাইরে চলে গেলেন, বাবা ঘাড়ে হাত ঘসতে ঘসতে বললেন আম্মা, কাইল রাইতে আপনের সাথে কথা কইয়াম নে।
বাবা টাকা দিয়েছিলেন। নানি মাসে মাসে তিন বছরে সে টাকা শোধ করেছিলেন। নানা শুনে একগাল হেসে বলেছেন–খায়রুন্নেসা ফুঁ দিলে তুষের আগুনও ঠান্ডা।
নানা বেহিসেবি লোক। আমুদে লোকও। খেয়ে এবং খাইয়ে তাঁর যত আনন্দ। নানি সংসারের হাল না ধরলে অবশ্য আমোদ আহলাদ সব ভেস্তে যেত নানার। বিক্রমপুরের বাউন্ডুলে ছেলে নানা। বাপের সিন্দুক ভেঙে জমানো টাকা পয়সা চুরি করে তের বছর বয়সে পালিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। এ শহর সে শহর ঘুরে ময়মনসিংহে এসে একসময় ফতুর হয়ে পড়েন। মসজিদে মসজিদে বিনে পয়সায় ঘুমোন, খান আর রাস্তার পাগল ফকির জড়ো করে আরব দেশের কিচ্ছা শোনান। মসজিদের লোকেরা নানাকে এক পয়সা দু’পয়সা দেয়। পয়সা পকেটে নিয়ে বাবর বাদশাহর মত নিজেকে মনে হয় তাঁর। রাস্তায় কাউকে ভিক্ষে করতে দেখলেই নানা জিজ্ঞেস করেন–বাড়ি কই? পেটে দানা পানি পড়ছে? ভিখিরির ক্ষিধে যায় না, ভিখিরির অভাবের গল্প শুনে নানা আহা আহা করেন, চোখ বেয়ে বর্ষার জলের মত জল ঝরে। পকেটের কানাকড়ি যা আছে, ভিখিরির হাতে দিয়ে বলেন–ভাল মন্দ কিছু খাইও।
জিলাইস্কুল মোড়ের চানতারা মসজিদের নতুন ইমাম প্রায়ই লক্ষ করেন নানা জুম্মার নামাজ পড়তে একপাল ভিখিরি নিয়ে মসজিদে আসেন। ওদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েন নানা। একদিন ডাকলেন –এই মিয়া তুমার নাম কি?
নানা একগাল হেসে বলেন–নাম আমার মনিরুদ্দিন।
–বাড়ি কই?
–বাড়ি নাই।
–বাপের নাম কি?
–ভুইলা গেছি।
–থাকো কই?
–এত বড় দুনিয়ায় থাকনের কি অভাব!
–লেখাপড়া জানো?
মনিরুদ্দিনের ফর্সা মুখে শাদা হাসি। কোনও উত্তর নেই।
বাউন্ডুলে ছেলেকে সংসারি করার ইচ্ছে জাগে ইমামের। ঘরে তাঁর বারো বছরের এক মেয়ে আছে বিয়ের বয়সী। ইমাম তক্কে তক্কে থাকেন মনিরুদ্দিনকে খপ করে ধরবেন একদিন। মসজিদের ভেতর এক শীতের রাতে কম্বলকাঁথা ছাড়া হাত পা গুটিয়ে মনিরুদ্দিনকে ঠান্ডা মেঝেয় শুয়ে থাকতে দেখে ইমাম বললেন –চল মনিরুদ্দিন, আমার বাড়িত লেপ আছে বিছনা আছে, ঘুমাইবা।
মনিরুদ্দিন নড়েন না।
–চল মনিরুদ্দিন, গরম ভাত খাইবা গুসতের ছালুন দিয়া।
মনিরুদ্দিন উঠে বসেন।
–তা বাড়ি আপনের কতদূর ইমাম সাইব? মনিরুদ্দিন জিজ্ঞেস করেন আড়মোড়া ভেঙে।
মনিরুদ্দিনকে সে রাতে বাড়ি নিয়ে গুসতের ছালুন দিয়ে গরম ভাত খাইয়ে বারবাড়ির বিছানায় গরম লেপের তলে শুইয়ে দিলেন। মনিরুদ্দিন ঘুমোলেন পরদিন দুপুর অবদি টানা। এমন আরাম তিনি বহু বছর পাননি। সৎ মায়ের যন্ত্রণায় ঘর ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। তাঁর মনে পড়ে নিজের মা বেঁচে থাকতে দুধভাত খাইয়ে তাঁকে এমন শুইয়ে রাখতেন। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে মনিরুদ্দিন দেখেন উঠোনে বদনির পানিতে অযু করছেন ইমাম। তাঁর বাবাও এমন বদনি কাত করে পানি ঢালতেন পায়ে। বদনিখানা ইমামের হাত থেকে নিয়ে নিজে তিনি পানি ঢালতে লাগলেন, যেন তাঁর বহু বছর না দেখা বাবার পায়ে ঢালছেন পানি। পানি ঢালতে ঢালতে মনিরুদ্দিন হঠাৎ হু হু করে কেঁদে উঠলেন।
–কান্দো ক্যান, মনিরুদ্দিন? কান্দো ক্যান?
ইমাম অবাক হয়ে বললেন।
মনিরুদ্দিন কোনও উত্তর না দিয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। প্রায় একমাস পর এক খাঁচা মিষ্টি নিয়ে ইমামের বাড়ি এসে হাসতে হাসতে বললেন– ইমাম সাইব, খুব ভাল মিষ্টি, খাইয়া দেখেন। গরম গরম রসগোল্লা। কলিকাতা থেইকা আনা।
মিষ্টি ইমামের বাড়ির সবাই খেলেন। খেয়ে দেয়ে ইমাম বাইরের ঘরে বসা মনিরুদ্দিনকে বললেন আমার মেয়ে খায়রুন্নেসারে তুমি বিয়া কর।
— বিয়া? মনিরুদ্দিন আঁতকে ওঠেন। বিয়া কইরা বউ তুলমু কই। মসজিদে?
— সেই চিন্তা কইর না। আমার জাগা জমির অভাব নাই। একটা কিছু ব্যবস্থা হইব। ইমাম কাঁধে হাত রেখে বললেন তাঁর।
মনিরুদ্দিন মন সেদিন ফুরফুরে। রাজি হতে বেশি সময় নিলেন না। রাত ঘন হওয়ার আগেই কাজি ডেকে বিয়ে পড়িয়ে ভাত গোসত রান্না করে খাইয়ে দাইয়ে লেপের তলে শুইয়ে দেওয়া হল মনিরুদ্দিনকে। খায়রুননেসা জানলেন না মনিরুদ্দিন দেখতে কেমন, তাঁর স্বভাব চরিত্র কেমন। লেখাপড়া জানা মেয়ে খায়রুনন্নেসা, সূর করে পুঁথিও পড়তে জানেন অথচ দিব্যি এক ক অক্ষর গোমাংসের সঙ্গে হুট করে তাঁর বিয়ে হয়ে গেল, গোমাংসের রসগোল্লা পেটে হজম হওয়ার আগেই। খায়রুননেসার আরও ভাল জামাই জুটতে পারত। কিন্তু ইমামের বদ্ধ ধারণা, মনিরুদ্দিনের বাড়ি ঘর টাকা পয়সা না থাক, বড় একখানা হৃদয় আছে। আর সারা জীবনে এই অভিজ্ঞতাই তিনি অর্জন করেছেন যে হৃদয়ের চেয়ে বড় কিছু জগতে নেই।