আকিকায় পাওয়া চারটে ছোট সুটকেস মা তুলে রাখলেন আলমারির ওপর। পিতলের কলসি চলে গেল রান্নাঘরের কাজে। আলমারির ভেতর জামা জুতো, থাল বাটি আর কোরান শরিফ। সোনার আংটি, মালা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে রাখলেন মা, চাবি বাঁধা আঁচলের কোণায়। আমার নাগালের ভেতর পড়ে থাকে কেবল বইখানা। আমার মাস্টার তখন বাড়িসুদ্ধ সবাই। বইয়ের ওপর ঝুঁকে আছি দেখলে ক থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত আমাকে উচ্চারণ করিয়ে ছাড়েন।
তাঁরা যা বলতে বলেন, বলি। পড়ে শ্লেটে পেনসিল ঠেসে অক্ষর আঁকার আগেই বলেন পড়, ময়আকার মা।
আমি বলি ময়আকার মা।
–ক ল ম কলম।
–ক ল ম কলম।
উঠোনের খাঁচায় বাঁধা ময়না পাখিকেও যা বলতে বলা হয়, বলে। শরাফ কিম্বা ফেলু মামা তখনও হাতে বই ধরেননি, আর আমার সবুজ সাথী শেষ।
আকিকার উৎসবের পর পরই কাউকে না জানিয়ে বসিরুদ্দিন নামের এক লোকের কাছে পুরো বাড়ি বিক্রি করে দেন নানা। বসিরুদ্দিন এসে বাড়ির দখল চাইলেই নানির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম আকাশ আকাশের জায়গায় আছে। অত বড় আকাশ ভেঙে নানির মাথায় পড়লে নানি কি আর বাঁচতেন! যা হোক, নানা টাকা কি করেছেন, কাকে দিয়েছেন এর কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি। নানি বসিরুদ্দিনকে বাড়ির ভাল চেয়ারটিতে বসিয়ে চা নাস্তা সামনে দিয়ে নরম গলায় বললেন –ভাইজান, একজনে পাগলামি কইরা সংসারের সবাইরে ভুগাইব, এইডা কি সইয্য হয়! আমার এতগুলা ছেলেমেয়ে। সবাইরে নিয়া আমারে পথে বইতে হইব। আপনেরে আমি টেকা শোধ কইরা দিয়াম। আপনে এই বাড়ি আমার কাছে বিক্রি কইরা দেন। আমি টেকা কিস্তিতে শোধ করাম।
বসিরুদ্দিন গলা কেশে বললেন–কিস্তিতে পুষাইব না। আমি, ঠিক আছে, আপনে যহন কইতাছুইন, আমি বাড়ি বিক্রি করাম, কিন্তু কিস্তিতে না। টেকা আমারে একবারে দিতে হইব।
নানি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে বলেন–এত টেকা একবারে আমি পাই কই! আমার দিকটা দেহেন। আমি অসহায় মেয়েছেলে! কয়ডা দিন তাইলে সময় দেন আমারে।
চায়ে চুমুক দিয়ে বসিরুদ্দিন বলেন–না না না। সময় আমি কেমনে দেই! সময় কি বানানো যায়! আল্লাহ মাইপা যে সময় দেন আমাগো হাতে, সেইডাই খরচা করি। আমারে টেকা কাইল পরশুর মধ্যে দিলে আমি বাড়ি বেচাম, নাইলে আমারে মাপ করুইন।
শরাফ মামার হাতে ভেতর ঘর থেকে পানের খিলি পাঠিয়ে দেন বসিরুদ্দিনকে, চা খেয়ে মুখে পান পুরে আঙুলে চুন তুলে বসিরুদ্দিন উঠোনের হাঁসমুরগির দিকে তাকিয়ে বললেন–আমি তাইলে কাইল বিকালে আসতাছি।
বসিরুদ্দিন চলে গেলে নানি পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন। বাঁশের ব্যাংক ভেঙে, আনাচে কানাচে যেখানে যত টাকা ছিল, বার করে দেখলেন মাত্র পাঁচশ।
বোরখা চড়িয়ে চলে গেলেন বাড়ির বাইরে। সুলেখার মার বাড়ি, মনুর মা, সাহাবউদ্দিনের বাড়ি ঘুরে এসে রাতে এসে আমাদের ঘরে উঠলেন। বাবা তখন ডাকতারখানা থেকে সবে রোগি দেখে ফিরেছেন।
–খবর পাইছুইন? এহন কি করি কন। নানি ব্যাকুল কণ্ঠে বলেন।
খবর বাবা পেয়েছিলেন, বাবা বাড়ি ফিরতেই মা বলেছেন–বাজান বাড়ি বেইচা দিছে বসিরুদ্দিন নামের এক লোকের কাছে। বাড়ির দখল লইতে আইছিল লোকে। মা কইল বাড়ি কিইনা লইব তার কাছ থেইকা। কিন্তু কেমনে কিনব কে জানে। এত টেকা মা পাইব কই। বসিরুদ্দিন একবারে টেকা চায়। কাইল পরশুর মধ্যে দিতে হইব। কিন্তু খবর না জানা স্বরে বাবা বললেন–কি খবর! কি হইছে কি!
দু’জন খাটের দু’কিনারে বসলেন। নানি বললেন–বাড়ি ত বেইচা দিছে সিদ্দিকের বাপে।
বাবার পরনে লুঙ্গি। লুঙ্গির নিচে পা দুলতে থাকে বাবার, বললেন–কোন বাড়ি? কার বাড়ি?
–কোন বাড়ি আবার, এই বাড়ি! নানি বিরক্ত গলায় বলেন।
–ক্যান, বেচছে ক্যান? বাবা প্রশ্ন করেন।
–এইডা কি আর আমি জানি! আমারে ত কিচ্ছু কয় নাই। মানুষটা আস্তা পাগল। বুদ্ধি সুদ্ধি নাই। টেকাগুলা কি করছে তাও কয় না।
বাবার পা দুলতে থাকে লুঙ্গির নিচে।
–বসিরুদ্দিনরে কইলাম তার কাছ থেইকা বাড়ি আমি কিইনা …
নানির কথায় ঠোকর দেন বাবা, — বসিরুদ্দিন কেডা?
— যে বেডার কাছে সিদ্দিকের বাপে বাড়ি বেচছে। নানি বলেন।
–বসিরুদ্দিন থাহে কই? বাবা জিজ্ঞেস করেন দোলা হাঁটু চুলকোতে চুলকোতে।
–নতুন বাজার নাকি কই জানি। নানি হাতের রুমাল খুলে পানের একটি খিলি মুখে পুরে বলেন।
–বসিরুদ্দিন করে কি? বাবা জিজ্ঞেস করেন।
–সেইডা জানি না। বসিরুদ্দিন বাড়িতে আইছিল। টেকা চাইল। আমি কইলাম টেকা কিস্তিতে দিয়াম। বাড়ি আমার কাছে বেইচা দেন। নানি থেমে থেমে বলেন।
–ভাল কথা। কিস্তিতে টেকা তাইলে দিয়া দেন। বাবা নিরুত্তাপ স্বরে বলেন।
–কিন্তু বসিরুদ্দিন মানে না। কয় একবারে তারে টেকা দিতে। নানির স্বরে উদ্বেগ।
–তাইলে একবারেই দিয়া দেন। বাবা মধুর হেসে বলেন।
–টেকা কি গাছে ধরে? ছয় হাজার টেকা আমি পাই কই!
নানি অসহায় চোখে ফেলেন বাবার চোখে। পা দোলানো বন্ধ করে বলেন বাবা –ঈদুন চা টা কিছু দেও। আম্মা চা খাইয়া যাইন।
নানি মাথা নাড়েন, চা খাবেন না তিনি।
–তাইলে কি খাইবাইন? কিছু একটা খাইন? বাবা বলেন।
–না না আমি কিছু খাইতাইম না। নানির স্বরে বিরক্তি।
–এই বিস্কুট চানাচুর কিছু দেও ত। বাবা মা’কে তাড়া দেন।
–না। না। না। নানি হাত উঁচিয়ে মা’কে থামান।
বাবা আর নানি বসে থাকেন খাটের দু’কিনারে। মা আর আমি আরেক খাটের মধ্যিখানে। কেউ কারও সঙ্গে আর কথা বলছেন না।