হাইট্যারার পর আকিকাও হবে। দাদাদের আকিকা হয়েছিল গরু জবাই করে, আমার হল একটি খাসিতে। মেয়ের বেলায় খাসি, ছেলের বেলায় একটি গরু নয়ত দুটো খাসি, এরকমই নিয়ম। আকিকার আগে আগে আমার নাম রাখা হবে কি এই নিয়ে বাড়িতে বৈঠক বসেছিল। বড়মামা বলেন নাম রাখ উষা। রুনু খালা বলেন শোভা, ঝুনু খালা পাপড়ি। দরজায় দাঁড়িয়ে দাদা বুড়ো আঙুল খোঁটেন চৌকাঠে। কোনও নামই তাঁর পছন্দ হয় না। ঘর ভরা মানুষের সামনে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থেকে দাদার ঘাড়ের রোম ফুলছে তা কারও নজরে পড়েনি। না পড়ারই কথা, নাম রাখার দায়িত্ব বড়দের, ছোটরা নামের বোঝে কী! তো বাদাম চিবুচ্ছিলেন দাদা, হঠাৎ হাঁ করলেন সারস পাখির মত, জিভ নড়তে লাগল যেন ঝড়ে কাঁপা বাঁশপাতা, ছিটকে বেরোতে লাগল বাদাম মুখ থেকে, বাদামের সঙ্গে শব্দও। বাড়ির কুকুর বেড়ালের ডাক, কাকের ডাক, বাচ্চার ট্যাঁ ট্যাঁ, উঠোনে এর ওর তারস্বরে চিৎকার, খেলার মাঠে ছেলেদের চেঁচামেচি সবকিছুর সঙ্গে দাদার বাদাম ভরা মুখের শব্দ ঠিক ঠাহর করা যায় না, এটি ওসব শব্দেরই একটি নাকি আলাদা। রুনু খালা অনুমান করেন চিকন চিৎকারটি দরজার কাছ থেকেই আসছে।
খপ করে দাদার কাঁধ ধরে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা রুনুখালা দাদাকে ঘরের মাঝখানে কাঠের থামের কাছে দাঁড় করান। বড় মামার, ঝুনুখালার, নানির, মা’র, হাশেম মামার চোখ তখন দাদার আলজিভ বের হয়ে থাকা মুখে, মুখের বাদামে। কান শব্দে।
কী কান্দস ক্যান? কেডা মারছে? রুনুখালা দাদার চিবুক উঁচু করে ধরে জিজ্ঞেস করেন।
দাদার গাল বেয়ে যে পানি ঝরছে তা হাতের তেলোয় মুছে, কান্নার দমক থামিয়ে বললেন–আমার বইনের নাম রাখতে হইব নাসরিন।
মামা খালারা এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ঘর কাঁপিয়ে হাসেন। যেন সার্কাসের ক্লাউন মঞ্চে এসে লোক হাসাচ্ছে।
এবার দাদাকে বৃত্তের ভেতরে নিয়ে আসা হল। বৃত্তটি রচনা করলেন বড়মামা, হাশেম মামা, রুনু আর ঝুনু খালা।
নাসরিন নাম রাখবি ক্যান? কোত্থেকা শুনলি এই নাম? কে কইছে এই নাম রাখতে? প্রশ্নের বাণের সঙ্গে দাদার হাতে এক ঠোঙা বাদামও দেওয়া হল। তিনি দাঁতে বাদাম ভাঙতে ভাঙতে বলেন, বাদামের দিকে তাকিয়ে, আমার ইস্কুলে একটা খুব সুন্দর মেয়ে আছে। নাসরিন নাম।
এবার বৃত্তে হাসি চেপে রাখা হল যার যার পেটের ভেতর আরও তথ্যের আশায়। নাসরিন কই থাকে? বাড়ি কই? হাশেম মামা জিজ্ঞেস করেন।
দাদা উত্তর দেওয়ার আগেই বড় মামা বলেন–তর ওই নাসরিন নাম টাম চলব না। নাম রাখা হইব উষা।
দাদা বাদামের ঠোঙা দূরে ছুঁড়ে ফেলে, ঠোঙা গিয়ে ঠেকল বাঁশের ব্যাংকে, বৃত্ত থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যান। ঘর থেকে নিজের জামা কাপড়ের এক পুঁটলি বেঁধে নিয়ে বলেন তিনি, গেলাম।
এই কই যাস, থাম। মা পেছন থেকে বলেন।
যেই দিকে দুই চোখ যায়। দাদা যেতে যেতে বলেন।
কাঁধে পুঁটলি নিয়ে ঠিকই তিনি বেরিয়ে যান বাড়ির বাইরে। পুকুর ঘাট থেকেই দাদা ফেরত আসবেন ভেবে বৃত্ত ভেঙে মামা খালারা বসে থাকেন খাটে পা ঝুলিয়ে কিন্তু ফেরেন না দাদা।
সন্ধে শেষ হয়ে রাত ঘন হলে মা বিলাপ শুরু করেন। বড়মামা আর হাশেম মামা বেরিয়ে যান দাদাকে ধরে আনতে। খবর পেয়ে নানাও।
রাত দশটায় হাশেম মামা হাজিবাড়ির জঙ্গল থেকে পাগল ছেলেকে ধরে এনে বাড়িতে হাজির করেন। দাদাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে মা বলেন– যে নাম রাখতে চাও তুমি, সেইটাই হইব বাবা।
ছেলে যা বলেছে তাই হবে, বাবা পরদিন সকালে জানিয়ে দেন বাড়িতে, নাম নাসরিনই। মামা খালারা বিষণ্ণ মুখে বসে থাকেন। রাজকন্যার এমন গেঁয়ো নাম রাখার কোনও মানে হয় না, যে নামের কোনও অর্থ নেই।
দাদা পরদিন ইস্কুল থেকে ফিরে উঠোনে দাঁড়িয়ে বৃত্তের মানুষদের দিকে তাকিয়ে বুড়ো আঙুল চুষতে চুষতে মিটমিট হাসেন।
–তর বইনের পুরা নাম কি দিবি রে হাগড়া গাড়ি? ঝুনুখালা কুটা দিয়ে কলপাড়ের দক্ষিণের গাছ থেকে আম পাড়তে পাড়তে বললেন।
–নাসরিন জাহান তসলিমা। দাদা বুড়ো আঙুল বের করে আকর্ণ হেসে বলেন। ফক করে হেসে ওঠেন ঝুনু খালা।
রুনু খালা উঠোনে বসে বটিতে কুচি কুচি করে আম কাটছিলেন ভর্তা বানাবেন, বলেন তর যে ইস্কুলের মেয়ে নাসরিন, তারে তর পছন্দ হয়?
দাদা দাঁত ছড়িয়ে হেসে বলেন–হয়।
–তারে বিয়া করবি?
দাদা বুড়ো আঙুল মুখে পুরে শরমের হাসি হেসে মাথা কাত করে রাখেন ডানে। তাঁর হাফপ্যান্টের দড়ি ঝুলে থাকে হাঁটু অবদি।
ঝুনু খালা কুটা ফেলে দাদার মাথায় ঠোনা মেরে বলেন–তরে তো বিয়া করব না ওই মেয়ে। তুই যে ইস্কুরে হাইগা দিতি প্যান্টের মধ্যে, এই খবর তো তর সুন্দরী মেয়ে নাসরিন পাইয়া গেছে।
দাদা দৌড়ে ঘরে ঢুকে মা’র আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। চোখে টলটল করে জল।
–কী হইছে, কান্দ কেন? মা জিজ্ঞেস করেন দাদার মাথায় হাত বুলিয়ে।
–ঝুনু খালা আমারে হাগড়া গাড়ি ডাকছে।
মা উঠোনে নেমে কপট ধমক লাগান ঝুনু খালাকে।
–বেচারারে কান্দাইছ না তো। জন্মের পর থেইকা এর পেট খারাপ। কত ওষুধ খাওয়াইলাম, পেট আর ভাল হয় না। সেই যে শুরু হইছে, আইজও পাতলা হাগে।
আকিকা হবে বলে নাম ঠিক হল আমার, আকিকার দিন পিছিয়ে দিলেন বাবা। কেন, মাদারিনগরে সে বছর ধান হয়নি ভাল, বাবার মন খারাপ। মাস কয় পর ধান হল ভাল কিন্তু বদলির কাগজ এল বাবার, পাবনায়। বাবার আবার মন খারাপ, পিছোতে হল আকিকার দিন। পাবনা থেকে ফিরে এসে আবার আকিকার প্রসঙ্গ। সে হতে হতে আরও দু’বছর গেল। আকিকার উৎসবে সকাল থেকে খালারা ঘরের মেঝেয় শাদা রঙের আল্পনা আঁকেন, রঙিন কাগজে মালা বানান, কাগজের শেকল বানিয়ে এক থাম থেকে আরেক থামে ঝুলিয়ে দেন। আকিকায় লোক আসে সোনার মালা, আংটি, পিতলের কলসি, সবুজ সাথী বই, জামা জুতো, কোরান শরিফ, থাল বাটি, সুটকেস উপহার নিয়ে। আয়না বাবুর্চি মাঠে গর্ত করে চুলো বানিয়ে খড়ি জ্বেলে বড় বড় ডেকচিতে পোলাও কোরমা রান্না করেন। সুগন্ধে বাড়ি ম ম করে। পাতিল পাতিল দই মিষ্টি কিনে আনেন নানা। আকিকার দিন দাদা ছিলেন সবচেয়ে ব্যস্ত। ধোয়া জামা কাপড় পরে নতুন জুতো পায়ে দিয়ে চুলে টেরি কেটে অতিথিদের সামনে ঘুরঘুর করতে করতে যাঁকেই দেখেছেন তাঁর দিকে প্রশ্রয়ের হাসি হাসতে, তাঁর কাছেই রহস্য ফাঁস করেছেন এই বলে যে বোনের নামটি রেখেছেন একা তিনিই, বাড়ির অন্যরা নানারকম নামের প্রস্তাব করেছিল, মন্দ বলে বাদ দেওয়া হয়েছে।