জাফর আলীর আশকারায় রজব আলীর পড়া দ্রুত এগোয়, চাটাইয়ের ওপর পা ছড়িয়ে বসে রজব আলী বর্ণপরিচয় শেষ করে বাল্যশিক্ষা পড়েন, গোপাল বড় সুবোধ ছেলে, তাহাকে যাহা দেওয়া যায়, সে তাহাই খায়। জাফর আলী উঠোনে বসে হুঁকো টানেন আর নাতির পড়ার শব্দ শোনেন। তাঁর ইচ্ছে করে পাঠশালা শেষ করিয়ে রজব আলীকে চন্ডিপাশা ইস্কুলে পড়াতে।
তিন মাইল হেঁটে রজব আলী চন্ডিপাশা ইস্কুলেও যান। ইস্কুলে কালিচরণ, বলরাম, নিশিকান্তকে ছাড়িয়ে যান। মেট্রিকের ফল হাতে দিয়ে পন্ডিতমশাই বলেন রজব আলী, লেখাপড়া চালাইয়া যা, ছাড়িস না।
রজব আলী লেখাপড়া ছাড়েননি। শহরে যাওয়ার অনুমতি মেলে না, পন্ডিতমশাই নিজে বাড়ি এসে জনাব আলী সরকারকে বলে যান–ছেলে আপনের জজ ব্যারিস্টার হইব। গুষ্ঠির ভাগ্য ফিরব। ছেলেরে যাইতে দেন।
সেই রজব আলী হাতে দুটো জামা, একখানা পাজামা, আর এক জোড়া কালো রাবারের জুতো, এক শিশি সর্ষের তেল ভরা পুঁটলি নিয়ে আসেন ময়মনসিংহ শহরে। পকেটে চার আনা পয়সা সম্বল। বাড়ি খোঁজেন জায়গির থাকার, চেনা এক লোক এক মোক্তারের বাড়িতে জায়গির থাকার কাজ দেন। ভাল ফল দেখিয়ে লিটন মেডিকেল ইস্কুলে ভর্তি হন। আত্মীয় বন্ধুহীন শহরে জায়গির বাড়ি থেকে লেখাপড়া করতে করতে শহরের নতুন বাজারে মনিরুদ্দিন মুন্সির সঙ্গে দেখা হয় বাবার একদিন। দরাজ দিল মুন্সির, দোকানের গদিতে বসে রাস্তার ফকির খাওয়ান বিনে পয়সায়। দেখে বাবার চোখ চকচক করে কি? মা বলেন হ চকচক করে। বড় টাকার লোভ মানুষটার। একটা পুইল্যা খেঁতা লইয়া শহরে আইছিল, আমার বাপে তারে ডাক্তারি পড়াইছে। আমার বাপের টেকা দিয়া ডাক্তারি পইড়া হে ডাক্তার হইছে। এহন পুরানা কথা বেবাক ভুইলা গেছে। এহন আমারে শাতায়। বাবা কি ভেবেছিলেন মনিরুদ্দিন মুন্সির করুণা জুটলে গ্রাম থেকে ধান বেচা টাকা এনে মেডিকেল ইস্কুলের খরচ পোষাতে হবে না, সে কারণেই তিনি পিছু নিয়েছিলেন মনিরুদ্দিন মুন্সির?
আরে না, মা বলেন, বাড়ি থেইকা তর বাপে কিছুই আনে নাই। বরং টেকা আরও বাড়িত পাডাইছে। তর বাপের আর খরচ কি ছিল, বিড়ি সিগারেট খায় নাই, পান জরদা খায় নাই। মেডিকেলে বৃত্তি পাইছে, লেখাপড়ার অত খরচ লাগে নাই।
তাহলে বৃত্তির টাকায় লেখাপড়ার খরচা চলেছে বাবার, আর জায়গির বাড়িতে চলেছে থাকা খাওয়া। ব্যস। কারও কাছে হাত পাতার দরকার পড়েনি!
হাতখরচ আছে না? আমার বাজানে তারে কত খাওয়াইছে। বাজান একটা নাপিতের দুকান কিনছিল, হেইডার ভাড়াডা তর বাপেই নিত। বিয়ার পরে বাজান তারে ঢাকা লইয়া গিয়া স্যুটের কাপড় কিইনা দিছে। নাস্তা পানি খাওয়ার টেকা বাজানে তারে কম দিছে! বৃত্তির টেকা হে দেশের বাড়িতেই পাডাইছে। বইখাতা যা লাগে আমার বাজানই তারে কিইনা দিছে।
আমার বাজানরে দুইবেলা কদমবুসি কইরা তর বাপে কইত–আপন বলতে আমার কেউ নাই। দূর গেরামে বাবা থাকেন, বড় গরিব। যদি কিছু না মনে করেন, আপনেরেই আমি বাবা ডাকব।
মনিরুদ্দিন মুন্সি অনুমতি দেন তাঁকে বাবা ডাকার। রজব আলীকে বাড়িতে এনে মাছ ভাত খাওয়ান, খাইয়ে দাইয়ে পকেটে টাকা গুঁজে দিয়ে বলেন–ভাল মন্দ খাইও। সম্পর্ক গড়াতে গড়াতে এমন হয় যে, মুন্সির বাড়িতে রজব আলীর আনাগোণা বেড়ে যায়। ঈদুল ওয়ারা সন্ধেয় যখন গৃহশিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করেন, রজব আলী জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখেন তাঁকে। হারিকেনের চিমনির ওপর কাগজ আটকে রাখেন গৃহশিক্ষক, যেন অন্ধকারে জানালায় দাঁড়িয়ে রজব আলী মুখে আলো পড়া ঈদুল ওয়ারাকে মনের আশ মিটিয়ে দেখতে পারেন। রজব আলী দেখেনও। ঈদুল ওয়ারার লেখাপড়া করার বিষম শখ, গড়গড়িয়ে পড়েন, গোটা গোটা অক্ষরে মুখস্ত করা ইতিহাস-বিদ্যা লেখেন খাতায়।
লিকলিকে মেয়েটিকে বিয়ে করার প্রস্তাব রজব আলীই পাড়েন সরাসরি মুন্সির কাছে। ছেলে দেখতে শুনতে ভাল, আদব কায়দা জানেন, ডাক্তারি পড়েন, মনিরুদ্দিন মুন্সি রজব আলীর আবেদনে সাড়া দেন। মেয়েকে লাল সিল্কের শাড়ি পরিয়ে কিছু পড়শিকে পোলাও মাংস খাইয়ে, বিয়ে পড়িয়ে দেন। নাক ভোঁতা কালো মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় এক নাক খাড়া ফর্সা ছেলের সঙ্গে।
মোক্তার বাড়ির পাট চুকিয়ে রজব আলী এসে ওঠেন মুন্সির বাড়িতে। মুন্সি তাঁর মেয়ে আর ঘর জামাইর জন্য চালা ঘর, যে ঘরটিতে জায়গির ছেলেরা থাকতেন, গুছিয়ে দেন। ঈদুল ওয়ারাকে পড়াতেন ওঁরা, বিয়ে হওয়ার পর পড়ালেখার পাট চুকেছে, ওঁরাও বিদেয় হয়েছেন। রজব আলীর এ বাড়িতে এসে একধরনের স্বস্তি হয়, জায়গির বাড়ির আর এ বাড়ির খাওয়া দাওয়ায় আদর যত্নে বিস্তর তফাৎ। ও বাড়িতে ছেলে পড়িয়ে থাকা খাওয়া মিলত। ক্ষিদে কমত বটে, তৃপ্তি হত না। এ বাড়িতে শাশুড়ি কোরমা, কালিয়া, দোপিঁয়াজা পাতে দিয়ে নিজে হাতপাখায় বাতাস করেন। শ্বশুর শাশুড়ি আর বাড়ি ভর্তি শালা শালির আদর পেলে, বউ যেমনই হোক, চলে। শহরে এক ঘর আত্মীয়ের দরকার ছিল রজব আলীর। শরীর ভাল থাকে, মনও। যে চালা ঘরটি ছেড়ে দিয়েছিলেন মনিরুদ্দিন মুন্সি একদা তাঁর মেয়ে জামাই হবু ডাকতার খাঁড়া নাকের রজব আলীকে, সে ঘরেই জন্ম হয় আমার দাদার, ছোটদার, আমার। দাদারা জন্মালে ঘরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আল্লাহুআকবর বলে পাড়া শুনিয়ে আযান দিয়েছেন নানা। আমার বেলায় আযানের দরকার পড়েনি, মেয়ে জন্মালে আযান দিতে হয় না। সাত দিনের দিন জাঁক করে হাইট্টারা হল আমার। দাদারা দেয়ালে মোমবাতি জ্বেলে বাড়ি আলো করেছিলেন। বাবার বন্ধুরা নানা রকম উপহার নিয়ে এসে আয়না বাবুর্চির হাতের চমৎকার খাবার খেয়ে গেলেন। হাইট্যারার দিন আঁতুড় ভাঙেন মা, ঘরদোর কাপড় চোপড় ধোয়া হয়, গোসল টোসল করে পয় পরিষ্কার হয়ে আগের জীবনে ফেরেন।