পরের রাতও ঘন হতে থাকে। বাবা বাড়ি ফেরেন না। মা ছোটদাকে ঘুম থেকে তুলে বললেন চল। যেমনে আছস, চল।
ছোটদার হাত ধরে টর্চ জ্বেলে অন্ধকার পুকুরঘাটের দিকে হনহন করে হাঁটেন মা। বড় রাস্তায় একটি রিক্সা জোটে, সেটি করেই পনেরো নম্বর পচা পুকুর পাড়ের বাড়িতে মাঝরাতে এসে থামেন। এক বুড়ো, খালি গা, লুঙ্গি পরা, বারান্দার চেয়ারে বসে হাওয়া খাচ্ছিলেন বাইরের, খনখনে গলায় বললেন–এত রাইতে কেডা?
— এইডা কি চাকলাদারের বাড়ি? মা জিজ্ঞেস করেন।
— আমিই চাকলাদার। আপনে কেডা? খনখনে গলা আবারও।
মা বারান্দায় উঠে এসে বলেন–ভাইসাব, আপনের বাড়িতে কি আমার স্বামী আইছে? ডাক্তার রজব আলী?
চাকলাদারের বুকের বেরিয়ে হয়ে থাকা হাড়গুলো নড়ে। তিনি দরজা আগলে বলেন — না আসে নাই।
চাকলাদারের কঙ্কাল এক ধাক্কায় সরিয়ে ভেতরে ঢোকেন মা। বসার ঘর পেরোলেই শোবার। ঘরের বাতি নেবানো, জানালা গলে আসা ল্যাম্পোস্টের আবছা আলোয় দেখেন বিছানায় মশারি টাঙানো। মশারি তুলে মা টর্চ জ্বাললেন হাতের। শুয়ে আছেন বাবা, সঙ্গে রাজিয়া বেগম। রাজিয়া বেগমের বুকের জাম্বুরা দুটো খোলা। বাবা ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠেন। কোনও কথা না বলে দ্রুত কাপড় চোপড় পরলেন, জুতো পরলেন। মা বললেন–চল।
মা আর ছোটদার পেছন পেছন হেঁটে বাবা রিক্সায় উঠলেন। কেউ কারও সঙ্গে কোনও কথা বলেননি সারা পথ। সারা পথ রিক্সায় মা’র কোলে বসে ছোটদা কেবল হাতের টর্চটিকে একবার জ্বালাতে লাগলেন, একবার নেবাতে।
বাড়িতে আমি তখন ঘুম থেকে জেগে মা মা করে কাঁদছি। কান্না থামাতে দাদা তাঁর বাঁ হাতের কণে আঙুল ঢুকিয়ে রাখেন আমার মুখে, সেটি চুষতে চুষতে আমার কান্না থামে। ছোটদার হাতে তখনও টর্চ, জ্বলছে নিবছে।
খ.
নান্দাইল থানার পাঁচরুখি বাজারের দক্ষিণে মাদারিনগর নামের অজপাঁড়াগাঁয়ে জনাব আলী কৃষকের ঘরে বাবার জন্ম। কৃষকের কিছু ধানি জমি ছিল, কিছু গরু ছিল। আমার কৃষক বড়দাদা, খাটুরে জোয়ান, বলদ জুড়ে ক্ষেতে লাঙল দিতেন, বাবাকে সঙ্গে যেতে হত ফুট ফরমাশ খাটতে, বাবাও লাঙল দেবেন, কৃষকের ছেলে কৃষক হবেন, ক্ষেতে বীজ ছড়াবেন, বীজ থেকে চারা হবে, চারা বড় হয়ে ধান হবে, ধান পাকবে, ধান কেটে গোলায় তুলবেন কিন্তু এক রাতে বাড়ির দাওয়ায় হুঁকো টানতে টানতে জাফর আলী সরকার, বড়দাদারও বাবা, বলেন–ও জনাব আলী, ছেড়ারে পাঠশালায় দেও।
পাঠশালায় দিতাম কেরে, বাড়িত কাম নাই! খাটুরে জোয়ান গামছায় পিঠের মশা তাড়াতে তাড়াতে বলেন।
পাঠশালায় গেলে বিদ্বান অইব। দশটা লুকের খাতির পাইব। লেকাপড়া শিইখা চাকরিবাকরি করব। দেহ না, খুশির বাপ লেহাপড়া করছে, শহরে চাকরি করে, গেরামের বেবাক জমি কিইনা লইতাছে। জাফর আলী সরকার, মাদারিনগর পাঠশালার মাস্টার, ছেলের কাছে নরম স্বরে কথাটি পাড়েন।
— আছিলাম বর্গা চাষী। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুড়াইত। দিন রাইত খাইটা আইজ নিজের কিছু জমি করছি। রজব আলী কাইম কাজ শিখতাছে। এই তো আর কয়দিন পরে নিজেই লাঙল ধরব। বাপ বেটায় মিইলা কাম করলে আরও কিছু জমি কিনন যাইব। জনাব আলী ছাউনি খসে পড়া গোয়াল ঘরের দিকে চেয়ে বলেন।
— জনাব আলী, দিন বদলাইতাছে। গেরামের শশীকান্ত, রজনীকান্ত, নীরদ, জোতির্ময় কইলকাতা গেল লেকাপড়া করতে। লেকাপড়া জানা মানুষরে লুকে মান্য গইন্য করে। ছেড়া তুমার লেকাপড়া জানলে লুকে তুমারেও মান্য করব। রজব আলী পাঠশালা থেইকা দুফুরে ফিইরা গরু চড়াইল, ফুট ফরমাইস খাটল।ওরে তো আর কইলকাতা দিতাছ না।
জাফর আলী হুঁকো দিয়ে জনাব আলীর হাতে, পিঠে হাত বোলান ছেলের — জনাব আলী, দুইডা দিন চিন্তা কর।
ফকফকে জ্যোৎস্না উঠোনে। রজব আলী গরুর গামলায় নুন পানি ঢালেন আর আড়ে আড়ে দেখেন বাপ দাদাকে। খুশিতে মন নাচে তাঁর।
জাফর আলী হাঁক ছাড়েন–কইরে, রজব আলী কই!
রজব আলী দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ান, নুন মাথা হাত লুঙ্গিতে মুছে।
–কি রে, পাঠশালায় পড়বি?
সজোরে মাথা নেড়ে রজব আলী বলেন–হ।
জনাব আলীর হুঁকো টানার শব্দ হয়, ফরৎ ফরৎ।
পাঁচরুখি বাজার থেকে শাদা জামা, নতুন একখানা ধুতি, বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় কিনে আনেন জাফর আলী নাতির জন্য। নাতি পরদিন সকালে পেট ভরে পান্তা খেয়ে, গাভির দুধ দুইয়ে, খড় কেটে গামলায় ভরে, পুকুরে নেয়ে এসে নতুন ধুতি জামা পরে হাতে কলাপাতা আর বাঁশের কলম নিয়ে ক্ষেতের আল বেয়ে খালি পায়ে পাঠশালায় যান। মাস্টার বলেন একে এক এক, ছাত্ররা তারস্বরে বলে একে একে এক। দুইয়ে একে দুই, তিনে একে তিন। রাতে চাটাই পেতে বসে বর্ণপরিচয় বইয়ের পাতা ওল্টান রজব আলী, তাঁর একদমে পড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে পুরো বই। কাঠাঁল পাতার ওপর সর্ষের তেল ঢেলে কুপির ওপর ধরে রাখেন, কুপির কালো ধোঁয়া বেরিয়ে তেল জমাট করে, সেই জমাট তেলকালি পানিতে গুলে রজব আলী কালি বানান, বাঁশের কলম ওই কালিতে ডুবিয়ে কলাপাতায় অ আ লেখেন। পরদিন কখন সকাল হবে, কখন আবার পাঠশালায় যাবেন, এই উত্তেজনায় তিনি ছটফট করেন। জনাব আলী ধমক লাগান–কুপি নিভা রজব আলী, তেল খরচা অইব।
মাসিক পাঁচ টাকা বেতনের মাস্টারি জাফর আলীর। পাচরুখি বাজার থেকে এক শিশি কেরোসিন তেল কিনে বাজারের তাবৎ লোককে বলে আসেন, নাতিরে পাঠশালায় দিলাম, নাতি লেকাপড়া করে রাইতে, কুপ্পিতে বাড়তি তেল লাগে। রজব আলী দেখবা বড় হইয়া ইংরেজের অপিসে কেরানি হইব।