শেখ মুজিব নিহত।
কেবল তাই নয়, পরিবারের প্রায় সবাইকে কারা যেন গুলি করে মেরে রেখেছে তাঁর বষিনশ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে। এ কি হল! এ ও কি সম্ভব! কপালের শিরা চেপে বসে থাকেন বাবা। ছোটদা বাড়ি থাকলে ঠোঁট ছোট করে বসে থাকতেন বারান্দায়। দাদা হয়ত বলতেন — শেখ কামাল আর শেখ জামাল, মুজিবের দুই ছেলে, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে মানুষেরে জ্বালাইয়া খাইছে। পকেটে পিস্তল নিয়া ঘুরত। বড় বাড় বাড়ছিল, মানুষ কত আর সহ্য করব।
মা ঘর ময় হাঁটেন অস্থির, আর থেকে থেকে বলেন — এই টা কি অমানুষের মত কাজ। ছেলে ছেলের বউ এতটুকু বাচ্চা ছেলে রাসেল সবাইরে মাইরা ফেলল! তারা কি দোষ করছিল? কী পাষন্ড গো বাবা। কী পাষন্ড!
— এখন কি দেশটা আবার পাকিস্তান হইয়া যাইব?
প্রশ্নটি বাবার দিকে ছুঁড়ে দিই। কোনও উত্তর ফেরত আসে না। তিনি কপালের শিরা চেপে তখনও।
— মা, কও না কেন, দেশটা কি পাকিস্তান হইয়া যাইব নাকি!
যেন বাবা মা সব উত্তর হাতে বসে আছেন। তাই কি হয় কখনও! মা বলেন — বংশ নির্বংশ কইরা ফেলাইছে রাইত দুপুরে। আল্লায় এদের বিচার করবেন।
বাবা তখনও শিরা চেপে। এরমধ্যে সাত সকালে বাবার কাছে পাড়ার দু’জন লোক আসেন। মাখন লাল লাহিড়ী আর এম এ কাহহার, মুন্নির বাবা। বৈঠক ঘরে বসে সকালের চা খেতে খেতে তাঁরা দেশের ভবিষ্যত নিয়ে কঠিন কঠিন কথা বলেন। দরজার আড়াল থেকে শুনে আমি তার কতক বুঝি, কতক বুঝি না। বড়রা আমাকে তাঁদের আলোচনায় টানেন না আমি যথেষ্ট বড় হইনি বলে অথবা আমি মেয়ে বলে, কে জানে!
ঘরে টানানো তর্জনি তোলা শেখ মুজিবের ছবিটির দিকে তাকিয়ে আমার বড় মায়া হতে থাকে। মানুষটি কাল ছিল, আজ নেই–বিশ্বাস হতে চায় না। রেডিওতে আর জয় বাংলা গান বাজে না। আমার ভয় হতে থাকে। আমি দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকি। এই বুঝি আবার যুদ্ধ লাগল, এই বুঝি আমাদের মোষের গাড়ি করে আবার পালাতে হবে কোথাও! এই বুঝি শহরের রাস্তায় কামান চলবে, এই বুঝি গুলি করে যাকে ইচ্ছে তাকে মেরে ফেলা হবে। এই বুঝি আমার শরীরে টর্চ ফেলে দেখবে কেউ, ঠান্ডা একটি সাপ ঢুকে যাবে আমার মাংসের ভেতর, হাড়ের ভেতর, রক্তে, মজ্জার ভেতর।
সময় এক রাতেই পাল্টে গেছে, শেখ মুজিবের নাম নেওয়া বারণ। জয় বাংলা বলা বারণ। আমার শ্বাস কষ্ট হতে থাকে। বৈঠক ঘর থেকে বাবার থেকে থেকে কী যে হইব ভবিষ্যত! হামাগুড়ি দিয়ে আসতে থাকে ভেতর ঘরে।
কী যে হইব ভবিষ্যত, বাবা পরদিনও বলেন, আবু আলী, দোকানের কর্মচারি, বাবার ডান হাত, দু’লাখ টাকা চুরি করে পালাল যেদিন ফার্মেসি থেকে।
মা বলেন কৃপণের ধন পিঁপড়ায় খায়, বউ পুলাপানরে শাতাইয়া টাকা জমাইলে ওই টাকা আল্লাহ রাহে না। কুনো না কুনো ভাবে যায়ই। কত কইছি আমার মার বেবাক সহায় সম্পদ সব লুট হইয়া গেছে, লুট ত এই বাড়ি থেইকাই হইল। তুমি কিছু সাহায্য কর মারে। ফিইরা চাও নাই। এহন দেহ টাকা কেমনে যায়! আল্লার বিচার।
দেশ থমথম করে, তবু মাদারিনগর থেকে রিয়াজুদ্দিন আর ঈমান আলী আসতে থাকেন, ওঁরা টাকা নিয়ে যান খতি ভরে, জমি কিনবেন। মা ওঁদের পাকঘরে বসিয়ে গামলা ভরে ভাত দিতে থাকেন, থালের কিনারে অল্প ডাল, আর পোড়া শুকনো মরিচ। ওঁরা শুকেনো মরিচ ডলে ভাত খেতে থাকেন। মা ওঁদের ঘুমোতে দেন মেঝেয়, মশারি ছাড়া। মশার কামড়ে ফোলা মুখ ফুলে ওঠে ওঁদের।
বাবা রাতে ফিরে জিজ্ঞেস করেন — ওদেরে খাওয়া দিছ?
মা গলায় রসুন তেলের ঝাঁজ মিশিয়ে বলেন — দিছি না? ঠাইস্যা খাইছে।
আমি লেখাপড়া করতে থাকি। পাঠ্যের নিচে অপাঠ্য। বাবা স্বপ্ন দেখতে থাকেন। মেয়ে পড়ালেখা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। আমি ছাদে উঠতে থাকি লুকিয়ে। পাড়ার কারও কারও চুলের ঢেউ, গালের টোল, চোখের হাসি, ঠোঁটের অভিমান দেখতে আমার ভাল লাগতে থাকে। সন্ধে হলে ছেলে দেখার পাট চুকিয়ে ছাদ থেকে নামি। ঘরে বসে কখন অমাবস্যা, কখন পূর্ণিমা আকাশ কালো বা আলো করে তার খবর রাখা সম্ভব হয় না। চাঁদের সঙ্গে বহুকাল আমার হাঁটা হয় না।
মা পীরবাড়িতে যেতে থাকেন। অন্ধকারে গা ঢেকে আমান কাকা আসতে থাকেন বাড়িতে। মা শরীর-মন ঢেলে নছিহত করে যেতে থাকেন। কাপড় চোপড় সুটকেসে গুছিয়ে খাটের তলায় রেখে দিয়েছেন মা। খুব শীঘ্র তিনি চলে যাবেন আল্লাহতায়ালার পাঠানো বোররাখে চড়ে, মক্কায়। প্রথম ব্যাচে নিজের নাম তোলার জন্য মা পীরের কাছে তদবীর করতে থাকেন। আমার আর মনে হতে থাকে না যে মা মরে গেলে আমিও মরে যাব।
বাবা ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে আবার বদলি হয়ে চলে এসেছেন ময়মনসিংহে। মেডিকেল কলেজে ছাত্র পড়ানোর চাকরি করতে থাকেন। গাধা পিটিয়ে মানুষ করার অধ্যাপক তিনি। বিকেলবেলা আরোগ্য বিতানের ডাক্তার লেখা ঘরটিতে বসে রোগী দেখতে থাকেন। রোগীদের ভিড় বাড়তে থাকে।
চাকলাদারের সঙ্গে তালাক হয়ে যাওয়ার পর রাজিয়া বেগম ঘন ঘন লোক পাঠাতে থাকেন বাবার কাছে।
ছোটদা কোথায় আছেন, মরে আছেন না বেঁচে, কেউ আমরা জানি না। বাবা ছোটদার বিছানা পেতেই রাখেন, হঠাৎ একদিন তিনি ফিরে আসবেন আশায়।
দাদা ঘরের আসবাবপত্র বানাতে থাকেন আর শহর ঘুরে পান পাতার মত মুখ এমন একটি সুন্দরী মেয়ে খুঁজতে থাকেন বিয়ে করবেন বলে।
আমি বড় হতে থাকি।