বাবাকে যেহেতু প্রশ্ন করার বুকের পাটা নেই, বড়াদাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম হিন্দুদের জিনিস তুমরা লুট করছিলা নাকি!
বড়দাদা বারান্দায় লোহার চেয়ারে বসে উঠোনের হাঁসমুরগির হাঁটাচলা দেখছিলেন। যেন হাঁসমুরগিই জগতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রাণী, যেন হাঁসমুরগির বাইরে মানুষ এবং তাদের যে কোনও জিজ্ঞাসা নিতান্তই ছেঁদো। প্রশ্নটি তাঁর গা ঠেলে ঘোর ভাঙিয়ে আবার করলে তিনি উত্তর দেন — বিহারিরা রাস্তায় ফালাইয়া জিনিসপত্র পুড়াইয়া দিতাছিল, রাস্তা থেইকা টুকাইয়া কিছু জিনিস বাড়িতে আইনা রাখছিলাম।
— কেডা আনছিল? বাবা ? বাবা আনছিল কি না কও? আমি চেপে ধরি বড়দাদাকে।
বড়দাদা হাঁস মুরগির দিকে গম ছুঁড়ে দিতে দিতে বলেন — ওই আমরাই।
ওই আমরাই। এরকম ওই হোথা উত্তর আমাকে স্বস্তি দেয় না।
বাড়ি লুট হওয়ার খবর পেয়ে বাবা বাড়ি এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন, কনুই ভেঙে দু’বাহুতে দুটো হাত রেখে। আমার ভাবতে ভাল লাগে বাবা অনুতাপ করছেন।
আমার দেখতে ইচ্ছে করে অনুতাপ করা বাবার মুখখানা। কেবল বাবার গর্জন শুনেছি, অহংকার দেখেছি। এত অহংকার, মানুষকে, আমার মনে হয় অমানুষ করে ফেলে সময় সময়।
দাদা ফিরে এলে খবর দিই — লুটের মাল ফেরত নিছে মানুষেরা।
ছোটদা ফিরে এলেও বলি।
বাড়ি থমথম করে। বাবা দাঁড়িয়েই থাকেন বারান্দায় হাতদুটো হাতে বেঁধে। স্তব্ধতা ভেঙে কাচ-ভাঙা গলায় মা বলেন, বাবা যেন শুনতে পান এমন দূরত্বে দাঁড়িয়ে, — কী দরকার আছিল পচা গুড়ের ড্রাম লুট করার! পাপের শাস্তি আল্লায়ই দেন। মাঝখান থেইকা আমার জিনিস গেল। আমার সেলাই মেশিনডা। নিজে টাকা জমাইয়া কিনছিলাম।
দুঃসময় আসে যখন, ঝাঁক বেধেঁই আসে। বাড়িটি লুট হওয়ার পর ঠিক পরের দিনই দাদাকে রক্ষীবাহিনীরা রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে গেল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রক্ষীবাহিনী নামে একটি বাহিনী বানিয়ে তাদের হাতে সন্ত্রাস কমানোর দায়িত্ব দিয়েছেন শেখ মুজিব। তারা নানা জায়গায় ঘাঁটি গেড়ে, ব্যস, রাস্তাঘাটে যাকেই সন্দোহ হচ্ছে, ধরে নিয়ে হাত পা বেঁধে পেটাচ্ছে। ভাজা মাছ উল্টে খেতে না জানা শাদাসিধে দাদাকেও। দাদাকে ছুটিয়ে আনতে গিয়ে ফেরত এলেন বাবা একা। পনেরোদিন একটানা পিটিয়ে সন্ত্রাসের কোনও হদিশ না পেয়ে ওরা ছেড়ে দিল দাদাকে। ঘাঁটি থেকে ফেরত এসে দাদা ভীষণ বিরোধী হয়ে উঠলেন শেখ মুজিবের। বলে বেড়ালেন — পাকিস্তান আমলই ভাল ছিল। রাস্তাঘাটে নিরাপত্তা ছিল।
যারা শেখ মুজিবকে পছন্দ করত, তারাও বলতে শুরু করেছে, এ কেমন সরকার, রক্ষীবাহিনী দিয়া দেশের নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার করতাছে!
খ.
এরকম কথা বছর কয়েক ধরে চলে। অসন্তোষ বাড়ে মানুষের। শেখ মুজিব বাকশাল নামে রাজনৈতিক দল তৈরি করে বাকি সব দল নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন।
— এ কেমন সরকার যে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়, মানুষ মরে না খাইয়া। বাবা বলেন।
টুপি দাড়ি অলা লোকেরা গর্ত থেকে বেরিয়ে চেঁচাতে লাগল — এইরম স্বাধীনতার কোনও মূল্য নাই। দেশটারে আবার পাকিস্তান বানাইতে হইব।
বড় মামা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন — দেশের যে কী হবে বুঝতে পারতাছি না। পাকিস্তান আমলেও যা হয় নাই এই দেশে তাই করতাছে এই সরকার। শবে বরাত পালন করছে ঘটা কইরা বঙ্গবভনে। পাকিস্তান আমলেও শবে বরাত পালন করা হইত না। ইসলামি সম্মেলনে গেছে মুজিব। রাশিয়া কত সাহায্য করল যুদ্ধের সময়, এহন মুজিব সরকার ইসলামি বিশ্বের খাতায় বাংলাদেশের নাম লেখাইছে। ভারতের বিরুদ্ধেও কথা কয় সরকার। ভারতের আর্মি না আসলে দেশ স্বাধীন হইত নাকি!
আমি রাজনীতির বেশি কিছু বুঝি না। যখন শেখ মুজিবের সাতই মার্চের ভাষণ বাজে রেডিও তে, এটুকুই বুঝি আমার ভাল লাগে। রোমকূপ দাঁড়িয়ে যায় উত্তেজনায়। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম যেন নিছক স্লোগান নয়, রক্তে তুফান তোলা কবিতা। ইস্কুলে গানের ক্লাসে গাই জয় বাংলা বাংলার জয়। এ তো নিছক গান নয়, অন্য কিছু। বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠার কিছু। পাড়ায় ক’দিন পর পরই প্যান্ডেল খাটিয়ে নাচ গানের অনুষ্ঠান হয়, ছুটে যাই মাইকে গানের আওয়াজ পেলেই। হারমোনিয়াম বাজিয়ে ছেলে মেয়েরা গান করে, নাচে। কী যে সুন্দর দেখায় ওদের! গানগুলো বুকের ভেতর কাঁপিয়ে দেয়। ক্ষুদিরামের গান শুনলেও এমন হত। ক্ষুদিরামের গল্প বলতেন কানা মামু, দেশ স্বাধীন করার জন্য এক ছেলে ইংরেজ বড়লাটকে বোমা মেরে ফাঁসিতে ঝুলেছিল। আমারও ক্ষুদিরামের মত হতে ইচ্ছে করে। অমন সাহসী, অমন বেপরোয়া।
হঠাৎ একদিন, সে সময় হঠাৎই, পুরো শহর থম থম করে। পাড়ার লোকেরা রাস্তায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে। যেন পৃথিবী ধ্বসে পড়ছে আর দু’মিনিট পর এ পাড়ার মাথায়। কারও কারও কানে রেডিও। মুখ শুকনো। চোখ গোল। কি হল কি হল। আবার কী! কান পেতে রেডিও শোনার দিন তো শেষ একাত্তরে, চারটে বছর কেবল পার হল, এর মধ্যে দুর্ভিক্ষ গেল, ভাঙা সেতু ভাঙা রাস্তা ঘাট সারাই হচ্ছে, কী হল তবে আবার! দেশ থমথম করলে লোকের অভ্যেস রেডিওতে বিবিসি শোনা। দেশের খবরে এ সময় কারও আস্থা থাকে না। লোকে যা করে, বাবাও তা করেন। আমাকে রেডিওর নব ঘোরাতে বলেন বিবিসির খবর ধরতে, বড় একটি দায়িত্ব পেয়ে খানিকটা গৌরব হয় আমার। আমাকে কখনও পড়ালেখা ছাড়া আর কিছু করার আদেশ বাবা দেন না। জগত সংসারের অন্য কিছুতে আমাকে ডাকা হয় না। নব ঘোরানোর কাজ সব দাদার কিংবা ছোটদার। আমার কেবল দূরে দাঁড়িয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা। দাদা নেই বাড়িতে, চাকরির কারণে শেরপুর গেছেন দু’দিনের জন্য। ছোটদা তো নেইই। নেই বলে আমি আজ নতুন রেডিওর নব ঘোরানোর দায়িত্ব পেয়েছি। বিবিসির কাছাকাছি এলে বাবা বলেন থাম থাম। শব্দ ভেসে আসে ঈথারে, ভাঙা শব্দ, অর্ধেক উড়ে যাওয়া শব্দ।