যে আগুন এতকাল ওরা আমার ভেতর পুরেছে, সেই আগুনই চতুর্গুণ ফুঁসে উঠছে আমার ভেতরে। আমি বাতাসের আগে আগে আবার পাগলা দুলালের মত হাঁটছি। আগুনই আমাকে সফর আলীর বাড়ি থেকে আলো হয়ে পথ দেখিয়ে নেবে গেঁতুর বাবার উঠোনে, সে উঠোনের বাতাসে আমি আমার কাতরানোর শব্দ পাব। সেই কাতরানো, এক উঠোন মানুষের সামনে, তালাক হয়ে যাওয়া আমার কাতরানো।
এটুকু ভেবে, আমি শ্বাস নিই। গেঁতুর মা গাছের গুঁড়ির মত বসে আছে বারান্দায়। মশা চরকির মত ঘুরছে তার মাথার ওপর। তার কুঁকড়ে থাকা শরীরটির দিকে চেয়ে আমি আর তার জায়গায় নিজেকে না বসিয়ে নিজের জায়গায়, চৌকাঠে, নিজেকে এভাবেই বসিয়ে রেখে গেঁতুর বাবার কুতকুত খেলার বয়সী বউ হই নিজে, গেঁতুর বাবার দায়ের কোপ আমাকে ফালি ফালি করে কাটে। রক্তাক্ত আমি উঠোন পড়ে কাতরাচ্ছি আর উঠোনে জড়ো হওয়া মানুষ আমাকে নিঃশব্দে দেখছে হাতে কনুইয়ের ভর রেখে, মাথার পেছনে হাত রেখে, দেখছে বায়োস্কোপের শেষ দৃশ্য। আমি তাবৎ দর্শককে চমকে দিয়ে গেঁতুর বাবার হাত থেকে দা ছিনিয়ে নিয়ে চামড়া কাটছি তার গায়ের, কেটে লবণ ছিটিয়ে দিচ্ছি। উঠোনের লোকেরা পাড়া কাঁপিয়ে চেঁচাচ্ছে, বলছে আমি পাগল, বদ্ধ পাগল।
হা পাগল!
মণির গায়ের চামড়া ছিলে মা লবণ মাখবেন বলেছিলেন ও চিংড়ি মাছের মাথা থেকে গু ফেলেনি বলে। আমান কাকা চিংড়ির মালাইকারি খেতে চেয়েছিলেন, খেতে গিয়ে তাঁর বমি হয়ে যায়। মা ক্ষেপে একেবারে ভূত হয়ে যান মণির ওপর। মণি সত্যি সত্যি ভাবছিল ওর চামড়া ছিলে লবণ মাখা হবে। আমিও। মণিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম চামড়া ছিইলা লবণ মাখলে কি হয়রে মণি?
–যন্ত্রণা হয় খুব। মণি বলেছিল, আতংকে নীল হয়ে ছিল ওর সারা মুখ।
ওর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে, ক’টি নিশুত রাতে ওর সঙ্গে শরীর শরীর খেলা খেলেছিলাম, মনে পড়ে। আলগোছে সরিয়ে নিই হাত। মনে মনে বলি, মণি তুই ভুলে যা ওইসব দিনের কথা, এ বাড়ি থেকে চলে গিয়ে তোর স্বপ্নের একটা ঘর তোল, তোর মা’কে আর চিনিকে নিয়ে সুখে থাক, কোনও ভরা শস্যের মাঠের কাছে থাক। যদি নদী থাকে ধারে কাছে, জলের মধ্যে কি করে সূর্য ডোবে দেখিস, আকাশে যে কি চমৎকার রং ফোটে তখন মণি! দেখিস তোর মন ভাল হবে।
মণির গায়ের চামড়া শেষঅবদি তোলেননি মা, লবণও মাখেননি। তবে কাউকে কাউকে এভাবে আমি মনে মনে যন্ত্রণা দিই। শরাফ মামাকে, আমান কাকাকে। আজ ইচ্ছে করছে গেঁতুর বাবাকে। কেবল ইচ্ছেই সার, মাঝে মাঝে ভাবি, কতটা আর পারি আসলে আমি! লিকলিকে এক মেয়ে, ঝড়ো হাওয়ায় হেলে পড়ি, আমার কি সাধ্য আছে রুখে দাঁড়াতে! মাঝে মাঝে এও ভাবি, না থাক, ইচ্ছেটুকু আছে তো!
১৯. যুদ্ধের পর
ক.
পাড়ার খালি পড়ে থাকা বাড়িগুলোয় হিন্দুরা ফিরে আসছে। কলকাতার শরণার্থী শিবির থেকে ফিরে আসছে নিজের দেশে, ফেলে যাওয়া ঘরে। জিনিসপত্র লুট হয়ে গেছে সব। খাঁ খাঁ করা উঠোনে রাস্তার নেড়িকুকুরগুলো শুয়ে ছিল। এখন মানুষে কলকল করছে। ছাদের রেলিংএ থুতনি রেখে ওদের ফিরে আসা দেখি। শুকনো ব্রহ্মপুত্রে যেন জোয়ার এসেছে। মরা বাগান ফুলে রঙিন হয়ে আছে। হারানো জিনিসের জন্য ওদের কাউকে শোক করতে দেখি না। নিজের ভিটেটুকু পেয়েই ওরা খুশি। এর মধ্যেই কীর্তন গাইতে শুরু করেছে কোনও কোনও বাড়ি। মেয়েরা সন্ধের বাতি নিয়ে উলু দিচ্ছে ঘরে ঘরে। আস্ত একটি শ্মশান আজ গা ঝেড়ে জাগল।
ওরা চলে আসার দিন সাতেক পর আমাদের কালো ফটক খুলে কাঁধে বন্দুক নিয়ে একদল মুক্তিযোদ্ধা আসে, পেছনে পনোরো ষোলজন মুখ চেনা পাড়ার লোক। অতিথিদের আমন্ত্রণ জানাই বাড়ির ভেতর হেসে, ওদের কিন্তু কারও মুখে হাসি নেই যেন জন্মের শত্তুরের বাড়ি ওরা বেড়াতে এসেছে। ওরা এ ঘরে ও ঘরে হাঁটে, আর বলে কই লুটের মাল কই! যার যা মাল উঠাইয়া লও।
পাড়ার মুখ চেনা লোকেরা এক এক করে আমাদের কাঁসার বাসন, পেতলের কলসি, চেয়ার টেবিল উঠিয়ে নিয়ে যায়। মা সেলাই মেশিনের ছিদ্রে তেল ঢালছিলেন, তেলের কৌটো হাতেই ধরা থাকে, মেশিনটি আলগোছে একজন কাঁধে উঠিয়ে নেয়। হতবাক দাঁড়িয়ে থাকি আমি, মাও।
বাড়ি লুট করে ওরা চলে যাওয়ার পর মা বলেন যেমন কর্ম তেমন ফল। ঠিকই আছে। কথাটি বাবার উদ্দেশ্যে বলেন মা, আমি বুঝি। গ্রাম থেকে ফিরে আসার পর বাড়িতে নতুন কিছু জিনিস দেখে মা বলেছিলেন এইগুলা কি কিনলা নাকি? কিনলা কিনলা পুরান জিনিস কিনলা ক্যান? পচা গলা গুড়ের ড্রাম দিয়া করবাটা কি!
বাবা মোজা খুলে জুতোর ভেতর ঢুকিয়ে রাখছিলেন, কথা বলছিলেন না।
— নাকি, হিন্দু বাড়ি থেইকা লইয়া আইলা! মা নাক সিঁটকে বলেছিলেন।
বাবা তারও উত্তর দেননি।
গুড়ের ড্রামগুলো দেখে আমিও অবাক বনেছিলাম। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল বাবা অন্যের বাড়ি থেকে জিনিসগুলো না বলে নিয়ে এসেছেন। যে বাবা প্রদীপ নামের এক হিন্দু ছেলেকে যুদ্ধের সময় বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন, আলম নাম নিয়ে ছেলেটি যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দিব্যি থেকে গেছে বাড়িতে, বাবা তাকে ওষুধের দোকানে রীতিমত ক্যাশে বসার কাজও দিয়েছেন আর সেই বাবা কি না হিন্দুদের ফেলে যাওয়া জিনিসে লোভ করেছিলেন! একাত্তরে এ বাড়িতে বড়দাদা, রিয়াজউদ্দিন আর ঈমান আলী ছিলেন। এরকমও হতে পারে ঘটনাটি ঘটিয়েছেন ওঁরাই।