দিলরুবা ইস্কুল ছেড়ে দেওয়ার পর আমার সঙ্গী হয়েছিল বই। লাইব্রেরির বইগুলো দ্রুত শেষ হতে থাকে। বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, রবীন্দ্রনাথ যা পাই ছাদে বসে, ছাদের সিঁড়িতে, পড়ার টেবিলে, বিছানায় শুয়ে, পড়ি। বাবা বাড়ি এলেই অপাঠ্য লুকিয়ে পাঠ্য বই ধরি, মূলত মেলে বসে থাকি। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে, চুপি চুপি বাতি জ্বেলে মশারির নিচে শুয়ে অপাঠ্য পড়ি। পাশে শুয়ে বেঘোরে ঘুমোয় ইয়াসমিন। মা মাঝে মাঝে বলেন — সারাদিন কি এত ছাইপাশ পড়স! মুবাশ্বেরা মইরা গেল। একটু আল্লাহর নাম ল এহন। সবারই ত মরতে হইব। মা’র কথার আমি কোনও উত্তর করি না। মা’র আদেশ উপদেশ আমার মাথার ওপর জৈষ্ঠ্যের সূর্য হয়ে বসে থাকে যেন আমাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেবে।
কোরান হাদিসের কথা না মানলে আখেরাতে আর রক্ষে নেই এরকম হুমকি আমাকে অনেক শুনতে হয়েছে। তবে এ যাবৎ হাদিস কাকে বলে আমার ঠিক জানা ছিল না। এখন জানার পর আর ইচ্ছে নেই তলিয়ে জানার। গুয়ের চারিতে জানি গু-ই থাকে, ওতে ঝাঁপ দিয়ে মণি মুক্তা খুঁজে পাওয়ার কোনও কারণ নেই। উইএ খাওয়া বইটিকে দু’হাতে বন্ধ করে রাখি। বইটি থেকে বেরোতে থাকে ঢেকুর, যেন এও গিলেছে বেহেসতের খানা। মা’র পায়ের শব্দে আমি তড়িতে বইটি তুলে তাকে রেখে দিই যেমন ছিল। উইপোকা নিঃশব্দে হাদিসের বই খাচ্ছে, মা জানেন না। মা ব্যস্ত আমান কাকাকে নছিহত করতে। প্রতিরাতে, মা’র অন্ধকার ঘর থেকে ফিসফিস খিলখিল শব্দ শুনি নছিহতের। মা’কে উইপোকার খবর কিছু বলি না। ওদের ক্ষিধে লেগেছে, খাক। আমার কি দায় পড়েছে পোকা মারতে যাওয়ার!
মুবাশ্বেরা মরে গেছে বলে আমি বুঝি না আমাকে কেন আল্লাহর নাম নিতে হবে। আল্লাহর নাম আমার নিতে ইচ্ছে করে না। আমার মনে হয় আল্লাহ ফাল্লাহ সব বানানো জিনিস। কোরান এক অশিক্ষিত লোভী কামুক পুরুষের লেখা, শরাফ মামার মত কোনও লোকের। অথবা ব্রহ্মপুত্রের তীরে যে লোকটি আমার বুক পাছা চেপে ধরেছিল, সে লোকের মত। হাদিস যদি মহাম্মদের বাণী হয়, তবে মহাম্মদ লোকটি নিশ্চয় গেঁতুর মা’র স্বামীর মত, কুৎসিত, কদাকার, নিষ্ঠুর। আল্লাহ আর মহাম্মদে আমি কোনও তফাৎ দেখতে পাই না।
বইটি তাকে তুলে রাখি ঠিকই, কিন্তু মনে আমার রয়ে যায় লক্ষ উই। ভেতরে নিঃশব্দে আমার অক্ষর শব্দ বাক্য জানি না কী কী সব আরও খেয়ে যায়।
বিকেলে গেতুঁর মা আসে। গেঁতুর মা’কে দেখে আমি প্রথম চিনতে পারিনি যদিও ভাঙা গলায় আগের মতই কথা বলে যাচ্ছিল। মা বসে ছিলেন বারান্দার চেয়ারে, হাতে তসবিহর গোটা নড়ছিল, গেঁতুর মা’র কথাও মা শুনছিলেন মন দিয়ে। তসবিহ নড়াতে হলে চাই মন দিয়ে দরুদ পড়া। দুটো কি করে একই সঙ্গে পারেন মা! মা’র সম্ভবত দুটো মন। একটি মন আল্লায়, আরেকটি মন জগতে। মা’র জগতটি আবার বেশ ছোট। দিনে দু’বার সে জগতে ভ্রমণ সারা যায়। গেঁতুর মা হঠাৎ কথা থামিয়ে কাপড় সরাতে শুরু করল। মা’র আঙুল তখন নীল তসবিহর গোটা আগের চেয়ে আরও দ্রুত সরাচ্ছে। তসবিহর গোটা সরে, গেঁতুর মা’র কাপড় সরে। তালে তালে। কাপড় সরিয়ে উরু, পা, পায়ের পাতা উন্মুক্ত করল সে, পোড়া। মা আহা আহা করে উঠলেন। গেঁতুর বাবা নয়, এবারের কান্ডটি করেছেন আরেক লোক, সফর আলি। সফর আলির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বছর দুই হল গেঁতুর মার। সে লোকই চেলা কাঠে আগুন লাগিয়ে পুড়েছে তাকে। কেন? যেহেতু স্বামী সে, স্বামী মাত্রই অধিকার রাখে স্ত্রীকে যা ইচ্ছে তাই করার। আমি এরকম একটি উত্তর দাঁড় করাই মনে মনে। কিন্তু মা এবং গেঁতুর মা’র জবাব ছিল সফর আলি লোকটি একটি ইতর, বদমাশ।
বলতে ইচ্ছে করে মা’কে, সফর আলি কোরান হাদিস মেনে চলে তাই বউ মেরেছে। ঠোঁটের মধ্যে অক্ষরগুলো নাড়াচাড়া করি। শেষ অবদি গিলে ফেলি। অক্ষরগুলো কি সবই উইএ খাচ্ছে! কে জানে!
গেঁতুর মা এ বাড়িতে ঝি-গিরি করতে এসেছে। পোড়া শরীর নিয়ে তার আর বিয়ে হওয়ারও জো নেই। কোনও পুরুষ তাকে আর ভাত কাপড় দেওয়ার জন্য বসে নেই। মা বলেন, তসবিহর গোটা তখন ধীরে ধীরে পার হয়, আমার তো বান্ধা কামের ছেড়ি একটা আছে। আমার আর লাগব না।
মা’র পা দুটো নড়ে। কিসের তালে কে জানে। অন্তরে তাঁর কোনও গোপন সঙ্গীত বাজে সম্ভবত। ময়ুর নাচের তাল। মা পেখম গুটিয়ে রাখেন দিনে, রাতে মেলেন। মা’র দু’পায়ের ফাকে চোখ রেখে আমি গেঁতুর মা’র সন্ধে নামা মুখখানা দেখি ঘরের চৌকাঠে বসে। আবছা অন্ধকারে মা’র হাতের তসবিহর নীল গোটাগুলো জ্বলতে থাকে বেড়ালের চোখের মত।
গেঁতুর মা’কে মা কাজ দিচ্ছেন না, কিন্তু বললেন খালি মুখে যাইও না। ডাইল ভাত কিছু খাইয়া যাইও।
আমি ফোঁস করে বলি, চৌকাঠে বসেই, পোড়া শরীর থেকে চোখ সরিয়ে — গেঁতুর মারে কামে রাখলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হইয়া যাইত!
মা নিরুত্তাপ স্বরে বলেন — মহাভারত ত অশুদ্ধই।
গেঁতুর মা বসে থাকে বারান্দায় কাটা গাছের গুঁড়ির মত। গাছের গুঁড়ির মাথার ওপর একশ মশা চরকির মত ঘুরছে, হাতে পায়ে কালো হয়ে মশারা লঙ্গরখানার খাবার খেতে বসেছে। পোড়া ত্বক থেকে সম্ভবত অনভূতিটুকুও উবে গেছে। কেবল পেটের ক্ষিধেটুকু রয়ে গেছে পেটেই। গরিবের এই হয়, সব যায়, সংসার সমাজ স্বজন সম্পদ, কেবল ক্ষিধে যায় না। আমি যদি গেঁতুর মা হতাম, নিজেকে তার জায়গায় বসিয়ে দেখি, দুটো ডাল ভাতের জন্য আমি অপেক্ষা না করে উঠে যাচ্ছি, পেছন ফিরছি না। হেঁটে যাচ্ছি বেল গাছের তল দিয়ে কালো ফটকের বাইরে। হাঁটছি, বাতাসের আগে আগে, পাগলা দুলালের মত হাঁটছি, কোথাও কারও দিকে না ফিরে। দুলাল মাউথ অর্গান বাজিয়ে হাঁটে, আমার মাউথ অর্গান নেই, আমার বুকের ভেতর বহুকাল থেকে জমা আর্তনাদ আছে, আর কোনও বাজনার দরকার নেই আমার। ভেতর থেকে হলকা বেরোচ্ছে আগুনের, এ আগুন আমাকে আর পোড়াচ্ছে না, মন পুড়ে সেই কবেই ছাই হয়ে গেছে, শরীরে আর কোনও বাকি ত্বক নেই আমার না পোড়া — এ আগুন আমার পোড়া ত্বক থেকে ফুলকি ছড়াতে ছড়াতে যাচ্ছে। আমি যখন সফর আলীর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছব, আমাকে দেখে সে চমকাবে, চুলো থেকে খড়ি হাতে নিয়ে তেড়ে আসবে, আমাকে স্পর্শ করার আগেই তার গায়ে আগুন ধরবে, ফুঁসে ওঠা ফুঁড়ে ওঠা আগুন, অন্ধ উদ্বাহু আগুন। আগুন ধেই ধেই নাচবে সফর আলীর শরীরে, তার হাতের জ্বলন্ত খড়িতে। তার খাঁক হওয়া অবদি আমি দাঁড়িয়ে থাকব। আমার ক্ষিধে মিটবে।