বছর পার হলে জান্নাতুল ফিরদাউসের পাট চুকোতে হয় মা’র। যেন চুল টেনে কেউ তাঁকে সুখের চৌবাচ্চা থেকে ওঠালো, আঁচলের গিঁট থেকে খুলে নিল স্বপ্নময় সংসার। রাজিয়া বেগম থেকে দূরে থেকে আলাদা সংসার করা মা’র আর হয়ে ওঠে না, বাবা আপিসে দরখাস্ত করে আবার চাকরির বদলি করিয়েছেন, ময়মনসিংহে। বাক্স পেটরা নিয়ে তাই রওনা হতে হয় পুরোনো শহরে, পুরোনো বাড়িতে। আচমকা ধুলোঝড় এসে উড়িয়ে নেয় একটি তুচ্ছ ক্ষুদ্র মেয়ের নিভৃত স্বপ্ন। এবার আর নানির বাড়িতে মাগনা থাকা নয়, এক চুলোয় রান্না হওয়া নয়, আলাদা উঠোন, আলাদা চুলো। সবচেয়ে পুবের উঠোনে বাবা নগদ টাকা দিয়ে নানির কাছ থেকে দুটো ঘর কিনে নিলেন। মা, বাবাকে ঘরজামাই বলে কেউ ডাকবে না জেনেও খুশিতে উচ্ছল হন না। যেন তিনি সত্যিকার জেলখানায় ঢুকেছেন ফিরে এসে। পাবনার জেলকেই তাঁর মনে হয়েছিল খোলা একটি জগত। বাড়িতে পা দিয়ে হু হু করে কেঁদেছিলেন মা। মামা খালারা ভেবেছেন এ আনন্দাশ্রু। ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরেছে, নানা হাঁফ ছেড়েছেন। রুনু আর ঝুনু খালার শুরু হল আমাকে নিয়ে লোফালুফি খেলা। আমি হাঁটছি কথা বলছি দৌড়োচ্ছি–এ যেন অদ্ভুত মজার ব্যাপার। যেন আমার ফিরে আসার কথা ছিল, যেমন গিয়েছিলাম তেমন। বাবা শহরে পা দিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন, মা’র একাকিত্ব বাবার পক্ষে অনুমান করা শক্ত। তাঁর সম্ভবত সময়ও নেই। তিনি মেডিকেল কলেজে ছাত্র পড়ানোর চাকরি শেষ করে বিকেলে তাজ ফার্মেসি নামে একটি ওষুধের দোকানের ভেতরে ছোট্ট একটি কোঠায় বসে রাত নটা অবদি রোগী দেখেন। ডাক্তার লেখা পর্দা সরিয়ে কোঠায় ঢুকতে হয়। ছ’বছর বয়সে আমাকে বেশ অনেকদিন যেতে হয়েছে বাবার ফার্মেসিতে, পেটে ইনজেকশন নিতে। ইস্কুল থেকে ফিরে বাঘা কুকুরটি আমাদের উঠোনে শুয়ে আছে দেখে আধলা ইট তুলে কুকুরটিকে ছুঁড়েছিলাম। বাঘাটি এমন চোখে তাকিয়েছিল আমার দিকে যেন ছিঁড়ে খাবে, সারা গা ঘাএ ভরা, লোম ওঠা, পাড়ার ছেলেরা কুকুরটিকে দেখলেই ঢিল ছোঁড়ে, তাই আমিও সেদিন। ঢিল ছুঁড়ে হাতের ধুলো ঝেড়ে যেই না সিঁড়িতে পা দেব, বাঘা উড়ে এসে আমার উরু কামড়ে ধরে। ধার-দাঁতে ছিঁড়ে নেয় শাদা মাংস। কুকুরের কামড় খাওয়া আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় বাবার ডাক্তারখানায়। প্রথমদিন দু’হাতে দুটো আর নাভির কিনারে একটি ইনজেকশন দিয়ে দেন বাবা, এরপর প্রতিদিন একটি করে চৌদ্দটি। ইনজেকশন দেওয়ার পর বাবা আমাকে শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে রসগোল্লা কিনে খাওয়াতেন। চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে পিরিচ থেকে রসগোল্লা চামচে তুলে খেতাম। বিকেলের ফুরফুরে হাওয়ায় রিক্সায় চড়ে বাবার কাছে যাওয়ায় আমার বিষম আনন্দ হত। সুইঁ ফোঁড়ানোর ব্যথাও মনে হত নিতান্ত পিঁপড়ের কামড়। স্বদেশী বাজারে ওষুধের গন্ধঅলা দোকানটিতে বসে বাবার অপেক্ষায় রোগিদের বসে থাকা দেখতাম, বাবাকে দেখতাম রোগির নাড়ি টিপতে, রোগীকে শুইয়ে কানে নল লাগিয়ে রোগির বুক পেট পরীক্ষা করতে, কাগজে খচখচ করে ওষুধ লিখতে। বাবার অন্য এক রূপ আমার দেখা হয় তখন, রাতে ঘরে ফেরা ক্লান্ত বিরক্ত অস্পষ্ট অচেনা মানুষ নন তিনি আর। বাবাকে আমার ভালবাসতে ইচ্ছে করত। কিন্তু তাঁকে ভালবাসা আমাদের কারও জন্য সহজ ছিল না।
বাবা হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে আসেন খোলস ছেড়ে। আলাদা বাড়িতে সংসার সাজানোর জিনিসপত্র কিনে গুছিয়ে বসার পর মা’কে বললেন কী এখন খুশি হইছ ত? এখন ত আর তুমার জামাইরে কেউ ঘরজামাই কইত না।
মা সস্তা লিপস্টিক মাখা ঠোঁটজোড়া ফুলিয়ে রঙিন কাচের চুড়িতে রিনিঝিনি শব্দ তুলে বলেন–হ, কইত না। তাতে আমার কি! আমারে ত কইবই কালা পচা। লেখাপড়া নাই। বিদ্যাবুদ্ধি নাই।
— তুমি হইলা তিনজনের মা। মায়ের দায়িত্ব ছেলেমেয়ে মানুষ করা। এদেরে ভাল কইরা লেখাপড়া করাও, এতেই শান্তি পাইবা। তুমি কালাপচা হইলেও বিয়া ত আমি তুমারে করছি, করি নাই? মা’র খোলা কোমর আঙুলে টিপে টিপে বাবা বলেন।
বাবার কথায় আর আদরে মা’র মন ভরে না। মা’র আবারও ভয় হতে থাকে রাজিয়া বেগম এই বুঝি বাবার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবেন। বাবার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় রাত জেগে বসে থাকেন মা। বাইরে ঝিঁ ঝি ডাকে। কুকুর কাঁদে। রাত বাড়তে থাকে হু হু করে। দরজায় কড়া নড়ার শব্দ আবার নিজের শ্বাসের শব্দে হারিয়ে যাবে ভয়ে তিনি শ্বাস আটকে রাখেন। এক অমাবস্যার রাতে বাবা ফেরেন না, দু’উঠোন পেরিয়ে এসে নানিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে মা বলেন–ও মা, নোমানের বাবা ত এহনও ফিরতাছে না। এগারোডা বাইজা গেছে। না জানি কই গেল। না জানি ওই বেডির বাসাত রাইত কাটাইতাছে।
নানি ধমকে থামান মা’কে–যা ঘুমা গা। জামাইএর লাইগা ত কাইন্দা মরলি। নিজের স্বার্থডা দেখ। নিজের কথা ভাব। কানলে তর লাভ কি! তুই কি কাইন্দা বেডাইনরে ফিরাইতে পারবি?
মা’র মনে পড়ে নানি কী মরা কান্না কেঁদেছিলেন যেদিন এক মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে নানা বাড়ি এলেন। দিব্যি বউএর সঙ্গে বিছানা পেতে শুতে শুরু করলেন, আর নানি পাশের বিছানায় শুয়ে সারারাত না ঘুমিয়ে কেঁদে বালিশ ভেজাতেন। মা জিজ্ঞেস করেছিলেন এত কান্দো ক্যান মা? নানি বলেছিলেন বড় হ, বুঝবি। বুঝবি বেডাইনরে কুনো বিশ্বাস নাই। এগোর জাতটা বড় খারাপ।
সে রাতে বাবা বাড়ি ফেরেন রাত দুটোয়। মা জেগেই ছিলেন। বাবা বললেন এক রোগির বাড়িতে দেরি হইয়া গেল। রোগীর শ্বাস যায় যায় অবস্থা। তারে নিয়া আবার হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি।